Sunday, October 30, 2016

ইসলামের আরকান সমূহ



যে কোন দালানকোঠা অথবা ঘরদোর হোক, তা অবশ্যই কোন ভিত্তি বা স্তম্ভের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। এ ঘরদোর ততোক্ষণ পর্যন্তই ঠিক থাকে, যতোক্ষণ তার ভিত্তি বা স্তম্ভ মজবুত থাকে। এ স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে যায় অথবা দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে তার উপর যে ঘর সেটাও দুর্বল হয়ে যাবে। আর যদি সে স্তম্ভ গোড়া থেকেই নড়ে যায় অথবা জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে যেতে চায়, তাহলে ঘরখানাও দাড়িয়ে থাকতে পারবে না এবং যে কোন সময়ে ধড়াস করে মাটিতে পরে যাবে। ইসলামের দৃস্টান্ত ঠিক একটি ঘরের মতো। এর পাঁচটি আরকান বা স্তম্ভ আছে। এগুলোকে ইসলামে আরকান বলে।
ইসলামী অট্রালিকা বা ঘরের এসব স্তম্ভ যতোটা মজবুত হবে ইসলামী দালানটাও ততোটা স্থয়ী হবে। যদি আল্লাহ না করুন এসব আরকান দুর্বল হয়, গোড়া আলগা হয়ে যায় অথবা পড়ে যাওয়ার মতন হয়, তাহলে ইসলামী দালানও ঠিক থাকতে পারবে না। ধাড়াস করে এক সময় যমীনের উপরে পড়ে যাবে।
এখন ইসলাম যদি আমাদের কাছে প্রিয় হয় এবং যদি আমরা এ ঘরের ছায়ায় থেকে নিশ্চিত মনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এক আল্লাহর বন্দেগী করতে চাই এবং সেই সাথে এ মহৎ আকাংখাও পোষণ করি যে, আল্লাহর সকল বান্দা এ দালান ঘরে আশ্রয় নিয়ে কুফর ও শির্কের বিপদ থেকে দূরে থাক, আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হিসাবে জীবনযাপন করুক এবং দ্বীন ও দুনিয়ায় সাফল্য লাভ করুক, তাহলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, আমাদেরকে আরকানের ইসলামের মর্মকথা ভালভাবে জানতে হবে এবং তার স্থায়িত্ব ও মজবুতির পুরোপুরি ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কোন অবস্থাতেই তাকে দুর্বল হতে দেয়া যাবে না। তার কারণ এই যে, ইসলামের এ বিরাট দালান ঘর তার অসংখ্য বরকতসহ তখনই কায়েম থাকতে পারে যখন তার এসব স্তম্ভ মজবুত হয়ে বিদ্যমান থাকবে।
ইসলামের আরকান পাঁচটিঃ
১. কালেমায়ে তাইয়েবাহ। অর্থাৎ কুফর ও শির্কের ধারণা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে ইসলামী আকায়েদের উপর ঈমান আনা।
২. নামায কায়েম করা।
৩. যাকাত দেয়া।
৪. রমযানের রোজা রাখা।
৫. বায়তুল্লাহর হজ্জ করা।
নবী (সা) বলেন : بني الاسلام على خمس
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর
شهادة ان لأ اله الأالله و ان محمدا رسول الله-
এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রসূল।
واقام الصلوة
এবং নামায কায়েম করা।
وايتاء الزكوة
এবং যাকাত দেয়া।
وصوم رمضان
এবং রমযানের রোযা রাখা।
وحج البيت
এবং আল্লাহর ঘরের যিয়ারত করা বা হজ্জ করা।
ইসলামী ধারণা- বিশ্বাস ও চিন্তাধারা
নেক আমলের বুনিয়াদ
ইসলামে যাবতীয় এবাদত ও নেক বুনিয়াদ হচ্ছে ঈমান। ঈমান ব্যতিরেকে কোন এবাদত নির্ভরযোগ্য নয় কোন নেকী কবুল হবার নয় এবং নাজাতও সম্ভব নয়। যে কোন আমল দেখতে যতোই নেক মনে হোক না কেন, ঈমান যদি তার বুনিয়াদ না হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তার কোনই মর্যাদা হবে না, কুরআন সেই আমলকে নেক আমল বলে, যার প্রেরণার উৎস ঈমান।
আল্লাহ বলেন :
যে ব্যক্তিই নেক আমল করবে, তা সে পুরুষ হোক অথবা নারী, সে যদি মুমেন হয়, তাহলে তার জন্যে আমি পূতপবিত্র জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেব। (সূরা আন-নমল : ৯৭)
কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে :
(হে রাসূল) তাদেরকে বলুন, তোমাদের কি বলে দেব কারা তাদের আমলের দিকদিয়ে সবচেয়ে অকৃতকার্য ও ব্যর্থ মনোরথ? তারা সেসব লোক যাদের সকল চেষ্টা-চরিত্র দুনিয়ার জীবনে গোমরাহীর মধ্যে ব্যয়িত হয়। অথচ তারা মনে করে যে, তারা নেক আমলই করছে। তারা ওসব লোক যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছে এবং আল্লাহর নিকটে হাযির হওয়ার ব্যাপার বিশ্বাস করেনি। সে জন্যে তাদের সব আমল ব্যর্থ হয়েছে। কিয়ামতের দিনে সে সবের কোনই মূল্য হবে না। ( সূরা আল-কাহাফ : ১০৩-১০৫)
ঈমান বলতে কি বুঝায়?
কালেমায়ে তাইয়েবা এবং কালেমায়ে শাহাদাতের মর্ম অন্তর দিয়ে মেনে নিয়ে মুখে উচ্চারণ করাকেই বলে ঈমান।
কালেমায়ে তাইয়েবাহ : لااله الا الله محمد رسول الله
আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রসূল।
কালেমায়ে শাহাদাত : اشهد ان لأ اله الا الله واشهد ان محمدا عبده ورسوله
আমি শাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দাহ এবং রাসূল।
কালেমায়ে তাইয়েবাহ এবং কালেমায়ে শাহাদাতের উপর ঈমান আনার পর যে সব বিষয়ের মোটামুটি স্বীকৃাতি দিতে হয় তাকে বলা হয় ইসলামী আকায়েদ।
ইসলামী আকায়েদ ছয়টি :
১. আল্লাহর ব্যক্তিসত্তা ও গুণাবলীর উপর ঈমান।
২. ফেরেশতাদের উপর ঈমান।
৩. রসূলগণের প্রতি ঈমান (খতমে নবুয়তের প্রতি ঈমানসহ)।
৪. আসমানী কেতাবসমূহের উপর ঈমান।
৫. আখেরাতের উপর ঈমান।
৬. তকদীরের উপর ঈমান।
এ ছটি আকীদা প্রকৃতিপক্ষে ঈমানের ছটি অংশ। এ সবের মধ্যে পারস্পারিক গভীর ও অনিবার্য সম্পর্ক আছে। এ সবের কোন একটিকে মেনে নিলে অন্যসব কয়টিকেই মেনে নিতে হয় এবং কোন একটিকে অস্বীকার করলে সবগুলোকেই অস্বীকার করা হয়। ঈমানের প্রকৃত অর্থ এই যে, এ সবগুলোকে অন্তর দিয়ে মেনে নেয়া। কেউ যদি এ সবের মধ্যে কোন একটি মেনে নিতে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কিছুতেই মুমেন বলা যাবে না। ঠিক তেমনি সেও মুমেন নয় যে ইসলামের এ ছটি আকীদার অতিরিক্ত কোন নতুন আকীদা নিজের পক্ষ থেকে ঈমানের অংশ বলে মনে করে এবং ঈমানের জন্যে তা প্রয়োজনীয় মনে করে।
আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর উপর ঈমান
১. এই যে বিরাট বিশাল প্রকৃতি জগত, তার মধ্যে অসংখ্য সৌর জগত আছে। এ ধরণের আরো বহু জগত আছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থাপনাও আছে। এসব কত বিরাট বিশাল তা আমাদের কল্পনার অতীত। এসব সৃষ্টি হঠাৎ করে ঘটনাক্রমে অস্তিত্ত্ব লাভ করেনি। বহু বছর যাবত বন্তুর স্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলও এসব সৃষ্টি নয়। বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালা তার আপন ইচ্ছায় ও নির্দেশে বিশেষ পরিকল্পনার ভিত্তিতে এসব সৃষ্টি করেছেন। তিনি এসবের প্রকৃত মালিক। তিনি তাঁর অসীম কুদরতে এসব কায়েম রেখেছেন এবং যতো দিন ইচ্ছা কায়েম রাখবেন।
২. প্রকৃতি রাজ্যের প্রতিটি বন্তুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। এমন কোন কিছু নেই যা তার দ্বারা সৃষ্টি না হয়ে আপনা আপনিই অস্তিত্বে এসেছে। প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব তাঁর উপর নির্ভরশীল। তিনিই সকলের প্রতিপালক। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে রক্ষা করেন এবং যাকে ইচ্ছা ধ্বংস করেন।
৩. তিনি আনাদি কাল থেকে আছেন এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত থাকবেন। তিনি চির জীবিত ও চির শাশ্বত। তার ধ্বংস নেই।
৪. তিনি এক ও একক। সকলেই তার মুখাপেক্ষী। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি সর্বশক্তিমান। কেউ তার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে না। তাঁর পিতা-মাতাও নেই, সন্তান-সন্তুতিও নেই। স্ত্রী, পুত্র-পরিজন, ভাই, বেরাদার, জ্ঞাতি, গোষ্ঠী কিছুই নেই।
৫. তিনি সকল বিষয়ে লা-শারীক। তাঁর সত্তায় ও গুণাবলীতে অধিকার ও এখতিয়ারে কোনই শরীক বা অংশীদার নেই। তিনি আপনা আপনি অস্তিত্ববান। তার অধিকার ও এখতিয়ারে, সত্তা ও গুণাবলীতে কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী তাঁকে হতে হয় না।
৬. কোন কিছুই তাঁর সাধ্যের অতীত নয়। এমন কোন বিষয়ের কল্পনা করা যেতে পারে না যা করতে তিনি অক্ষম। সকল প্রকারের বাধ্যবাধকতা, অক্ষমতা ও দোষ-ত্রুটির উর্ধে তিনি। তিনি সকল মঙ্গলের উৎস । যতো পবিত্র নাম উৎকৃষ্ট গুনাবলী তা সবই তাঁর জন্যে। নিদ্রা অথবা তন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি পাক পবিত্র এবং সকল দোষ ত্রুটির উর্ধে।
৭. তিনি সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতির একমাত্র বাদশাহ বা শাসক। সকল কর্তৃত্বের উৎস তিনি। বিশ্ব প্রকৃতিতে একমাত্র তারই কর্তৃত্ব চলছে। তার কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব প্রয়োগের ব্যাপারে তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি ব্যতীত কর্তৃত্ব প্রভুত্ব আর কারো হতে পারে না। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করারও কেউ নেই।
৮. তিনিই সকল শক্তির আসল উৎস ও কেন্দ্র। অন্য সকল শক্তি তাঁর কাছে নগণ্য। বিশ্ব প্রকৃতিতে এমন কিছু নেই যা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ করতে পারে অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। তা সে মানুষ হোক, ফেরেশতা অথবা জ্বিন হোক অথবা অন্য কোন শক্তিশালী সৃষ্টি হোক। প্রকৃতি রাজ্যের কোন বৃহত্তম গ্রহ অথবা দৃশ্য অদৃশ্য কোন শক্তি ( ) তারা যতো বড়ো ও শক্তিশালী হোক- তারা আল্লাহর অসীম কুদরত ও ক্ষমতার কাছে কিছুমাত্র নয়।
৯. তিনি সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান। তিনি সর্বদ্রষ্টা। প্রত্যেকটি বন্তু তিনি দেখতে পান তা সে ভূগর্ভে হোক অথবা অসীম আকাশের কোন স্থানে হোক। তিনি ভবিষ্যত সম্পর্কে অবহিত। মানুষের মনের কথা তার অন্তরের অন্তঃস্থলে লুক্কায়িত ভাবধারা ও আবেগ অনুভূতি এবং সকল প্রকার গোপন সহস্য তাঁর পুরোপুরি জানা। তিনি মানুষের কাঁধের শিরা-উপশিরা থেকেও নিকটে অবস্থান কেরন। তিনি পূর্বাপর সকল বিষয়ের সুনিশ্চিত জ্ঞান রাখেন। গাছ থেকে এমন কোন পাতা পড়ে না যা তাঁর জ্ঞানের বাইরে অথবা ভূখন্ডে লুক্কায়িত এমন শস্যবীজ নেই যা তাঁর জানানেই।
১০. জীবন মৃত্যু তাঁর হাতে। যাকে ইচ্ছা তাকে জীবন ও মৃত্যু দান করেন। যাকে তিনি মারতে চান তাক রক্ষা করার কেউ নেই এবং যাকে তিনি জীবিত রাখতে চান তাকে কেউ মারতে পারে না।
১১. সকল সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা তাঁর। এ সম্পদ থেকে যাকে তিনি বঞ্চিত করতে চান তাকে কেউ কিছু দিতে পারে না। যাকে তিনি দিতে চান তাকে কেউ তা ঠেকাতে পারে না। কাউকে সন্তান দান করা না করা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। যাকে ইচ্ছা তাকে পুত্র সন্তান দেন, যাকে ইচ্ছা তাকে কন্যা অথবা যাকে ইচ্ছা তাকে উভয়ই দেন। আবার যাকে ইচ্ছা তাকে উভয় থেকেই বঞ্চিত করেন। তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কারো এতটুকু ক্ষমতা নেই।
১২. লাভ-লোকসান একমাত্র তাঁর একতিয়ার। তিনি কাউকে ক্ষতি অথবা বিপদের সম্মুখীন করতে চাইলে কেউ তা ঠেকাতে পারে না। আর যদি তিনি কারো মংগল করতে চান, তাহলে কেউ তার কোন ক্ষতি বা অমংগল করতে পারে না। মোট কথা, আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ কারো কোন মংগল-অমংগল করতে পারে না।
১৩. একমাত্র তিনিই সকলের রিজিকদাতা। রিজিকের চাবিকাঠি একমাত্র তাঁরাই হাতে। তিনিই তার যাবতীয় সৃষ্টি সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। সকল-কেই তিনি রুজি দান করেন। রুজি রোজগারের ব্যাপারে কমবেশী করাও তার হাতে। যার জন্যে তিনি যাতটুকু নির্ধারিত করে রেখেছেন, সে ততটুকুই ঠিক মতো পাবে। এর কমবেশী কারার অধিকার কারো নেই।
১৪. তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ। তিনি বিজ্ঞ ও সুস্থ বিচার সম্পন্ন। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তকারী। তিনি কোন হকদারের হক নষ্ট করেন না এবং কারো উপর যুলুম করেন না। এ তাঁর ন্যায়-নীতির খেলাপ যে, সুকৃতিকারী এবং দুষ্কৃতিকারী তার নিকটে সমান হবে। প্রত্যেককে তার আপন আপন কৃতকর্ম অনুযায়ী তিনি প্রতিদান দেন। কোন অপরাধীকে তিনি তার অপরাধের অধিক শাস্তি দেন না এবং কোন নেক লোককে তার যথোপযুক্ত পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করেন না। তাঁর একটি সিদ্ধান্ত তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান সুস্থ বিচার-বুদ্ধি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
১৫. তিনি তাঁর বান্দাহকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনি গুনাহ মাফ করে দেন, তওবাকারীর তওবা কবুল করেন। তিনি তাঁর বান্দাহদের উপর সর্বদা রহমত বর্ষণ করে থাকেন। তাঁর রহমত ও মাগফিরাত থেকে মুমেনদের নিরাশ হওয়া উচিত নয়।
১৬. তিনিই একমাত্র সত্তা যাকে ভালোবাসা যেতে পারে। একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। তাঁকে ব্যতীত আর কাউকে ভালোবাসতে হলে তাঁরই জন্যে ভালোবাসতে হবে, তাঁর ভালোবাসাই সকল ভালোবাসাকে নিয়ন্ত্রন করবে।
১৭. একমাত্র তিনিই আমাদের কৃতজ্ঞতা পাওয়ার হকদার। সকল এবাদত দাসত্ব ও আনুগত্য পাওয়ার অধিকার একমাত্র তাঁরই। তিনি ব্যতীত অপর কেউ না আনুগত্য লাভের অধিকারী হতে পারে আর না তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। একমাত্র তাঁর সামনেই সবিনয়ে দাঁড়ানো যেতে পারে। তাঁকেই সিজদা করা যেতে পারে। তাঁর কাছেই সব কিছু চাওয়া যেতে পারে। তাঁর কাছেই সবিনয়ে কাকুতি মিনতি করা যেতে পারে।
১৮. এ অধিকার তাঁর যে, মানুষ তাঁর আনুগত্য করবে। তাঁর আইন মেনে চলবে। নিরংকুশভাবে তাঁর নির্ধারিত শরীয়তের বিধান মেনে চলবে। হালাল হারাম নির্ধারণ করার অধিকার একমাত্র তাঁর। এ ব্যাপারে কারো কণামাত্রও অধিকার নেই।
১৯. একমাত্র তাকেই ভয় করতে হবে। তাঁর উপরেই আশা ভরসা রাখতে হবে। প্রতিটি ব্যাপারে সাহায্য তাঁর কাছেই চাইতে হবে। তাঁকেই বাসনা পূরণকারী, ত্রাণকর্তা, অভিভাবক ও সাহায্যদাতা মনে করতে হবে। সকল ব্যাপারে নির্ভর তাঁর উপরেই করতে হবে।
২০. হেদায়াত তাঁর কাছেই চাইতে হবে। সুপথ দেখানো তার কাজ। তিনি যাকে হেদায়াত করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ সুপথে আনতে হবে না।
২১. কুফর, শির্ক, নাস্তিকতা বিদাআত প্রভৃতি ইহকাল ও পরকালের জন্যে ধ্বংস নিয়ে আসে। দুনিয়ার মধ্যে নিকৃষ্ট মানুষ তারাই যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাঁর দ্বীন কবুল করে না, তাঁর সাথে অন্যকে অংশীদার বানায় এবং তাঁর আনুগত্য করার পরিবর্তে আপন প্রবৃত্তির আনুগত্য করে।
২২. কুফরী অবস্থায় যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের উপর আল্লাহর লানৎ, ফেরেশেতাদের লানৎ এবং সমগ্র মানবজাতির লানৎ।
২৩. কুফর ও শির্কের পরিণাম আল্লাহর অসুন্তুষ্টি এবং তার ফলে চিরন্তন শাস্তি ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে।
২৪. শির্ক সুস্পষ্ট যুলুম ও মিথ্যা। অন্যান্য সকল গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু শির্কের গুনাহ কিছুতেই মাফ করবেন না।
ان الله لايغفر ان يشرك به ويغفر ما دون ذالك لمن يشاء
তাকদীরের উপর ঈমান
তাকদীরের উপর ঈমান বলতে গেলে আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুণাবলীর উপর ঈমানেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ জন্যে কুরআনে তার উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য হাদীসে এর গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করে একে ইসলামের স্থায়ী আকীদাহ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।
তাকদীরের উপর ঈমানের প্রকৃত অর্থ এই যে, বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে যা কিছু ভালো ও মন্দ আছে অথবা ভবিষ্যতে হবে তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এবং সবই তাঁর জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত। ভালো মন্দের কোন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকও তাঁর জ্ঞানের বহির্ভূত নয়। তাঁর জ্ঞান প্রতিটি বন্তুকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। মানুষ দুনিয়ায় জন্মগ্রহন করে ভাল কাজ করবে, না মন্দ কাজ করবে, তা তার জন্মের পূর্ব থেকেই আল্লাহর জানা আছে। বিশ্ব প্রকৃতির কোন অণুপরমাণু তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গতিশীল ও ক্রিয়াশীল হতে পারে না, আর না কোন সূক্ষ্ম বস্তুরও কার্যক্রম বা গতিশীলতা তার জ্ঞানের বাইরে থাকতে পারে। আল্লাহ যার জন্যে যা লিখে রেখেছেন তা খণ্ডন করার এতটুকু শক্তি কারো নেই। তিনি কাউকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করে থাকলে তা দেবার ক্ষমতাও কারো নেই। ভালো মন্দ ভাগ্য নির্ধারণ একমাত্র তাঁরই হাতে এবং মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভগ্য তাঁর পূর্ব নির্ধারিতভ। [আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার বুকে মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যে তার সীমিত পরিবণ্ডলে ভাল-মন্দ কাজ করার যে স্বাধীনতা বা এখতিয়ার দিয়েছেন, তার সব কিছু জানা থাকলেও সে এখতিয়ার ক্ষুণ্ণ হয় না। দ্বীন ইসলামের শিক্ষা এইযে, মানুষ যেন সর্বদা নেক আমল করতে থাকে এবং দ্বীনের আনুগত্যের ব্যাপারে অবহেলা না করে। তাকদীর প্রসঙ্গটি নিয়ে মাথা ঘামানো এবং তার জটিল তথ্যনুসন্ধান থেকে বিরত থাকতে হবে। শুধু এতটুকু মনে রাখতে হবে যে, নেক আমলকারী মুমেনের জন্যে আল্লাহ বেহেশত তৈরী করে রেখেছেন এবং দুষ্কৃতিকারীদের জন্য জাহান্নাম। ঈমান এনে আমি যদি নেক আমল করি, তাহলে আমি বেহেশতের হকদার হবো। আর কাফের হয়ে যদি মন্দ কাজ করি তাহলে আমাকে জাহান্নামেই নিক্ষেপ করা হবে ]
নবী পাক (সা) এর এরশাদঃ-
كتب الله مقاديرالخلائق قبل ان يخلق السموت والارض بخمسين الف سنة قال وكان عرشه على الماء (مسلم)
আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগতের তাকদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, তখন আল্লাহর আরশ ছিল পানির উপর। অর্থাৎ পানি ব্যতীত কোন সৃষ্টিই তখন ছিল না। (মুসলিম)
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
১. ফেরেশতা আল্লাহ তায়ালার এক অনুগত সৃষ্টি। এ নূরের পয়দা। এ আমাদের দৃষ্টি বহির্ভূত। তাঁরা নারীও নন, পুরুষও নন। আল্লাহ তাঁদেরকে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছেন। সে কাজই তাঁরা করে যাচ্ছেন।
২. ফেরেশতাগণ আপন মর্জি মত কিছু করেন না। আল্লাহর শাসন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রভুত্বেও তাঁদের কোন অধিকার নেই। তাঁরা আল্লাহর এখতিয়ার বিহীন প্রজা। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে যে আদেশ করা হয়, তা দ্বীধাহীন চিত্তে পালন করার কাজেই তাঁরা লেগে যান। তাদের এমন সাধ্য নেই যে, তাঁর হুকুমের বিপরীত কিছু করেন।
৩. তারা হরহামেশা আল্লাহর স্তবস্তুতি করে থাকেন। না তাঁরা আল্লাহর কোন আদেশ লংঘন করেন, আর না তাঁরা আল্লাহর সার্বক্ষনিক স্তবস্তুতিতে ক্লান্তিবোধ করেন। দিন রাত নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁরা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেন।
৪. ফেরেশতাগণ সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকেন। আল্লহর নাফরমানী অথবা বিদ্রোহের ধারণাও তাঁরা করতে পারেন না।
৫. যে কাজে তাঁরা নিয়োজিত তা পরিপূর্ণ দায়িত্ব সহকারে সমাধা করেন। কর্তব্যে কোন অবহেলা প্রদর্শন অথবা কাজে ফাকি দেয়ার কোন মনোভাব তাদের থাক না।
৬. তাঁদের সংখ্যা কত তা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে চারজন অতি প্রসিদ্ধ এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভকারী। তার হচ্ছেন:
ক. হযরত জিবারাইল (আ) নবীদের কাছে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে ওহী নিয়ে আসতেন আল কুরআন নাযিলের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে। এ জন্যে যে, নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) ছিলেন সর্বশেষ নবী।
খ. হযরত ঈসরাফীল (আ) কেয়ামতের পূর্বে শিঙ্গায় ফুঁৎকার দিবেন, যার মাধ্যমে কেয়ামত শুরু হবে।
গ. হযরত মিকাইল (আ)। বৃষ্টি বর্ষণ ও আল্লাহর সৃষ্টি জীবের প্রতি রিজিক পৌছানোর দায়িত্ব তার উপর। 
ঘ. হযরত আযরাইল (আ)। তিনি প্রতিটি সৃষ্টি জীবের জীবন গ্রহণের কাজে নিয়োজিত।
৭. দুজন করে ফেরেশতা প্রত্যেক মানুষের সাথে থাকেন। একজন তার ভালো কাজ এবং অন্যজন তার মন্দ কাজ লিপিবদ্ধ করেন। তাদেরকে বলা হয় ‘কেরামান কাতেবীন’ (সম্মানিত লেখর বৃন্দ)।
৮. দুজন ফেরেশতা মানুষের মৃত্যুর পর তার কবরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদেরকে বলা হয় মুনকির ও নাকির।
রসূলগণের প্রতি ঈমান
১. আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি তাঁর হুকুম আহকাম ও হেদায়াত পৌছাবার জন্যে যে ব্যবস্থা করেন তাকে ‘রেসালাত’ বলা হয়। যারা মানুষের কাছে এ হেদায়াত এবং পায়গাম পৌছিয়ে দেন, তাদেরকে বলা হয় নবী, রসূল অথবা পয়গাম্বার।
২. রসুল বা নবী আল্লাহর বানী মানুষের কাছে ঠিকমত পৌছিয়ে দেন। এ ব্যাপারে তারা কোন খেয়ানত করেন না। না অতিরঞ্জিত করেন। না কিছু গোপন করেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অহী নাযিল হয়। তা মানুষের কাছে পৌছাবার পুরোপুরি হক আদায় করেন।
৩. ‘রেসালাত’ আল্লাহর দান। যাকে ইচ্ছা তাঁকে তা দান করেন। এ মর্যাদা মানুষের কোন ইচ্ছা-অভিলাষ এবং কোন চেষ্টা-চরিত্রের ফল নয়। এ আল্লাহর বিশেষ দান। তিনিই জানেন এ মহান খেদমত কার কাছ থেকে নেবেন এবং কিভাবে নেবেন।
৪. ‘রসূল’ অবশ্যই মানুষ হয়ে থাকেন। ফেরেশতা, জ্বীন অথবা অন্য কোন সৃষ্টি এ মর্যাদা লাভ করতে পারে না। আল্লাহর উপরেও তাদের কোন অধিকার অথবা প্রভাব থাকে না। তাঁদের বৈশিষ্ট্য এই যে, আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর প্রতিনিধি এবং রেসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্যে বেছে নেন। তাঁদের কাছে তিনি তাঁর অহী পাঠান।
৫. যে জীবন বিধান বা দ্বীন তিনি পেশ করেন, তা তিনি স্বয়ং পুরোপুরি মেনে চলেন এবং তিনি তাঁর দাওয়াতের আদর্শ বা নমুনা হয়ে থাকেন। তার এ কাজ নয় যে, তিনি অন্যকে দ্বীনের আনুগত্যের দাওয়াত দিবেন এবং স্বয়ং তা থেকে দুরে থাকবেন।
৬. প্রত্যেক যুগে নবী এসেছেন। প্রত্যেক জাতির জন্যে এসেছেন। প্রত্যেক দেশে এসেছেন। মুসলমান সব নবীর উপর ঈমান আনে। কারো নবুয়তকে অস্বীকার করে না। যেসব নবী রাসূলগণের উল্লেখ কুরআন ও হাদীসে আছে মুসলমান তাদের প্রতি ঈমানের স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। কিন্তু যাদের উল্লেখ কুরআন হাদীসে নেই, তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে। না তাদের নবী হওয়ার কথা স্বীকার করে, আর না তাদের সম্পর্কে এমন কোন উক্তি করে যার দ্বারা তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়।
৭. প্রত্যেক নবীর দাওয়াত একই ছিল। তাদের কোন এক জনকে অস্বীকার করলে সকলকে অস্বীকার করা বুঝায়। তাঁরা সকলে একই দলভূক্ত ছিলেন এবং সকলে একই বাণী নিয়ে এসেছেন।
৮. নবীর উপর ঈমান আনার অর্থ এই যে, তাঁর পুরোপুরি আনুগত্য করতে হবে। নবীর আনুগত্য করা না হলে শুধু মৌখিক নবী বলে স্বীকার করলে তা হবে একেবারে অর্থহীন।
৯. নবী মুহাম্মাদ (সা) পর্যন্ত এসে নবুয়ত শেষ হয়ে গেছে। কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী আসবেন না। সে জন্যে তিনি খাতামুন নাবিয়ীন। তাঁর নবুয়ত সমগ্র বিশ্বের জন্যে এবং যতোদিন দুনিয়া থাকবে, ততোদিনের জন্য তাঁর নবুয়ত থাকবে। আল্লাহর কাছে তারাই নাজাত পাবে যারা তাঁর উপর ঈমান এনে তাঁর আনুগত্যের ভেতরেই জীবন যাপন করবে।
১০. আমাদের জন্যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ আদর্শ নবী মুহাম্মাদ (সা) এর জীবন। দ্বীনের ব্যাপারে তাঁর হুকুমই চূড়ান্ত। মুসলমানের কাজ হচ্ছে এই যে, যে কাজের নির্দেশ তাঁর পক্ষ থেকে আসবে তা মন প্রাণ দিয়ে পালন করতে হবে। যে কাজ করতে তিনি নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। মোট কথা তাঁর প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিতে হবে।
১১. রসূলের আনুগত্য প্রকৃতিপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য। রাসুলের নাফরমানী তেমনি আল্লাহর নাফরমানী হবে। আল্লাহর মহব্বতের তাগিদেই রসূলের আনুগত্য, এ হচ্ছে ঈমানের কষ্টিপাথর। রসূলের নাফরমানী মুনাফেকীর আলামত।
১২. রসূলের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ঈমানের পরিচায়ক। তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা ও বেয়াদবি যাবতীয় নেক আমল বরবাদ করে দেয়। মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য হলো রসূলকে তা মা-বাপ, সন্তানাদি ও আত্মীয়-স্বজন থেকেই শুধু অধিকতর প্রিয় মনে করবে না, বরঞ্চ তার নিজের জীবন অপেক্ষাও অধিকতর প্রিয় মনে করবে।
কুরআন বলে : النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ
নবী মুমেনদের জন্যে তাদের নিজেদের জীবন অপেক্ষাও অধিকতর প্রিয়। (আহযাব : ৬)
১৩. রেসালাতের উপরে ঈমানের সুস্পষ্ট দাবী হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক মুসলমান নবী মুস্তফা (সা) এর উপর দরূদ পড়বে এবং তাঁর জন্যে দোয়া করবে।
আসমানী কিতাবসমূহের উপর ঈমান
১. আল্লাহ তায়ালা তার বন্দাদের হেদায়াতের জন্যে বহু ছোট বড় কিতাব নাযিল করেছেন। এসব কিতাবে তিনি দ্বীনের কথা বলেছেন এবং জীবন পরিচালনার জন্যে বিধানও দিয়েছেন। নবীগণ এসব কিতাবের মর্মকথা সুস্পস্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং নিজে আমল করে দেখিয়েছেন।
২. সমস্ত আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনতে হবে। কারণ এসব কিতাবের বুনিয়াদী শিক্ষা ছিল এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ বলা হয়েছে, আল্লাহর বন্দেগী কর এবং কুফর ও শির্ক থেকে দূরে থাক।
৩. আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যে চারটি প্রসিদ্ধ যা চার জন প্রখ্যাত পয়গাম্বেরের উপর নাযিল করা হয়েছিল। যথা:-
ক. তাওরাত। এ নাযিল হয়েছিল হযরত মূসা (আ) এর উপর।
খ. যবুর। এ নাযিল হয়েছিল হযরত দাউদ (আ) এর উপর।
গ. ইঞ্জিল। এ নাযিল হয়েছিল হযরত ঈসা (আ) এর উপর।
ঘ. কুরআন মজীদ। নাযিল হয়েছিল সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) এর উপর।
৪. আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে শুধুমাত্র কুরআন মজীদ তার আসল রূপ ও আকৃতিতে তার প্রতিটি আসল শব্দ, অক্ষর ও যের-যবর-পেশসহ অবিকল বিদ্যমান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এভাবেই সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ স্বয়ং তার সংরক্ষণের ওয়াদা করেছেন। কিছু যালেম-পাপাচারী যদি (নাউযুবিল্লাহ) কুরআনের সকল অনুলিপি জ্বালিয়ে ফেলে, তথাপি তা সংরক্ষিত থাকবে। তার কারণ এই যে, সকল যুগে সকল দেশে এমন কোটি কোটি মুসলমান ছিল, আছে এবং থাকবে যাদের বক্ষে কুরআন অবিকল সংরক্ষিত ছিল, আছে এবং থাকবে।
৫. অন্য তিনটি আসমানী কিতাবের বহুলাংশ পরিবর্তন করা হয়েছে। তার কোনটি এখন তার আসল রূপে বিদ্যমান নেই। প্রথমতঃ এ কিতাবগুলো সে সব নবী দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার অনেক পরে সংকলিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ পথভ্রষ্ট ও দুনিয়ার স্বার্থ শিকারী লোকেরা এসব কিতাবে বর্ণিত শিক্ষার সাথে এমন কিছু সংযোজিত করেছে যা দ্বীনের বুনিয়াদী শিক্ষার পরিপন্থী এবং এমন সব বিষয় ছাঁটাই করেছে যা ছিল তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। এ জন্যে আজকাল আল্লাহর প্রকৃতি দ্বীন জানবার এবং তার উপর আমল করার একটি মাত্র সংরক্ষিত, নির্ভরযোগ্য ও সর্বজন গৃহীত উপায় রয়েছে এবং তা হচ্ছে কুরআন মজীদ। তাকে অস্বীকার করে এবং তার মুখাপেক্ষী না হয়ে কেউই আল্লাহর সত্যিকার দ্বীনের আনুগত্য করতে পারে না। কেয়ামত পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী মানবজাতির উচিত এ কিতাবের উপর ঈমান আনা। তার উপর ঈমান আনা ব্যতীত নাজাত কিছুতেই সম্ভব নয়।
৬. কুরআন পাকের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অধিকার কারো নেই। নবীর কাজও শুধু এই ছিল যে, তিনি ঠিক মতো তা মেনে চলবেন। কুরআন পাক থেকে নিজের মন মতো অর্থ বের করা এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দ্বারা তার আয়াতসমূহকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা নেহায়েতে বেদ্বীন লোকের কাজ।
৭. কুরআনে মানব জাতির সকল সমস্যার সমাধান আছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের এমন কোন বিষয় নেই যার সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্ট হেদায়েত দেয়া হয়নি। এ জন্যে জীবনের কোন এক ক্ষেত্রে কুরআন থেকে বেপরোয়া হওয়া এবং তার দেয়া মূলনীতির মুকাবিলায় অন্য মূলনীতি অনুযায়ী জীবন গড়ে তোলা পথ ভ্রষ্টতা এবং কুরআনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা।
আখেরাতের উপর ঈমান
১. মানুষের জীবন শুধু এ দুনিয়ার জীবনই নয়। বরঞ্চ মরণের পর পুরর্জীবন লাভ করার পর এক দ্বিতীয় জীবন শুরু হবে যা হবে চিরন্তন জীবন এবং যার পর মৃত্যু আর কাউকে স্পর্শ করবে না। এ জীবন আপন আপন কর্ম অনুযায়ী অত্যন্ত সুখের হবে অথবা অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টের। এ জীবনের উপর বিশ্বাসকেই বলে আখেরাতের উপর বিশ্বাস।
২. মরণের পর প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির নিকটে মনকির ও নকীর ফেরেশতাদ্বয় এসে জিজ্ঞাস করবেন :
বল তোমার রব কে?
বল তোমার দ্বীন কি?
নবী মুস্তফা (সা) কে দেখিয়ে বলবেন বল ইনি কে?
এই হচ্ছে আখেরাতের পরীক্ষার প্রথম ঘাঁটি।
৩. একদিন যখন শিংগায় ফুক দেয়া হবে তখন সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি লন্ড-ভন্ড হয়ে যাবে। পৃথিবী ভয়ংকর ভাবে এবং থর থর করে কাঁপাতে থাকবে। সূর্য চন্দ্রের মধ্যে সংঘর্ষ হবে। তারকারাজি আলোক বিহীন অবস্থায় চারদিকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হযে পড়বে। পাহাড় পর্বত ধৃনানো তুলার মতো উড়তে থাকবে। আকাশ ও পৃথিবীর সকল প্রকার জীব মৃত্যুবরণ করবে এবং গোটা বিশ্বজগত সম্পুর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।
৪. অতপর আল্লাহর আদেশে দ্বিতীয়বার শিংগায় ফক দেয়া হবে। তখন সকল মৃত ব্যক্তি পুনর্জীবনর লাভ করবে। এক নতুন জগত অস্তিত্বলাভ করবে। এবার মানুষের জীবন হবে চিরন্তন জীবন। একেই বলে কেয়াকমতের দিন এবং এ দিনটি হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। ভয় ও সন্ত্রাসে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হতে থাকবে। দৃষ্টি থাকবে নীচের দিকে। প্রত্যেকে তার পরিণামের প্রতীক্ষা করবে।
৫. সকল মানুষ হাশরের ময়দানে আল্লাহর সম্মুখে একত্র হবে। আল্লাহ বিচারের আসনে সমাসীন হবেন সেদিন সকল। কর্তৃত্ব প্রভূত্ব একমাত্র তারই হবে। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কারো মুখ ‍খুলবার সাহস হবে না। আল্লাহ প্রত্যেকের পৃথক পৃথকভাবে হিসাব নেবেন। তিনি তাঁর জ্ঞান, সুস্থবিচার বুদ্ধি ও ন্যায় পরায়ণতার ভিত্তিতে সঠিক ফয়সালা করবেন। প্রত্যেকের তার সঠিক ও ন্যায় সংগত প্রতিদান দেয়া হবে। কারো প্রতি কণামাত্র অবিচার করা হবে না।
৬. নেক বান্দাহদের ডান হাতে এবং পাপীদের বাম হাতে তাদের নামায়ে আমল দেয়া হবে। নেক লোকেরা নাজাত ও সাফল্য লাভ করবেন এবং পাপাচারী ব্যর্থ মনোরথ হবে। সাফল্যকারীদের মুখমন্ডল আনন্দে সমুজ্জল হবে। পক্ষান্তরে পাপাচারীদের মুখমন্ডল দুঃখ-বেদনায় মলীন ও কালো হবে। নেক ও ধার্মিক লোকেরা বেহেশতে আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি লাভ করবেন এবং খোদাদ্রোহীদেরকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হবে।
৭. সে দিনের সিদ্ধন্ত হবে অটল ও অপরিবর্তনীয়। এ সিদ্ধন্ত কেউ এড়াতে পারবে না। মিথ্যা কথা বলে অথবা কোন বাহানা করে কেউ আল্লাহকে প্রতারিত করতে পারবে না। আর না কেউ অলী অথবা কোন নবী কারো অন্যায় সুপারিশ করবেন। শাফায়াত বা সুপারিশের জন্যে একমাত্র তিনি মুখ খুলতে পারবেন যাকে আল্লাহ অনুমতি দেবেন। একমাত্র তারই জন্যে সুপারিশ করা হবে যার জন্যে আল্লাহ সুপারিশের অনুমতি দেবেন। দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় আসারও সুযোগ করো হবে না যাতে করে সে নেক আমল করে আখেরাতের জীবন সার্থক করবে। করো ক্রন্দন ও বিলাপও কাউকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাচাতে পারবে না।
৮. দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের আমল সংরক্ষিত করা হচ্ছে। আমরা যা কিছুই বলছি এবং করছি তা সবই আল্লাহর ফেরেশতাগণ লিখে রাখছেন। মুখ থেকে কোন কথা বেরুবার সাথে সাথেই ফেরেশতা তা অবিকল সংরক্ষিত করে রাখছেন।
৯. মানুষের কোন আমলই সেদিন আল্লাহর দৃষ্টির অগোচরে থাকবে না। তা সরিষা পরিমাণ কোন কঠিন পাথরের মধ্যে প্রেথিত হোক, আকাশে বাতাসে হোক অথবা ভগর্ভের কোন অন্ধকার স্তরে লুক্কায়িত হোক, আল্লাহ সেদিন তা এনে হাজীর করবেন। প্রত্যেকেই সেদিন আল্লাহর সামনে ধরা পড়বে।
১০. জান্নাতবাসী মুমেনদেরকে এমন অনুপম ও অফুরন্ত সুখসম্পদ দান করা হবে যে, যা চোখ কোন দিন দেখেনি, কান এ সম্পর্কে কিছু শুনেনি এবং অন্তর তা কোনদিন অল্পনাও করেনি। যেদিকেই তারা যাবেন, চারদিকে থেকে সালাম সালাম খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ, ধ্বনীই শুধু শুনা যাবে। এ আনন্দ সুখ থেকে তাদেরকে কোনদিন বঞ্চিত করা হবে না। তাদের সব চেয়ে বড় পাওয়া হবে এই যে, আল্লাহ তাদেরকে তার দীদার দান করবেন এবং বলবেন, হে আমার বন্দাগণ। আজ আমি তোমাদের প্রতি আমার সন্তোষ প্রকাশ করছি। এখন আমি আর কখনো তোমাদের প্রতি নারাজ হবো না।
১১. খোদাদ্রোহীদেরকে জাহান্নামের দাউ দাউ করে জ্বলা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে তাদেরকে ঘিরে রাখবে এবং সেখান থেকে কোনদিন তারা পালাতে পারবে না। তারা মরেও যাবে না যে, যন্ত্রনা থেকে নিষ্কৃতি পাবে। আর না তারা জীবিত থাকবে জীবন উপভোগ করার জন্যে। নৈরাশ্যে প্রতি মুহূর্তে তারা মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু মৃত্যু তাদের কপালে আর ঘটবে না। জাহান্নামের আগুন রাগে ফেটে পড়তে থাকবে এবং কখনো নিভে যাবে না। পিপাসায়কাতর হয়ে যখন জাহান্নামবাসী ছটফট করবে, তখন তাদেরকে উত্তপ্ত গলিত ধাতু পানীয় হিসাবে দেয়া হবে। যার ফলে মুখ পুড়ে যাবে। অথবা এমন জিনিস দেয়া হবে যা গলদেশ পার হতে পারবে না। তাদের গলায় আগুনের হাসুলি এবং আলকাতরা ও আগুনের পোশাক পরানো হবে। ক্ষধায় তাদেরকে কন্টকযুক্ত খাদ্য খেতে দেয়া হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি ভয়ানক ক্রুদ্ধ থাকবেন।
১২. কে বেহেশতবাসী এবং কে জাহান্নামবাসী তার সঠিক জ্ঞান আল্লাহ তায়ালার রয়েছে। অবশ্যি যে কাজগুলো একজন মানুষকে বেহেশতে নিয়ে যাবে তা নবী করীম (সা) সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে যে কাজগুলোর পরিণাম জাহান্নাম তাও সুস্পষ্ট করে তিনি বলে দিয়েছেন। দুনিয়ার আমরা কাউকে নিশ্চিত সহকারে বেহেশতী বলতে পারি না। অবশ্যি ঐ সব ভাগ্যবান ব্যতীত যাদেরকে নবী পাক (সা) বেহেশতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। কিন্তু ভালো নিদর্শন দেখে আল্লাহর রহমতের আশা অবশ্যই করা যেতে পারে।
১৩. আল্লাহ ইচ্ছা করলে যে কোন গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন। কুরআন বলে, আল্লাহ কুফর ও শির্কের গুনাহ মাফ করবেন না। তবে খাটি দেলে তওবা করলে তিনি মাফ করবেন।” (সূরায়ে ফুরকান)।
১৪. জীবনের যে কোন সময়ে ঈমান আনলে অথবা গুনাহ থেকে তওবা করলে তার ঈমান এবং তওবা আল্লাহ কবুল করেন। মৃত্যুর সময় যখন আযাবের ফেরেশতা দেখা যায় তখন না করো ঈমান কবুল হবে না তওবা

Saturday, October 29, 2016

গায়ের ইসলামী আকায়েদ ও চিন্তাধারা



মুসলমান হওয়ার জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন যে, ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত হয়ে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তার উপর ঈমান এনে তার ভিত্তিতেই জীবনকে সংশোধিত করে গড়ে তুলতে হবে। ঠিক তদনুরূপ এটাও প্রয়োজন যে, ইসলাম ও ঈমানের পরিপন্থী গায়ের ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সম্পর্কেও পূর্ণ অবহিত হতে হবে। এসব আকীদাহ-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে মন মস্তিষ্ক ও পবিত্র করতে না পারলে ইসলামের দাবী পূরণ ও সত্যিকার ইসলামী জীবন যাপন কিছুতেই সম্ভব নয়।
নিম্নে সংক্ষেপে সে সব গায়ের ইসলাশী ধারণা বিশ্বাসের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যার থেকে একজন মুসলমান পূর্ণ অনুভূতি সহকারে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখতে পারে।
১. কুফরী চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড পসন্দ করা, এতে গর্ববোধ করা এবং অপরকেও এর জন্যে উদ্বুদ্ধ করা ঈমানের একেবারে খেলাপ। এসব থেকে অতি সত্বর তওবা করতে হবে।
২. দ্বীন ইসলামের আসল আখলাক এবং তার নিদর্শনাবলীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, অবজ্ঞা ও ঘৃনা সহকারে এ সবের উল্লেখ করা। ইসলামের প্রতি নির্লজ্জ উক্তি এবং নিকৃষ্ট ধারনের মুনাফেকী। এ ধরনের কথা বার্তা বরদাশত করা, কথা ও কাজের দ্বারা এ সবের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ না করা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। দ্বীনের প্রতি আনুগত্যহীনতা প্রকাশ করা হয় এবং এর দ্বারা ঈমানের চরম দুর্বলতা প্রকাশ করা হয়।
৩. আল্লাহ ও তাঁর নবী পাক (সা) এর নিদর্শনাবলী অবগত হওয়ার পরেও বাপ-দাদার প্রথা এবং সামাজিক আচার অনুষ্ঠান পালনে অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালনকে অবমাননাকর মনে করা ইসলাম বিরোধী আকীদাহ-বিশ্বাস ও চিন্তাধারার ফল। ঈমানের সাথে ও সবের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই।
৪. আল্লাহ ‍ও রাসূলের হুকুম আহকাম নিজের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করা, তার অর্থ বিকৃতি করে আপন স্বার্থের অনুকূল করা এবং আল্লাহ ও রসূলের আদেশ-নিষেধগুলো হুবহু পালন করা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা চরম মুনাফেকীর কাজ।
৫. আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম-আহকামের সমালোচনা করা, তার মধ্যে ত্রুটি বের করা, সময়োপযোগী মনে না করা, এ ধরনের উক্তি করা যে, এসব অন্ধযুগের কাজ-কারবার। এসব কিছুই ভ্রান্ত চিন্তাধারার ফলশ্রুতি যার সাথে ঈমানের কোনই সম্পর্ক নেই।
৬. আল্লাহর অবিশ্বাসীরা হালাল-হারামের বাছ-বিচার না করে ধন-সম্পদ উপার্জন করে এবং আনন্দ মুখর জীবন যাপন করে। এসব দেখে কোন মুসলমান যদি তার ইমান সম্পর্কে লজ্জাবোধ করে এবং বলে আহা! যদি মুসলমান না হতাম তাহলে আমরাও দুনিয়াকে উপভোগ করতে পারতাম, তাহলে এসব চিন্তা, ধারণা ও উক্তি ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারারই ফল বলতে হবে। এসব থেকে ঈমানকে রক্ষা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
৭. শরীয়তের বাধা-নিষেধকে উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা মনে করা, মহিলাদেরকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করাতে গর্ববোধ করা, ঘরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদেরকে পরস্পরের সাথে হাত মিলাতে, নিঃসংকোচে গল্প আলাপ করতে সম্পকর্ক স্থাপন করতে দেখে গর্ববোধ করা এবং এটাকেই প্রগতি মনে করা নির্লজ্জ ধরনের ধর্মহীনতা। এটা আত্মমর্যাদা এবং ইদানী মার্যাদাবোধের একেবারে খেলাপ।
৮. দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণে ঔদাসীন্য, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞাতার শুধু নিশ্চিত থাকাই নয়। বরঞ্চ অজ্ঞতার কারণেই ইসলামের উপর আমল না করার জন্যে অক্ষমতা প্রকাশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিন্তাধারা যা একজন মুসল মানের ঈমান আকীদাসহ নষ্ট করে দেয়।
৯. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে লাভ-লোকসান, সম্মান-অসম্মান, উন্নতি-অবনতি প্রভৃতির মালিক মোখতার মনে করা, তৌহীদী বিশ্বাসের বিপরীত।
১০. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্যে অন্তরে ভীতি পোষণ করা, কারো উপরে ভরসা করা, কারো উপরে আশা পোষণ করা, মানব জীবনের উত্থান-পতনের এখতিয়ার অন্য কারো আছে বলে বিশ্বাস করা ইমানকে বিনষ্ট করে।
১১. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক, কার্যসম্পাদনাকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী, সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করা তৌহীদী আকীদার বিপরীত।
১২. ভবিষ্যত সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তা বিশ্বাস করা ঈমান নষ্ট করে দেয়।
১৩. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে হাযের নাযের মনে করা যে, গোপন এবং প্রকাশ্য সব তার জানা আছে, ইসলামী আকীদার খেলাপ।
১৪. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্যে ডাকা, করো কাছে রুজি ও সন্তানাদি চাওয়া, করো নামে সন্তানের নাক কান ছিদ্র করার চুলের ঝুটি রাখা, কারো নামে মানত মানা পরিপূর্ণ শির্ক।
১৫. আল্লাহ ছাড়া কারো নামে পশু ছেড়ে দেয়া, পশু যবেহ করা, সন্তান বাচার জন্যে বেদআতি কাজ-কর্ম করা, নবপ্রসূত সন্তানকে রক্ষা করার জন্যে তার শিয়রে কোন অস্ত্র রাখা, সন্তানের জীবনের জন্যে অন্য কোন শক্তিকে ভয় করা প্রভৃতি শির্ক এবং তৌহীদের বিপরীত।
১৬. বিয়ে শাদী, সন্তানের জন্ম ও খাৎনার সময় এমন সব কাজ কর্ম অপরিহার্য মনে করা যা ইসলাম অপরিহার্য মনে করেনি, গায়ের ইসলামী চিন্তা ধারা ও কুসংস্কার।
১৭. রোগ ও মৃত্যুর জন্যে আল্লাহর উপর দোষারোপ করা, অসংগত ও গোস্তাখীপূর্ণ উক্তি করা, আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা ঈমান বিনষ্টকারী।
১৮. অসাধারণ বিপদ-আপদে পতিত হয়ে এবং বার বার বিপদ ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আল্লাহর অনুগ্রহের প্রত্যাশা না করা এবং (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহকে দয়ামায়াহীন মনে করা কুফরী চিন্তা ধারার বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের শয়তানী অসঅসা মনের মধ্যে প্রকাশ পেলে সংগে সংগে খাঁটি দেলে তওবা করা উচিত।
১৯. কারো সামনে হাত বেঁধে দাঁড়ানো, কাউকে সিজদা করা, কারো সামনে মস্তক অবনত করা শির্ক।
২০. কবরে চুমো দেয়া, তার সামনে হাত বেঁধে দাড়ানো, কবরে কপাল ঠেকানো এবং এ ধরনের আর যত সব কর্মকাণ্ড সবই তৌহীদী আকীদার পরিপন্থী এবং চরম অবমাননা।
২১. কোন পীরের ছবি বরকতের জন্যে কাছে রাখা, তাতে ফুলের মালা পরানো এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন পুরোপুরি শির্ক।
২২. আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং এমন বিশ্বাসের ঘোষণা করা যে, অবস্থার পরিবর্তন করার ক্ষমতা তার আছে-একেবারে শির্ক।[কোন মৃত ব্যক্তির কবরের পাশ দিয়ে যেতে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্যে গাড়ী বা যানবাহন থামানো এবং সেই মৃত ব্যক্তি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারে বলে তার কবরে কিছু নযর নিয়ায দেয়া, না দিলে নারায হয়ে কোন বিপদে ফেলতে পারেন বলে বিশ্বাস করা ষোল আনা শির্ক- অনুবাদক।]
২৩. কারো আদেশ-নিষেধকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সমতুল্য মনে করা, তার নির্দেশকে অগ্রাধিকার দেয়া, শরীয়তের বিধানগুলোতে কমবেশী করার অন্য কারো অধিকার আছে বলে মনে করা, কাউকে শরীয়তের উর্ধে মনে করা অথবা কাউকে এমন মনে করা যে, শরীয়তের কোন বিধান সে মাফ করে দিতে পারে-একেবারে শির্ক।
২৪. কারো বাড়ী এবং কবরের তাওয়াফ করা, কোন স্থানকে কা’বা শরীফের মতো মনে করে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা ইসলাম বিরোধী আকীদারই বহিঃপ্রকাশ।
২৫. আলী বখস, নবী বখশ, হোসেন বখশ, আবদুন্নবী প্রভৃতি নাম রাখা এবং কাউকে ইয়া গউসুল মদদ, ইয়া অলীউল মদদ প্রভৃতি নাম ধরে ডাকা তৌহীদি আকীদার খেলাপ।
২৬. আল্লাহর আইনের তুলনায় মানুষের তৈরী আইন সঠিক মনে করা, তা মেনে চলা, অপরিহার্য মনে করা, তা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা-চরিএ করা, তার সমর্থক ও সাহায্যকারী হওয়া ঈমান ও ইসলামী চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত।
২৭. আখেরাতে নাজাতের জন্যে ঈমান ও আমলের পরিবর্তে পীর অলীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাকে যথেষ্ট মনে করা এবং এমন মনে করা যে, তার সুপারিশে সব কিছু হয়ে যাবে অথবা আল্লাহর উপর তিনি এতোখানি প্রভাব খাটাতে পারেন যে, যেমন খুশী তেমন সিদ্ধান্ত করাতে পারেন-একেবারে ইসলাম বিরোধী আকীদাহ-বিশ্বাস।
২৮. নিজেকে পাপ অথবা পূণ্য করতে একেবারে বাধ্য মনে করা এবং মনে করা যে, বান্দার ভালো-মন্দ করার কোনই অধিকার নেই ভালো-মন্দ সবই আল্লাহ্ করান এবং বান্দাহ বাধ্য হয়েই তাই করে-একেবারে ইসলাম বিরোধী ধারণা বিশ্বাস। এ বিশ্বাসসহ আখেরাতের উপর বিশ্বাস অর্থহীন হয়ে পড়ে।
২৯. নিজেকে সকল কাজ করতে পরিপূর্ণ সক্ষম মনে করা এবং এমন মনে করা যে, মানুষ যা কিছু করে তাতে আল্লাহর করার কিছুই নেই, প্রত্যেক কাজ করার পূর্ণ এখতিয়ার মানুষের আছে-ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারা। এমন চিন্তাধারা থেকে অন্তরকে পাক-পবিএ রাখা দরকার।
৩০. নবী-রাসূলগনকে নিষ্পাপ মনে না করা, কোন মন্দ কাজ তাঁদের প্রতি আরোপ করা অথবা তাঁদেরকে আসমানী কিতাবের প্রণেতা মনে করা ইসলাম বিরোধী আকীদাহ-বিশ্বাস।
৩১. সাহাবায়ে কেরাম (রা) এর সমালোচনা করা, তাঁদের দোষত্রুটি বের করা, তাঁদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা অথবা তাঁদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারা। এসব চিন্তাধারা থেকে তওবা করা উচিত।
৩২. আল্লাহ ও তাঁর রসূল দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় চিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। এখন কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে অথবা স্বপ্নের মাধ্যমে কিংবা নিজের জ্ঞান বুদ্ধিতে দ্বীন সম্পর্কে নতুন কিছু আবিষ্কার করা, তা চালু করা ও তা প্রয়োজনীয় মনে করা বিদআত। বিদআত বাড়ো গুনাহ এবং গোমরাহী।
৩৩. বিপদ ও দুঃখ কষ্টে পড়ে নিজের ভাগকে ভালোমন্দ বলা, তাকদীরের বিরুদ্ধে উক্তি করা এবং এ ধরণের কথা বলা কি বলব, আমার তাকদীর মন্দ, আল্লাহ আমার কপালে এই রেখেছিলেন, আমার ভাগ্য কি এমন যে, সুখের মুখ দেখবো এ ধরনের উক্তি করায় আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হয় এবং তাঁর শানে গোস্তাখী করা হয়। এ ধরণের ইসলাম বিরোধী ধারণা ও উক্তি থেকে নিজেকে পাক রাখা দরকার। আল্লাহর প্রত্যেকেটি কাজে সন্তুষ্ট থাকা এবং তাঁর প্রতিটি সিদ্ধন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া প্রকৃত ঈমানের আলামত।

Tuesday, October 11, 2016

যাদের উপর যাকাত ফরজ

যাদের উপর যাকাত ফরজ


নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরজ। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বছরের
যাকাত প্রদান করা ফরজ। অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি যদি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়েও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। যাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি তা প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।
যাকাতের নিসাব কী?
রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোনো একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে।
কোনো ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্র মাসের হিসাবে এক বৎসর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে তাহলে তার উপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত রূপে প্রদান করা ফরজ। মনে রাখতে হবে বছরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরি। বছরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও যাকাত প্রদান করতে হবে।
সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের উপর বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। অতএব, বছরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলেও বছরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশী হয় তাহলে ওই বেশী পরিমাণের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। বছরের যে কোনো অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। যাকাত ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের উপর বছর অতিক্রম করা শর্ত। যাকাত, যাকাতুল ফিতর, কুরবানি এবং হজ এ সকল শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সাথে সম্পৃক্ত।
যাকাত বহির্ভুত সম্পদ :
জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ি, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহ-পালিত পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির যাকাত হয় না।
ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত হয় না। শস্য ও গবাদি পশুর যাকাত পরিশোধ করার পর ওই শস্য বা গবাদি পশু বিক্রি করে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ওই অর্থের উপর একই বছরে যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার যাকাত হয় না।
যেসব সম্পদের যাকাত ফরজ :
১. স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ, ২. বাণিজ্যিক পণ্য, ৩. মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু, ৪. শস্য ও ফলমূল।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত :
যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ ভরি=১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত যে কোনো বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত ফরজ।
হীরা, ডায়মন্ড, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসেবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার যাকাত দিতে হবে। অলংকারসহ সকল প্রকার স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে।
নগদ অর্থের যাকাত :
নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোস্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি অ্যাকাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কিম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতিবছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে।
প্রতিষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে চাকরিজীবীর বেতনের একটি অংশ নির্দিষ্টহারে কর্তণ করে ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা করা হলে ওই অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে না। কারণ ওই অর্থের উপর চাকরিজীবীর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ ফেরৎ পাওয়ার পর যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে (অপ্শনাল) ভবিষ্যৎ তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ওই অতিরিক্ত জমা অর্থের উপর বছরান্তে যাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকরিজীবীর অন্যান্য সম্পদের সাথে এই অর্থ যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে।
পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে। মানত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মাহরের জমাকৃত টাকা, হজ ও কুরবানির জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বছরান্তে যথা নিয়মে যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) উপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার উপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ওই মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার উপর যাকাত :
যাকাত প্রদানের সময় উপস্থিত হলে মালিকানাধীন সকল বৈদেশিক মুদ্রার নগদ, ব্যাংকে জমা, টিসি, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদি যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির বসবাসের দেশের মুদ্রাবাজারে বিদ্যমান বিনিময় হারে মূল্য নির্ধারণ করে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে প্রদান করতে হবে।
মোহরাণার অর্থের উপর যাকাত :
’মাহর’ বিধানের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের জন্য এক অনন্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। কনে, বরের সাথে তার বিবাহবন্ধনে স্বীকৃতির সম্মানীস্বরূপ, বরের কাছ থেকে মাহর (মোহরাণা) পেয়ে থাকে। মাহর বাবদ প্রাপ্ত জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে। মাহরের অর্থ নিসাব মাত্রার হলে অথবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরাণার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তার উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ এই অর্থ তার আওতাধীনে নেই।
প্রচলিত মুদ্রায় (টাকায়) ধার্যকৃত ’মাহর’ বিয়ের সময় সাথে সাথে পরিশোধ না করে, বিলম্বে প্রদান করা হলে তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। বর্তমানকালে বিদ্যমান মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাসের ফলে এই পাওনা পরবর্তীতে যখন পরিশোধ করা হয়, তখন মাহরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ একান্ত নগণ্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হয়ে যায়। শরীয়াহ্ বিশারদরা এই সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মত পোষণ করেন যে, প্রচলিত মূদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে ’মাহর’ নির্ধারণ করা উচিত। যাতে করে বিবাহিত নারীদের এই অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং পরবর্তীকালে প্রচলিত মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত কারণে তাদের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
শেয়ার :
যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনকে সমমূল্য বিশিষ্ট বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ক্ষুদ্রাংশগুলোকে শেয়ার বলে। শেয়ার মালিককে কোম্পানির নিট সম্পত্তির একজন অংশীদার হিসাবে গণ্য করা হয়। শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্য বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসায় বিনিয়োগ, কোম্পানির আংশিক মালিকানা অর্জন এবং লভ্যাংশ বা মুনাফা উপার্জন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমন-
অসামাজিক বা অনৈতিক ব্যবসায়ে লিপ্ত, নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বা সুদী কারবার ও দৈবনির্ভর লেনদেনে নিয়োজিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বৈধ নয়। কোম্পানি নিজেই যদি শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান করে তা হলে শেয়ারমালিককে তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর যাকাত দিতে হবে না। কোম্পানি যাকাত প্রদান করতে পারবে যদি কোম্পানির উপ-বিধিতে এর উল্লেখ থাকে অথবা কোম্পানির সাধারণ সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথবা শেয়ারমালিকরা কোম্পানিকে যাকাত প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেন।
কোম্পানি নিজে তার শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান না করলে শেয়ার মালিককে নিম্নোক্ত উপায়ে যাকাত প্রদান করতে হবে-
১. শেয়ারমালিক যদি শেয়ারগুলো বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করে, তাহলে যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত উপায়ে নির্ণয় করা হবে-
ক) শেয়ারমালিক যদি কোম্পানির হিসাবপত্র যাচাই করে তার মালিকানাধীন শেয়ারের বিপরীতে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেন, তাহলে তিনি ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
খ) কোম্পানির হিসাবপত্র সম্পর্কে যদি তার কোন ধারনা না থাকে তাহলে তিনি তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর বার্ষিক অর্জিত মুনাফা যাকাতের জন্য বিবেচ্য অন্যান্য সম্পত্তির মূল্যের সঙ্গে যোগ করবেন এবং মোট মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
২. শেয়ার মালিক যদি শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা (মূলধনীয় মুনাফা) করার জন্য শেয়ারগুলো ব্যবহার করেন তাহলে যেদিন যাকাত প্রদানের ইচ্ছা হবে, শেয়ারের সেদিনের বাজার মূল্য ও ক্রয়-মূল্যের মধ্যে যেটি কম তারই ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন। একজন শেয়ার মালিক ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কোম্পানির শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের এই স্বাধীনতা শেয়ার বাজারকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটি সাধারণ ব্যবসা কার্যক্রমকে প্রায় জুয়াখেলায় পরিণত করে। যা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ।
বাণিজ্যিক সম্পদের যাকাত :
ব্যবসার নিয়তে (পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনের জন্য) ক্রয়কৃত, আমদানি-রপ্তানি পণ্য, ট্র্যানজিট বা পরিবহন পণ্য, বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য ও মজুদ মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের উপর সর্বসম্মতভাবে যাকাত ফরজ। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি, দালান বা যে কোনো বস্তু অথবা মালামালের মূল্যের উপরও যাকাত প্রদান করতে হবে। বাকী বিক্রির পাওনা, এলসি মার্জিন ও আনুষঙ্গিক খরচ, ব্যবসার নগদ অর্থসহ অন্যান্য চলতি সম্পদ যাকাতের হিসাবে আনতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার দেনা যেমন বাকীতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
যাকাত নির্ধারণের জন্য বিক্রেতা তার পণ্যের ক্রয়-খরচ মূল্যকে (ক্রয়মূল্যের সাথে ভাড়াসহ ক্রয়-সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগ করে) হিসাবে ধরবেন। ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন’। (সুরা বাক্বারা, আয়াত-২৭৫)
উৎপাদিত পণ্য :
তৈরি বা উৎপাদিত পণ্য, উপজাত দ্রব্য, পঙক্রিয়াধীন পণ্য, উৎপাদন পঙক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য তৈরি বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্যায়ন উৎপাদন খরচ মূল্যের অথবা পাইকারি বাজার দরের ভিত্তিতে হবে। পপঙক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খরচের ভিত্তিতে করতে হবে। মজুদ কাঁচামাল এবং উৎপাদন পঙক্রিয়ায় কাঁচামালের সাথে ব্যবহৃত প্যাকিং সামগ্রী ক্রয়- খরচ মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব হবে এবং যাকাতের আওতাধীন পণ্যদ্রব্যসহ ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পত্তির সাথে যোগ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন পঙক্রিয়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পদ যেমন- জমি, দালান, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।
স্থায়ী সম্পত্তির যাকাত :
স্থায়ী সম্পত্তি বলতে বুঝায় জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি।
ক. বসবাস, ব্যবহার, উৎপাদন কাজে বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তির উপর যাকাত ধার্য হয় না।
খ. আয় উপার্জনের জন্য ভাড়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত ধার্য হয় না। তবে এসব সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ অর্জিত নিট আয় অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হবে।
গ. বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- জমি, গৃহ, দোকান, এপার্টমেন্ট, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে।
ঋণদাতার উপর যাকাত :
ক. আদায়যোগ্য ঋণ আদায় হওয়ার পর অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে।
১. যে ঋণ নগদে বা কোন দ্রব্যের বিনিময়ে কারো কাছে পাওনা হয়, এরূপ ঋণ আদায় হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে এবং বিগত বৎসরগুলোরও যাকাত প্রদান করতে হবে।
২. যে পাওনা কোনো দ্রব্য বা নগদ ঋণের বিপরীতে নয়, যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ, দান, অছিয়ত, মোহরাণার অর্থ ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আদায়ের পর যাকাত ধার্য হবে। এগুলোর উপর বিগত বৎসরগুলোর যাকাত প্রদান করতে হবে না।
খ. আদায় অযোগ্য বা আদায় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ যাকাতের হিসাবে আসবে না। যদি কখনও উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবলমাত্র এক বছরের জন্য এর যাকাত দিতে হবে।
ঋণগ্রহিতার উপর যাকাত :
ক. ঋণগ্রহিতার ঋণের টাকা মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি (যেমন-অতিরিক্ত বাড়ি, দালান, এপার্টমেন্ট, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ি ও আসবাবপত্র ইত্যাদি) থাকে, যার মাধ্যমে এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম, তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
খ. স্থাবর সম্পদের উপর কিস্তিভিত্তিক ঋণ (যেমন-হাউজিং লোন ইত্যাদি) যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
গ. ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থাকে তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
ঘ. শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায় তবে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
ঙ. যদি অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তির মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয়, তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকী ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। বিলম্বে প্রদেয় বা পুনঃতপসিলিকৃত ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
পশুর যাকাত :
উটের সর্বনিম্ন নিসাব পাঁচটি, গরু-মহিষের ত্রিশটি এবং ছাগল-ভেড়ার চল্লিশটি। তবে এ ধরনের পশু বৎসরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ করলেই এসব পশুর উপর সংখ্যা ভিত্তিক যাকাত ধার্য হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যে কোনো পশুসম্পদ প্রতিপালন করা হলে সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এদের উপর যাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস্য, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেণু, পোনা ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।
প্রিয়নবী মুহম্মদ (সা.) পানিতে বাস করা অবস্থায় মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। মাছ যখন বিক্রির জন্য ধরা হবে তখনই এর যাকাত পরিশোধ করতে হবে।
শস্য ও ফলের যাকাত (উশর) :
শস্য ও ফলমূলের যাকাতকে উশর বলে। জমি থেকে উৎপন্ন সকল প্রকার শস্য, শাকশব্জি, তরি-তরকারি ও ফলের উপর যাকাত প্রযোজ্য। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ওষুধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ফসল আসার সাথে সাথে উশর পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই।
বৎসরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিকবার উশর পরিশোধ করতে হবে। অনেক ধরনের ফল, ফসল ও শাকশব্জি একই সাথে কাটা বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন- মরিচ, বেগুন, পেঁপে, লেবু, কাঁঠাল ইত্যাদির পরিপক্কতা বুঝে কিছু কিছু করে কয়েকদিন পর পর পুরো কৃষি মৌসুমে বার বার উত্তোলন করা হয়। ফসলের মালিক যদি ফসলের আনুমানিক পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে প্রথম থেকেই প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে উশর (যাকাত) পরিশোধ করবেন। যদি মালিকের পক্ষে ফসলের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হয়, তবে তিনি প্রথম উত্তোলন থেকে ফসলের হিসাব রাখবেন এবং যখনি মোট উত্তোলিত ফসলের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছবে তখনি ওইদিন পর্যন্ত মোট উত্তোলিত ফসলের যাকাত পরিশোধ করবেন এবং তৎপরবর্তী প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে যাকাত পরিশোধ করবেন।
জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণে ব্যবহার উপযোগী বৃক্ষের ক্ষেত্রে, এরূপ বৃক্ষ যখন কাটা হবে তখন এগুলোর উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে। তা যত দীর্ঘ সময় পর কাটা হউক না কেন। যে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না, প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হয়, তার ফসলের যাকাত হবে দশ ভাগের একভাগ (১০%)। আর যে জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়, তার ফসলের যাকাত হবে বিশ ভাগের একভাগ (৫%)। ফসল উৎপাদনের ব্যয় যেমন- চাষ, সার, কীটনাশক, বপন ও কর্তণ ইত্যাদি খরচ উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে। তবে এ সব খরচ মোট উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি বাদ যাবে না। ফসলের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক বা ৬৫৩ কিলোগ্রাম।
অনেক কৃষি ফসল আছে যা মাপা বা ওজন করা হয় না। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল, শাকশব্জি, ফুল, অর্কিড, চারা, বৃক্ষ ইত্যাদি। এগুলোর নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ ফসল চাল বা গমের ৬৫৩ কেজির মূল্য (স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য) নিসাব হিসাবে গণ্য করা যাবে।
বাংলামেইল২৪ডটকম