Friday, December 23, 2016

সদকায়ে ফিতরের বয়ান

সদকায়ে ফিতরের অর্থ
ফিতরের আভিধানিক অর্থ রোযা খোলা। সদকায়ে ফিতরের অর্থ রোযা খোলার সদকা। পারিভাষিক অর্থে সদকায়ে ফিতর বলতে বুঝায় সেই ওয়াজিব সদকা যা রমযান খতম হওয়ার এবং রোযা খোলার পর দেয়া হয় যে বছর মুসলমানদের ওপর রমযানের রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার হুকুম দেন।
সদকায়ে ফিতরের তাৎপর্য ও উপকারিতা
রমযান মাসে রোজাদারগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী এ চেষ্টা করেন যাতে করে তারা রমযানের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন এবং ঐসব সীমারেখা, নিয়ম পদ্ধতি ও শর্তাবলীর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখেন যা মেনে চলার জন্যে শরীয়াতে তাকীদ করা হয়েছে। তথাপি জ্ঞাতে অজ্ঞাতে মানুষের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে যায়। সদকায়ে ফিতরের একটি তাৎপর্য এইযে, মানুষ আল্লাহর পথে আগ্রহ সহকারে তার অর্জিত মাল খরচ করবে যাতে করে তার ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হয় এবং আল্লাহর দরবারে রোযা কবুল হয়। উপরন্তু ঈদ উপলক্ষে সদকায়ে ফিতর দেয়ার একটা তাৎপর্য এটাও যে, সমাজের গরীব দুস্থ লোক যেন নিশ্চিন্তে এবং ভালোভাবে অন্ত বস্ত্রের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে ঈদগাহে উপস্থিত হতে পারে যাতে করে ঈদগাহের সম্মেলন বিরাট হয় এবং পথে মুসলমানদের বিপুল জনসমাগমের কারণে ইসলামের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর এজন্য নির্ধারিত করেছেন যে, এ ফিতরা রোজাদারদেরকে বেহুদা কাজ কর্ম এবং অশ্লীলতার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পাক করবে এবং সে সাথে অভাবগ্রস্তদের খানা পিনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করবে তার সে সদকা কবুল হবে এবং যে নামাযের পরে পরিশোধ করবে তা সাধারণ দান খয়রাতের মতো একটি সদকা হবে। (আবু দাউদ)
শাহ অলী উল্লাহ (র) বলেন, ঈদের দিন খুশীর দিন। এদিনে মুসলমানদের বিরাট জনসমাবেশের মাধ্যমে ইসলামের শান শওকত প্রকাশ পায় এবং সদকায় ফিতরের দ্বারা এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। তাছাড়া সদকায়ে ফিতর রোযার পূর্ণতারও কারণ হয়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ)
সদকায়ে ফিতরের হুকুম
সদকায়ে ফিতর এমন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমান নারী পুরুষ, নাবালক সাবালকের ওপর ওয়াজিব (আহলে হাদীসের মতে সদকায়ে ফিতর যাকাতের মতো ফরয। অতএব প্রত্যেক ধনী গরীব, নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট-বড়, সকলের ওপর ফরয। তাদের যুক্তি এই যে, নবী (স) মক্কার অলিতে গলিতে লোক পাঠিয়ে এ ঘোষণা করিয়ে দেন সাধান থাক। সদকায় ফিতর প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আযাদ গোলাম, ছোট-বড় সকলের ওপর ওয়াজিব। (তিরমিযি) উপরন্তু ইবনে ওমর (রা) বলেন, নবী (স) সদকায়ে ফিতর ফরয বলেছেন এবং তাহলো প্রত্যেক নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট ও বড়োর জন্যে এক সা খেজুর, এক সা যব এবং হুকুম দিয়েছেন যে, ঈদগাহে যাবার পূর্বে তা দিতে হবে।)যার কাছে তার প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতো মূল্যের মাল হবে যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়। সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক। যেমন ধরুন, কারো কাছে তার বসবাসের গৃহ ছাড়া আরও বাড়ী-ঘর আছে যা খালি পড়ে আছে অথবা ভাড়ার জন্যে তৈরী করা হয়েছে। যদি সে ঘর-বাড়ীর মূল্য নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার মালিকের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে যদিও সে বাড়ীর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। তবে যদি বাড়ীর ভাড়ার দ্বারা সে জীবিকা অর্জন করে তাহলে তা তার প্রকৃত প্রয়োজনের মধ্যে শামিল হবে এবং তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে না। অথবা কারো ঘরে ব্যবহারের সামগ্রী ছাড়াও কিছু আসবাবপত্র আছে যেমনঃ তামার বাসনপত্র, মূল্যবান ফার্নিচার প্রভৃতি যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ অথবা তার অধিক, তাহলে তার ওপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। যদিও সে সব মালের যাকাত দিতে হবে না।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে ওপরে বর্ণিত নেসাব ছাড়া অন্য কোনো শর্ত নেই। না আযাদী কোনো শর্ত, আর না বালেগ হওয়া অথবা হুশ জ্ঞান থাকা। গোলামের ওপরও ওয়াজিব। কিন্তু তার মনিব তা দিয়ে দিবে। নাবালেগ ও পাগল ছেলেমেয়েদের ফিতরা তার বাপ-মা অথবা ওলী দিয়ে দেবে।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য এটাও শর্ত নয় যে, মাল এক বছর স্থায়ী হতে হবে। বরঞ্চ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পূর্বেও যদি কেউ ধন দৌলতের মালিক হয়, তাহলে তার ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় ঈদের দিনের প্রভাতকাল (আহলে হাদীসের নিকটে সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় রমযানের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদের নামাযের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। এক বলা হয় রোযা খোলার সদকা। অতএব রমযানের শেষ রোযা খোলার পর থেকেই এ ওয়াজিব হয় যদিও তা আগেও দিয়ে দেয়া দুরস্ত আছে) অতএব যে ব্যক্তি ফজর হওয়ার পূর্বে মারা যায় অথবা ধন দৌলত থেকে বঞ্চিত হয় তার ওপর ওয়াজিব হবে না। যে শিশু ফজরের পর জন্মগ্রহণ করবে তার ওপরও ওয়াজিব হবে না। তবে যে ঈদের রাতে জন্মগ্রহণ করবে তার ওপর ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে যে ফজরের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে অথবা ধনের মালিক হয় তাহলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে।
সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করার সময়
সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় যদিও ফজরের সময় কিন্তু ওয়াজিব হওয়ার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য এটাই দাব করে যে, ঈদের কিছু দিন পূর্বে তা অভাবগ্রস্তদের কাছে পৌছিয়ে দেয়া হোক। যাতে করে গরীব দুস্থ অন্ন-বস্ত্রের সামগ্রী নিশ্চিন্তে লাভ করে সকলের সাথে ঈদগাহে যেতে পারে। বুখারী শরীফে আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা) দু একদিন পূর্বেই সদকায়ে ফিতর বিতরণ করতেন। দু চার দিন পূর্বে দেয়া না গেলে ঈদের নামাযের পূর্বে অবশ্যই দিয়ে দেয়া উচিত। নবী (স) বলেনঃ
********** আরবী ************
যে ব্যক্তি সদকায়ে ফিতর নামাযের পূর্বে দিয়ে দেবে তাহলে সেটা হবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত সদকা। আর যে নামাযের পরে দেবে, তার সদকা হবে দান খয়রাতের মতো একটি সদকা।
কাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব
১. সচ্ছল ব্যক্তি তার নিজের ছাড়াও নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দিবে, নাবালেগ সন্তান যদি ধনবান হয় তাহলে তাদের ধন থেকে নতুবা নিজের পক্ষ থেকে দেবে।
২. যেসব সন্তান হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তাদের মাল থাক আর না থাক, তাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর দিয়ে দেয়া ওয়াজিব, তারা সাবালক হোক বা না হোক।
৩. যারা তাদের খাদেম বা চাকর বাকরের পৃষ্ঠপোষকতা ও ভরণ পোষণ করে তারা তাদের পক্ষ থেকে সদকা দিয়ে দেবে।
৪. সাবালক সন্তানদের পক্ষ থেকে পিতার দেয়া ওয়াজিব যদি তারা দুস্থ ও দরিদ্র হয়। মালদার হলে ওয়াজিব হবে না।
৫. বিবির পক্ষ থেকে ওয়াজিব তো নয়। তবে স্বামী দিয়ে দিলে বিবির পক্ষ থেকে হয়ে যাবে।
৬. বাপ মারা গেলে দাদার উপরে সকল দায়িত্ব এসে পড়ে যা পিতার ছিল।
৭. স্ত্রীলোক যদি সচ্ছল হয় তাহলে শুধু তার সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তার নিজের ছাড়া স্বামী, সন্তান বা মা-বাপের পক্ষ থেকে দেয়া তার ওয়াজিব নয়।

Thursday, December 22, 2016

ওশরের বিবরণ

ওশরের অর্থ
ওশরের আভিধানিক অর্থ এক দশমাংশ। কিন্তু পরিভাষায় ওশর হচ্ছে উৎপন্ন ফসলের যাকাত যা কোনো জমির উৎপন্নের দশ ভাগের এক ভাগ এবং কোনো জমির বিশ ভাগের এক ভাগ।
ওশরের শরয়ী হুকুম
********** আরবী ************
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের রোজগারের উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে খরচ কর। এবং তার মধ্য থেকেও যা তোমাদের জন্যে আমি জমিন থেকে বের করেছি। (উৎপন্ন করেছি)। (সূরা আল বাকারাঃ ২৬৭)
অন্য স্থানে বলা হয়েছেঃ
********** আরবী ************
এবং আল্লাহর হক আদায় কর যেদিন তোমরা ফসল কাটবে। (সূরা আল আনআমঃ১৪১)
তাফসীরকারগণের এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে, এর অর্থ হলো উৎপন্ন ফসলের যাকাত অর্থাৎ ওশর।
কোরআন পাকের উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ ফরয এবং হাদীস সম্পর্কে তাকীদ রয়েছে। নবী বলেনঃ
যে জমি বৃষ্টির পানি অথবা ঝর্নার বা নদী নালার পানিতে প্লাবিত হয় অথবা নদীর কিনারে হওয়ার কারণে স্বভাবত উর্বর ও পানিসিক্ত থাকে, তার থেকে উৎপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ ওশর বের করা ওয়াজিব। আর যে জমিতে কুপের পানি তুলে চাষ করা হয় তার বিশ ভাগের একভাগ ওয়াজিব।
ওশরের হার
বর্ষা নদী নালার পানিতে যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় অথবা নদীর কিনারায় হওয়ার কারণে যে জমিতে স্বভাবতই উর্বরতা ও পানি থাকে সে জমির উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ যাকাত হিসাবে বের কর ওয়াজিব। আর বিভিন্ন উপায়ে সেচ কাজের দ্বারা যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় তার বিশভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে বের করা ওয়াজিব।
ওশর (ফসলের যাকাত) আল্লাহর হক এবং তা মোট উৎপন্ন ফসলের প্রকৃত এক-দশমাংশ অথবা এক-বিশমাংশ। অতএব শস্য অথবা ফল ব্যবহারযোগ্য হলে প্রথমে তার ওশর বের করতে হবে তারপর সে শস্য বা ফল ব্যবহার করা হবে।
ওশর বের করার আগে তা ব্যবহার করা জায়েজ নয় নতুবা এক-দশমাংশ হোক অথবা তার অর্ধেক তা আল্লাহর পথে যাবে।
কোন কোন জিনিষের ওশর ওয়াজিব
জমি থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক বস্তুর ওপর ওশর ওয়াজিব। যা গুদামজাত করা হয় এমন ফসলের উপরও, যেমন খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, আখ, খেজুর, শুকনো ফল প্রভৃতি এবং ঐসব ফসলের উপরও যা গুদামজাত করা যায় না, যেমন শাকসবজি, শসা, খিরা, গাজর, মূলা, শালগম, তরমুজ, আম, মালটা প্রভৃতি।(কোনো ফকীহর মতে শাক সবজি, তরি-তরকারী, ফলমূল যা গুদামজাত করা যায় না তার ওপর ওশর ওয়াজিব নয়। তবে যদি কৃষক বাজারে বিক্রি করে তাহলে তার উপর তেজারতি যাকাত ওয়াজিব হবে তার মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে। অর্থাৎ যদি বছরের প্রথমে এবং শেষে তেজারতি মাল দুশ দিরহাম অথবা অধিক হয়।)
মধুর উপরেও ওশর ওয়াজিব।নবী (স) বলেনঃ ********** আরবী ***********মধুর ওশর দাও।–(বায়হাকী)
হযরত আবু সাইয়াদাহ (রা) বলেন, আমি নবী (স)-কে বলেছিলাম আমার কাছে মৌমাছি পালিত আছে। তখন নবী (স) বলেন, তাহলে তার ওশর দাও।(ইমাম মালেক (রা) এবং হযরত সুফিয়ান সওরী (র) এর নিকট মধুর ওশর নেই। ইমাম শাফেয়ী (র) এর মশহুর বক্তব্যও তাই। ইমাম বুখারী (র) বলেন, মধুর যাকাতের ব্যাপারে কোনো হাদীস সহীহ নয়। বায়হাকীতে আছে এক ব্যক্তি নবীর দরবারে মধুর ওশর এনে আরজ করে, সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করুন। নবী (স) সে বনের হেফাযতের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর হযরত ওমর (রা) এর খেলাফত আমলে সুফিয়ান বিন ওয়াহাব এ ব্যাপারে তার কাছে প্রকৃত সত্য জানতে চাইলেন, তিনি তাকে লিখে জানালেন যে, সে নবীকে যা দিতো তা তোমাকে দিতে এলে নিয়ে নিবে এবং সাবলা বনের হেফাজতের ব্যবস্থা করে দেবে। নতুবা তা তো মৌমাছি দ্বারা তৈরী জিনিস আসমানের পানির মতো। যে ইচ্ছা করে সে তা ব্যবহার করতে পারে।
আল্লামা মওদূদীর অভিমত এই যে, মধুর ওপরে যাকাত নেই। তবে তার ব্যবসার ওপরে সেই ধরনের যাকাত হবে যা অন্যান্য তেজারতি মালের ওপর হয়ে থাকে।)
ওশরের মাসয়ালা
১. ওশরের মোট উৎপন্ন ফসলের আদায় করতে হবে। ওশর আদায়ের পর অবশিষ্ট ফসল থেকে কৃষির যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। যেমন কারো জমিতে ত্রিশ মণ ফসল হল। এক দশমাংশ তিন মণ ওশর দেওয়ার পর বাকি সাত মণ থেকে কৃষির খরচপত্র বহন করতে হবে।
২. ফসল যখনই ব্যবহার যোগ্য হবে তখনই তার উপর ওশর ওয়াজিব হবে। যেমন-ছোলা, মটর, আম প্রভৃতির পাকার পূর্বেই ব্যবহার করতে হবে। অতএব তখন যে পরিমাণ হবে তার ওশর বের করতে হবে। ওশর বের করার পূর্বেই তা ব্যবহার করা দুরস্ত নয়।
৩. কারো বাগানে ফল হয়েছে। তা পাকার পূর্বে বিক্রি করলে ওশর খরিদদারের উপর ওয়াজিব হবে। পাকার পর বিক্রি করলে ওশর বিক্রেতার ঘাড়ে পড়বে।
৪. জমিতে যে চাষ করবে ওশর তারই উপর ওয়াজিব হবে তা সে জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করুক অথবা বর্গা নিয়ে চাষ করুক।
৫. দুজন মিলে চাষাবাদ করলে ওশর উভয়ের উপর ওয়াজিব হবে তা যদি বীজ একজনের হয় তবুও।
৬. ওশর ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব কোন শর্ত নয়।(ইমাম আযম ও ইমাম শাফেয়ীর মতে পাঁচ ওয়াসাক (ত্রিশ মণ) এর কম হলে তার ওশর নেই। আহলে হাদীসের অভিমতও তাই। ওশর ফরয হওয়ার এ একটি শর্ত যে, উৎপন্ন ফসল অন্তত পাঁচ ওয়াসাক বা ত্রিশ মণ হবে। তার প্রমাণ নিম্ন হাদীসঃ …………….. আরবী …………
পাঁচ ওয়াসাকের কম ফসলের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।-বুখারী) ফসল কম হোক বেশী হোক ওশর দিতে হবে। অবশ্যি দু আড়াই কিলো ফসল ধর্তব্য নয়।
৭. ওশরে বছর পূর্ণ হওয়ার প্রশ্নও নেই। বরঞ্চ যে জমিতে বছরে দু ফসল হয় তার প্রত্যেক ফসলের ওশর দিতে হবে।
৮. নাবালেগ শিশু ও মাথা খারাপ লোকের ফসলেরও ওশর ওয়াজিব।
৯. ওয়াকফ করা জমি চাষ করলে চাষির উপর ওশর ওয়াজিব।
১০. বৃষ্টির পানিতে উর্বর জমিতে কৃত্রিম উপায়ে সেচ কার্য করলে তার ওশর নির্ধারণে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, স্বাভাবিক বর্ষণের কারণে সে জমি অধিক উর্বরতা লাভ করেছে, না সেচের কারণে।
১১. ওশর ফসলের আকারেও দেয়া যায় অথবা তার মূল্য।
১২. বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে যেসব জমি মুসলমানদের মালিকানায় আছে, তা ওশরী এবং তার ওশর দিতে হবে।
১৩. জমির খাজনা দিলে ওশর মাফ হয় না।
১৪. যাকাত যেসব খাতে ব্যয় করা হয়, ওশরও সেসব খাতে ব্যয় করতে হবে।
গুপ্তধন ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা
মাটির নীচে রক্ষিত সম্পদ ও খনিজ দ্রব্যাদির মাসয়ালা নিম্নরূপ:
১. মাটির নীচে রক্ষিত প্রাপ্ত সম্পদের পাঁচ ভাগের এক বায়তুল মালের জন্য নির্দিষ্ট। হাদীসে আছে …………….. আরবী ………… অর্থাৎ গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশও বায়তুল মালে দেয়া ওয়াজিব।
২. খনিজ দ্রব্য তা ধাতব পদার্থ হোক যেমন লোহা, রূপা, সোনা, রাং ইত্যাদি অথবা অধাতব পদার্থ যেমন গন্ধক, এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালের অংশ। আর বাকী চার ভাগ খনির মালিক পাবে।
৩. যেসব খনিজ দ্রব্য আগুনে পোড়ালে নরম হয় না যেমন জাওহার ইত্যাদি অথবা তরল পদার্থ যেমন কেরোসিন ও পেট্রোল ইত্যাদি। এসব দ্রব্যে বায়তুলমালের কোনো অংশ নেই। (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর মতে খনিজ পদার্থ ধাতব, অধাতব বা তরল যা-ই হোক না কেন শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত ওয়াজিব যদি তা নেসাব পরিমাণ হয় এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়ে এ মতে আমল করা হতো।)

হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী

হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দশটি। তার মধ্যে কোনো একটি শর্ত পাওয়া না গেলে হজ্জ ওয়াজিব হবে না।
১. ইসলামঃ অমুসলিমের প্রতি হজ্জ ওয়াজিব হতে পারে না।
২. জ্ঞান থাকাঃ পাগল, মস্তিষ্ক বিকৃত ও অনুভূতিহীন লোকের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।
৩. বালেগ  হওয়াঃ নাবালেগ শিশুদের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়, কোনো সচ্ছল ব্যক্তি বালেগ হওয়ার পূর্বেই শৈশব অবস্থায় হজ্জ করলে তাতে ফরয আদায় হবে না। বালেগ হওয়ার পর পুনরায় তাকে হজ্জ করতে হবে। শৈশবের হজ্জ নফল হবে।
৪. সামর্থঃ হজ্জকারীকে সচ্ছল হতে হবে। তার কাছে প্রকৃত প্রয়োজন ও ঋণ থেকে নিরাপদ এতোটা অর্থ থাকতে হবে যা সফরের ব্যয়ভার বহনের জন্যে যথেষ্ট হয় এবং হজ্জ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার অধীন পরিবারস্থ লোকের জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট অর্থ মওজুদ থাকে, কারণ এসব লোকের ভরণপোষণের দায়িত্ব শরীয়াত অনুযায়ী তার।
৫. স্বাধীনতাঃ গোলাম ও বাদীর ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।
৬. শারীরিক সুস্থতাঃ এমন অসুস্থ না হওয়া যাতে করে সফর করা সম্ভব নয়। অতএব ল্যাংড়া, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, এবং অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বয়ং হজ্জ করা ওয়াজিব নয়। অন্যান্য সব শর্তগুলো পাওয়া গেলে অন্যের সাহায্যে হজ্জ করাতে পারে।
৭. কোনো যালেম ও স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষ থেকে জীবনের কোনো আশঙ্কা না থাকা এবং কারাগারে আবদ্ধ না থাকা।
৮. পথ নিরাপদ হওয়াঃ যদি যুদ্ধ চলছে এমন অবস্থা হয়, পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যানবাহন ধ্বংস করা হচ্ছে, পথে চোর ডাকাতের আশংকা থাকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জলপথে ভ্রমণ সম্ভব না হয় অথবা যে কোনো প্রকারের আশংকা যদি থাকে, তাহলে এসব অবস্থায় হজ্জ ওয়াজিব হবে না। অবশ্য এ অবস্থায় এমন লোকের অসিয়ত করে যাওয়া উচিত যে, তার পরে অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুকূল হলে তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ হজ্জ করবে।
৯. হজ্জের সফরে স্বামী অথবা কোনো মুহররম ব্যক্তি থাকতে হবেঃ এর ব্যাখ্যা এই যে, সফর যদি তিন রাত দিনের কম হয় তাহরে মেয়েলোকের স্বামী ছাড়া সফরের অনুমতি আছে।তার বেশী সময়ের সফল হলে স্বামী অথবা মুহররম পুরুষ ছাড়া হজ্জের সফর জায়েয নয়। (যে মহিলার স্বামী নেই এবং কোনো মুহররম পুরুষও নেই, তার ঐসব বন্ধু সফরকারীর সাথে যাওয়া জায়েয যাদের নৈতিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে। এ হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম মালেকের অভিমত। নির্ভরযোগ্য বন্ধু বান্ধব এর ব্যাখ্যা ইমাম শাফেয়ী (র) এভাবে করেছেনঃ কিচু সংখ্যক মেয়েলোক নির্ভরযোগ্য হতে হবে এবং তারা মুহররম লোকের সাথে হজ্জে যাচ্ছে। তাহলে এ দলের সাথে স্বামিহীন একজন মেয়েলোক যেতে পারে। অবশ্য দলে মাত্র একজন মেয়েলোক থাকলে যাওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ীর এ অভিমত অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে একজন স্বামীহিন ও মুহাররমহীন মেয়েলোকের হজ্জ আদায় করার সুযোগ রয়েছে এবং ওসব ফেতনার আশংকাও নেই যার কারণে কোনো মেয়েলোকের মুহররম ছাড়া সফর করা নিষিদ্ধ।)এটাও জরুরী যে, এ মুহররম জ্ঞানবান, বালেগ, দীনদার এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে। অবোধ শিশু, ফাসেক, এবং অনির্ভরযোগ্য লোকের সাথে সফর জায়েয নয়।
১০. ইদ্দত অবস্থায় না হওয়াঃ ইদ্দত স্বামীর মৃত্যুর পর হোক অথবা তালাকের পর হোক, ইদ্দতের সময় হজ্জ ওয়াজিব হবে না।
হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত
হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত চারটি। এ শর্তগুলোসহ হজ্জ করলে তা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হবে। নতুবা হবে না।
১. ইসলামঃ ইসলাম হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার যেমন শর্ত, তেমনি সহীহ হওয়ার শর্ত। যদি কোনো অমুসলিম হজ্জের আরকান আদায় করে এবং তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করেন, তাহলে এ হজ্জ সহীহ হওয়ার জন্যে জরুরী যে, হজ্জকারী মুসলমান হবে।
২. হুশ জ্ঞান থাকাঃ হুশ-জ্ঞানহীন ও পাগল ব্যক্তির হজ্জ সহীহ হবে না।
৩. সকল আরকান নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে আদায় করা। হজ্জের মাসগুলো হচ্ছে, শাওয়াল, যুলকাদ, ও যুলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। এমনি হজ্জের সকল আরকান আদায় করার সময়ও নির্দিষ্ট আছে,স্থানও নির্দিষ্ট আছে। আর ব্যতিক্রম করে হজ্জের আরকান আদায় করলে হজ্জ সহীহ হবে না।
৪. যেসব কারণে হজ্জ নষ্ট হয় তার থেকে বেচে থাকা এবং হজ্জের সকল আরকান ও ফরয আদায় করা। যদি হজ্জের কোনো রুকন আদায় করা না হয় কিংবা ছুটে যায় তাহলে হজ্জ সহীহ হবে না।
হজ্জের আহকাম
১. হজ্জ ফরয হওয়ার সকল শর্ত বিদ্যমান থাকলে জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। হজ্জ ফরযে আইন এবং তার ফরয হওয়া কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে। যে ব্যক্তি হজ্জ ফরয হওয়া অস্বীকার করবে সে কাফের এবং যে ব্যক্তি হজ্জের শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করবে না সে গুনাহগার এবং ফাসেক।
২. হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে সে বছরই তা আদায় করা উচিত। ফরয হওয়ার পর বিনা কারণে বিলম্ব করা এবং এক বছর থেকে আর এক বছর পর্যন্ত টালবাহানা করা গুনাহ।
নবী (স) বলেন, যে হজ্জের ইচ্ছা পোষণ করে তার তাড়াতাড়ি করা উচিত। হতে পরে যে, সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। অথবা সওয়ারীর উটনী হারিয়ে যেতে পারে। আর এটাও হতে পারে যে, অন্য কোনো প্রয়োজন তার হতে পারে। (ইবনে মাজাহ)
উটনী হারিয়ে যাওয়ার অর্থ সফরের উপায় উপাদান না থাকা। পথ নিরাপদ না থাকা এবং এমন কোনো প্রয়োজন এসে যাওয়া যার জন্যে হজ্জের আর সম্ভাবনা থাকে না। মানুষ ফরযের বোঝা মাথায় নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। পরিস্থিতি কখন অনুকূল হবে এবং জীবনেরই বা কি ভরসা? অতএব কোন ভরসায় মানুষ বিলম্ব করবে এবং হজ্জ করার পরিবর্তে শুধা টালবাহানা করতে থাকবে?
৩. হজ্জের ফরয আদায় করার জন্য যাদের অনুমতি নেয়া শরীয়াতের দিক দিয়ে জরুরী যেমন কারো মা বাপ দুর্বল অথবা রোগাক্রান্ত এবং তার সাহায্য প্রার্থী অথবা কোনো ব্যক্তি কারো কাছে ঋণী অথবা কারো জামিন এমন অবস্থায় অনুমতি ছাড়া হজ্জ করা মাকরূহ তাহরীমি।
৪. হারাম কামাইয়ের দ্বারা হজ্জ হারাম।
৫. ইহরাম না বেধে মীকাতে প্রবেশ করলে হজ্জ ফরয় হয়ে যায়।
৬. হজ্জ ফরয হওয়ার পর কেউ বিলম্ব করলো, তারপর সে অসমর্থ হয়ে পড়লো এবং অন্ধ, পঙ্গু অথবা কঠিন অসুখে পড়লো এবং সফরের যোগ্য রইলো না, তাহলে সে তার নিজের খরচে অন্যকে পাঠিয়ে বদলা হজ্জ করে নেবে।
মীকাত ও তার হুকুম
১. মীকাত অর্থ সেই নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত স্থান যেখানে ইহরাম বাধা ছাড়া মক্কা মুকাররামা যাওয়া জায়েয নয়। যে কোনো কারণেই কেউ মক্কা মুকাররামা যেতে চাক তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধবে। ইহরাম বাধা ছাড়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)
২. বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকদের জন্য পাঁচটি মীকাত নির্দিষ্ট আছে।
ক. যুল হুলায়ফাহঃ
এটি মদীনাবাসীদের জন্যে মীকাত। ঐসব লোকের জন্যেও যারা মদীনার পথে মক্কা মুকাররমা আসতে চায়। এ মীকাত মদীনা থেকে মক্কা আসবার পথে প্রায় আট নয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ মীকাত মক্কা থেকে অন্যান্য সব মীকাতের তুলনায় অধিকতর দূরত্বে অবস্থিত, আর মদীনাবাসীদের এ অধিকারও রয়েছে এজন্যে যে, সর্বদা মদীনাবাসী আল্লাহর পথে অধিকতর কুরবানী করেছে।
খ. যাতে ইরাকঃ
এটি ইরাক এবং ইরাকের পথে আগত লোকদের মীকাত। এ মীকাত মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
গ. হুজফাহঃ
এটি সিরিয়া এবং সিরিয়ার দিক থেকে আগমনকারী লোকদের জন্যে মীকাত। মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
ঘ. কারনুল মানাযেলঃ
মক্কা মুকাররামা থেকে পূর্ব দিকে পথের ওপর এক পর্বতময় স্থান যা মক্কা থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নজদবাসীদের মীকাত এবং ঐসব লোকের জন্যে যারা এ পথে আসে।
ঙ. ইয়ালামলামঃ
মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে এসেছে এমন পথের ওপর একটি পাহাড়ী স্থান যা মক্কা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে। এটি ইয়ামেন এবং এ পথে আগমনকারী লোকদের মীকাত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের লোকের জন্যেও এ মীকাত।
এসব মীকাত স্বয়ং নবী (স) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম থেকে একথা জানা যায়। এসব মীকাত ঐসব লোকের জন্যে যারা মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী, যাদেরকে পরিভাষায় আফাকী বর এখন যারা মীকাতের মধ্যে বসবাস করে তারা যদি হেরেমের সীমার ভেতরে হয় তাহলে হেরেমই তাদের মীকাত। আর হেরেমের সীমার বাইরে হিলে অবস্থানকারী হলে তার জন্যে হিল মীকাত। অবশ্য হেরেমের মধ্যে অবস্থানকারী ওমরার জন্যে ইহরাম বাধতে চাইলে তার মীকাত হিল, হেরেম নয়।
হজ্জের ফরয
হজ্জের চারটি ফরয। তার মধ্যে কোন একটি ছুটে গেলে হজ্জ হবে না। ফরয নিম্নরূপঃ
১. ইহরাম – এটি হজ্জের শর্ত এবং হজ্জের রুকন।
২. আরাফাতে অবস্থান কিছু সময়ের জন্য হলেও।
৩. যিয়ারতে তাওয়াফ – এর প্রথম চার চক্কর ফরয এবং বাকী তিন চক্কর ওয়াজিব।
৪. এ ফরযগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রম অনুসারে আদায় করা।

সিহরী ও ইফতার


রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদেকের পূর্বে যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকে সিহরী বলে। নবী (স) স্বয়ং সিহরীর ব্যবস্থাপনা করতেন এবং অন্যকেও সিহরী খাওয়ার তাকীদ করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) সিহরীর সময় আমাকে বলতেন, আমার রোযা রাখার ইচ্ছা আমাকে কিছু খেতে দাও। তখন আমি তাকে কিছু খেজুর এবং এক বাটি পানি খেতে দিতাম।
নবী (স) সিহরীর তাকীদ করতে গিয়ে বলেন, সিহরী খেয়ো এজন্য যে, এতে বিরাট বরকত রয়েছে।
বরকত বলতে এই যে, দিনের কাজকর্মে এবং ইবাদাত বন্দেগীতে দুর্বলতা মনে হবে না এবং রোযা সহজ হবে।
একবার নবী (সা) বলেনঃ দিনে রোযা রাখার জন্যে সিহরী খাওয়া দ্বারা সাহায্য নাও এবং রাতের ইবাদাতের জন্যে কায়লূলা দ্বারা সাহায্য নিও।
সিহরী খাওয়া সুন্নাত। মুসলমান এবং ইহুদী নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তারা সিহরী খায় না, মুসলমান খায়, ক্ষিধে না হলে কিছু মিষ্টি, অথবা দুধ অথবা পানি খেয়ে নেয়া উচিত এজন্যে সিহরী খাওয়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব আছে।
নবী (স) বলেন, সিহরী খাওয়া প্রত্যক্ষ বরকত। সিহরী খেতে ভুলো না, তা এক চুমুক পানি হোক না কেন। কারণ সিহরী যারা খায় তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্যে এস্তেগফার করেন।
সিহরী বিলম্বে করা
সুবহে সাদেক হতে সামান্য বাকী আছে এতোটা বিলম্ব করে সিহরী খাওয়া মুস্তাহাব।অনেকে সাবধানতার জন্যে অনেক আগে সিহরী খায়। এটা ভালো নয়। বিলম্বে খাওয়াতে সওয়াব আছে।
ইফতার তাড়াতাড়ি করা
ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সাবধানতার জন্যে বিলম্ব করা মনাসিব নয়, বরঞ্চ তৎক্ষণাৎ ইফতার করা উচিত। এভাবে অপ্রয়োজনীয় সাবধানতার ফলে দ্বীনি মানসিকতা লোপ পায়। এটা দীনদারি নয় যে, লোক অযথা নিজেদেরকে কষ্টে ফেলবে। বরঞ্চ দীনদারি হচ্ছে এই যে, বিনা বাক্যে ব্যয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে।
নবী (স) বলেন, তিনটি বিষয় পয়গম্বরসুলভ আচরণের শামিলঃ
১. সিহরী বিলম্বে খাওয়া।
২. ইফতার তাড়াতাড়ি করা।
৩. নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।
হযরত ইবনে আবি আওফা(রা) বলেন, আমরা একবার সফরে নবী (স) এর সাথী ছিলাম। তিনি রোযা ছিলেন। যখন সূর্য দৃষ্টির আড়াল হলো তখন তিনি একজনকে বললেন, ওঠ আমার জন্যে ছাতু গুলে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আর  একটু দেরী করুন সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভালো হয়। এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নাম এবং আমাদের জন্যে ছাতু গুলে দাও। সে আবার বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ,এখনো দিন আছে বলে মনে হচ্ছে। আবার এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নেমে পড় এবং আমাদের জন্যে ছাতু তৈরী করে দাও। তখন সে নামলো এবং সকলের জন্যে ছাতু তৈরী করলো। নবী (সা) ছাতু খেয়ে বললেন, তোমরা যখন দেখবে যে রাতের কালো ছায়া ওদিক থেকে ছেয়ে আসছে তখন রোযাদারের রোযা খোলা উচিত।(বুখারী)
নবী (স) বলেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, আমার বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐ বান্দাহকে আমার পছন্দ হয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। (তিরমিযি) (অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কিছুতেই বিলম্ব করো না।)
নবী (স) আরো বলেন, লোক ভালো অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করতে থাকবে। (বুখারী, মুসলিম)
কোন জিনিস দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব
খেজুর এবং খুরমা দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব তা না হলে পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।নবী (স)স্বয়ং এসব দিয়ে ইফতার করতেন।
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) মাগরিবের নামাযের পূর্বে কয়েকটি ভিজানো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না হলে খুরমা দিয়ে। তাও না হলে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন। (তিরমিযি, আবু দাউদ)
এসব জিনিস দিয়ে ইফতার করার জন্যে নবী (স) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ রোযা রাখলে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। তা না হলে পানি দিয়ে। আসলে পানি অত্যন্ত পবিত্র। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
খেজুর ছিল আরবের উপাদেয় খাদ্য এবং ধনী গরীব সকলেই তা সহজেই লাভ করতো। আর পানি তো সর্বত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এসব দিয়ে ইফতার করার জন্যে প্রেরণা দেয়ার তাৎপর্য এই যে, উম্মত যেন কোনো কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সময় মতো সহজেই রোযা খুলতে পারে। পানির একটা বৈশিষ্ট্য নবী (স) বলেন যে, তা এতোটা পাক যে তার দ্বারা সবকিছু পাক করা যায়। বাহ্যিক পাক তো অনুভবই করা যায়। তার সাথে রূহানী পবিত্রতাও হয়। রোযাদার যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সচেতন ঈমানের সাথে সারাদিন তৃষ্ণার্ত থেকে এবং সূর্যাস্তে ঠান্ডা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে শোকর গুজারির প্রেরণা সৃষ্টি হয় যার দ্বারা তার বাতেন বা আধ্যাত্মিক দিক আলোকিত করার সৌভাগ্য হয়।
কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা এবং অন্য কোনো জিনিস দিয়ে ইফতার করা তাকওয়ার খেলাফ মনে করা একেবারে ভুল। এমনি এ ধারণা করাও ভুল যে লবণ দিয়ে ইফতার করা বড়ো সওয়াবের কাজ।
ইফতারের দোয়া
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ তোমার জন্য রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।
ইফতারের পরের দোয়া
*******আরবী*********
পিপাসা চলে গেলে, রগ শো ঠিক হয়ে গেল এবং আল্লাহ চাইলে প্রতিদানও অবশ্যই মিলবে। (আবু দাউদ)
ইফতার করাবার সওয়াব
অন্যকে ইফতার করানোও পছন্দনীয় আমল এবং ইফতার যে করায় তাকেও ততোটা সওয়াব দেয়া হয় যতোটা দেয়া হয় রোযাদারকে। তা রোযাদারকে দু লোকমা খানা খাইয়ে দেয়া হোক অথবা একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হোক।
নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের মতোই সওয়াব পাবে। (বায়হাকী)
সিহরী ছাড়া রোযা
রাতে সিহরীর জন্যে যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তবুও রোযা রাখা উচিত। সিহরী খাওয়া না হলে রোযা না রাখা কাপুরুষের কাজ। সিহরী না খাওয়ার জন্যে রোযা ছেড়ে দেয়া বড় গোনাহের কাজ।
যদি কখনো দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে এবং মনে হয় যে, রাত বাকী আছে এবং কিছু খানাপিনা করা হলো। তারপর দেখা গেল যে, সুবহে সাদেকের পর খানাপিনা করা হয়েছে। তাহলে এ অবস্থায় যদিও রোযা হবে না, তথাপি রোযাদারের মতোই থাকতে হবে কিছু পানাহার করা যাবে না।
এতো বিলম্বে যদি ঘুম ভাঙ্গে যে, সুবহে সাদেক হওয়ার সন্দেহ হয় তাহলে এমন সময় খানাপিনা মাকরূহ এবং সন্দেহ হওয়ার পর খানাপিনা গোনাহর কাজ। পরে সত্যি সত্যিই জানা গেল যে, সুবেহ সাদেক হয়েই গেছে তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে। কিন্তু সন্দেহেই যদি থেকে যায় তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে না। তবে সতর্কতার জন্যে কাযা করবে।

Tuesday, December 20, 2016

যাকাতের বিভিন্ন মাসয়ালা


১. কাউকে আপনি টাকা কর্জ দিয়েছেন। কিন্তু তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন যদি আপনি আপনার যাকাতের মধ্যে ঋণ কেটে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। কিন্তু যদি ঋণের পরিমাণ টাকা তাকে যাকাত দিয়ে দেন এবং তাপর তার কাছে তা আবার ঋণ হিসেবে আদায় করে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
২.ঘরে কাজ কর্মের যেসব চাকর চাকরানি, দাই প্রভৃতি থাকে তাদের কাজের পারিশ্রমিক ও বেতন হিসেবে তোদেরকে যাকাত থেকে দেয়া জায়েয হবে না।
৩. দুঃস্থ অভাবগ্রস্তদের কাপড় বানিয়ে দিতে, শীতের মওসুমে লেপ কম্বল বানিয়ে দিতে, বিয়ে শাদীতে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যাকাত থেকে ব্যয় করা যেতে পারে।
৪. যে মেয়েলোক কোনো শিশুকে দুধ খাইয়েছে সে যদি গরবী দুঃস্থ হয় তাহলে তাকে যাকাতের টাকা পয়সা দেয়া যেতে পারে। সে শিশু বয়স্ক হওয়ার পর তার দুধ মাকে যাকাত দিতে পারে।
৫. একজনকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়া হলো। তারপর জানা গেল যে সে সাহেবে নেসাব অথবা হাশেমী সাইয়েদ, অথবা অন্ধকারে যাকাত দেয়া হলো তারপর জানা গেল যে, সে আপন মা অথবা মেয়ে অথবা এমন কোনো আত্মীয় যাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়, তাহলে এ অবস্থায় যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্যি যে নেবে সে যদি হকদার না হয় তাহলে তার নেয়া উচিত নয় এবং নেয়ার পর তার ফেরত দেয়া উচিত।
৬. কাউকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়ার পর জানা গেল যে, সে অমুসলিম, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় দিতে হবে।
৭. নোট, মুদ্রা, তেজারতি মাল যা কিছুই সোনা চাঁদির নেসাবের পরিমাণ হবে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। যেমন, কারো কাছে কিছু নোট আছে এবং বিভিন্ন মুদ্রা আছে সব মিলে ৪০০/- টাকা হচ্ছে অথবা এতো টাকার তেজারতি মাল আছে, তাহলে যদিও সোনার নেসাব পুরো হচ্ছে না, চাঁদির নেসাব পুরো হচ্ছে, তাহলেও সে ব্যক্তি সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে এবং তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এজন্যে যে ৪০০/- টাকা সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্যের অধিক। (মনে রাখা দরকার যে, সোনা এবং চাঁদির মূল্য বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে (১৯৮৩) সাড়ে ৩৬ তোলা চাঁদির মূল্য প্রায় তিন হাজার টাকা। তাছাড়া নেসাব সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে সাড়ে ৫২ তোলা চাঁদি এবং সাড়ে ৭ ভরি সোনা যাকাতের নেসাব। যাই হোক, সোনা ও চাঁদির বাজার দরের ওপরই যাকাতের নেসাব ঠিক হবে। অনুবাদক
৯. ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর যাকাত ওয়াজিব।
১০. এক ব্যক্তি সারা বছর বিভিন্নভাবে সদকা খয়রাত করতে থাকলো কিন্তু যাকাতের নিয়ত করলো না। তাহলে বছর শেষ হওয়ার পর ঐসব খয়রাত করা মাল যাকাতের হিসেবে ধরা যাবে না। এজন্যে যাকাত বের করার সময় যাকাতের নিয়ত করা শর্ত।
১১. যাকাতের টাকা মানি অর্ডার করে পাঠানো যায় এবং মানি অর্ডার ফিস যাকাত থেকে বাদ দেয়া জায়েয।

Monday, December 19, 2016

নতুন চাঁদ দেখার পর রোযা


হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) নতুন চাঁদ দেখলে, বলতেন:
********** আরবী ************
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, হে আল্লাহ এ চাঁদকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান ও ইসলামের চাঁদ হিসেবে উদিত কর। যে কাজ তোমার পছন্দনীয় এবং প্রিয় সে কাজের তাওফিক আমাদেরকে দাও। হে চাঁদ! তোমার এবং আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ। (তিরমিযি ও দারেমী)
রোজার প্রকারভেদ ও তার হুকুম
রোজা ছয় প্রকার-যার বিস্তারিত বিবরণ ও হুকুম জানা জরুরী।
(১) ফরজ, (২) ওয়াজিব, (৩) সুন্নাত, (৪) নফল, (৫) মাকরূহ, (৬) হারাম।
১. ফরজ রোযা- বছরে শুধু রমজানের রোজা (৩০ বা ২৯চাদ অনুযায়ী) মুসলমানদের উপর ফরজ। কুরআন ও হাদীস থেকে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুসলিম উম্মত আর গোটা ইতিহাসে বরাবর এর উপর আমল করে এসেছে। যে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার অস্বীকার করবে সে কাফের হবে এবং ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হবে। আর বিনা ওজরে রোজা ত্যাগ করলে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে। রমজানের রোজা কোন কারণে বা অবহেলা করে করা না হলে তার কাযা করাও ফরজ। এ ফরজ কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, যখনই সুযোগ হবে করতে হবে। বরঞ্চ যথা শীঘ্র করা উচিত।
২. ওয়াজিব রোজা– মানতের রোজা, কাফফারার রোজা ওয়াজিব।কোন নির্দিষ্ট দিনে রোজ রাখার মানত করলে সেই দিনে রোজা রাখা জরুরী। দিন নির্দিষ্ট না করলে যে দিন ইচ্ছা করা যয়। বিনা কারণে বিলম্ব করা ঠিক নয়।
৩. সুন্নাত রোজা– যে রোজা নবী (স) স্বয়ং করেছেন এবং করতে বলেছেন তা সুন্নাত। তা রাখার বিরাট সওয়াব রয়েছে। কিন্তু তা সুন্নাতে মুয়ক্কিদাহ নয় এবং না করলে গোনাহ হবে না। সুন্নাত রোজা নিম্নরূপ:
  • আশুরার রোজা।অর্থাৎ মুহররমের নয় তারিখ এবং দশ তারিখে দুটি রোজা।
  • আরাফার দিনের রোজা। অর্থাৎ যুলহজ্জের নয় তারিখে রোজা।
  • আইয়াম বীযের রোজা। অর্থাৎ চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা।
৪. নফল রোজা– ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত বাদে সব রোজা নফল বা মোস্তাহাব। নফল রোজা এমন যে, তা নিয়মিত করলে বিরাট সওয়াব পাওয়া যায়। যেমনঃ
  • শাওয়াল মাসের ছটি রোজা।
  • সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা।
  • শাবানের ১৫ই তারিখের রোযা।
  • যুলহজ্জ মাসের প্রথম আট রোজা।
৫. মাকরূহ রোজা-
  • শুধু শনি অথবা রবিবার রোজা রাখা।
  • শুধু আশুরার দিন রোজা রাখা।
  • স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে রোজ রাখা।
  • মাঝে কোন দিন বাদ না দিয়ে ক্রমাগত রোজা রাখা যাকে সাওমে ভেসাল বলে।
৬. হারাম রোজা-বছরে পাঁচদিন রোজা রাখা হারাম
  • ঈদুল ফিতরের দিন রোজা ।
  • ঈদুল আযহার নে রোজা।
  • আইয়ামে তাশরীকে রোজা রাখা অর্থাৎ ১১ই, ১২ই, ১৩ই যুলহাজ্জ তারিখে রোজা রাখা হারাম।

সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ

সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ আশি তোলা সেরের হিসেবে এক সের তিন ছটাক গমের আটা (মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মতে- একজনের সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ এক সের সাড়ে বার ছটাক। সাবধানতার জন্যে দু সের দেয়া ভালো) যব বা যবের আটা, অথবা খুরমা, মুনাক্কা দিতে হলে গমের দ্বিগুণ দিতে হবে। (নবী (স) এর যুগে সম্ভবত যব এবং খুরমা মুনাক্কার মূল্য সমান ছিল)
সদকায়ে ফিতরের বিভিন্ন মাসায়েল
১. যে ব্যক্তি কোনো কারণে রমযানের রোযা রাখতে পারেনি, তারও সদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব। সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে রোযা শর্ত নয়।
২. সদকায়ে ফিতর খাদ্য শস্যের আকারেও দেয়া যায়, তার মূল্যও দেয়া যায়। দেয়ার সময় ফকীর মিসকিনদের সুবিধা বিবেচনা করে খাদ্য শস্য বা মূল্য দেয়া উচিত।
৩. গমের পরিবর্তে অন্য কিছু যেমন জোয়ার, বাজরা, ছোলা, মটর প্রভৃতি দেয়ার ইচ্ছা থাকলে গম অথবা যবের মূল্যে পরিমাণ হওয়া উচিত।
৪. একজনের সদকায়ে ফিতর একজন ফকীরকেও দেয়া যায় এবং কয়েকজনকেও দেয়া যায়। তেমনি কয়েকজনের ফিতরা একজনকেও দেয়া যায় এবং কয়েকজনকেও দেয়া যায়।
৫. কারো কাছে কিছু গম এবং কিছু যব আছে। তাহলে হিসেব করে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ পূর্ণ করে দেবে।
৬. প্রয়োজন হলে ফিতরা অন্যস্থানেও পাঠানো যায়। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া অন্যত্র না পাঠানো উচিত।
৭. সদকায়ে ফিতরের ব্যয়ের খাতও তাই, যাক যাকাতের।

নেসাব ও যাকাতের হার আদায়

৪০টি ভেড়া ছাগলে একটি ভেড়া বা ছাগল।
৪১ থেকে১২০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত ওয়াজিব নয়।
১২১ হলে দুটি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
১২২ থেকে ২০০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।
২০১ হলে তিনটি ছাগল।
২০২ থেকে ৩৯৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।
৪০০ হলে ৪টি ছাগল বা ভেড়া যাকাত দিতে হবে।
৪০০ এর পরে ১০০ পুরো হলে একটা ছাগল বা ভেড়ার হিসেবে যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ শতকরা একটি করে। ভেড়া ছাগলের যাকাত এক বছর বা তার বেশী বয়সের বাচ্চা যাকাত দিতে হবে।
গরু মহিষের নেসাব ও যাকাতের হার
যাকাতের ব্যাপারে গরু ও মহিষের একই হুকুম। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয (র) মহিষকে গরু হিসেবে ধরে তার ওপর ঐ ধরনের যাকাত আরোপ করেন যা নবী (স) নির্ধারণ করেছিলেন। উভয়ের নেসাব ও যাকাতের হার এক কারো কাছে উভয় ধরনের পশু থাকলে উভয়কে মিলিয়ে নেসাব পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যার সংখ্যা বেশী হবে তার মধ্যে থেকে যাকাত দিতে হবে। উভয়ের সংখ্যা সমান হলে যে কোনো একটা দেয়া যাবে।
নেসাব ও যাকাতের হার
যে ব্যক্তি ৩০টি গরু মহিষের মালিক হবে তার ওপর যাকাত ফরয হবে। তার কম হলে যাকাত নেই।
৩০টি গরু মহিষের মধ্যে গরু বা মহিষের একটি বাচ্চা দিতে হবে যার বয়স পূর্ণ এক বছর হয়েছে।
৩১ থেকে ৩৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই। ৪০টি গরু মহিষ হলে এমন একটি বাচ্চা যাকাত দিতে হবে যার বয়স পূর্ণ দু বছর।
৪১ থেকে ৫৯ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই। ৬০টি গরু মহিষ হলে এক বছরের দুটি বাচ্চা যাকাত দিতে হবে। ষাটের পরে প্রত্যেক ৩০ গরু মহিষ এক বছরের বাচ্চা এবং প্রত্যেক ৪০ গরু মহিষে দু বছরের বাচ্চা দিতে হবে।
যেমন ধরুন কারো কাছে ৭০টি গরু মহিষ আছে। এখন ৭০টিতে দু নেসাব আছে একটা তিরিশের এবং অন্যটা চল্লিশের। যদি ৮০টি গরু মহিষ হয় তাহলে চল্লিশ চল্লিশের দু নেসাব হবে। অতএব দু বছরের দু বাচ্চা ওয়াজিব হবে। ৯০টি হলে ত্রিশ ত্রিশের তিন নেসাব হবে। যার জন্যে প্রত্যেক ৩০টির ওপর এক বছরের বাচ্চার হারে যাকাত দিতে হবে।
উটের নেসাব ও যাকাতের হার
যে ব্যক্তি পাঁচটি উটের মালিক হবে সে সাহেবে নেসাব হবে। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তার কম উটের যাকাত নেই।
নেসাব ও যাকাতের বিবরণ
পাঁচটি উটের ওপর একটি ছাগল ওয়াজিব এবং ৯টি উট পর্যন্ত ঐ একটি ছাগল।
দশটি উট হলে দুটি ছাগল এবং ১৪টি পর্যন্ত ঐ দুটিই।
পনেরোটি উট হলে তিনটি ছাগল এবং ১৯টি পর্যন্ত ঐ একই।
বিশটি উটে ৪টি ছাগল এবং ২৪টি পর্যন্ত ঐ একই।
পঁচিশটি উটের ওপর এমন এক উটনী যার বয়স দ্বিতীয় বছর শুরু হয়েছে।
২৬ থেকে ৩৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না। ৩৬টি উট হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স তৃতীয় বছর শুরু হয়েছে।
৩৭ থেকে ৪৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোন যাকাত নেই।
৪৬টি হলে উট হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে।
৪৭ থেকে ৬০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।
৬১টি হলে এমন এক উটনী দিতে হবে যার বয়স পঞ্চম বছর শুরু হয়েছে।
৬২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।
৭৬ হলে দুটি উটনী যাদের বয়স তৃতীয় বছর শুরু হয়েছে।
৭৭ থেকে ৯০ পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো যাকাত নেই।
৯১ হলে দুটি এমন উটনী যাদের বয়স চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে।
১২০ পর্যন্ত উপরোক্ত দুটি উটনী।
তারপর পুনরায় সেই হিসেব শুরু হবে অর্থাৎ ৫টির ওপর এক ছাগল, ১০টির উপর দু ছাগল।
যাকাত দানের ব্যাপারে একটি জরুরী ব্যাখ্যা
সোনা,চাঁদি ও পশুর যে যাকাত ওয়াজিব হবে তা সোনা, চাঁদি এবং পশুর আকারেও দেয়া যাবে এবং নগদ টাকাও দেয়া যাবে। অলংকারের যাকাতে সোনা চাঁদি দেয়া জরুরী নয়। বাজারের প্রচলিত নিরিখে তার মূল্য ধরে নগদও দেয়া যায়।
কোন কোন খাতে যাকাত ব্যয় করা যায়
কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা শুধু যাকাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম বয়ান করে তার জন্যে শুধু তাকীদই করেননি, বরঞ্চ বিশদভাবে তার ব্যয় করার খাতগুলোও বলে দিয়েছেন।
********** আরবী ************
এ সদকা তো ফকীর মিসকিনদের জন্যে এবং তাদের জন্য যারা সদকার কাজের জন্য নিয়োজিত এবং তাদের জন্য যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য। এবং শৃঙ্খলা মুক্ত করার জন্যে। ঋণগ্রস্তদের সাহায্যে জন্যে। আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে অবশ্য পালনীয় ফরয আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং মহাজ্ঞানী। (সূরা আত তাওবাঃ৬০)
এ আয়াতে যাকাতের আটটি খাতের কথা বলা হয়েছেঃ
১) ফকীর বা দরিদ্র, ২) মিসকিন অভাবগ্রস্ত অথচ হাত পাতে না, ৩) যাকাত আদায় ও বণ্টনের কর্মচারী, ৪) মন জয় করার উদ্দেশ্যে, ৫) শৃংখলমুক্ত করার জন্যে, ৬) ঋণগ্রস্তদের জন্যে, ৭) ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে, ৮) পথিক মুসাফির।
যাকাত এ আটা খাতেই ব্যয় করা যেতে পারে তার বাইরে নয়।
হযরত যিয়াদ বিন আল হারেস (রা) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নবী (স) এর খেদমতে এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বললো, যাকাত থেকে আমাকে কিছু দিন। নবী (স) বললেন, আল্লাহ যাকাত ব্যয় করার খাতগুলো কোনো নবীর ওপর ছেড়ে দেননি আর না কোনো নবীর ওপর। বরঞ্চ তিনি স্বয়ং তার ফায়সালা করে দিয়েছেন। তার আটটি খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তুমি যদি এ খাতগুলোর মধ্যে পড় তাহলে অবশ্যই তোমাকে যাকাত দিয়ে দেব।
খাতগুলোর বিশদ বিবরণ
১. ফকীর: ফকীর বলতে সে সব নারী পুরুষকে বুঝায় যারা তাদের জীবন ধারণের জন্যে অপরের সাহায্য সহযোগিতায় ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে ঐসব দুঃস্থ, অভাবগ্রস্ত, অক্ষম অপারগ ব্যক্তি শামিল যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে আর্থিক সাহায্যের হকদার। জীবিকা অর্জনে অক্ষম ব্যক্তি, পঙ্গু, এতিম শিশু, বিধবা, স্বাস্থ্যহীন, দুর্বল, বেকার এবং যারা দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার এমন লোকদেরকে সাময়িকভাবে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে এবং তাদের জন্যে স্থায়ী ভাতাও নির্ধারিত করা যেতে পারে।
২. মিসকীনঃ মিসকিন বলতে ঐসব দরিদ্র সম্ভ্রান্ত লোক বুঝায় যারা খুবই দুস্থ ও অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সম্মানের ভয়ে ও লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না। জীবিকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা ও পরিশ্রম করার পরও দু মুঠো ভাত জোগাড় করতে পারে না, তবুও নিজের দুঃখের কথা কাউকে বলে না। হাদীসে মিসকিনের সংজ্ঞা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
********** আরবী ************
যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না, আর না তাকে (তার আত্মসম্মানের জন্যে) বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্যে লোক তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে, আর না সে বেরিয়ে পড়ে লোকের কাছে কিছু চায়। (বুখারী, মুসলিম)
৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী ***** আরবী *****: এরা হচ্ছে ঐসব লোক, যারা যাকাত, ওশর আদায় করে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করে,বণ্টন করে এবং তার হিসেব পত্র সংরক্ষণ করে। তারা সাহেবে নেসাব হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের বেতন যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে।
৪. যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য ***** আরবী ****: এ হচ্ছে ঐসব লোক যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য। ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের স্বার্থে তাদেরকে হাত করা, তাদের বিরোধিতা বন্ধ করা প্রয়োজন হয়। এসব লোক কাফেরও হতে পারে এবং ঐসব মুসলমানও হতে পারে যাদের ইসলাম তাদেরকে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের খেদমতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে যথেষ্ট নয়। এসব লোক সাহেবে নেসাব হলেও তাদেরকে যাকাত দেয়া যেতে পারে।
হানাফীদের অভিমত এই যে, ইসলামের সূচনায় এ ধরনের লোকের মন জয় করার জন্য যাকাত থেকে খরচ করা হতো। কিন্তু হযরত ওমর (রা) হযরত আবু বকর (রা) এর যমানায় এ ধরনের লোককে যাকাত দিতে অস্বীকার করেন (প্রকৃত ঘটনা এই ছিল যে, নবী (স) এর ইন্তেকালের পর উয়ায়না বিন হাসান এবং আকরা বিন হারেস হযরত আবু বকর (রা) এর কাছে এক খন্ড যমী দাবী করেন। তিনি তাদেরকে দানের ফরমান লিখে দেন। তারা চাইছিল যে, বিষয়টিকে মজবুত করার জন্যে অন্যান্য সাহাবীগণও সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করুক। কিছু স্বাক্ষরও হলো। তারপর যখন হযরত ওমর (রা) এর সাক্ষ্য নিতে গেল তখন তিনি ফরমান পড়ার পর তাদের চোখের সামনেই ছিঁড়ে ফেলে দেন। তাদেরকে বলেন, নবী (স) তোমদের মন জয় করার জন্যে তোমাদেরকে এরূপ দিতেন। কিন্তু সেটা ছিল ইসলামের দুর্বলতা যুগ। এখন আল্লাহ ইসলামকে তোদের মুখাপেক্ষী করে রাখেননি। তারপর তারা হযরত আবু বকর (রা) এর নিকটে অভিযোগ করে বলে, খলীফা কি আপনি, না ওমর? কিন্তু না হযরত আবু (রা) এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন, আর না অন্যান্য সাহাবীগণ হযরত ওমর (রা) থেকে ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। এর থেকে হানাফীগণ এ যুক্তি পেশ করেন যে, যখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেল এবং এমন শক্তির অধিকারী হলো যে, তারা নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হলো, তখন স অবস্থা আর রইলো না যার কারণে মন জয় করার জন্যে একটা অংশ রাখা হয়েছিল। অতএব সাহাবীদের ইজমার ভিত্তিতে ঐ অংশ চিরদিনের জন্যে রহিত হয়ে গেল) এবং এ ব্যবস্থা চিরদিনের জন্যে রহিত হয়ে যায়।
এ অভিমত ইমাম মালেকও পোষণ করেন। অবশ্যি কোনো কোনো ফকীহর মতে এ খাত এখনো বাকী রয়েছে এবং প্রয়োজন অনুসারে মন জয় করার জন্যে যাকাতের মাল ব্যয় করা যেতে পারে। (আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেনঃ আমাদের নিকটে সঠিক এটাই যে, মুয়াল্লেফাতু কুলুব এর অংশ কেয়ামত পর্যন্ত রহিত হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। নিঃসন্দেহে হযরত ওমর (রা) যা কিছু বলেছিলেন তা ঠিক ছিল। যদি ইসলামী রাষ্ট্র মন জয় করার জন্যে অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজনবোধ না করে, তাহলে কেউ তার ওপরে এটা ফরয করে দেননি যে, এ খাতে অবশ্যই কিছু না কিছু খরচ করতে হবে। কিন্তু কোনো সময়ে যদি তার প্রয়োজন হয়, তাহলে আল্লাহ তার জন্যে অবকাশ রেখেছেন, তা বাকী থাকা উচিত। হযরত ওমর (রা) এবং সাহাবায়ে কেরামের যে বিষয়ের ওপর ইজমা হয়েছিল তা এই যে, সে সময়ে যে অবস্থা ছিল তখন মন জয় করার জন্যে কাউকে কিছু দেয়া তারা জরুরী মনে করেননি। তার থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সংগত কারণ নেই যে, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা ঐ খাতকে কেয়ামত পর্যন্ত রহিত করে দিয়েছে যা কুরআনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বাঞ্ছনীয়তার জন্যে রাখা হয়েছিল। (তাহফীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৭, ইমাম শাফেয়ীরও তাই মত)
৫. শৃংখলমুক্ত করা (গোলাম আযাদ করা): অর্থাৎ যে গোলাম তার মনিবের সাথে এরূপ চুক্তি করেছে যে, এতো টাকা দিলে তাকে মুক্ত করে দেবে, এমন গোলামকে বলে মাকাতিব। আযাদীর মূল্য পরিশোধ করার জন্যে মাকাতিবকে যাকাত দেয় যেতে পারে। সাধারণ গোলামকে যাকাতের টাকা দিয়ে আযাদ করা জায়েয নয়। কোনো সময়ে যদি গোলাম বিদ্যমান না থাকে, তাহলে এ খাত রহিত হয়ে যাবে।
৬.ঋণগ্রস্তঃ যারা ঋণের বোঝায় পিষ্ট এবং আপন প্রয়োজন পূরণের পর ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। বেকার হোক অথবা উপার্জনশীল এবং এতো সম্পদ নেই যে কর্জ পরিশোধের পর নেসাব পরিমাণ মাল তার কাছে থাকবে। ঋণগ্রস্তের মধ্যে তারাও মাশিল যারা কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণ অথবা জরিমানা দিতে হয়েছে অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট নষ্ট হয়ে গেছে অথবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার সব সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে।
৭. ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে): এর অর্থ আল্লাহর পথে জেহাদ। কেতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের তুলনায় জেহাদ শব্দটি সাধারণত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জেহাদ ফী সাবিলিল্লাহর মধ্যে যে সমুদয় চেষ্টা চরিত্র শামিল যা মুজাহিদগন কুফরী ব্যবস্থাকে নির্মূল করে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে করে থাকেন। সে চেষ্টা চরিত্র কলমের দ্বারা হোক, হাত মুখ ও তরবারির দ্বারা হোক অথবা কঠোর শ্রম সাধনার দ্বারা হোক তার সীমারেখা এতো সীমিত নয় যে, তার অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ এবং তার এতোটা ব্যাপকও নয় যে, তার মধ্যে দৈনন্দিন সকল সমাজকল্যাণমূলক কাজও শামিল করা যায়। অতীতে ইসলামের মনীষীগণ জেহাদে ফী সাবিলিল্লাহর সর্বসম্মতভাবে এ অর্থই গ্রহণ করেছেন যে, তা এমন সব চেষ্টা চরিত্র যা দ্বীনে হক কায়েম করার জন্যে, তার প্রচার ও প্রসারের জন্যে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে করা হয়। এ চেষ্টা চরিত্র যারা করে তাদের যাতায়াত খরচ, যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করার জন্যে যাকাত থেকে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
৮. পথিক বা মুসাফিরঃ পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়িতে যত ধন সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।
যাকাতের অর্থ ব্যয় সম্পর্কে কিছু কথাঃ
১. এটা জরুরী নয় যে, যাকাতের অর্থ সব খাতেই ব্যয় করতে হবে যা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। বরঞ্চ প্রয়োজন অনুসারে ও সুযোগ সুবিধা মত যে যে খাতে যতোটা মুনাসিব মনে করা হবে ব্যয় করা যেতে পারে। এমনকি যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো একটি খাতে সমুদয় অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
২. যাকাত ব্যয় করার যেসব খাত, ওশর এবং সদকায়ে ফিতরেরও সেই খাত। নফল সদকা অবশ্যি দাতার এখতিয়ারাধীন।
৩. বনী হাশিমের লোক যদি যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজে নিযুক্ত হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত থেকে পারিশ্রমিক দেয়া জায়েয হবে না। নবী (স) তার নিজের ওপর এবং বনী হাশিমের লোক বিনা পারিশ্রমিকে এ খেদমত করতে চাইলে করতে পারেন যেমন নবী (স) স্বয়ং যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ করেছেন।
৪. সাধারণ অবস্থায় কোনো ব্যক্তির যাকাত সে বস্তিরই অভাবগ্রস্ত ও দুঃস্থদের মধ্যে ব্যয় করা উচিত, এটা মুনাসিব নয় যে, সে বস্তির লোক বঞ্চিত থাকবে এবং যাকাত অন্য স্থানে পাঠানো হবে। তবে অন্য স্থানের প্রয়োজন যদি তীব্র হয় অথবা দীনি বাঞ্ছনীয়তার দাবী হয়, যেমন কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে অথবা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে অথবা কোনো আকস্মিক বিপদ এসেছে, কিংবা প্রলয়ঙ্কর ঝড়-তুফান হয়েছে, অথবা অন্য স্থানে কোনো দ্বীনি মাদরাসা আছে যার আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন, অথবা কোনো আত্মীয় স্বজন আছে, তাহলে অন্য স্থানে যাকাত পাঠানো জায়েয। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, নিজ বস্তির লোক একেবারে যেন বঞ্চিত না হয়।
যাদের যাকাত দেয়া জায়েয নয়
সাত প্রকারের লোককে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। দিলে যাকাত আদায় হবে না।
১. বাপ-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, তাদের বাপ-মা।
২. সন্তান-সন্ততি, নীচের দিক পর্যন্ত যথা ছেলে-মেয়ে, পৌত্র, প্রপৌত্র, নাতী-নাতনী প্রভৃতি।
৩. স্বামী।
৪. স্ত্রী।
এসব লোককে যাকাত দেয়ার অর্থ আপনজনদেরকে উপকৃত করা। তবে তার অর্থ এটাও কখনো নয় যে, লোক তার মাল দ্বারা এসব লোকের কোনো সাহায্য করবে না। বরঞ্চ শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাদের ভরণ পোষণ ও দেখা শুনা করা প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। উপরোক্ত চার ধরনের আত্মীয় ছাড়া অন্যান্য সকল আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া শুধু জায়েযই ……. অতি উত্তম ও বেশী সওয়াবের বিষয়।
৫. সাহেবে নেসাব সচ্ছল ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ দেয়াও নাজায়েয। কোনো গরীব দুঃস্থকে এতোটা দেয়াও জায়েয নয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যায়। তবে যদি সে ঋণগ্রস্ত হয় অথবা অধিক সন্তানের মালিক হয় তাহলে প্রয়োজন অনুসারে বেশী পরিমাণ দেয়া যেতে পারে। নবী (স) বলেন, সদকা মালদারের জন্যে জায়েয নয় এ পাঁচ ধরনের লোক ছাড়া, যথা (১) আল্লাহর পথে জেহাদকারী, (২) ঋণগ্রস্ত,( ৩) সদকা আদায় ও বন্টনকার, (৪) এমন ব্যক্তি যে তার অর্থ দিয়ে সদকার মাল খরিদ করে, (৫) এমন ব্যক্তি যার প্রতিবেশী মিসকিন এবং মিসকিন এবং মিসকিন তার ধনী প্রতিবেশীকে তার প্রাপ্ত সদকা হাদীয়া পেশ করে। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
৬. অমুসলিমকে যাকাত দেয়াও জায়েয নয়।
৭. বনী হাশিমের বংশধরদের নিম্নের তিন গোত্রকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়।
(ক) হযরত আব্বাস (রা) এর বংশধর।
(খ) হারেসের বংশধর।
(গ) আবু তালেবের বংশধর।
হযরত আলী (রা) ও হযরত ফাতেমা (রা) এর সন্তানগণ উক্ত তৃতীয় গোত্রের।
অবশ্যি আজকাল এ যাচাই করা মুস্কিল যে, প্রকৃতপক্ষে বনী হাশিমের বংশধর কে। অতএব বায়তুলমাল থেকে তো প্রত্যেক অভাবগ্রস্তের সাহায্য পাওয়া উচিত। তবে যদি কারো হাশেমী হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে তাহলে তার যাকাত নেয়া উচিত নয়।
ইমাম মালেক (র) বলেন, নবী (স) বলেন, সদকার মাল মুহাম্মাদ (স) এর আওলাদের জন্যে জায়েয নয়। এজন্যে যে, সদকা লোকের ময়লা তো বটে। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)

ব্যবসার মালের যাকাত

ব্যবসার মালের নেসাবও তাই যা সোনা চাঁদির নেসাব। অর্থাৎ সোনা অথবা চাঁদির নেসাবের ভিত্তিতে যাকাত দিতে হবে। যেমন ধরুন আপনার কাছে মোট চারশ টাকা মওজুদ আছে। এত সোনার নেসাব তো হয় না কিন্তু চাঁদির নেসাব হয়, তাহলে সেই নেসাব অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে।
ব্যবসার মালের যাকাতের পদ্ধতি এই যে, ব্যবসা শুরু করার দিন থেকে এক বছর হয়ে গেলে মওজুদ মালে Stock in trade মূল্য হিসেব করতে হবে। তারপর দেখতে হবে নগদ তহবিল Cash in hand কি আছে। এখন উভয়ের সমষ্টির ওপর যাকাত বের করতে হবে। যদি মওজুদ স্টক এবং নগদ তহবিল নেসাবের কম হয় এবং তারপর হঠাৎ ব্যবসার পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় নেসাব পরিমাণ কিংবা তার অধিক হয়ে যায়, তাহলে যে তারিখ থেকে দাম বেড়েছে সে তারিখ থেকে যাকাতের বছর শুরু হবে।
যদি কোন ব্যবসায় কয়েকজন অংশীদার থাকে,তাহলে ব্যবসার সামগ্রিক স্টক এবং নগদ তহবিলের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। বরঞ্চ প্রত্যেক অংশীদারের অংশ এবং মুনাফার টাকার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি এ অংশ এবং তার মুনাফা নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে নতুবা হবে না।
এমনিভাবে কিছু মাল যদি কয়েক ব্যক্তির অংশীদারিত্বে হয় তাহলে তার ওপর যাকাত তখনই হবে, যখন প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ হবে। যেমন ধরুন, দু ব্যক্তির মিলে চল্লিশ ছাগল আছে অথবা ষাট তোলা চাঁদি দু ব্যক্তির মালিকানায় আছে। তাহলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না।
ব্যবসার কাজে প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, ফার্নিচার, ষ্টেশনারী দ্রব্যাদি, দালানকোঠা, অর্থাৎ উৎপাদনের উপাদানের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয় না। শুধু ব্যবসার মালপত্র এবং নগদ তহবিল মিলে যে মূল্য হবে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। (ইমাম শাফেয়ীর অভিমত এই যে, কারবারে সামগ্রিক স্টক এবং নগদ তহবিল যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ হোক বা না হোক। ইমাম মালেকের মতেও যাকাত সামষ্টিক মাল থেকেই আদায় করতে হবে। কিন্তু ঐসব অংশীদারকে গণনার বাইরে রাখাতে হবে যারা সাহেবে নেসাব নয় অথবা যে এক বছরের কম সময়ে তার অংশের মালিক হয়েছে। এ অভিমতই বেশী মুনাসিব এবং বাস্তব)যাকাত দেয়ার সময় এসব কাজের টাকা পয়সাও হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে যা ব্যবসা করা কালীন আদান প্রদান হয়েছে। হযরত সামরা বিন জুন্দুব বলেন, নবী (স) আমাদেরকে ব্যবসার মালের যাকাত দিতে বলেছেন। (আবু দাউদ)
অলংকারের যাকাত
সোনা চাঁদি যে আকারেই হোক তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তা সে মুদ্রা হোক, খন্ড, তারব্রকেড হোক, অথবা কাপড়ের ওপর সোনার জরির কাজ হোক, অথবা কাপড় বুনোনে সোনা বা সোনা চাঁদির চিকন তার হোক, অথবা মেয়েদের ব্যবহারের অলংকার হোক, প্রত্যেক বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
ইয়ামেনের জনৈকা মহিলা নবী (স) এর খেদমতে হাজির হলো, তার সাথে তার মেয়ে ছিল যার হাতে সোনার দুটি মোটা কঙ্কণ ছিল। নবী (স) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এর যাকাত দাও?  সে বলল, জি না, যাকাত তো দিই না। নবী (স) বললেন, তুমি কি এটা পছন্দ করো যে, কেয়ামতের দিন ঐ অপরাধে তোমাকে আগুনের কঙ্কণ পরিয়ে দেয়া হবে। একথা শুনে মহিলাটি দুটি কঙ্কণ খুলে নবীর হাতে দিয়ে বললো, এগুলো আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যে পেশ করছি। (নাসায়ী)
হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেন, আমি কঙ্কণ পরতাম এবং একদিন নবী (স)কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ। এটা কানয (যে সঞ্চিত সম্পদে যাকাত দেয়া হয় না) বলে গণ্য হবে? তিনি বললেন, যে মাল যাকাত দেয়ার পরিমাণে পৌছে এবং তার যাকাত দেয়া হয় তা কানয নয়। (আবু দাউদ)
অলংকারের যাকাত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা মওদূদী বলেনঃ অলংকারের যাকাত সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত আছে। একটি অভিমত এই যে, এর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। কর্জ হিসেবে তা দেয়াটাই তার যাকাত। এ হচ্ছে আনাস বিন মালেক, সাঈদ বিন মুসাইয়্যের এবং শাবীব উক্তি। দ্বিতীয় অভিমত এই যে, অলংকারের যাকাত জীবনে একবার দিলেই যথেষ্ট হবে। তৃতীয় অভিমত এই যে,যে অলংকার সর্বদা ব্যবহার করা হয় তার ওপর যাকাত নেই। যা অধিক সময়ে তুলে রাখা হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। চতুর্থ অভিমত এই যে, সব রকমের অলংকারের যাকাত ওয়াজিব। আমাদের মতে এ সর্বশেষ অভিমতটি সঠিক। প্রথমত, যেসব হাদীসে সোনা চাঁদির ওপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার হুকুম রয়েছে তার শব্দগুলো সাধারণ। যেমন চাঁদির ওপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত এবং পাঁচ উকিয়ার কম হলে তার ওপর যাকাত নেই। বিভিন্ন হাদীস ও আসার থেকে জানা যায় যে, অলংকারের ওপর যাকাত ওয়াজিব। আবু দাউদ, তিরমিযি ও নাসায়ীতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে যে, একজন নারী নবী (স) এর দরবারে আসে এবং তার সাথে তার মেয়ে ছিল। তার দুটি হাতে সোনার কঙ্কণ ছিল। নবী (স) বললেন, তুমি এর যাকাত দাও? সে বললো না। তখন নবী (স) বলেন, তুমি কি পছন্দ কর যে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে তার বদলে আগুনের কঙ্কণ পরিয়ে দেবেন?
উপরন্তু মুয়াত্তা, আবু দাউদ ও দারে কুতনীতে নবী (স) এর এ উক্তি নকল করা হয়েছে ********** আরবী ************ যে অলংকারের যাকাত তুমি দিয়েছ তা কানয নয়। ইবনে হাযম বলেন, হযরত ওমর (রা) ও তার গভর্নর আবু মূসা আশয়ারীকে যে ফরমান পাঠান, তাতে এ হেদায়েত ছিল মুসলমান মেয়েলোকদেরকে আদেশ কর তারা যেন তাদের অলংকারের যাকাত দেয়।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল অলংকার সম্পর্কে হুকুম কি? তিনি বলেন, যখন তা দুশ দিরহাম পরিমাণ হবে তখন তার যাকাত দিতে হবে। এ ধরনের উক্তি সাহাবাদের মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) এবং আয়েশা (রা) এবং তাবেঈনদের মধ্যে সাইদ বিন মুসাইয়্যেব, সাঈদ বিন বুহাইব, আতা, মুজাদি, ইবনে সিরীন ও যুহরী এবং ফেকার ইমামদের মধ্যে সুফিয়ান সাওরী, আবু হানিফা ও তার সঙ্গীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
যাকাতের হার
১. সোনা, চাঁদি, ব্যবসার মাল, ধাতু মুদ্রা, নোট, অলংকার প্রভৃতির শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত ওয়াজিব হবে।
২. সোনা চাঁদি অথবা অলংকারে চল্লিশ ভাগের একভাগ সোনা অথবা যাকাত হিসেবে দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু জরুরী নয় যে সোনা চাঁদি যাকাত হিসেবে দিতে হবে। তার মূল্য হিসেব করে নগদ অর্থ দেওয়া যেতে পারে। কাপড় অন্যান্য বস্তু দেওয়া যেতে পারে। নগদ অর্থ ও তেজারতি মালের মূল্য সোনা অথবা চাঁদির কোনটির নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।
৩. সোনা চাঁদি নেসাব পূর্ণ হয়ে কিছু বেশী সোনা চাঁদি অথবা তেজারতি মাল কারো কাছে যদি থাকে তাহলে তার উপর এ অবস্থায় যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি তা নেসাবের এক পঞ্চমাংশ হয়। তার কম হলে যাকাত মাফ। (ইলমুল ফেকাহ)
৪. যদি কোন অলংকার দলা অথবা কাপড়ে সোনা বা চাঁদি উভয়ে থাকে তাহলে দেখতে হবে কার পরিমাণ বেশী। যার পরিমাণ বেশী হবে তার হিসেব ধরতে হবে। যদি সোনা ধরতে তাহলে সব সোনা মনে করে সোনার নেসাবনুযায়ী যাকাত দিতে হবে। যদি চাঁদির পারিমাণ বেশী হয় তবে সমুদয় চাঁদি মনে করে চাঁদির নেসাব অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে।
৫. সোনা, চাঁদির অলংকারাদীতে যদি অন্য কোন ধাতু মিশ্রিত থাকে এবং তার পরিমাণ যদি সোনা চাঁদির কম হয় তাহলে তা ধর্তব্যের মধ্যে হবে না। তা সোনা চাঁদি মনে করে যাকাত দিতে হবে। আর যদি তার মধ্যে সোনা চাঁদি কম থাকে তাহলে শুধু সোনা চাঁদির হিসেব করতে হবে। তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে, নতুবা দিতে হবে না।
৬. একজনের নিকট কিছু সোনা ও কিছু চাঁদি আছে। তার মধ্যে যেটারই নেসাব পুরো হবে তার সাথে অন্যটার মূল্য হিসেব করে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।
৭. যদি কারো নিকটে সোনাও নেসাবের কম এবং চাঁদিও নেসাবের কম আছে। তাহলে চাঁদিকে সোনার সাথে মিলিয়ে অথবা সোনাকে চাঁদির সাথে মিলিয়ে যে নেসাব পুরো হবে তার শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে। এমনি কিছু নগদ টাকা আছে, কিছু চাঁদি আছে, কিছু তেজারতি মাল আছে। তাহলে সব মিলিয়ে যদি চাঁদি অথবা সোনার নেসাব পুরো তাহলে যাকাত দিতে হবে।
৮. অলংকারের যেসব মণিমুক্তা প্রভৃতি থাকবে তার যাকাত নেই। ওজনে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকী সোনা চাঁদির শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে।
যে সবের উপর যাকাত নেই
১. বাঁশের বাড়ি ঘরের উপর যাকাত নেই তা যতই মূল্যবান হোক না কেন।
২. যে কোন প্রকারের মণিমুক্তা ইত্যাদির উপর যাকাত নেই।
৩. কৃষি সেচ কাজের জন্য যে পশু, যেমন- গরু, মহিষ, উট প্রতি পালন করা হয় তার উপর যাকাত নেই। এ ব্যাপারে মূলনীতি এই যে এক ব্যক্তি তার কারবারে উৎপাদনের যেসব উপাদান ব্যবহার করে তা যাকাত বহির্ভূত। হাদীসে আছে ********** আরবী******* যেসব উঠ দিয়ে কৃষি কাজ করা হয় তার উপর যাকাত নেই। কারণ তার যাকাত যমীন থেকে উৎপন্ন ফসল থেকে আদায় করা হয়। এরূপ উৎপাদনের যন্ত্রপাতির উপর যাকাত নেই।
৪. কল-কারখানা মেশিন যন্ত্রপাতির উপর যাকাত নেই। উপরুন্ত কারখানার দালান কোটা, ব্যবসার ব্যবহৃত ফার্নিচার, দোকান ঘর এসবের উপর যাকাত নেই।
৫. ডেইরী ফার্মের পশুর উপর যাকাত নেই। কারণ সেগুলো তো উৎপাদনের উপাদানের মধ্যে পড়ে। অবশ্য ডেইরী থেকে উৎপাদিত বস্তুর উপর যাকাত ওয়াজিব আছে।
৬. মূল্যবান কোন জিনিস কেউ যদি শখ করে ঘরে রাখে তার উপর যাকাত নেই। তবে যদি ব্যবসা করা হয় তার উপর যাকাত আছে। যেমন তেজারতি মালের উপর।
৭. কেউ যদি চৌবাচ্চায় বা পুকুরে সৌখিন মাছ পুষে তাহলে তার উপর যাকাত নেই। কিন্তু তার ব্যবসা করলে যাকাত দিতে হবে।
৮. গৃহপালিত পশু যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাখা হয়, যেমন দুধ পানের জন্য গাভী, বোঝা বহনের জন্য গরু –মহিষ, যানবাহনের জন্য ঘোড়া হাতি উঠ থাকলে তার সংখ্যা যতই হোক না কেন তার যাকাত দিতে হবে না।
৯. চড়ে বেড়াবার জন্য মোটর সাইকেল কার বাস থাকলে তার উপর যাকাত নেই।
১০. ডিম বিক্রির জন্য হাঁস-মুরগির ফার্ম করলে হাঁস-মুরগির উপর যাকাত নেই। তবে বিক্রি করা ডিমের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে যেমন অন্যান্য ব্যবসার উপর হয়।
১১. সখ করে মুরগি অথবা কোন পাখি পুষলে তার উপর যাকাত নেই।
১২. যেসব জিনিষের ভাড়া খাটানো হয়, যেমন সাইকেল, রিক্সা, ট্যাক্সি, বাস, ফার্নিচার, ক্রয়কারী প্রভৃতির উপর যাকাত নেই। তবে এসব থেকে যা মুনাফা হবে তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে বছরে অতীত হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে। ঐসব জিনিষের মূল্যের উপর কোন যাকাত নেই।
১৩. দোকান ও বাড়ি ঘর থেকে যে যাকাত আদায় করা হয় তার উপর কোন যাকাত নেই, তার মূল্য যতই হোক না কেন।
১৪. পরনের কাপড়, কোট, প্যান্ট, চাদর, কম্বল, টুপি, জুতা, ঘড়ি, ঘরের আসবাবপত্র, কলম প্রভৃতির উপর যাকাত উপর যাকাত নেই,তার মূল্য যতই হোক না কেন।
১৫. গাধা, খচ্চর, ঘোড়ার উপর যাকাত নেই, যদি তা ব্যবসার জন্য না হয়।
১৬. ওয়াকফের পশুর ওপরও যাকাত নেই। যেসব ঘোড়া জেহাদের জন্য পালা হয় এবং যেসব অস্ত্রশস্ত্রও জেহাদও দীনের খেদমতের জন্য, তার ওপরও যাকাত নেই।
পশুর যাকাত
সাধারণ মাঠে ময়দানে চরে বেড়ানো গৃহপালিত পশু বংশ বৃদ্ধি ও দুধের জন্য প্রতিপালিত হলে তাকে পরিভাষায় সায়েমা বলে। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। যেসব পশু গোশত খাওয়ার জন্য পালা হয় এবং বন্য পশু যেমন হরিণ, নীল গাই, চিতা প্রভৃতির উপর যাকাত নেই। তবে এ বন্য পশু যদি ব্যবসার জন্য হয়,তাহলে তার উপর তেমনি যাকাত ওয়াজিব হবে যেমন তেজারতের মালের উপর। অর্থাৎ ব্যবসার মূলধন যদি বছরের সূচনায় ও শেষে দিরহাম অথবা তার বেশী হয় তাহলে যাকাত নতুবা হবে না।
যে পশু গৃহপালিত ও বন্য পশুর সংগমে পয়দা হয় তার উপর যাকাত ওয়াজিব এবং শর্তে যে, সংগমকারী পশুগুলোর মধ্যে মাদা গৃহ পালিত হয় এবং নর বন্য হয়। যেমন ছাগল ও নর হরিণের সংগমে যে পশু পয়দা হয় তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
যেসব সায়েমা পশু ওয়াকফ করা তার উপর যাকাত নেই। এভাবে যে ঘোড়া ওয়াকফ করা অথবা জেহাদের জন্য পালা হয় তার উপর যাকাত নেই।
সায়েমা পশু যদি যাকাতের জন্য পালা হয় তাদের উপর ঐরূপ যাকাত ওয়াজিব হবে যা তেজারতি মালের উপর হয়।
যদি কেউ বংশ বৃদ্ধির জন্য সায়েমা পশু পালন করে তারপর বছরের মাঝখানে ব্যবসার ইচ্ছা করলো। তাহলে সে বছরে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু যে দিন থেকে ব্যবসার ইচ্ছা করছে সেদিন থেকে তার তেজারতি বছর শুরু হবে। এবং বছর পুরো হওয়ার পর তেজারতি যকাত দিতে হবে।
ভেড়া ছাগলের নেসাব ও যাকাতের হার
যাকাতের ব্যাপারে ভেড়া ছাগল দুম্বা সকলের একই হুকুম। সকলের একই নেসাব এবং যাকাতের হার একই। যদি কারো কাছে দুম্বাও আছে এবং ছাগলও আছে এবং তা নেসাব পরিমাণ হয়েছে তাহলে উভয়ের পৃথক পৃথক যাকাত দিতে হবে।আর যদি উভয়ের একত্র করলে নেসাব পূর্ণ তাহলে যর সংখ্যা বেশী যাকাতে সেই পশুটি দিতে হবে। উভয়ের সংখ্যা সমান হলে যেটা ইচ্ছা দেয়া যায়।

সোনা চাঁদির নেসাব

চাঁদির নেসাব দুশ দিরহাম যার ওজন ছত্রিশ তোলা সাড়ে পাঁচ মাশা চাঁদি হয়। যার কাছে এ পরিমাণ চাঁদি থাকবে এবং তার ওপর এক বছর অতীত হবে তার যাকাত ওয়াজিব। তার কম ওজনের চাঁদির যাকাত ওয়াজিব নয়। (এ নেসাব মাওলানা আবদুশ শুকুর সাহেবের গবেষণালব্ধ (ইলমুল ফেকাহ দ্রঃ) মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গী মহল্লীর গবেষণাও তাই। অবশ্যি কিছু আলেমের মতে চাঁদির নেসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এটাই অধিক প্রচলিত।)
সোনার নেসাব বিশ তালাই মিসকাল যার ওজন পাঁচ তোলা আড়াই মাশা সোনা। (এ নেসাবও মাওলানা আবদুস শুকুর সাহেবের গবেষণার ফল (ইলমুল ফেকাহ) যা মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গী মহল্লা সমর্থন করেন। অবশ্য সাধারণত এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, সোনার নেসাব সাড়ে সাত তোলা। (বেহেশতী জেওর) যার কাছে এতো ওজনে সোনা হবে এবং তারপর এক বছর অতীত হবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। তার কম ওজনের সোনার জন্যে যাকাত দিতে হবে না।
মুদ্রা ও নোটের যাকাত
সরকারী মুদ্রা, যে কোনো ধাতুর হোক না কেন এবং কাগজের নোট প্রভৃতির যাকাত ওয়াজিব। তাদের মূল্য তাদের ধাতব দ্রব্য অথবা কাগজ হওয়ার কারণে নয় বরং তাদের ক্রয় ক্ষমতার জন্যে আইন গত তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে তা সোনা চাঁদির স্থলাভিষিক্ত। অতএব যার কাছে ৩৬ তোলা সাড়ে পাঁচ মাশা চাঁদির মূল্য মুদ্রা অথবা নোটের আকারে থাকবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
যে মুদ্রার বাজারে প্রচলন নেই, অথবা খারাপ হয়ে গিয়েছ অথবা সরকার উঠিয়ে নিয়েছে- তার মধ্যে যদি কিছু পরিমাণে সোনা চাঁদি থাকে, তাহলে চাঁদি বা সোনার পরিমাণ অনুযায়ী তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
বিদেশী মুদ্রা যদি নিজ দেশে সহজেই আপন মুদ্রার সাথে বদল করা যায় তাহলে তার হুকুম নগদ মূল্যের মতো। যদি বদল করা না যায় তাহলে তার ওপর যাকাত এ অবস্থায় ওয়াজিব হবে যদি তার মধ্যে নেসাব পরিমাণ সোনা চাঁদি থাকে। সোনা চাঁদি না থাকলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
দিরহামের ওজনের যাচাই
যাকাত প্রসঙ্গে যে দিরহাম উল্লেখ করা হয়েছে তা বলতে এমন দিরহাম যার ওজন ২ মাশা দেড় রতি। নবী (স) এবং হযরত আবু বকর (রা) এর যমানায় দিরহাম বিভিন্ন ওজনের হতো। হযরত ওমর (রা) মনে করলেন দিরহাম বিভিন্ন ওজনের হওয়ার কারণে লোকের ভেতর পারস্পারিক কলহ সৃষ্টি হয় এবং যাকাতের ব্যাপারেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি প্রত্যেক ওজনের এক এক দিরহাম নিয়ে একত্র করে গলিয়ে নেন। এবং তিন ভাগ করে এক ভাগের ওজনেই করেন। তাতে চৌদ্দ কীরাত হয় এবং এ ওজনের ওপরে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা হয়। তারপর সমস্ত আরবের এ ওজনের প্রচলন হয়। সে মোতাবেক শরীয়াতের দায়িত্ব পালন হতে থাকে। (বাহরুর রায়েক প্রভৃতি)
তাহারাত ও নাজাসাত (পবিত্রতা অপবিত্রতা) অধ্যায়ে যে দিরহামের কথা বলা হয়েছে তা এক মিসকাল অর্থাৎ দীনারের সমান। আল্লামা ইবনে আবেদ শামীম গবেষণা অনুযায়ী একশ যবে এক দীনার, চার যবে এক রতি এবং আট রতিতে এক মাশা হয়। এ হিসেব অনুযায়ী এক দীনারের ওজন তিন মাশা এক রতি হয়। এ গবেষণা অনুযায়ী আসান ফেকাহর প্রথম খণ্ডে আমরা এক দিরহামের ওজন ৩ মাশা ১ রতি লিখেছি।

যাকাতের মাসায়েল

১. যাকাত দেয়ার সময় হকদারকে বা যাকাত গ্রহীতাকে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এ যাকাত। বরঞ্চ উপহার, বাচ্চাদের জন্যে তোহফা এবং ঈদের উপহার বলে দেয়াও জায়েয। এতটুকু যথেষ্ট যে যাকাত দাতা যাকাত দেয়ার নিয়ত করবে।
২. শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক হিসেবে এবং কর্মচারী বা খাদেমকে বেতন হিসেবে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। তবে বায়তুলমালের পক্ষ থেকে যেসব লোক যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নিযুক্ত থাকে তাদের বেতন যাকাতের টাকা থেকে দেয়া যেতে পারে।
৩. বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েজ এবং মাসিক কিস্তিতে দেয়াও জায়েয এ শর্তে যে দাতা সাহেবে নেসাব হবে। যদি কেউ এ আশায় অগ্রিম যাকাত দেয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে তাহলে এমন ব্যক্তির যাকাত হবে না। সে সময়ে সে সাহেবে নেসাব হবে এবং বছর পূর্ণ হবে তখন তাকে আবার যাকাত দিতে হবে। (বেহেশতি জিওর)
হযরত আলী (রা) বলেন, হযরত আব্বাস (রা) অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে নবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
৪. যাকাতে মধ্যম ধরনের মাল দিয়ে দেয়া উচিত। এটা ঠিক নয় যে, যাকাত দাতা সাধারণ মাল যাকাত হিসেবে দিবে এবং এটাও ঠিক নয় যে, যাকাত সংগ্রহকারী সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাল যাকাত হিসেবে নিয়ে নেবে। দাতা আল্লাহর পথে ভালো জিনিস দেবার চেষ্টা করবে এবং আদায়কারী কারো ওপরে বাড়াবাড়ি করবে না।
৫. যাকাত যে আদায় করবে (সংগ্রহ করবে) সে ইচ্ছা করলে যে বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে বস্তুত নিতে পারে, যেমন সোনা অথবা পশু এবং ইচ্ছা করলে তার মূল্যও নিতে পারে। উভয় অবস্থায় যাকাত হয়ে যাবে। একথা মনে রাখতে হবে মূল্য আদায় করতে হলে তা যাকাত দেবার সময়ে যে মূল্য হবে তাই আদায় করতে হবে যে সময়ে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে সময়ের মূল্য নয়। যেমন মনে করুন এক ব্যক্তি ছাগল প্রতিপালন করে। বছর পূর্ণ হবার পর একটি ছাগল তার যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। এখন তার মূল্য ৫০ টাকা। এখন কোনো কারণে যাকাত কয়েক মাস বিলম্বে দেয়া হচ্ছে। আর এ সময়ে সে ছাগলটির মূল্য যদি বেড়ে গিয়ে ৬০ টাকা হয় অথবা কমে গিয়ে ৪০ টাকা হয় তাহলে এ ষাট অথবা চল্লিশ টাকা যাকাত দিতে হবে।
৬. যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালেই জমা হওয়ার কথা। ইসলামী রাষ্ট্রেরই এ দায়িত্ব যে, সে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা করবে। যেখানে মুসলমানগণ তাদের অবহেলার কারণে গোলামির জীবন যাপন করছে অর্থাৎ যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই, সেখানে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কায়েম করবে এবং সেখানে সকল যাকাত নির্দিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয় করবে। আর এ ধরনের সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা থেকে যদি মুসলমান বঞ্চিত হয় তাহলে নিজের পক্ষ থেকেই হকদারদের কাছে যাকাত পৌছিয়ে দেবে এবং অবিরাম শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে যাতে করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ তায়ালার বহু নির্দেশ ও আইন কানুন মেনে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
৭. যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে যাকাতের হকদার যেমন পঙ্গু, রোগী, স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল, গরীব দুস্থ, মিসকিন, বিধবা, এতিম প্রভৃতি। তাদেরকে সাময়িকভাবেও বায়তুলমাল থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে এবং স্থায়ীভাবেও তাদের ভরণ পোষণের অথবা ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৮.বায়তুলমাল থেকে যাকাত হকদার কোনো এক ব্যক্তিকেও দেয়া যায় এবং কোনো সংগঠন বা সংস্থাকেও দেয়া যায়। স্বয়ং এ ধরনের কোনো সংস্থাও কায়েম করা যেতে পারে যা যাকাত ব্যয় করার উপযোগী, যেমন এতিমখানা, দুঃস্থদের জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৯. অভাবগ্রস্তদেরকে যাকাত খাত থেকে কর্জে হাসানা দেয়াও জায়েয। বরঞ্চ অভাবগ্রস্তদের অবস্থার উন্নয়নের জন্যে এবং তাদের আপন গায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে কর্জে হাসানা দেয়া অতি উত্তম কাজ।
১০.যেসব আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েজ, তাদেরকে দিলে দ্বিগুণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। এক যাকাত দেয়ার এবং দ্বিতীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিদান বা সওয়াব। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন যাকাত গ্রহণ করতে যদি লজ্জাবোধ করে অথবা অভাবগ্রস্ত হওয়া স্বত্বেও যাকাত নেয়া খারাপ মনে  করে, তাহলে তাদেরকে একথা বলা ঠিক নয় এ যাকাতের টাকা বা বস্তু। কারণ হকদারকে যাকাতের কথা বলে শর্ত নয়। উৎকৃষ্ট উপায় এই যে, কোনো ঈদের পূর্বে অথবা বিয়ে শাদীতে সাহায্য বা উপঢৌকন স্বরূপ অথবা অন্য কোনো প্রকারে যাকাত তাদেরকে পৌছিয়ে দিতে হবে।
১১. চাঁদ মাস হিসেবে যাকাত হিসেবে করে দিয়ে দেয়া ভালো। তবে এটা জরুরী নয়। সৌর মাস হিসেবেও যাকাত দেয়া যায়। কোনো বিশেষ মাসে যাকাত দিতে হবে তাও জরুরী নয়। কিন্তু যেহেতু রমযান মাস মুবারক ও বেশী নেকী করার মাস এবং সওয়াব বেশী গুণে পাওয়া যায়, সে জন্যে এ মাসে যাকাত দেয়া সবচেয়ে ভালো। তাই বলে এমন করা ওয়াজিব নয়। যাকাত আদায়ের এ কোনো শর্তও নয়।
১২. সাধারণভাবে এটাই ন্যায়সঙ্গত যে, এক অঞ্চলের যাকাত সেই অঞ্চলেই ব্যয় বা বণ্টন করা। কিন্তু অন্য অঞ্চলেও বিশেষ প্রয়োজনে দেয়া যায়। যেমন বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অন্য এলাকায় বাস করে এবং তারা অভাবগ্রস্ত অথবা অন্য এলাকায় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে এমন অবস্থায় সেসব এলাকায়ও যাকাত পাঠানো যায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে প্রথম এলাকা বা বস্তির কোনো দুঃস্থ লোক যেন বঞ্চিত না হয়।
১৩. যাকাত আদায় হওয়ার জন্যে এটাও শর্ত যে, যাকে যাকাত দেয়া যাবে তাকে যাকাতের মালিক বানাতে হবে এবং যাকাত তার হস্তগত হতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি খানা তৈরী করে হকদারকে খাইয়ে দিলো, তাহলে সে যাকাত সহীহ হবে না। হা খানা তৈরী করে তার হাতে দিয়ে তাকে যদি এ এখতিয়ার দেয়া হবে যে, সে তা নিজেও খেতে পারে কিংবা অন্যকে খাওয়াতে অথবা যা খুশি তোই করতে পারে, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কোনো সংস্থা বা বায়তুলমালকে যাকাত দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে যাকাত সংগ্রহ বা আদায়কারীকে দিয়ে দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূর্ণ হয়। তারপর বায়তুলমাল অথবা যাকাত আদায়কারীর দায়িত্ব এসে গেল। যাকাত দাতার এ দায়িত্ব নয় যে, হকদারকে পুনরায় মালিক বানিয়ে দেবে।
১৪. যদি কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো আত্মীয়, বন্ধু অথবা যে কোনো লোকের পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে তা হয়ে যাবে। যেমন স্বামী তার স্ত্রীর গহনা প্রভৃতির যাকাত নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিলে স্ত্রীর যাকাত দেয়া হয়ে যাবে।
একবার নবী পাক (স) এর চাচা হযরত আব্বাস (রা) নবীর নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী হযরত ওমর (রা) কে যাকাত দিলেন না। তাতে নবী (স) বললেন, তার যাকাত আমার দায়িত্ব। বরঞ্চ তার চেয়েও বেশী। ওমর তুমি বুঝ না যে, চাচা পিতার সমতুল্য। (মুসলিম)
মালিকানা দানের প্রসঙ্গ
হানাফী আলেমগণের মতে যাকাত সহীহ হওয়ার অনিবার্য শর্ত হচ্ছে, অন্যকে মালিক না বানালে যাকাত আদায় হবে না।এ প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী বিশদ টীকা লিখেছেন যা মালিক বানাবার প্রসঙ্গ উপলব্ধি করার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। নিম্নে তার দূর দৃষ্টিমূলক টীকা বা মন্তব্য দেয়া হলোঃ
আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে:

সদকা তো গরীব দুঃখীদের জন্যে এবং মিসকিনদের জন্যে। তাদের জন্যেও যারা এর জন্যে কাজ করে এবং তাদেরও জন্যে যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্যে। (সূরা আত তাওবাঃ ৬০)
লক্ষ্য করুন এখানে লামের কার্যকারিতা শুধুমাত্র গরীব দুঃখীর ওপর নয়। বরঞ্চ মিসকিন, যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতে কুলুবুহুম (যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য) এর ওপরও বটে। এ লাম মালিক বানিয়ে দেবার জন্য অধিকার দেয়ার জন্য। অথবা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য হোকে এবং অন্য যে কোনো অর্থেই হোক, মোটকথা যে অর্থেই গরীব দুঃখীর জন্যে সম্পৃক্ত হবে, ঐ অর্থে বাকী তিন প্রকার লোকের জন্যেও হবে। এখন হানাফীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদি লাম তামলিক বা মালিকানা দানের দাবী করে তাহলে যাকাত এবং ওয়াজিব সদকার মাল এ চার প্রকারের লোকের যে কাউকেই দেয়া হোক তাতে মালিকানা দানের দাবী পূরণ হয়ে যায়। তারপর আবার বার বার মালিকানা প্রদানের হুকুম কোথা থেকে বের হয়? ফকির মিসকিনদের মালিকানায় যাকাতের মাল পৌঁছে যাওয়ার পর তা ব্যয় করার ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ আছে নাকি? যদি না থাকে তাহলে যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারীদের …………. হাতে যাকাত পৌঁছে যাওয়ার পর মালিক বানিয়ে দেয়ার ইলামের দাবী যেহেতু পূরণ হয়ে যায়, সে জন্য পুনরায় মালিক বানিয়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতার যুক্তি কি হতে পারে? লামকে যদি মালিকানা প্রদানের অর্থেই গ্রহণ করা হয়,তাহলে এক ব্যক্তি যখন যাকাত ও ওয়াজিব সদকার মাল যাকাত বিভাগরে কর্মচারীদের হাতে তুলে দেয়, তখন সে তো বলতে গেলে তাদেরকে তার মালিক বানিয়ে দিল এবং এ মাল এভাবে তাদের মালিকানা ভুক্ত হয়ে গেল যেমন ফাই ও গণিমতের মাল সরকারের (ইসলামী রাষ্ট্রের) মালিকানাভুক্ত হয়ে যায়। তারপর তাদের ওপর এ বাধ্যবাধকতা আর থাকে না যে, পরে সেসব মাল তারা যেসব হকদারের ওপর ব্যয় করবে তা মালিকের আকারেই করবে। বরঞ্চ তাদের এ অধিকার রয়েছে যে, অবশিষ্ট সাতটি যাকাতের খাতে যেভাবে মুনাসিব এবং প্রয়োজন বোধ করবে খরচ করবে তামলিকে লামের দৃষ্টিতে (মালিক বানানোর যে শর্ত সে দিক দিয়ে) তাদের ওপর কোন বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। অবশ্যি যে বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে তা শুধু এই যে, যে ব্যক্তিই যাকাত সংগ্রহ এবং বণ্টনের কাজ করবে সে তার কাজের পারিশ্রমিক নেবে। অবশিষ্ট মাল সে অন্যান্য হকদারের জন্যে ব্যয় করবে। এজন্যে যে, এসব লোককে যাকাত বিভাগের কর্মচারী হওয়ার কারণে ওসব মালের মালিক বানিয়ে দেয়া হয় স্বর হকদার হওয়ার দিক দিয়ে নয়। …… যাকাত আদায় ও বণ্টনের কর্মচারী শব্দগুলো স্বয়ং সে উদ্দেশ্য প্রকাশ করে যার জন্য যাকাত তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অতপর এ শব্দগুলো এটাও নির্ধারিত করে দেয় যে, কর্মচারী হিসেবে এ মারের কত অংশ বৈধভাবে নিজের জন্যে ব্যয় করার অধিকার রাখে।
এ বিশ্লেষণের  পর সেই হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক যা ইমাম আহমদ (র) হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলো-

আপনার প্রেরিত কর্মচারীকে যখন আমি যাকাত দিয়ে দিলাম তখন আমি আল্লাহ এবং তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হলাম তো?
নবী (স) জবাবে বললেনঃ

হ্যাঁ তুমি যখন তা আমার প্রেরিত কর্মচারীর হাতে তুলে দিলে তখন তুমি আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হয়ে গেলে। এ প্রতিদান তোমার জন্য রয়েছে। যে নাজায়েয ভাবে তা ব্যয় করবে তার গোনাহ তার হবে।
এর থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যাকাতদাতা তার যাকাত …….. যাকাত কর্মচারীর হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যায়। অন্য কথায় যেভাবে ফকীর মিসকিনের যাকাত দলে মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়, ঠিক তেমনি …………. কে দিলেও তা পূরণ হয়ে যায়।
এখন একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, ………… এর শব্দগুলো যা কুরআনে বলা হয়েছে, তা কোন কোন লোকের ওপর প্রযোজ্য হয়। লোক তা শুধু ঐসব কর্মচারী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ মনে করে যাদেরকে ইসলামী সরকার নিযুক্ত করেন। কিন্তু কুরআন পাকের শব্দগুলো সাধারণভাবে বলা হয়েছে যা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হতে পারে যে যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ করে। সাধারণ অর্থে ব্যবহার্য এই শব্দগুলোকে বিশেষ অর্থে ব্যবহারে কোন যুক্তি আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে নেই। যদি কোন ইসলামী সরকার না থাকে অথবা আছে কিন্তু তার দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন এবং মুসলমানদের কোন একটি দল এ কাজ করার জন্য মাছে নামলো। তাহলে কোন যুক্তি বলে একথা বলা যেতে পারে যে, না তোমরা আমার দৃষ্টিতে এতো আল্লাহর এক রহমত যে (যাকাত কর্মচারী) সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করার পরিবর্তে তাঁর হুকুম এমন সাধারণ শব্দ দিয়েছন যে, তার ফলে এ অবকাশ পায় যে, ইসলামী সরকারের অবর্তমানে অথবা কর্তব্যে অবহেলাকারী সরকার বিদ্যমান থাকলেও মুসলমান নিজেদের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা করতে পারে। যদি আল্লাহ তায়ালার এ সাধারণ হুকুমকেই সাধারণই থাকতে দেওয়া হয়। তাহলে গরীব ছাত্রদের শিক্ষা, এতিমদের প্রতিপালন, বৃদ্ধ অপারগ ও পঙ্গু ব্যক্তিদের দেখাশুনা, দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা এবং এধরনের অন্যান্য কাজের জন্য যেসব সংস্থা কাজের জন্য সে সবের ব্যবস্থাপকগন একেবারেই ন্যয়সঙ্গতভাবেই এর পর্যায়ে পড়বে। ফলে তাদের যাকাত গ্রহণ করার এবং প্রয়োজন অনুসারে খরচ করার এখতিয়ার থাকবে। এমনিভাবে এমন ধরনের সংস্থা কায়েম করারও অবকাশ থাকবে যা বিশেষভাবে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য কায়েম করা হবে। তাদের ব্যবস্থাপকও বলে গণ্য হবে। এবং যাকাত বণ্টন করার ব্যাপারে তামলিকের ফতোয়া দ্বারা তাদের হাত বাধার প্রয়োজন থাকবে না।
আমার দৃষ্টিতে যদি কুরআনের শব্দগুলোকে সাধারণ অর্থে রাখা যায় তাহলে উপরোক্ত  (যাকাত কর্মচারী ও ব্যবস্থাপকদের) এর উপরই তা প্রযোজ্য হবে না। বরঞ্চ অন্যান্য বহু কর্মচারীও এর সংজ্ঞায় পড়বে। যেমন একজন এতিমের অলী, একজন রোগী ও পঙ্গু ব্যক্তর দেখাশুনা করার লোক এবং একজন অসহায় ব্যক্তির সেবা শুশ্রূষাকারী ব্যক্তিও আমেল যাকাত কর্মী। যাকাত সংগ্রহ করে ঐসব লোকের প্রয়োজন পূরণ করার তার অধিকার রয়েছে। প্রচলিত পন্থায় তার কাজের পারিশ্রমিক সে নিতে চাইলেও নিতে পারবে।
যাকাতের টাকা পয়সা যদি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে তার জন্য ডাক খরজ এবং ব্যাংকের পারিশ্রমিক ও তার থেকে দেওয়া যেতে পারে। কারণ তারাও খেদমত করার সময় পর্যন্ত (যাকাতের কর্মচারী) বলে বিবেচিত হবে।
যাকাত আদায় করতে, যাকাতের মাল একস্থান তেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে অথবা যাকাতের হকদারদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্যে রেলগাড়ি, বাস, টাঙ্গা, ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি যা কিছু ব্যবহার করা হবে, সে সবের ভাড়া যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ এসব খেদমত করার সময় এ সবই (যাকাত কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।
যাকাতের হকদারদের জন্যে যত প্রকার কর্মচারী ও মজুর কাজে লাগেনা হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ তারা সব (যাকাত কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।
যাকাতের হকদারের জন্যে যত প্রকার কর্মচারী ও মজুর কাজে লাগানো হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ তারা সব এর মধ্যে গণ্য হবে। কেউ রেলওয়ে ষ্টেশনে খাদ্য শস্যের বস্তা নিয়ে গেলে, কেউ দরিদ্র রোগীদের খেদমতের জন্যে গাড়ী চালালে অথবা কেউ এতিম শিশুদের দেখাশুনো করলে তারাও ঐ পর্যায়ে পড়বে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, (যাকাত কর্মচারীগণ যে খরচ পত্রাদি করবে তার মধ্যে এমন কোন বাধা নিষেধ আছে নাকি যে, তারা যাকাতের হকদারের খেদমতের জন্য কোন ঘর-দোর বানাতে পারবে না এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন, গাড়ী, ঔষধ-পত্র, যন্ত্রপাতি, কাপড় প্রভৃতি খরিদ করতে পারবে না? আমি একথা বলি যে, হানাফীগণ এ আয়াতের যে ব্যাখ্যাদান করেছেন তার দৃষ্টিতে এ বাধা নিষেধ শুধুমাত্র তাদের জন্যে যারা যাকাত দেয়। তারা স্বয়ং নিঃসন্দেহে এ ধরনের কোনো খরচ-পত্রাদি করতে পারে না। তাদের কাজ হলো এই যে, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত যাদের জন্যে তাদের অথবা তাদের মধ্যে কারো মালিকানায় তা দিয়ে দেবে। এখন রইলো **********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারী)এর ব্যাপারে তো তাদের বেলায় এ ধরনের কোনো বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। তারা যাকাতের সকল হকদারদের জন্যে আপন স্থানে অলী বা উকিল। প্রকৃত হকদার এ মাল থেকে যেভাবে খরচপত্র করতে পারে, সে সমুদয় খরচপত্রও তারা তাদের অলী অথবা উকিল হিসেবে করতে পারে। তারা যখন ফকীর মিসকিনদের প্রয়োজনে কোনো ঘর দোর তৈরী করে অথবা কোনো যানবাহন খরিদ করে তখন তা যেন ঠিক এমন যে, বহু ফকীর মিসকিন প্রত্যেকে আলাদা আলাদা যাকাত পাওয়ার পর সম্মিলিতভাবে কোনো ঘর দোর তৈরী করলো অথবা কোনো যানবাহন খরিদ করলো, যেসব খরচপত্রাদী করার জন্যে তাদের ওপর কোনো বাধা নিষেধ নেই। যাকাত কর্মচারীদেরকে **********আরবী ************ যাকাত দেয়ার পন্থা আল্লাহ তায়ালা এজন্যে নির্ধারণ করেছেন এবং তাদের হাতে যারা যাকাত দেয় তাদেরকে আল্লাহর রাসূল এজন্যে ফরয থেকে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন যে, তাদেরকে এ মাল দেয়ার অর্থ সকল হকদারকে নিয়ে দেয়া। তারা হকদারদের পক্ষ থেকেই যাকাত সংগ্রহ করে এবং তাদের প্রতিনিধি ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তা খরচ করে। তাদের খরচপত্রের ব্যাপারে এ দিক দিয়ে অবশ্যই আপত্তি ও অভিযোগ করা যেতে পারে যে, তারা অমুক খরচ অপ্রয়োজনে করেছে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করেছে অথবা আপন পারিশ্রমিক প্রচলিত হার থেকে অধিক নিয়েছে অথবা কর্মচারীকে প্রচলিত হার থেকে অধিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার জানা মতে শরীয়াতের এমন কোনো কায়দা কানুন নেই যার ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে যে, অমুক অমুক খরচ করা যাবে আর অমুক অমুক খরচ করা যাবে না। যাকাতের হকদারদের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন কাজ করার অনুমতি শরীয়াত তাদেরকে দিয়েছে। (তরজুমানুল কুরআন ডিসেম্বর, ১৯৫৪)
যাকাতের নেসাব
যাকাতের নেসাব বলতে বুঝায় মূলধনের সেই সর্বনিম্ন পরিমাণ যার ওপর শরীয়াত যাকাত ওয়াজিব করে। যে ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ মূলধন থাকবে তাকে সাহেবে নেসাব বলা হয়।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য
যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা। ধন আবর্তনশীল রাখার জন্য এবং সমাজের সকল শ্রেণীর সুবিধা ভোগের জন্যে ধনশালী ও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হয় এবং দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নবী করীম (স) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা লোকের ওপর সদকা (যাকাত) ফরয করেছেন। তার নেয়া হবে ধনীদের কাছ থেকে এবং বিলিয়ে দেয়া হবে দুঃস্থদের মধ্যে। (বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি)
শরীয়াতের দৃষ্টিতে ধনী ও সচ্ছল তারা যাদের কাছে নেসাব পরিমাণ মাল মওজুদ থাকে এবং বছর অতীত হওয়ার পরও মওজুদ থাকে। নবীর যমানায় ঐসব লোক ধনী ও সচ্ছল ছিল যাদের কাছে খেজুরের বাগান, সোনা, চাঁদি, গৃহপালিত পশু ছিল এবং শরীয়াত ঐসব জিনিসের একটা বিশিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে বলে যে, অন্তত এতটুকু পরিমাণ যার কাছে মওজুদ থাকবে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে সচ্ছল। তার মাল থেকে সদকা আদায় করে সমাজের দুঃস্থদেরকে দেয়া হবে। নবী (স) বলেনঃ পাঁচ ওয়াসাক ওজনের কম খেজুরের যাকাত নেই। পাঁচ উকিয়ার কম চাঁদির যাকাত নেই এবং পাঁচ উটের কম হলে তার যাকাত নেই। (বুখারী, মুসলিম)। ওয়াসাক ও উকিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রঃ
নেসাবের মধ্যে পরিবর্তনের প্রশ্ন
বর্তমান যুগে যেহেতু টাকার মূল্য অসাধারণ ভাবে কমে গেছে এবং সোনা, চাঁদি, ও গৃহপালিত পশুর যে নেসাব নবীর যমানায় নির্ধারিত করা হয়েছিল মূল্যের দিক দিয়ে তার মধ্যেও অসাধারণ পার্থক্য এসে গেছে। এ জন্যে কেউ কেউ এ দাবী করেছেন যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে যাকাতের নেসাব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যাক। এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বলেনঃ
খোলাফায়ে রাশেদীনের যমানার নবী (স) কর্তৃক নির্ধারিত নেসাব ও যাকাতের হারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এবং এখন তার কোনো প্রয়োজনও অনুভূত হয় না।আমাদের ধারণা এই যে, নবী (স) এর পরে তার নির্ধারিত নেসাব পরিবর্তন করার এখতিয়ার কারো নেই। অবশ্যই সোনার নেসাবে পরিবর্তন সম্ভব। কারণ যে রেওয়ায়েতে তার নেসাব বিশ মিসকাল বলা হয়েছে তার সনদ অত্যন্ত দুর্বল (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ১৪৪-১৪৫)
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নেসাব এবং যাকাতের হারে পরিবর্তন না করার হিকমত ও তাৎপর্যের ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী (র) বলেনঃ শরীয়াত প্রণেতা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখারও নির্দিষ্ট পরিমাণে রদবদল করার অধিকার আমাদের নেই। এ দ্বারা যদি একবার খুলে দেয়া হয় তাহলে এক যাকাতেরই নেসাব ও পরিমাণের ওপর আঘাত পড়বে না। বরঞ্চ নামায, রোযা, হজ্জ, বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বহু বিষয় এমন আছে যার মধ্যে সংশোধন ও রহিত করণের কাজ শুরু হয়ে যাবে এবং এর জের কোথাও গিয়ে শেষ হবে না। উপরন্তু এ দুয়ার একবার খুলে দিলে যে ভারসাম্য শরীয়াত প্রণেতা ব্যক্তি এ সমাজের মধ্যে সুবিচারের জন্যে কায়েম করেছেন তা খতম হয়ে যাবে। তারপর ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে। ব্যক্তিবর্গ চাইবে নেসাব ও হারের মধ্যে পরিবর্তন তাদের স্বার্থ অনুযায়ী হোক এবং জামায়াত বা সমাজ চাইবে তাদের স্বার্থ মুতাবেক হোক। বাছাইয়ের সময় এ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।নেসাব কমিয়ে হার বাড়িয়ে যদি কোনো আইন প্রণয়ন করা হয় তাহলে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তারা তা সন্তুষ্টচিত্তে দেবে না যা দেয়া ইবাদাতের আসল স্পিরিট। বরঞ্চ ট্যাক্সের মতো জরিমানা মনে করে দেবে এবং তারপর দিতে নানা বাহানা ও অবহেলা করবে। এখন যেমন আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মনে করে প্রত্যেক ব্যক্তি মাথা নত করে এবং ইবাদাতের প্রেরণাসহ সন্তুষ্টচিত্তে যাকাতের টাকা বের করে দেয়, তা আর অবশিষ্ট থাকবে না। যদি আইন সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাদের ইচ্ছামতো কোনো নেসাব এবং কোনো হার অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ১৫৭)

যাকাতের মহত্ব, গুরুত্ব ও শর্ত

পূর্ববর্তী শরীয়াতে যাকাত 

যাকাতের এ মর্মকথা ও প্রাণশক্তি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে দেখলে জানা যায় যে, যাকাত মুমিনের জন্যে একটি অপরিহার্য আমল এবং একটি অপরিহার্য গুণ। এ কারণে প্রত্যেক নবীর শরীয়াতে এর হুকুম বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যায়।
কুরআন সাক্ষ্য দেয় যে, যাকাত সকল আম্বিয়ার উম্মতের ওপর তেমনি ফরয ছিল যেমন নামায ফরয। সূরা আম্বিয়াতে হযরত মূসা (আ) ও হযরত হারূন (আ) এর প্রসঙ্গে বর্ণনায় পর বিস্তারিতভাবে সে চিন্তামূলক কথোপকথন বর্ণনা করা হয়েছে যা হযরত ইবরাহীম (আ) ও তার জাতির মধ্যে হয়েছিল। অতঃপর এ প্রসঙ্গেই হযরত লুত (আ) হযরত ইসহাক (আ) এবং হযরত ইয়াকুব (আ) এর উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছেঃ
এবং আমরা তাদের সকলকে নেতা বানিয়েছি। তারা আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী হেদায়াতের কাজ করতো। এবং আমরা তাদেরকে ওহীর মাধ্যমে নেক কাজ করার নামাযের ব্যবস্থাপনা করার যাকাত দেয়ার হেদায়াত করেছিলাম এবং তারা সকলে ইবাদাতকারী বান্দা ছিল।
কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ঐ ওয়াদা ও শপথের উল্লেখ করা হয়েছে যা ইহুদীদের নিকট থেকে নেয়া হয়েছিল। তার গুরুত্বপূর্ণ দফাগুলোর মধ্যে একটি দফা এটাও ছিল যে, তারা নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে।
এবং স্মরণ কর সেই কথা যখন আমরা বনী ইসরাঈলের নিকট পাকা ওয়াদা নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া তোমরা কারো বন্দেগী যেন না কর, মা বাপের সাথে যেন ভালো ব্যবহার কর। আত্মীয় স্বজন এতীম ও মিসকিনের সাথেও যেন ভালো ব্যবহার কর এবং লোকের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে। নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। (সুরা আল বাকারা ৮৩)
অন্য একস্থানে বনী ইসরাইলকেই আল্লাহ তায়ালা বলেন
এবং আল্লাহ (বনী ইসরাইলকে) বলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি যদি তোমরা নামায কায়েম করতে থাক এবং যাকাত দিতে থাক।
(সূরা মায়েদা ১২)
হযরত ইবরাহীম (আ) এর পুত্র এবং নবী (স) এর পূর্ব পুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ) এর প্রশংসা করতে গিয়ে কুরআন বলে যে, তিনি তার আপন লোকজনদেরকে নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার তাকীদ করতেন
এবং (ইসমাঈল) তার আপন লোকজনকে নামায ও যাকাতের জন্যে তাকীদ করতো এবং সে তার রবের পছন্দই বান্দা ছিল। (সূরা মরিয়ম ৫৫)
হযরত ঈসা (আ) তার পরিচয় পেশ করতে গিয়ে তার নবুয়াতের পদে ভূষিত হওয়ার উদ্দেশ্যেই এটা বলেন, আমার আল্লাহ আমাকে আজীবন নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার অসিয়ত করেন।
এবং তিনি আমাকে হুকুম করেছেন যে, নামায কায়েম করি এবং যাকাত দিতে থাকি যতদিন বেচে থাকবো। (সুরা মরিয়ম ৩১)
যাকাতের মহত্ব ও গুরুত্ব
ইসলামে যাকাতের যে অসাধারণ মহত্ব ও গুরুত্ব রয়েছে তার অনুমান এর থেকে করা যায় যে, কুরআন পাকে অন্তত বত্রিশ স্থানে নামায ও যাকাতের এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের পর প্রথম দাবীই হচ্ছে নামায ও যাকাতের। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি ইবাদাত পালন করার অর্থ গোটা দ্বীন পালন করা। যে বান্দা মসজিদের মধ্যে আল্লাহর সামনে গভীর আবেগ সহকারে তার দেহ ও মন বিলিয়ে দেয়, সে মসজিদের বাইরে আল্লাহর হক কিভাবে অবহেলা করতে পারে? ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি তার প্রিয় ধন সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আল্লাহর পথে সন্তুষ্ট চিত্তে বিলিয়ে দিয়ে মনে গভীর শান্তি অনুভব করে, সে অন্যান্য বান্দাদের হক কিভাবে নষ্ট করতে পারে? আর ইসলাম তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও বান্দার হকেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্যে কুরআন নামায এবং যাকাতের ইসলামের পরিচায়ক এবং ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশের সাক্ষ্য বলে গণ্য করে। সূরা তওবায় আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা ও অসন্তোষ প্রকাশের পর মুসলমানদেরকে এ হেদায়াত দেন যে, তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে নামায কায়েম করতে ও যাকাত দিতে থাকে, তাহলে তারা দ্বীনি ভাই বরে গণ্য হবে। তারপর ইসলামী সমাজে তাদের সেস্থান হবে যা মুসলমানদের আছে।
যদি তারা (কুফর ও শিরক থেকে) তওবা করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।(সূরা আত তওবা ১১)
এ আয়াত একথাই বলে যে, নামায ও যাকাত ইসলামের সুস্পষ্ট আলামত এবং অকাট্য সাক্ষ্য। এ জন্যে কুরআন যাকাত না দেয়াকে মুশরিকদের নিদর্শন ও কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছে। এ ধরনের লোককে আখিরাতে অস্বীকারকারী ও ঈমান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ধ্বংস ওসব মুশরিকদের জন্যে যারা যাকাত দেয় না এবং আখিরাত অস্বীকারকারী। (সূরা হা মীম আস সাজদা ৬-৭)
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) এ খেলাফত কালে যখন কিছু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করলো তখন তিনি তাদেরকে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ও মুরতাদ হওয়ার সমতুল্য মনে করলেন এবং ঘোষণা করলেন, এসব লোক নবীর যামানায় যে যাকাত দিতো তার মধ্যে থেকে একটি ছাগলের বাচ্চা দিতেও যদি অস্বীকার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবো। হযরত উমর (রা) সিদ্দিকে আকবরকে বাধা দিয়ে বললেন, আপনি তাদের বিরুদ্ধে কি করে জেহাদ করবেন যেহেতু তারা কালেমায় বিশ্বাসী। তিনি আরও বলেন, নবী (স) এর ইরশাদ হচ্ছে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে তার জান মাল আমার পক্ষ থেকে নিরাপদ। হযরত আবু বকর (রা) তার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করে বলেন।
আল্লাহর কসম যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই করবো।(বুখারী, মুসলিম)(হযরত আবু বকর (রা) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জেহাদের যুক্তি হিসেবে সূরা তাওবার ৫নং আয়াত পেশ করেন:
তারা যদি তওবা করে নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দাও। (অনুবাদক)
নামায ও যাকাত দ্বীনের এমন দুটি রুকন বা স্তম্ভ যা অস্বীকার করলে অথবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করলে তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে পড়া এবং মুরতাদ হওয়ার সমতুল্য। আর মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে মুরতাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ বলেন, আমাদেরকে নামায পড়ার এবং যাকাত দেয়ার হুকুম করা হয়েছে। যে যাকাত দেবে না তার নামাযও নেই- (তাবরানী)
যারা যাকাত দেয়া থেকে বিরত, কুরআন তাদেরকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত বলেছেঃ
হেদায়াত ঐ সব মুত্তাকীদের জন্যে যারা গায়েবের ওপর ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং যা আমি তাদেরকে দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে। (সূরা আল বাকারা ২-৩)
কুরআনের দৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে তারাই সাচ্চা মুমিন যারা যাকাত দেয়-
যারা নামা কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যা দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে তারাই সাচ্চা মুমিন। (সুরা আনফাল ২-৩)
নবী করীম (স) যাকাতের মহত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী, এবং জাহান্নাম থেকে দূরে। অপরদিকে কৃপণ আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের নিকটে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, একজন জাহেল দানশীল একজন কৃপণ আবেদের তুলনায় আল্লাহর নিকটে অনেক বেশী পছন্দনীয়। (তিরিমিযি)
যাকাত অবহেলার ভয়ংকর পরিণাম
যাকাতের অসাধারণ গুরুত্বের কারণে, কুরআন ঐসব লোকদের জন্যে চরম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা বলেছে যারা যাকাত দেয় না। ক্ষয়শীল ধন সম্পদের মহব্বতে উন্মত্ত হয়ে তারা যেন ভয়াবহ পরিণাম ডেকে না আনে, তার জন্যে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তারা যেন সে ভয়াবহ শাস্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, যার ধারণা করতেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়।
যারা সোনা চাঁদি জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। ( সে শাস্তি হলো এই যে,) এমন একদিন আসবে যেদিন জাহান্নামের আগুনে সেসব সোনা চাঁদি উত্তপ্ত করা হবে এবং তারপর তা দিয়ে তাদের চেহারা ও মুখমণ্ডল, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। (এবং বলা হবে) এ হলো সেই ধন সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা করে রেখেছিলে। অতএব এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের আস্বাদ গ্রহণ করো। (সূরা আত তওবা ৩৪-৩৫)
হযরত আবদুল্লাহ  বিন উমর (রা) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, এ আয়াতে বলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বলতে কি বুঝায়। তিনি বলেন বলতে সে ধন সম্পদ বুঝায় যার যাকাত দেয়া হয়নি। যারা যাকাত দেয় না তাদেরকে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে নবী (স) আখিরাতের ভয়ংকর আযাবের চিত্র এভাবে এঁকেছেন।
যাকে আল্লাহ তায়ালা ধন দৌলত দিয়েছেন তারপর সে তার ধনের যাকাত দিলো না। তখন তার ধনকে কিয়ামতের দিন বিষধর সাপের রূপ দেয়া হবে। বিষের তীব্রতায় সে সাপের মাথা লোমহীন হবে। তার চোখ দুটি কালো দাগ হবে। কেয়ামতের দিন সে যাকাত না দেয়া কৃপণ ব্যক্তির গলা জড়িয়ে ধরবে এবং তার দু চোয়ালে তার বিষধর দাঁত বসিয়ে দিয়ে বলবে আমি তোর ধন সম্পদ আমি তোর সঞ্চিত ধন দৌলত।
তারপর নবী (স) নিম্নের আয়াত তেলাওয়াত করেন:
যাদেরকে আল্লাহ তার অনুগ্রহে দান দৌলত দিয়েছেন এবং কৃপণতা করে তারা যেন এ ধারণা না করে যে, এ কৃপণতা তাদের জন্যে মঙ্গলজনক, বরঞ্চ এ তাদের জন্য অত্যন্ত অমঙ্গলজনক। কৃপণতা করে যা কিছু তারা জমা করে রেখেছে কেয়ামতের দিন তা হাসুলি বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে। (সুরা আলে ইমরান ১৮০)
উপরন্তু নবী পাক (স) যাকাত অবহেলা করার ভয়ানক পরিণাম থেকে বাচার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে নসীহত করেন, তিনি বলেন-
কেয়ামদের দিন তোমাদের মধ্য কেই যেন আমার কাছে এ অবস্থায় না আসে যে, তার ছাগল তার ঘাড়ের ওপর চাপানো থাকবে এবং সে সাহায্যর জন্যে আমাকে ডাকবে। আমি তখন বলবো আজ তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে পারবো না আমি তোমাকে আল্লাহর হুকুম আহকাম পৌছিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর দেখ, সেদিন তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার উট তার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে আমার নিকটে না আসে। সে সাহায্যের জন্যে আমাকে ডাকবে এবং আমি তাকে বলবো তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে পারবো না। আমি তো আল্লাহর হুকুম তোমাকে পৌছিয়ে দিয়েছিলাম। (বুখারী)
একদিন নবী (স) দেখলেন যে, দুজন মহিলা হাতে সোনার কঙ্কণ পরিধান করে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এর যাকাত দাও কিনা। তারা না বললে নবী বললেন, তোমরা কি তাহলে এটা চাও যে, এ সবের পরিবর্তে তোমাদের আগুনের কঙ্কণ পরানো হবে? তারা বললো না না, কখনোই না।
তখন নবী (স) বললেন, এ সবের যাকাত দিতে থাকো। (তিরমিযি)
হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা) বলেন, নবী (স) খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকেরা! লোভ লালসা থেকে দূরে থাকো। তোমাদের পূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছে তারা এ লোভ লালসার জন্যেই হয়েছে। লোভ তাদের মধ্যে কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা কৃপণ ও ধনের পূজারী হয়ে পড়ে। এ তাদেরকে আপনজনের প্রতি দয়া মায়ার সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রেরণা দেয় এবং তারা দয়া মায়া ছিন্ন করার অপরাধ করে বসে। এ তাদেরকে পাপাচার প্রেরণা দেয় এবং তারা পাপাচার করে। (আবু দাউদ)
কুরআন ও সুন্নাতের এসব সাবধান বাণীর ফলে সাহাবায়ে কেরাম (রা) ……. সদকার ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। অনুভূতি এতোটা তীব্র ছিল যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কপর্দকও কাছে রাখা হারাম মনে করতেন। আবু যর (রা) এর তো চির অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি একত্রে কিছু লোক দেখতেন তখন যাকাতের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।
যাকাতের তাকীদ ও প্রেরণা
যাকাতের অসাধারণ গুরুত্ব ও মহত্বের কারণে কুরআন পাকের বিরাশি স্থানে এর তাকীদ করা হয়েছে। সাধারণত নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলা হয়েছে। যেমন:
এবং নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও।
কুরআন ও সুন্নাতের তার বিরাট দ্বীনি ও দুনিয়াবি ফায়দার কথা বলে বিভিন্নভাবে এজন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন:
 
যারা তাদের মাল আল্লাহর পথে খরচ করে তাদের এ খরচের দৃষ্টান্ত একটি শস্যদানার মতো যে দানা থেকে সাতটি শীষ বের হয় এবং প্রত্যেক শীষে একশটি দানা হয়। এভাবে আল্লাহ যে আমলকে চান তাকে বাড়িয়ে দেন এবং আল্লাহ প্রশস্ত ও মুক্ত হস্ত এবং জ্ঞানী (সূরা বাকারা ২৬১)
কৃষক তার শস্যবীজ আল্লাহর যমীনের কাছে হস্তান্তর করে আশায় দিন গুনতে থাকে এবং বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে। তাপর আল্লাহ তাকে একটি বীজের পরিবর্তে অগণিত শস্য দানা দান করেন। এ ঈমান উদ্দীপক অভিজ্ঞতাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করে আল্লাহ এ কথা বুঝাতে চান যে, বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যা কিছু খরচ করবে আল্লাহ তা এতোটা বাড়িয়ে দেবেন যে, এক একটি দানার বিনিময়ে সাতশ দানা দান করবেন। বরঞ্চ এর চেয়ে অধিকও তিনি দিতে পারেন। বান্দার গভীর নিষ্ঠা এবং আবেগ উচ্ছ্বাসের স্বীকৃতি আল্লাহ দিয়ে থাকেন। তিনি এতো পরিমাণে দান করেন যে, বান্দা তার ধারণাই করতে পারে না। আর এ দান ও ……… আখিরাতের জন্যেই নির্দিষ্ট নয়, বরঞ্চ দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা ………. সমাজকে মঙ্গল ও বরকত, সচ্ছলতা ও উন্নতি দান করে থাকেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তোমরা যে যাকাত দাও, যাকাত দানকারী প্রকৃতপক্ষে তার মাল বর্ধিত করে। (সূরা আর রূম ৩৯)
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যাকাত, সদকা প্রভৃতি তারাই দেয় যারা উদার, দানশীল, পরস্পর সহানুভূতিশীল, শুভাকাঙ্ক্ষী। আর এসব গুণাবলী সৃষ্টি করে যাকাত ও সদকা।দুনিয়াতে মঙ্গল ও বরক, শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নতি ও সচ্ছলতা ঐ সমাজের ভাগ্যে জোটে যার লোকের মধ্যে এসব গুণাবলী সাধারণভাবে পাওয়া যায়, ধন মুষ্টিমেয় স্বার্থপর, সংকীর্ণচেতা ও কৃপণের হাতে পুঞ্জিভূত হয় না। বরঞ্চ গোটা সমাজে তার সুষম বণ্টন হয় এবং সকলের আপন আপন সাহস ও যোগ্যতা অনুযায়ী জীবিকা অর্জন ও খরচ করার স্বাধীনতা থাকে এবং সকলে একই প্রকার সুযোগ সুবিধা লাভ করে।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার পবিত্র উপার্জন থেকে একটি খেজুরও সদকা করে, আল্লাহ সেটা নিজ হাতে নিয়ে বর্ধিত করতে থাকেন যেমন তোমরা তোমাদের সন্তান প্রতিপালন কর, তারপর সেটা একটা পাহাড়ের সমান হয়ে যায়। (বুখারী)
হযরত আবু হুরাইরা (রা) আরও বলেন, নবী (স) বলেছেন, সদকা দেয়াতে মাল কম হয় না (বেড়েই যায়) কাউকে ক্ষমা করাতে মহত্বই বাড়ে (তাতে অপমান হয় না) এবং যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর জন্যে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে উচ্চমর্যাদা দান করেন। (মুসলিম)
কুরআন সুস্পষ্ট করে বলে যে, অন্তরকে পাক-পবিত্রকারী, সৎ পথের পথিক, হিকমতের গুণে গুণান্বিত আল্লাহর সন্তুষ্টি, মাগফেরাত ও রহমত লাভকারী, আখিরাতের চিরন্তন শান্তি ও আল্লাহর
নৈকট্য লাভকারী ঐসব লোক যারা সন্তুষ্টচিত্তে হরহামেশা যাকাত দিতে থাকে।
(হে নবী) তাদের মাল থেকে সদকা গ্রহণ করে তাদেরকে পাক কর এবং নেকির পথে তাদেরকে অগ্রসর কর। (সূরা আত তওবা ১০৩)
শয়তান তোমাদেরকে অভাব ও দৈন্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল ও লজ্জাজনক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করারে প্ররোচনা দেয়। অন্যদিকে আল্লাহ তোমাদেরকে তার মাগফেরাত ও করুণার আশ্বাস দেন এবং তিনি মুক্ত হস্ত এবং বিজ্ঞ। তিনি যাকে চান হিকমত দান করেন। আর যে হিকমত লাভ করে প্রকৃতপক্ষে সে বিরাট সম্পদ লাভ করে। (সূরা আল বাকারা ২৬৮-২৬৯)
এবং তারা যা কিছু আল্লাহর পথে খরচ করে তা আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং রাসূল (স) এর পক্ষ থেকে রহমতের দোয়া নেবার উপায় বানায়। মনে রেখো, ও অবশ্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় এবং আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে তার রহমতের মধ্যে নিয়ে নেবেন। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমা দয়াশীল। (সূরা আত তওবা ৯৯)
এবং জাহান্নামের আগুন থেকে ঐ ব্যক্তিকে দূরে রাখা হবে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করে এবং যে এজন্য অপরকে মাল দান করে যাতে করে তার মন কৃপণতা লোভ ও দুনিয়ার মোহ থেকে পাক হয়। (সূরা আল লাইল ১৭-১৮)
হযরত আদী বিন হাতিম (র) বলেন, নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি হে লোকেরা! জাহান্নামের আগুন থেকে বাচ, খুরমা খেজুরের এক টুকরা দিয়ে হলেও। (বুখারী)
হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন নবী (স) বলেছেন, কেয়ামতের দনে আল্লাহর আরশ ছাড়া যখন কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না, তখন সাত রকমের লোক আরশের ছায়ায় থাকতে পারবে। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি এমন হবে, যে এমন গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে যে, তার বাম হাত জানতে পারবে না ডান কি খরচ করলো। (বুখারী)
নবী (স) এর দরবারে কেউ সদকার মাল নিয়ে হাজির হতো যখন তিনি অত্যন্ত খুশী হতেন এবং তার জন্যে রহমতের দোয়া করতেন। একবার হযরত আবু আওফা (রা) সদকা নিয়ে নবীর দরবারে হাজির হন। তখন নবী (স) তার জন্যে নিম্নের দোয়া করেন:
হে আল্লাহ আবু আওফার পরিবারের ওপর তোমার রহমত নাযিল কর। (বুখারী)
একবার নবী পাক (স) আসরের নামাযের পরেই ঘরে চলে যান এবং কিছুক্ষণ পর বাইরে আসেন। সাহাবায়ে কেরাম কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, সোনার এক টুকরা ঘরে রয়েছিল। রাত পর্যন্ত তা ঘরের পড়ে থাকবে এটা আমি ঠিক মনে করলাম না। তাই তা অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে এলাম। (বুখারী)
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সদকা ও দান করার ফলে আল্লাহর রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং খারাপ ধরনের মৃত্যু থেকে মানুষ রক্ষা পায়।
একথা ঠিক যে, আল্লাহর গযব থেকে নিরাপদ এবং খাতেমা বিল খায়ের (ঈমানের সাথে মৃত্যু) ছাড়া একজন মুমিনের চরম ও পরম বাসনা আর হতে পারে?
যাকাতের হুকুম
প্রত্যেক সাহেব নেসাবের (সচ্ছল ব্যক্তি) ওপর ফরজ যে, যদি তার কাছে নেসাব পরিমাণ মাল এক বৎসর যাবত মজুদ থাকে, তাহলে তার যাকাত সে অবশ্যই দেবে। যাকাত অপরিহার্য ফরজ। এ ফরজ কেউ অস্বীকার করলে সে কাফের হবে। আর যে ফরজ হওয়া অস্বীকার করে না বটে কিন্তু যাকাত দেয় না সে ফাসেক এবং কঠিন গুনাহগার।
যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য
সরকারের পক্ষ থেকে জনসাধারণের উপর যে ট্যাক্স ধার্য করা হয়, যাকাত এ ধরনের কোন জিনিষ নয়। এ হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। এবং দ্বীন ইসলামের অন্যতম রোকন বা স্তম্ভ, নামাজ রোজা ইসলামের রোকন। কুরআনে নামাজের সাথে সাথেই সাধারণত যাকাতের উল্লেখ আছে। এ হচ্ছে আল্লাহর সেই দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যা প্রত্যেক যুগে নবীগণের দ্বীন ছিল।
যাকাত ব্যবস্থার ফলে মানুষের মনে ও ইসলামী সমাজে যে বিরাট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সুফল হয় তা একমাত্র তখনই হতে পারে যখন ইবাদত ও ট্যাক্সের মৌলিক পার্থক্য মনে বদ্ধমূল থাকবে এবং যাকাত আল্লাহর ইবাদত মনে করেই দেওয়া হবে।
অবশ্য যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা ইসলামী রাষ্ট্রের উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। এবং এ আইন শৃঙ্খলার একটা দায়িত্ব। কিন্তু এ জন্য নয় যে, এ একটি ট্যাক্স বা সরকার আরোপিত কোন কর। বরঞ্চ ইসলামের সকল সামষ্টিক ইবাদতে একটা শৃঙ্খলা বিধান করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সাতটি।(আহলে হাদীসের দৃষ্টিতে প্রথম পাঁচটি শর্ত জরুরী। তাদের নিকটে জ্ঞান সম্পন্ন (সজ্ঞান) ও বালেগ হওয়া যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য জরুরী নয়। তাদের দলিল হচ্ছে কুরআনের বাণী …..আরবী…… যাকাত দাও। এবং প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষের জন্যে এবং …….আরবী ……. (হে নবী) তাদের মাল তেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক এবং তাদের তাযকিয়া কর। পবিত্রতা ও তাযকিয়া প্রত্যেক মুসলমানদের আবশ্যক। সে জন্যে প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষের ওপর যাকাত ফরয। সে জ্ঞানবান ও বালেগ হোক বা না হোক। আহলে হাদীস ছাড়া অন্যান্য আলেমগণও পরের দুটি শর্ত স্বীকার করেন না। অর্থাৎ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্যে জ্ঞান সম্পন্ন ও বালেগ হওয়াকে শর্ত বলে গণ্য করেন না।)
(১) মুসলমান হওয়া.
(২) নেসাবের মালিক হওয়া.
(৩) নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া.
(৪) ঋণগ্রস্ত না হওয়া.
(৫) মাল এক বছর স্থায়ী হওয়া.
(৬) জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া.
(৭) বালেগ হওয়া.
নিম্নে এসব শর্তের বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ
১. মুসলমান হওয়া।অমুসলিমের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। অতএব যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলো, তাকে তার অতীত জীবনের যাকাত দিতে হবে না।
২. নেসাবের মালিক হওয়া।অর্থাৎ এতো পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে যার উপর শরীয়ত যাকাত ওয়াজিব করেছে।
৩. নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। প্রকৃত প্রয়োজন বলতে বুঝায় এমন সব জিনিষ যার উপর মানুষের জীবন যাপন ও ইজ্জত আব্রু নির্ভরশীল যেমন খানা-পিনা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বাসের বাড়ি-ঘর, পেশাজীবী লোকের যন্ত্রপাতি, মেশিন প্রভৃতি। যানবাহনের পশু, সাইকেল মোটর প্রভৃতি, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, পড়াশুনার বই-পুস্তক, (বিক্রির জন্য নয়) এসব কিছু প্রকৃত প্রয়োজনের জিনিষ। এসবের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে অতিরিক্ত মাল নেসাবের পরিমাণ হলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি অন্যান্য শর্তগুলোও থাকে।
৪. ঋণগ্রস্ত না হওয়া।যেমন কোন ব্যক্তির নিকটে নেসাবের পরিমাণ মাল আছে বটে কিন্তু অপরের কাছে তার ঋণ রয়েছে। তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে এতো পরিমাণ মাল আছে যে, ঋণ পরিশোধ করার পরও নেসাবের পরিমাণ মাল অবশিষ্ট থাকে তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে।
৫. মাল এক বছরকাল স্থায়ী হওয়া। নেসাব পরিমাণ মাল হলেই তার যাকাত ওয়াজিব হবে না। বরঞ্চ সে পরিমাণ মাল এক বছর স্থায়ী হলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
হযরত ইবনে উমর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যে কোনো উপায়েই সম্পদ লাভ করুক তার ওপর যাকাত তখনই ওয়াজিব হবে যখন তা পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী থাকবে। (তিরমিযি)
৬. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। যে ব্যক্তি জ্ঞান বুদ্ধি থেকে বঞ্চিত যেমন পাগল। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।
৭. বালেগ হওয়া। নাবালেগ শিশুর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়, তার কাছে যতোই মাল থাক না কেন। তার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। তার অলীর ওপরও ওয়াজিব নয়। (এ প্রসঙ্গে আল্লামা মওদূদী নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটা মত এই যে, এতিমের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। দ্বিতীয় মত হচ্ছে এই যে, এতিম সাবালক হওয়ার পর তার অলী তার সম্পদ তাকে হস্তান্তর করার সময় তাকে যাকাতের বিবরণ বলে দেবে। তখন তার কাজ হচ্ছে এই যে, সে তার এতিম থাকাকালীন সময়ের পুরো যাকাত আদায় করবে।তৃতীয় মত এই যে, এতিমের মাল যদি কোনো কারবারে লাগানো হয়ে থাকে এবং তার মুনাফা হচ্ছে তাহলে তার অলী যাকাত দেবে। অন্যথায় যাকাত ওয়াজিব হবে না। চতুর্থ মত এই যে, এতিমের মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব এবং তা দেয়ার দায়িত্ব অলীর। এ চতুর্থ অভিমত অধিকতর সঠিক। হাদীসে আছে:
অর্থাৎ সাবধান, যে ব্যক্তি এমন এতিমের অলী যার মাল আছে তার উচিত, তার মালে কোনো ব্যবসা করবে এবং তা এমনি পড়ে থাকতে দেবে না, যাতে তার সব মাল যাকাতে খেয়ে না ফেলে। (তিরমিযি, দারে কুতনী, বায়হাকী)
এর সম অর্থবোধক একটি মুরসাল হাদীস ইমাম শাফেয়ী (র) এবং মরফু হাদীস তাবারানী ও আবু উবায়দ থেকে বর্ণিত আছে। তার সমর্থক সাহাবা ও তাবেঈন দ্বারা পাওয়া যায় যা হযরত উমর (রা) হযরত আয়েশা (রা), হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা) এবং হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে।
মস্তিষ্ক বিকৃত লোকের সম্পর্কেও এ ধরনের মতভেদ আছে যেমন উপরে বলা হয়েছে। এতেও আমাদের মতে সঠিক অভিমত এই যে, পাগলের মালেরও যাকাত ওয়াজিব এবং তা আদায় করার দায়িত্ব অলীর। ইমাম মালেক (র) এবং ইবনে সোহাব যুহরী ও অভিমতেরই ব্যাখ্যা করেছেন। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ.১৩০, ১৩৮)
যাকাত আদায় সহীহ হওয়ার শর্ত
যাকাত আদায় সহীহ হওয়ার শর্ত ছয়টি। এ ছয়টি শর্ত পাওয়া গেলে যাকাত আদায় হবে। অন্যথায় হবে না। যেমন-
১. মুসলমান হওয়া,
২. যাকাত দেয়ার নিয়ত করা,
৩. নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা,
৪. মালিকানা বানিয়ে দেয়া,
৫. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া,
৬. বালেগ হওয়া। নিম্নে এ সবের বিশ্লেষণ ও ফায়দা বর্ণিত হলোঃ
১. মুসলমান হওয়া। যাকাত সহীহ হওয়ার শর্ত এই যে, যাকাতদাতাকে মুসলমান হতে হবে। যেহেতু অমুসলিমের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। সে জন্যে কোনো অমুসলিম যাকাত দিলে তা হবে না। অতএব ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যদি কেউ ভবিষ্যতের যাকাত দিয়ে দেয় এবং তারপর ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে পূর্বের দেয়া যাকাত দিয়ে দেয় এবং তাপর ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে পূর্বের দেয়া যাকাত সহীহ হবে না। মুসলমান হওয়ার পর পুনরায় যাকাত দিতে হবে।
২. যাকাত দেয়ার নিয়ত করা। যাকাত বের করার সময় অথবা হকদারকে দেয়ার সময় যাকাত দেয়ার নিয়ত জরুরী। যাকাত বের করার সময় যাকাতের নিয়ত না করলে হবে না। যাকাতের জন্য এটা প্রয়োজন যে, সে মাল হকদারের কাছে পৌঁছে যেতে হবে।
৩. যাকাত দেওয়ার সময় যাকাত গ্রহণকারীকে তার মালিক বানাতে হবে। সে মালিক হকদারকে বানানো হোক অথবা যাকাত আদায়কারী ও বণ্টনকারী সংস্থাকে করা হোক।
৪. নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা। যাকাত দেয়ার খাত কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। এসব ছাড়া অন্য কোন খাতে ব্য করলে তা হবে না।
৫. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। মস্তিষ্ক বিকৃত অথবা পাগল যাকাত দিলে তা হবে না।
৬. বালেগ হওয়া।নাবালেগ শিশু যাকাত দিলে তা হবে না।
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার কিছু মাসায়েল
১. প্রকৃত প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ রাখা হয়েছে তা যদি ঐ বছরেই খরচ করার প্রয়োজন হয় তাহলে তার যাকাত দিতে হবে না। আর যদি সে বছরের পর ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। -(ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)
২. যে মালের মধ্যে অন্য কোন হক, যেমন ওশর, খেরাজ প্রভৃতি ওয়াজিব হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। (ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)
৩. কেউ যদি কোন কিছু কারো কাছে রেহেন বা বন্ধক রাখে তাহলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। যে রেহেন দেবে এবং যে নেবে তাদের কারো ওয়াজিব হবে না।-(ইলমুল ফেকাহ-৪র্থ)
৪. কারো কোন মাল হারিয়ে গেলে কিংবা অর্থ হারিয়ে গেল। তারপর কিছু কাল পরে আল্লাহর ফযলে তা পাওয়া গেলে এবং হারানো অর্থ হস্তগত হলে, তাহলে হারানোর সময় ওয়াজিব হবে না। এজন্য যে, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য মাল নিজেরে আয়ত্বে এবং মালিকানায় থাকা দরকার।
৫. কারো কাছে বছরের প্রথমে নেসাবের পরিমাণ মাল মওজুদ ছিলো। মাঝখানে কিছু সময় তা হারিয়ে গেল অথবা নিঃশেষ হয়ে গেল। তারপর বছরের শেষভাগে আল্লাহর ফযলে নেসাবের পরিমাণ মাল হয়ে গেল। তাহলে সে মালের যাকাত ওয়াজিব হবে। মাঝামাঝি সময় মাল না থাকা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না।-(ইলমুল ফেকাহ)
৬. কেউ গ্রেফতার হলে তার মালের যাকাত দিতে হবে। তার অবর্তমানে যে ব্যক্তি তার কারবার চালাবে অথবা তার মালের মোতায়াল্লি হবে সে যাকাত দেবে। (রাসায়েল ও মাসায়েল-২য় খন্ড)
৭. মুসাফিরের মালের উপর যাকাত ওয়াজিব যদি সে নেসাবের মালিক হয়। অবশ্যি মুসাফির হওয়ার কারণে গ্রহণেরও হকদার হবে। কিন্তু যদি সে ধনী ও সাহেবে নেসাব। সে জন্য তার উপর যাকাত ওয়াজিব। তার সফর তাকে যাকাতের হকদার বানায় এবং তার মালদার হওয়া তার উপর যাকাত ফরজ হয়। (বেহেশতী জিউর-৩য় খন্ড)
৮. কেউ কাউকে কিছু দান করলো। তা যদি নেসাবের পরিমাণ হয় এবং এক বছর অতীত হয় তাহলে তার যাকাত ওয়াজিব হবে। (ঐ)
৯. ঘরের সাজ সরঞ্জাম, যেমন তামা, পিতল, এলুমিনিয়াম, স্টিল, প্রভৃতির বাসনপত্র, পড়নের ও গায়ে দেওয়ার কাপড়-চোপড়, শতরঞ্জি, ফরাস, ফার্নিচার, প্রভৃতি, সোনা চাঁদি ছাড়া অন্য ধাতুর অলংকার, মতির অলংকার, মতির হার, প্রভৃতি, যতোই মূল্যবান হোক, তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। (ঐ)
১০. কোন উৎসবের জন্য কেউ বহু পরিমাণ শস্যাদি খরিদ করলো। তারপর মুনাফার জন্য তা বিক্রি করে দিল। তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। যাকাত ঐ মালের উপর ওয়াজিব হবে না যা ব্যবসার নিয়তে কেনা হবে। (ঐ)
১১. কারো কাছে হাজার টাকা ছিলো। বছর পূর্ণ হওয়ার পর পাঁচশ টাকা নষ্ট হয়ে গেল এবং বাকী পাঁচশ সে ব্যক্তি খয়রাত করে দিল। তাহলে নষ্ট হওয়া টাকার যাকাতই ওয়াজিব রইলো খয়রাতের টাকার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (ইমাম শাফেয়ী (র) এর মতে সমুদয় টাকার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি ব্যবসায় মোট টাকা নেসাবের পরিমাণ বা তার বেশী হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে পৃথকভাবে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ নেসাব পরিমাণ না হলেও।)
১২. যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর কারো সব সহায় সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না।
১৩. কোন ব্যবসায় কয়েক ব্যক্তি অংশীদার। সকলের টাকাই লাগানো হয়েছে। যদি প্রত্যেক অংশীদারের পৃথক পৃথক অংশ নেসাবের কম হয় তাহলে কারো ওপরে যাকাত ওয়াজিব হবে না, তাদের সকলের মোট অংশ নেসাব পরিমাণ হোক বা তার অধিক হোক।
১৪. কোনো ব্যক্তি রমযান মাসে দু হাজার টাকার যাকাত দিয়ে দিল। এ দু হাজার টাকা তার কাছে সংরক্ষিত রয়ে গেল। এখন রজব মাসে আল্লাহর ফজলে আরও দু হাজার অতিরিক্ত সে পেয়ে গের। এখন বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাকে চার হাজারের যাকাত দিতে হবে। তার একথা মনে করলে চলবে না যে, সে রজব মাসে যা পেলো তা এক বছর পূর্ণ হয়নি। বছরের ভেতরে যে টাকা বা মাল বাড়বে, তা ব্যবসার মুনাফার কারণে হোক অথবা পশুর বাচ্চা হওয়ার কারণে হোক। অথবা দান বা মীরাস পাওয়ার কারণে হোক, মোট কথা যেভাবেই মাল বা অর্থ পাওয়া যাক না কেন, সব মালের যাকাত দিতে হবে পরবর্তী সময়ে পাওয়া মাল বা অর্থ এক বছর পূর্ণ না হলেও তার যাকাত দিতে হবে।