Friday, May 26, 2017

সিজদায়ে তেলাওয়াতের বয়ান


সিজদায়ে তেলাওয়াতের হুকুম
কুরআন চৌদ্দটি (আহলে হাদীসের নিকটে পনেরো আয়াত। তারা সূরা হজ্জের ৭৭ আয়াতেও সিজদা করেন। শাফেয়ীদের মতেও তাই)আয়াত এমন আছে যা পড়লে বা শুনলে সিজদা করা ওয়াজিব হয়। (ইমাম আবু হানীফা ছাড়া অন্যান্যদের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াত সুন্নাত।)তা পুরো আয়াত পড়া হোক অথবা পূর্বাপর সহ সিজদার শব্দ (ঐসব আয়াতের উপর রেখা টানা থাকে)পড়া হোক সিজদা ওয়াজিব হয়ে যাবে। একে সিজদায়ে তেলাওয়াত বলে।
নবী (স) যখন কেউ সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করে তখন শয়তান এক ধারে বসে বিলাপ করতে থাকে এবং বলে হয় আফসোস, আদম সন্তানদের সিজদার হুকুম দেয়া হলে তারা সিজদা করলো এবং জান্নাতের হকদার হলো। আমাকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হলে আমি অস্বীকার করে জাহান্নামের হকদার হলাম। (মুসলিম, ইবনে মাজা)
সিজদায়ে তেলাওয়াতের স্থানগুলো
সূরা আরাফের ২০৬ আয়াত, সুরা রাদের ১৫ আয়াত, সূরা নহলের ৪৯, ৫০আয়াত, সুরা বনী ইসরাঈলের ১০৯আয়াত, সুরা মরিয়মের ৫৮ আয়াত, সূরা হজ্জের ১৮ আয়াত, সূরা ফুরকানের ৬০ আয়াত,সূরা আন নামলের ২৫-২৫ আয়াত, সূরা হা-মীম সাজদার ৩৮ আয়াত, সূরা আন নাজমের ৬২ আয়াত, সূরা ইনশিকাকের ২০-২১ আয়াত এবং সূরায়ে আলাকের ১৯ আয়াত।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্ত
সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্তঃ
(অর্থাৎ নামাযের যেসব শর্ত,সিজদায়ে তেলাওয়াতেরও তাই। যেসব কারণে নামায নষ্ট হয়, সেসব কারণে সিজদায়ে তেলাওয়াত নষ্ট হয়।)
১. তাহারাত
শরীক পাক হওয়া। অর্থাৎ নাজাসাতে গালীযা থেকে পাক হতে হবে। নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক হতে হবে। অযু না থাকলে অযু করতে হবে এবং গোসলের দরকার হল গোসল করতে হবে।
  • পোশাক পাক হওয়া।
  • নামাযের স্থান পাক হওয়া।
  • সতর ঢাকা।
  • কেবলার দিকে মুখ করা।
  • সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করা।
অধিকাংশ আলেমের এ মত। কিন্তু কোনো কোনো আলেমের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াতের জন্যে অযু থাকা জরুরী নয়। আহলে হাদীসের মতে অযুসহ সিজদায়ে তেলাওয়াত তো উত্তম কিন্তু বিনা অযুতেও জায়েয।
আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেনঃ
এ সিজদার জন্যে অধিকাংশ আলেম ঐসব শর্তের পক্ষে যা নামাযের শর্ত। কিন্তু যতো হাদীস সিজদায়ে তেলাওয়াত সম্পর্কে পাওয়া যায় তার মধ্যে এসব শর্তের জন্যে কোনো দলিল নেই। তার থেকে এটাই মনে হয় যে, সিজদার আয়াত শুনার পর যে যেখানে যে অবস্থায় আছে সিজদাহ করবে তা অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী হওয়া সম্ভব হোক বা না হোক। প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক পাওয়া যায় যারা এ পদ্ধতিতে আমল করেছেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি পথ চলতে চলতে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোথাও সিজদার আয়াত এলে ব্যাস মাথা নত করতেন। অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী থাকুন বা না থাকুন। এসব কারণে আমরা মনে করি যে, যদি কেউ অধিকাংশ আলেমগণের খেলাফ আমল করে তাহলে তাকে মন্দ বলা যাবে না। কারণ আলেম সাধারণের মতের সমর্থনে কোনো প্রমাণিত সুন্নাত নেই এবং প্রথম যুগে মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায় যাদের আমল আলেম সাধারণের মতের খেলাপ ছিল। (তাফহীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, সূরা আল আরাফ, টীকা ১৫৭)
সিজদার জন্যে এ নিয়ত করা শর্ত নয় যে, এ সিজদা অমুক আয়াতের। আর যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করা হয় তো নিয়ত শর্ত নয়।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ম
কেবলামুখী দাড়িয়ে সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করতে হবে এবং আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। সিজদা করার পর আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাড়াতে হবে। তাশাহুদ পড়ার ও সালাম ফেরানোর দরকার নেই।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, যখন তোমরা সিজদার আয়াতে পৌছবে তখন আল্লাহ আকবার বলে সিজদায় যাবে এবং মাথা উঠাবার সময় আল্লাহু আকবার বলবে। (আবু দাউদ)
বসে বসেও সিজদায়ে তেলাওয়াত করা যায় তবে দাড়িয়ে সিজদায় যাওয়া মুস্তাহাব।
সিজদায়ে তেলাওয়াতে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা ছাড়াও অন্য মাসনুন তসবিহ পড়া যায়। কিন্তু ফরয নামাযে সিজদায়ে তেলাওয়াত করতে হলে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা পড়া ভালো। অবশ্যই নফল নামায অথবা নামাযের বাইরে সিজদায়ে তেলাওয়াতে যে কোনো তসবিহ পড়া যায়। যেমন নিম্নের তসবিহ পড়া যেতে পারেঃ
*******আরবী*********
আমার চেহারা সেই সত্তাকে সিজদা করছে যিনি তাকে পয়দা করেছেন এবং তার মধ্যে কান ও চোখ দিয়েছেন। এসব তারই শক্তির দ্বারা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মহত্ব ও বরকতের উৎস, যিনি সর্বোৎকৃষ্ট স্রষ্টা।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের মাসায়েল
১. সিজদায়ে তেলাওয়াত তাদের ওপর ওয়াজিব যাদের ওপর নামায ওয়াজিব। হায়েয নেফাস হয়েছে এমন নারী এবং নাবালেগদের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব নয়। এমন বেহুশ লেকের ওপরও ওয়াজিব নয় যে একদিন এক রাতের বেশী বেহুশ রয়েছে।
২. সিজদার আয়াত নামাযে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সিজদাহ ওয়াজিব হবে বিলম্বের অনুমতি নেই। নামাযের বাইরে সিজদার আয়াত পড়লে তৎক্ষণাৎ সিজদা করা ভালো। বিলম্বেও কোনো দোষ নেই। অবশ্যই বিনা কারণে বেশী বিলম্ব করা মাকরূহ।
৩.যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়া হয়। তাহলে এ সিজদা ঐ নামাযেই আদায় করা ওয়াজিব হবে। যদি সিজদার আয়াত পড়ে কেউ অন্য কোনো নামাযে সিজদা আদায় করে তাহলে জায়েয হবে না। যদি কেউ সিজদার আয়াত পড়ে নামাযের মধ্যে সিজদাহ করতে ভুলে যায় তাহলে তওবা এস্তেগফার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। হ্যাঁ যদি এ নামায নষ্ট হয় তাহলে নামাযের বাইরে সিজদাহ করা যাবে।
৪. কেউ নামায পড়ছে বা পড়াচ্ছে। সে যদি অন্য কারো কাছে সিজদার আয়াত শুনে, তা সে অন্য লোক নামাযেই পড়ুক অথবা নামাযের বাইরে পড়ুক, তাহলে শ্রবণকারী নামাযী বা ইমামের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব হবে না।
৫. কোনো মুক্তাদী সিজদার আয়াত পড়লে, না ইমামের ওপর না মুক্তাদীর ওপর সিজদাহ ওয়াজিব হবে।
৬. কেউ ইমামের নিকটে সিজদার আয়াত শুনলো কিন্তু সে এমন সময় জামায়াতে শামিল হলো যখন সিজদাহ করে ফেলেছে। তাহলে যদি সে ঐ রাকায়াত পেয়ে যায় যে রাকায়াতে ইমাম সিজদাহ করেছে তাহলে তারও সিজদাহ হয়ে যাবে। কিন্তু পরের রাকায়াতে শামিল হলে তাকে নামাযের পর সিজদাহ করতে হবে।
৭. কেউ যদি মনে মনে সিজদার আয়াত পড়ে, মুখে না পড়ে। অথবা শুধু লেখে অথবা এক এক অক্ষর পড়ে, তাহলে সিজদা ওয়াজিব হবে না।
৮. যদি একই স্থানে সিজদার আয়াত বার বার পড়ে তাহলে একই সিজদাহ দিতে হবে। আর যদি কয়েক সিজদার আয়াত পড়ে তাহলে যতো আয়াত পড়বে ততো সিজদাহ করতে হবে। আবার এক আয়াত কয়েক স্থানে পড়লে যতো স্থানে পড়বে ততবার সিজদাহ করতে হবে।
৯। তেলাওয়াতের সময় সকল শ্রোতার যদি অযু থাক, তাহলে সিজদার আয়াত উচ্চস্বরে পড়া ভালো। কিন্তু বিনা অযুতে থাকলে অথবা সিজদাহ করার অবকাশ না থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে পড়া ভালো এজন্যে যে, তারা অন্য সময়ে সিজদাহ করতে ভুলে যেতে পারে এবং গুনাহগার হবে।
১০. সিজদার আয়াতের আগে এবং পরের আয়াত পড়া এবং সিজদার আয়াত বাদ দেয়া অথবা পুরো সূরা পড়া এবং সিজদার শেষ আয়াত বাদ দেয়া মাকরূহ।
১১. কিছু নাদান লোক কুরআন পড়তে পড়তে সিজদার আয়াতে পৌছলে কুরআনের ওপরেই সিজদাহ করে। এভাবে সিজদা আদায় হবে না। সিজদায়ে তেলাওয়াত ঐভাবে আদায় করা উচিত যা ওপরে বলা হয়েছে।
১২. সিররী (যা আস্ত পড়া হয়) নামাযগুলোতে এমন সূরা পড়া উচিত নয় যাতে সিজদাহ আছে। এমনি জুমা ও দু ঈদের নামাযে পড়া উচিত নয় যেখানে বিরাট জামায়াত হয়। তাহলে মুক্তাদীদের সন্দেহের সৃষ্টি এবং নামায নষ্ট হবে।
শুকরানা সিজদাহ
শুনে অথবা আল্লাহর রহমতে কোনো বিরাট নিয়ামত লাভ করে অথবা কোনো ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করে অথবা কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় অথবা কোনো বিপদ মুসিবত দূর হয়ে যায় তখন আল্লাহর ফজল ও করমের জন্যে শুকরানা সিজদাহ আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু এ সিজদাহ নামাযের সাথে সাথেই না করা উচিত। নতুবা অজ্ঞ লোক একে নামাযের অংশ মনে করতে থাকবে অথবা এটা সুন্নাত মনে করে পালন করতে থাকবে। এ নামায থেকে পৃথক সিজদাহ। এজন্যে তা এমনভাবেই করা উচিত যাতে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে। হযরত আবু বকর (রা) বলেন, নবী (স) যখন কোনো ব্যাপারে খুশী হতেন অথবা কোনো সুসংবাদ শুনতেন তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য সিজদাহ করতেন। (তিরমিযি)
কোনো কোনো লোক বেতরের পর দু সিজদাহ করে এবং তা সুন্নাত মনে করে এটা ভুল। সুন্নাত মনে করে তা করা ভুল এবং ত্যাগ করা উচিত।

তারাবীর নামাযের বয়ান


তারাবীহ তারাবীহ শব্দের বহুবচন। তার অর্থ বিশ্রামের জন্যে একটুখানি বসা। পরিভাষায় তার অর্থ হলো রমযানুল মুবারকে রাতে যে সুন্নাত নামায পড়া হয় তার চার রাকায়াত পর পর বিশ্রামের জন্য বসা। যেহেতু ঐ বিশ রাকায়াত নামাযে পাঁচটি তারাবীহ করা হয়, সে জন্যে এ সুন্নাত নামাযকে তারাবীহ বলা হয়ে থাকে।
তারাবীর নামাযের হুকুম
তারাবীর নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। নবী (স) তার বিশেষ ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা)ও। যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তারাবীহ পরিত্যাগ করবে সে গোনাহগার হবে। এ নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তারপর এটাও মনে রাখতে হবে, তারাবীহ নামায রোযার অধীন নয়। অর্থাৎ এরূপ মনে করা ভুল যে, তারাবীহ পড়া জরুরী যদি সেদিন রোযা রাখা হয়। এ দুটি পৃথক পৃথক ইবাদত। যারা কোনো ওজর বা অক্ষমতার কারণে রোযা রাখতে পারে না। যেমন কেউ রোগী অথবা সফরে রয়েছে, অথবা রোযা রাখেনি, অথবা মেয়ে মানুষ হায়েয নেফাসের কারণে রোযা রাখেনি কিন্তু তারাবীর সময় পাক হয়ে গেছে- তাদের তারাবীহ পড়া উচিত। না পড়লে সুন্নাত পরিত্যাগ করার গোনাহ অপরিহার্য হবে।
তারাবীহ নামাযের ফযিলত
নবী (স) শাবান মাসের শেষ দিন রমযান মাসের আগমনীকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেনে। তিনি বলেন, এ মাসে একটি রাত এমন আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। এ মাসে রাতের বেলায় আল্লাহ তায়ালা তারাবীহ নামায পড়া নফল করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ ফরয নয়, সুন্নাত। এজন্যে যে ফরযের মুকাবেলায় সুন্নাত মুস্তাহাব সবকেই নফল বলা হয়।) যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো কাজ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টি সহকারে করবে, তার প্রতিদান ও সওয়াব এতো হবে- যতোটা অন্যান্য মাসের ফরয ইবাদাতের হয়। (মিশকাত-বর্ণনাকারী সালমান ফারসী (র)। এ এক দীর্ঘ বর্ণনা। এখানে কিছুটা অংশ নকল করা হয়েছে।)
নবী (স) আর একটি হাদীসে একে মাগফেরাতের উপায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রাতগুলোতে ঈমানী প্রেরণা এবং আখিরাতের প্রতিদানের নিয়তে তারাবীহ নামায পড়লো, তার কৃত সকল গোনাহ মাফ করে  দেয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)
তারাবীহ নামাযের সময়
যে রাতে রমযানের চাঁদ দেখা যাবে সে রাত থেকে তারাবীহ শুরু হয়। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে তারাবীহ বন্ধ হয়ে যায়। তারাবীহ নামাযের সময় এশার নামাযের পর থেকে শুরু হয় এবং ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। যদি কেউ এশার নামাযের পূর্বে তারাবীহ পড়ে তাহলে তারাবীহ হবে না। যদি কেউ এশার নামাযের পর তারাবীহ পড়ে এবং কোনো কারণে এশার নামায পুনরায় পড়তে হয়, তাহলে তারাবীহ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার)
অবশ্যই এক তৃতীয়াংশ রাতের পর মধ্যে রাতের আগেই তারাবীর নামায পড়া মুস্তাহাব। মধ্য রাতের পর পড়া জায়েয হলেও আগেভাগে পড়ার যে নীতি তার খেলাপ হবে। (তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটি এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বড়ো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেনঃ এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটা। এশার সময়, না তাহাজ্জুদের সময়? উভয়ের সপক্ষে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু বেশী আগ্রহ দেখা যায় শেষ সময়ের দিকে। কিন্তু প্রথমে সময়কে প্রাধান্য দেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি এই যে, মুসলমানগণ সমষ্টিগতভাবে প্রথম সময়েই তারাবীহ পড়তে পারে। শেষ ময় অবলম্বন করা হলে উম্মতের বিরাট সংখ্যা গরিষ্ঠ এ সওয়াব থেকে বঞ্চিত রয়ে যাবে এবং তা বিরাট ক্ষতির বিষয় হবে। যদি কিছু নেক লোক শেষ সময়ের ফযিলত লাভের উদ্দেশ্যে প্রথম ওয়াক্তের জামাতে শরীক না হয়, তাহলে এ আশংকা হতে পারে যে, জনসাধারণ হয়তো এসব নেক লোকের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে অথবা তাদের জামায়াতে শরীক না হওয়ার কারণে জনসাধারণ নিজেরাই তারাবীহ পড়া ছেড়ে দেবে। অথবা ঐসব নেক রোকদেরকে তাদের তাহাজ্জুদ পড়ার ঢাক ঢোল পেটাতে হবে। (রাসায়েল ও মাসায়েল, তৃতীয় খন্ড, ২৩১ পৃঃ)
তারাবীহ নামাযের জামায়াত
নবী (স) রমযানে তিন রাত ২৩, ২৫ এবং ২৭শে রাত তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়িয়েছেন। তারপর যখন তিনি সাহাবীদের মধ্যে বিরাট উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুরাগ লক্ষ্য করলেন তখন মসজিদে এলেন না। সাহাবায়ে কেরাম (রা) মনে করলেন তিনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তারা তার দরজায় আওয়াজ দিতে লাগলেন। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় আরও বরকত দিন। আমি এ আশংকায় বাইরে যাইনি যে, কি জানি এ নামায তোমাদের ওপর ফরয হয়ে না যায় এবং হামেশা তোমরা তা পালন করতে না পার। এ জন্যে তোমরা এ নামায ঘরেই পড়তে থাক, কারণ নফল নামায ঘরে পড়াতে বেশী সওয়াব ও বরকতের কারণ হয়। (বুখারী)
এ হাদীস থেকে এতোটুকু প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং নবী পাক (স) তিন রাত জামায়াতে তারাবি পড়িয়েছেন। অবশেষে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা) রীতিমতো তার জামায়াত কায়েম করেন এবং সাহাবায়ে কেরাম নতশিরে তা মেনে নেন। পরবর্তীকালে কোনো খলীফাই এ সুন্নাতের বিরোধিতা করেননি। এ জন্যে আলেম সমাজ এ জামায়াতকে সুন্নাতে মুয়াককাদাহ কেফায়া বলেছেন। (তারাবীর নামাযের জামায়াত সম্পর্কে এক ব্যক্তি আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) কে প্রশ্ন করেন। তিনি বিশদভাবে তার জবাব দেন এবং বিষয়টির ওপর ভালোভাবে আলোচনা করেন। নিম্নে প্রশ্ন ও তার জবাব দেয়া হলোঃ
প্রশ্নঃ ওলামায়ে কেরাম সাধারণত বলে থাকেন যে, তারাবীহ আউয়াল ওয়াক্তে (এশার সাথে) পড়া ভালো এবং তারাবীহ জামায়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ যদি কোনো মহল্লায় জামায়াতসহ তারাবীহ পড়া না হয়, তাহলে মহল্লাবাসী গোনাহগার হবে। আর যদি দুজন মিলেও মসজিদে তারাবীহ পড়ে তাহলে সকলের পক্ষ থেকে জামায়াত ত্যাগের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। একথা কি ঠিক? যদি তাই হয়। তাহলে হযরত আবু বকর (রা) এর যামানায় কেন তা হয়নি? তাহলে সে সময়ের মুসলমানদের ওপর কি হুকুম হবে? জামায়াত সহ তারাবীহ না পড়ার কারণে তারা কি গোনাহগার ছিলেন?
জবাবঃ নবী (স) এর যামানা থেকে শুরু করে হযরত ওমর (রা) এর প্রাথমিক কার পর্যন্ত রীতিমতো এক জামায়াতে সকল লোকের তারাবীহ পড়ার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। বরঞ্চ লোক হয়তোবা আপন আপন ঘরে পড়তো কিংবা মসজিদে আলাদা আলাদাভাবে ছোট ছোট জামাত করে পড়তো। হযরত ওমর (রা) যা কিচু করেন তাহলো এই যে, এ বিচ্ছিন্নতা দূর করে সকলকে একটি জামায়াতের আকারে নামায পড়ার হুকুম দেন। তার জন্যে হযরত ওমর (রা) এর নিকটে এ অকাট্য যুক্তি ছিল যে, নবী (স) এর ধারাবাহিকতা একথা বলে বন্ধ করে দেন যে, তা কোনো দিন ফরয না হয়ে যায়। তারপর নবী (সা) এর অতীত হওয়ার পর এ আশংকা আর রইলো না যে, কোনো কাজের দ্বারা এ জিনিস ফরয বলে গণ্য হবে। এ জন্যে হযরত ওমর (রা) সুন্নাত হিসেবে তা জারী করেন। এ ছিল হযরত ওমর (রা) এর দীন সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার এক অন্যমত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে, তিনি শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যার ফলে তিনি উম্মতের মধ্যে একটা সঠিক তরীকা প্রচলিত করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা) এর মধ্যে কারো এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন না করা, বরঞ্চ তা নতশিরে মেনে নেয়া একথাই প্রমাণ করে যে, তিনি শরীয়াত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবেই পূরণ করেছেন যে, তাকে যেন ফরযের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া না হয়।
অন্ততপক্ষে একবার তো তার তারাবীতে শরীক না হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। একবার তিনি আবদুর রহমান বিন আবদের সাথে বাইরে বের হয়ে মসজিদে লোকদেরকে তারাবীহ পড়তে দেখে তার প্রশংসা করেন। যার ভিত্তিতে আলেম সমাজ একথা বলেন যে, যে বস্তিতে মোটেই তারাবীর নামায জামায়াতসহ পড়া হয় না সে মহল্লায় সকল লোক গুনাহগার হবে, তাহলে এই যে, তারাবীহ ইসলামের এমন একটি সুন্নাত যা খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে গোটা উম্মতের মধ্য প্রচলিত আছে, ইসলামের এমন এক পদ্ধতি পরিত্যাগ করা এবং বস্তির সব লোক মিলে পরিত্যাগ করা দীন থেকে বেপরোয়া হওয়ার আলম। তা যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে ক্রমশ তার থেকে ইসলামের সকল রীতি পদ্ধতি মিটে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।)
তারাবীহ নামাযের রাকায়াতসমূহ
সাহাবীগণের ইজমা থেকে প্রমাণিত যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত। বিশ রাকায়াত এভাবে পড়তে হবে যে, দু দু রাকায়াতের পর সালাম ফিরাতে হবে এবং প্রত্যেক চার  রাকায়াত পর বিশ্রামের জন্যে এতোটা সময় বসতে হবে যতোটা সময়ে চার রাকায়াত পড়া যায়। বিশ্রামের জন্যে এতোটুকু সময় বসা মুস্তাহাব। তবে যদি অনুভব করা হয় যে, মুক্তাদীগণ এতক্ষণ বসতে পেরেশানি বোধ করেন তাহলে ততোক্ষণ না বসা ভালো। এ ব্যাপারে মুক্তাদীদের ভাবাবেগের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।
আহলে হাদীসের মতে আট রাকায়াত তারাবীহ পড়া সুন্নাত। তাদের মতে বিশ রাকায়াত পড়া সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।তাদের মতে অধিকাংশ রেওয়াতের আট রাকায়াতের এবং হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) এর যে রেওয়ায়েতে বিশ রাকায়াতের কথা বলা হয়েছে তা অন্যান্য হাদিসগুলোর তুলনায় দুর্বল। আল্লামা মওদূদী (র) এ বিষয়ে যে অভিমত প্রকাশ করেনে তা নিম্নে দেয়া হলোঃ
হযরত ওমর (রা) এর জামানায় যখন জামাতের সাথে তারাবী পড়ার সিলসিলা শুরু হল তখন সাহাবীগণের সর্বসম্মতিক্রমেই বিশ রাকায়াত পড়া হত। হযরত ওসমান গনী (রা) হযরত আলী (রা) এর জামানায় এ নিয়ম মেনে চলা হত। তিনজন খলীফা এ বিষয় একমত হওয়া এবং এ ব্যাপারে মতবিরোধ না করা এ কথারই প্রমাণ যে, নবী (স) এর যুগ থেকেই লোক বিশ রাকায়াত পড়তেই অভ্যস্ত। এ কারনেই ইমাম আবু হানীফা (র) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বিশ রাকাতের পক্ষেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর সপক্ষে ইমাম মালেকেরও এর একটি উক্তি পাওয়া যায়। দাইদ যাহেরী (র) একে প্রমাণিত সুন্নাত বলে মেনে নিয়েছে।
হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজ (র) এবং আবান ইবনে ওসমান বিশের পরিবর্তে ছত্রিশ রাকায়াত পড়ার নিয়ম শুরু করেন। তার কারণ এ ছিল না যে, তাদের তাহকীক ও তথ্যানুসন্ধান খোলাফায়ে রাশেদীনের তাহকীকের বিপরীত ছিল। বরঞ্চ তাদের লক্ষ ছিলো যাতে করে ছওয়াবের দিক দিয়ে মক্কার বাইরের লোক মক্কাবাসীদের সমান হতে পারে। মক্কাবাসীদের নিয়ম ছিলো এই যে, তারা তারাবীর প্রত্যেক চার রাকাআত পর কাবা ঘরের তাওয়াফ করতেন। এ দুই বুযুর্গ প্রত্যেক তাওয়াফের বদলে চার রাকায়াত পড়া শুরু করেন। এ নিয়ম যেহেতু মদীনাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং যেহেতু ইমাম মালেক মদীনাবাসীদের আমলকে সনদ মনে করতেন। সে জন্য তিনি পরবর্তীকালে বিশ রাকায়াতের স্থলে ছত্রিশ রাকায়াতের ফতোয়া দেন।
চার রাকায়াত পরপর বিশ্রামের সময় কি আমল করা যায়
তারাবীহ বা বিশ্রামের সময় ইচ্ছা করলে কেউ চুপচাপ বসেও থাকতে পারে অথবা মসবীহ পড়তে পারে এবং ইচ্ছা করলে নফল পড়তে পারে। মক্কা মুয়াযযমার লোক বসে থাকার পরিবর্তে তা্ওয়াফ করতেন। মদীনাবাসী চার রাকায়াত নফল পড়ে নিতেন। কতিপয় ফকিহ বলেন যে, তারাবীর সময় নিম্নের দোয়া পড়বেঃ
*******আরবী*********
বাদশাহ শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতি অক্ষমতা থেকে পাক পবিত্র। পাক ও মহান সত্তা যিনি, সকল সম্মান, শ্রদ্ধা, মহত্ব, ভয়ভীতি, শক্তিমত্তা, বড়ত্ব,পরাক্রমশীলতার অধিকারী। পবিত্র সেই সত্তা, যিনি চির জীবিত, যার নিদ্রা ও মৃত্যু নেই। তিনি পাক পবিত্র ও ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে । তিনি আমাদের রব এবং ফেরেশতাকুল এবং জিবরাঈলের রব প্রভু পরওয়ারদেগার। হে রব! আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দাও।
বেতের নামাজের জামাত
শুধু রমজান মাসে বেতের নামাজ জামায়াতে পড়া প্রমাণিত আছে। রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতের জামায়াতে পড়া যায়েজ নেই।
*******আরবী*********
রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতেরের জামায়াত যায়েজ নেই। এতে মুসলিম উম্মতের ইজমা রয়েছে। (হেদায়া)
যারা একাকী নামাজ পড়লো তারাও জামায়াতে বেতেরের নামাজ পড়তে পারে। কিন্তু যারা তারাবীহ জামায়াতে পড়লো তাদের জন্য বেতের জামায়াতে পড় জরুরী। কারণ তারাবীর সুন্নাত নামাজ জামাতে পড়ার পর বেতেরের ওয়াজিব নামাজ একা পড়া দুরস্ত নয়। এটাও ঠিক নয় যে, তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ে শুয়ে পড়বে এবং পরে তাহাজ্জুদের সাথে বেতের পড়বে।
তারাবীতে কুরআন খতম
রমজান মুবারকের পুরো মাসে একবার কুরআন পাক ক্রমানুসারে খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (ইলমুল ফেকাহ)
নবী করীম (স) প্রতি মাসে হযরত জিবরাঈল আমীন (আ ) কে পুরো কুরআন শুনিয়ে দিতেন। যে বছর তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন, সে বছর জিবরাঈলকে তিনি দুবার কুরআন শুনিয়ে দেন। উম্মতকে তিনি এভাবে উব্ধুদ্ধ করেনঃ
রোজা ও কুরআন মুমিনের জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে আমার রব! আমি এ ব্যক্তিকে দিনের বেলায় খানা পিনা ও অন্যান্য সম্ভোগ থেকে বিরত রাখলাম এবং সে বিরত থাকলো। অতএব হে আমার রব! এ লোকের পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করো। কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বিরত রেখেছি। এবং সে তার মিষ্টি ঘুম ছেড়ে দিয়ে তোমার দরবারে দড়িয়ে দাড়িয়ে কুরআন পড়তে থাকে। অতএব হে আমার রব! এ ব্যক্তির পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল কর। আল্লাহ উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন।(মিশকাত)
সাহাবায়ে কেরাম (রা) এ সুন্নাত যত্ন সহকারে পালন করেন। হযরত ওমর (রা) তারাবীহ নামায জামায়াত সহ পড়ার এবং এতে পুরো কুরআন শুনাবার বিশেষ ব্যবস্থা করতেন। দীন থেকে সাধারণ সম্পর্কহীনতা, লোকের অলসতা ও অমনোযোগিতার কারণে এ সুন্নাত ছেড়ে দেয়া কিছুতেই ঠিক নয়। অন্তত একবার তো তারাবীর মধ্যে পুরো কুরআন শুনার এবং শুনাবার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই করা উচিত। আর যেখানে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাবে, ইবাদাত ও কুরআন তেলাওয়াত অনুরাগ দেখা যাবে এবং নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, কুরআন পাক পূর্ণ মনোযোগ ও আদবের সাথে থেমে থেমে এমনভাবে পড়া যাবে যে, তেলাওয়াতের হক আদায় হবে, সেখানে একাধিকবার খতম করাও পছন্দনীয় কাজ বলা হয়েছে। অবশ্যই তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা ঠিক নয়। কারণ এ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতের হক আদায় করা যাবে না।
নবী (সা) এর তেলাওয়াতের ধরণ হাদীসে এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে যে তিনি এক একটি অক্ষর সুস্পষ্ট করে এবং এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন। তিনি উম্মতকে তারতীলের সাথে এবং থেমে থেমে তেলাওয়াত করার ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে বলেন-কুরআন পাঠকারীদের কেয়ামতের দিন বলা হবে- তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে থেমে থেমে খোশ এলাহানের সাথে সেজেগুজে কুরআন পড়তে ঠিক তেমনিভাবে পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময় এক স্তর ওপরে ওঠাতে থাক। তোমরা তেলাওয়াতের সর্বশেষ আয়াতের নিকটেই তোমার বাসস্থান পাবে। (তিরমিযি)
জরুরী হেদায়াত
যদি কোথাও নামায ও কুরআনের প্রতি অনুরাগ অসাধারণ কম হয় এবং মুক্তাদীদের অলসতা ও অবহেলার কারণে এ আশংকা হয় যে, যদি তারাবীতে পুরো কুরআন খতম করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তা শুধু লোকের ওপর বোঝাই হবে না, বরঞ্চ মসজিদে আসা এবং জামায়াতে নামায পড়া তারা এড়িয়ে চলতে থাকবে, এমন অবস্থায় খতমে কুরআনের ব্যবস্থা না করাই ভালো। তখন সংক্ষিপ্ত সূরা দিয়ে তারাবীহ পড়তে হবে যাতে করে তারাবীর সুন্নাত থেকে মানুষ বঞ্চিত না হয়। কিছু লোক জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারাবীতে কুরআন শুনা এবং শুনানোকে আসল উদ্দেশ্যে মনে করে। তারা তারাবীর নামাযে শান্ত পরিবেশ, ভারসাম্য এবং একাগ্রতার দিকে মোটেই লক্ষ্য রাখে না। এসব লোক যখন তারাবীতে গোটা কুরআন অত্যন্ত দ্রুতবেগে শুনে, তখন তারা পুনরায় না তারাবীহ পড়ার প্রতি যত্ন নেয় আর না জামায়াতে তারাবীহ পড়ার জন্যে মসজিদে আসা প্রয়োজন মনে করে। এ ধরনের চিন্তা অত্যন্ত মারাত্মক। যদি পুরো কুরআন শুনার সুযোগ না হয়, অথবা কুরআন খতম হয়ে যায়, তারপরও তারাবীর নামায এক স্থায়ী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এর ব্যবস্থাপনায় কখনো অবহেলা প্রদর্শন করা উচিত নয়।
তারাবীহ নামাযের বিভিন্ন মাসায়েল
১. তারাবীর নিয়ত এভাবে করবে- দু রাকায়াত সুন্নাত তারাবীর নিয়ত করছি। তারপর দু রাকায়াতের নিয়ত। এমনিভাবে দশ সালাম সহ বিশ রাকায়াত পুরো করতে হবে।
২. তারাবীর পর বেতের পড়া উৎকৃষ্ট। কিন্তু কোনো কারণে যদি তারাবীহ পড়ার পূর্বে অথবা সমস্ত তারাবীহ পড়ার পূর্বে বেতের নামায পড়া হয়, তো জায়েয হবে।
৩. যদি কোনো মুক্তাদী বিলম্বে এলো এবং তার কিছু তারাবীহ বাকী থাকতে ইমাম বেতেরের জন্য দাঁড়ালো, তাহলে তার উচিত ইমামের সাথে বেতের পড়া। তারপর বাকী তারাবীহ পরে পুরো করবে।
৪. চার রাকাআত পড়ার পর এতো সময় পর্যন্ত আরাম নেয়া মুস্তাহাব যতো সময়ে চার রাকায়াত পড়া হয়েছে। কিন্তু বেশীক্ষণ বসা যদি মুক্তাদীদের জন্যে কষ্টকর হয় তাহলে অল্প সময় বসা ভালো।
৫. যদি কেউ এশার ফরয না পড়ে তারাবীহ শরীক হয় তাহলে তার তারাবীহ দুরস্ত হবে না।
৬. কেউ যদি এশার ফরয জামায়াতে পড়লো এবং তারাবীহ জামায়াতে পড়লো না, তার জন্যেও বেতের নামায জামায়াতে পড়া দুরস্ত হবে।
৭. যদি কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়লো না, সেও বেতের নামায জামায়াতে পড়তে পারে।
৮. বিনা ওজরে বসে তারাবীহ পড়া মাকরূহ। অবশ্য ওজর থাকলে বসে পড়া দুরস্ত।
৯. কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়তে পারলো না, তার জন্যে তারাবীর নামায জামায়াতে পড়া জায়েয।
১০. ফরয ও বেতের এক ইমাম এবং তারাবীহ দ্বিতীয় কোনো ইমাম পড়াতে পারে। হযরত ওমর (রা) ফরয এবং বেতের স্বয়ং পড়াতেন এবং তারাবীহ পড়াতেন হযরত ওবাই বিন কায়াব (রা)।
১১. যদি তারাবীর কয়েক রাকায়াত কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা পুনরায় পড়া জরুরী। তখন কুরআন পাকের ঐ অংশও পুনরায় পড়া উচিত যা নষ্ট হওয়া রাকায়াতগুলোতে পড়া হয়েছে যাতে কুরআন খতম সহীহ নামাযে হয়।
১২. তারাবীতে দ্বিতীয় রাকায়াতে বসার পরিবর্তে ইমাম দাড়িয়ে গেল, যদি তৃতীয় রাকায়াতের সেজদার পূর্বে তার মনে পড়ে যায় অথবা কোনো মুক্তাদী মনে করিয়ে দেয় তাহলে ইমামের উচিত বসে যাওয়া এবং তাশাহুদ পড়ে এক সালাম ফিরিয়ে সেজদা সাহু দেবে, তারপর নামায পুরো করে সালাম ফিরাবে। তাতে করে এ দুরাকায়াত সহীহ হবে। আর যদি তৃতীয় রাকায়াতে সেজদা করার পর মনে পড়ে তাহলে এক রাকায়াত তার সাথে মিলিয়ে চার রাকায়াত পুরো করবে। এ চার রাকায়াত দু রাকায়াতের স্থলাভিষিক্ত হবে।
১৩. যদি ইমাম দ্বিতীয় রাকায়াতে কাদার জন্যে বসে পড়ে এবং তারপর তৃতীয় রাকায়াতের জন্যে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ অবস্থায় চার রাকায়াত পুরো করে তাহলে চার রাকায়াতই সহীহ হবে।
১৪. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি তাদের জন্যে তারাবীহ জামায়াতে পড়া দুরস্ত নয়। এজন্যে যে ফরয নামায একা পড়ে নফল নামায জামায়াতে পড়লে নফলকে ফরযের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। তার দুরস্ত নয়।
১৫. কেউ যদি মসজিদে এমন সময় পৌঁছে যখন এশার ফরয হয়ে গেছে তাহরে সে প্রথমে ফরয পড়বে তারপর তারাবীতে শরীক হবে। তারাবীর যেসব রাকায়াত বাদ যাবে সেগুলো হয় বিরতির সময় পড়ে নেবে অথবা জামায়াতে বেতের পড়ার পর পড়বে।
১৬. কিছু লোক এশার ফরয নামায জামায়াতে পড়ার পর তারাবীহ জামায়াত করে পড়েছে। তাদের সাথে ঐসব লোকও শরীক হতে পারে যারা ফরয জামায়াতে পড়েনি। এজন্যে যে, এরা ঐসব লোকের অনুসরণ করেছে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে তারাবীহ জামায়াতের সাথে পড়ছে।
১৭. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি একা পড়েছে তারাও ঐসব লোকের সাথে বেতেরের জামায়াতে শরীক হতে পারে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে বেতের জামায়াতে পড়ছে।
১৮. আজকাল শবীনার যেরূপ রেওয়াজ হয়ে পড়েছে তা কিছুতেই জায়েয নয়। শবীনা পাঠকারী একান্ত বেপরোয়া হয়ে দ্রুতবেগে পড়ে যায়। তার না শুদ্ধ অশুদ্ধ পড়ার কোনো চিন্তা থাকে আর না তেলাওয়াতের আদবের দিকে সে খেয়াল করে। এ ধরনের কেরায়াত থেকে প্রভাব ও হেদায়াত গ্রহণ করার কোনো অনুভূতিই হয় না। কোনো প্রকারে খতম করাই হয় পাঠকারীর উদ্দেশ্যে। তারপর মুক্তদীদের অবস্থা এই হয় যে, কয়েকজন ইমামের পেছনে দাড়িয়ে থাকে বটে, কিন্তু অধিকাংশই কয়েক রাকায়াত মাত্র ইমামের সাথে পড়ে। অনেকে পেছনে বসে বসে গল্প করে। ইমামের দ্রুত পড়ার প্রশংসা করে এবং নানান ধরনের গল্প গুজব করে। এটা সে রাতের নামায ও তেলাওয়াত নয় যা নবী (স) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা সুন্নাত মনে করে সাহাবায়ে কেরাম রীতিমতো পালন করতেন। এ প্রকৃতপক্ষে কুরআনের সাথে যুলুম ও বাড়াবাড়ি করা এবং তারাবীর বিদ্রূপ করা।
কুরআন বলেঃ
*******আরবী*********
এ কিতাব কল্যাণ ও বরকতের উৎস যা আমরা তোমার ওপর নাযিল করেছি যাতে লোক তার আয়াতগুলোর ওপর চিন্তা-গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ তার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ২৯)
নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করলো। সে কিছুতেই কুরআন বুঝলো না। (তিরমিযি)
কুরআন বলে- যখন কুরআন পড়া হয় তখন পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তা শুনো।
১৯. তারাবীতে কুরআন পড়ার নিয়ম এই যে, কোনো এক সূরায় বিসমিল্লাহ উচ্চস্বরে পড়তে হবে। কারণ এ কুরআনের একটি আয়াত। পুরে কুরআন পাঠকারীকে বিসমিল্লাহ পড়তে হবে এবং শ্রবণকারীকে শুনতে হবে। এজন্যে হাফেযকে উচ্চস্বরে পড়তে হবে। সাধারণত কুল হু আল্লাহ এর প্রথমে বিসমিল্লাহ পড়া হয়। এটা জরুরী নয়। যে কোনো সুরার শুরুতে পড়া যায়। যে কোনো সুরার সূতে পড়া উচিত যাতে করে লোকের এ ভুল ধারণা দূর হয় যে, কুল হু আল্লাহ এ শুরুতে পড়তে হয়। যাদের মতে এ প্রত্যেক সূরায় একটি আয়াত তাদের উচিত তারাবীর নামাযে প্রত্যেক সুরার শুরুতে তা পড়বে। হানাফী মতে বিসমিল্লাহ কুরআন মজীদের একটি আয়াত। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী এবং মক্কা ও কুফার ক্বারীগণের মতে এ প্রত্যেক সূরার একটি আয়াত।
২০. কেউ কেউ তারাবীতে তিনবার কুল হু আল্লাহু পড়ে (কেউ বলেন- কুল হু আল্লাহ তিনবার পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু নামাযে নয়, নামাযের বাইরে) তা পড়া মাকরূহ।
২১. কুরআন খতম করার পর সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার কুরআন শুরু করা সুন্নাত। নবী (সা) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ কাজ পছন্দ করেন যে, কেউ কুরআন খতম করলে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার শুরু করে ………………… পর্যন্ত পড়বে।
কুরআন তেলাওয়াতের নিয়মনীতি
১। তাহারাত পাক পবিত্রতা
কুরআন পাক আল্লাহ পাকের পবিত্র ও মহান কালাম। তাতে হাত লাগাতে এবং তেলাওয়াত করার জন্যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পুরোপুরি ব্যবস্থা দরকার। অযু না থাকলে অযু করা এবং গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল করা অপরিহার্য।
*******আরবী*********
তাতে সে ব্যক্তিই হাত লাগাতে পারে যে একান্ত পাক পবিত্র। (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৭৯)
হায়েয নেফাস ও জানাবাতের (গোসল ফরয হওয়া) অবস্থায় কুরআন শুনা তো জায়েয, কিন্তু পড়া এবং স্পর্শ করা হারাম। বিনা অযুতে পড়া জায়েয কিন্তু স্পর্শ করা ঠিক নয়। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) সকল অবস্থায় তেলাওয়াত করতেন এবং বিনা অযুতেও। কিন্তু জানাবাতের অবস্থায় কখনো তেলাওয়াত করতেন না। হযরত ওমর (রা) বলেন, হায়েয হয়েছে এমন নারী এবং গোসল ফরয হয়েছে এমন লোক কুরআন থেকে কিছুই পড়বে না। (অর্থাৎ এমন অবস্থায় কুরআন পড়া হারাম) (তিরমিযি)
২। কুরআন তেলাওয়াতের সময় নিয়ত খাটি হওয়া উচিত। তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং হেদায়াত চাওয়া। কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করা। নিজের খোশ এলহানের ওপর গর্ব করা, নিজের দীনদারির ঢাকঢোল পেটানো, লোকে প্রশংসা করুক এমন বাসনা পোষণ করা নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা। এমনিভাবে যারা মানুষ দেখানো কুরআন পড়ে অথবা দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্যে কুরআন পড়ে তারা কখনো কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করবে না। এস লোক কুরআন পড়া সত্ত্বেও কুরআন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। প্রকৃতপক্ষে যে নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা, অসৎ প্রবণতা এবং অসাধু উদ্দেশ্যে পোষণ করে,তার মধ্যে কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে না কোনো অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে, আর না কুরআনের পরিচয় ও নিগূঢ় তত্ত্ব লাভ করতে পারে।
৩। নিয়মিত পাঠ এবং একে অপরিহার্য মনে করা
কুরআন পাঠ দৈনিক নিয়মিতভাবে হওয়া উচিত। কোনো দিন বাদ না দিয়ে দৈনিক পড়া মুস্তাহাব। তেলাওয়াত যে কোনো সময়ে করা যায় কিন্তু উপযুক্ত সময় হচ্ছে সকাল বাদ ফজর। যাদেরকে আল্লাহ কুরআন হিফয করার সৌভাগ্য দিয়েছেন তাদের তো দৈনিক পড়া এজন্যে নেহায়েত জরুরী যে, না পড়লে মনে থাকবে না। আর কুরআন পাক মুখস্থ করার পর ভুলে যাওয়া কঠিন গোনাহের কাজ। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাক মুখস্থ করেছে, তারপর ভুলে গিয়েছে সে কেয়ামতের দিন কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হবে। (বুখারী)
নবী (সা) আরও বলেন-
কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করো, নতুবা এ তোমাদের বক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম, রশি ঢিল করলে যেমন উট পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি সামান্য অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাবের জন্যে কুরআন বক্ষ থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। (মুসলিম)
নিয়মিত তেলাওয়াতের প্রেরণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়লো এবং দৈনিক নিয়মিত তেলাওয়াত করতে থাকলো, তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ থলিয়ার মতো যার সুগন্ধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়া শিখেছে কিন্তু তা তেলাওয়াত করে না তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ বোতলের মতো যা কর্ক বা ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে। (তিরমিযি)
খোশ এলহানের সাথে তেলাওয়াত করার বিরাট সওয়াব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, কেয়ামতের দিনে কুরআন পাঠকারীদের বলা হবে, তোমরা যেমন থেমে ও খোশ এলহানে দুনিয়ায় কুরআন পড়তে তেমনি পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে এক একটি স্তর ওপরে উঠতে থাক। তোমার ঠিকানা হবে তোমার শেষ আয়াতের নিকটে। (তিরমিযি)
রাগ-রাগিনীসহ কুরআন পাঠ মাকরূহ তাহরীমি। এর থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনা
উৎসাহ উদ্দীপনাসহ কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনাও হওয়া উচিত। হযরত খালেদ বিন মাদান বলেন, কুরআন শুনার সওয়াব কুরআন পড়ার দ্বিগুণ। (দারেমী)
নবী (সা) অন্যের কুরআন পড়ার শুনতে বড়ো ভালবাসতেন। একবার তিনি হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কে বললেন, আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বললেন, হুজুর আপনাকে কুরআন শুনাবো? কুরআন তো আপনার ওপরে নাযিল হয়েছে। নবী (সা)বললেন, হ্যাঁ শুনাও। কেউ পড়লে তা শুনতে আমার বড়ো ভালো লাগে। তখন হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) সূরা নিসা পড়া শুরু করলেন। যখন তিনি পড়লেন-
*******আরবী*********
চিন্তা করে দেখ, তখন কি অবস্থা হবে যখন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষ্যদাতা নিয়ে আসব এবং তাদের ওপর তোমাকে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দাঁড় করাব। (সূরা আন নিসাঃ৪১)
তখন নবী (সা) বললেন, থাম, থাম।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি দেখলাম নবী (স)এর দু চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। (বুখারী)
হযরত আবু মূসা (রা) খুব সুন্দর কুরআন পড়তেন। যখনই তার সাথে হযরত ওমর (রা) এর দেখা হতো, তিনি বলতেন, আবু মূসা, আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ করিয়ে দাও। তখন আবু মূসা কুরআন তেলাওয়াত শুরু করতেন। (সুনানে দারেমী)
৫। চিন্তা গবেষণা
কুরআন বুঝে শুনে পড়া, তার আয়াতগুলোর ওপরে চিন্তা গবেষণা করা এবং  তার দাওয়াত ও হেকমত আয়ত্ত করার অভ্যাস করা উচিত। এ সংকল্প নিয়ে তেলাওয়াত করা উচিত যে, তার আদেশগুলো মানতে হবে এবং নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহর কেতাব তো এজন্যেই নাযিল হয়েছে যে, তা বুঝে শুনে পড়তে এবং তার হুকুমগুলোর ওপর আমল করতে হবে।
আল্লাহ বলেনঃ
*******আরবী*********
যে কেতাব তোমার ওপরে নাযিল করেছিলাম তা বরকতপূর্ণ যাতে করে তারা এর আয়াতগুলো ওপর চিন্তা গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ ২৯)
ফর ফর করে দ্রুত কয়েক সূরা পড়ার চেয়ে অল্প কিছু চিন্তা ভাবনা করে ও বুঝে পড়া অনেক ভালো। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেনঃ ক্বাদর এবং আল কারি’আ এর মতো ছোট ছোট সূরা বুঝে পড়া অনেক ভালো ফর ফর করে আল  ইমরান এবং বাকারা পড়ার চেয়ে।
নফল নামাযে এটাও জায়েয যে, কেউ একই সূরা অথবা একই আয়াত বার বার পড়বে। তার মর্মকথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করবে এবং মহব্বতের সাথে বার বার পড়বে। একবার নবী (সা) একই আয়াত বারবার সারারাত পড়তে থাকনে এবং এভাবে ভোর হয়ে যায়। আয়াতটি হলো-
*******আরবী*********
হে রব! তুমি যদি তাদেরকে আযাব দাও তাহলে এরা তো তোমার বান্দাহ। আর যদি ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ। (সূরা আল মায়েদাঃ ১১৮)
অবশ্য কুরআনের অর্থ ও মর্ম না জেনে তেলাওয়াত করারও বিরাট সওয়াব রয়েছে কিন্তু যে তেলাওয়াতের দ্বারা অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাযকিয়া হয় এবং আমলে প্রেরণা সঞ্চার হয় তাহলো বুঝে শুনে পড়া।
নবী (সা) বলেনঃ লোহা যেমন পানিতে জং ধরে, তেমনি অন্তরে জং ধরে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে এ জং দূর করার উপায় কি? নবী (স) বললেন, বেশী বেশী মৃত্যুতে স্মরণ করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা।
তাওরাতে আছে, আল্লাহ বলেন, বান্দাহ! তোমার লজ্জা করেন যে, যখন সফরে তোমার কাছে তোমার ভাইয়ের চিঠি আসে তখন তুমি থেমে যাও অথবা রাস্তা থেকে সরে গিয়ে বসে পড় এবং তার এক একটি অক্ষর পড়তে থাক ও তার ওপর চিন্তা গবেষণা কর। আর এক কেতাব (তাওরাত) হচ্ছে আমার ফরমান যা তোমার জন্যে পাঠিয়েছি যাতে করে তুমি সবসময় চিন্তা-গবেষণা করতে পার এবং তার হুকুমগুলো মেনে চলতে পার। কিন্তু তুমি এটা মানতে অস্বীকার করছো এবং তার হুকুম মেনে চলতে গড়িমসি করছ আর যদি তা পড় তো তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা কর না। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)
হযরত হাসান বসরী (রা) বলেন, ইসলামের প্রথম যুগের লোকেরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন যে, কুরআন হচ্ছে আল্লাহর ফরমান এবং তার পক্ষ থেকে  এ নাযিল হয়েছে। বস্তুত তারা রাতের বেলায় গভীর মনোনিবেশ সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং দিনের বেলায় তার হুকুমগুলো মেনে চলতেন। কিন্তু তোমাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা শুধুমাত্র তার শব্দগুলো পড় এবং অক্ষরগুলোর যের যবরও দুরস্ত কর। কিন্তু আমলের দিক দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, তোমরা এ ব্যাপারে একেবারে পেছনে রয়েছ। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)
৬। একনিষ্ঠা ও বিনয়
পূর্ণ একাগ্রতা, আগ্রহ ও বিনয় নিষ্ঠার সাথে কেবলা মুখী হয়ে তেলাওয়াত করা উচিত। তেলাওয়াতের সময় অবহেলা করে ও বেপরোয়া হয়ে, এদিক সেদিক তাকানো, কারো সাথে কথাবার্তা বলা, এমন কোনো কাজ করা যাতে একাগ্রতা নষ্ট হয় এসব কিছুই মাকরূহ বা অবাঞ্ছিত কাজ।
৭। তাউয-তাসমিয়া
তেলাওয়াত শুরু করার সময় *******আরবী****** পড়া উচিত।মাঝে অন্য কোনো কাজের দিক মন দিলে কিংবা কারো সাথে কথাবার্তা বললে পুনরায় *****আরবী********* পড়া উচিত। নামাযের বাইরে প্রত্যেক সূরার শুরুতে পড়া *******আরবী*********মুস্তাহাব। শুধু সূরা তাওবার শুরুতে *******আরবী********* না পড়া উচিত।
৮। তেলাওয়াতের সময় কুরআন পাকের বিষয়বস্তু থেকে প্রভাব গ্রহণ এবং তা প্রকাশ করা মুস্তাহাব। (কিন্তু এ ব্যাপারে অত্যন্ত হুশিয়ার ও সজাগ থাকতে হবে। কারণ রিয়া মানুষের সকল নেক আমল  বরবাদ করে দেয়।) যখন পুরস্কার এবং জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতের উল্লেখ করা হয় এবং মুমিনদেরকে রহমত ও মাগফিরাতের কল্যাণ ও নাজাতের, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দীদারের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন আনন্দিত হওয়া উচিত। আর যখন আল্লাহর রাগ ও গজব, জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি, জাহান্নামবাসীর আর্তনাদ প্রভৃতির উল্লেখ সম্বলিত আয়াতগুলো পড়া হবে, তখন তার ভয়ে কাদা উচিত। যদি কান্না না আসে তো কান্নার চেষ্টা করতে হবে। নবী (স) তেলাওয়াতের সময় আযাবের আয়াত পড়ে দোয়া করতেন এবং ক্ষমা করে দেয়ার আয়াত পড়লে তাসবিহ পড়তেন।
৯। আওয়াজে ভারসাম্য
তেলাওয়াত অতি উচ্চস্বরে ও অতি নিম্নস্বরে নয় বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বরে পড়তে হবে যেন নিজের মনও সেদিকে আকৃষ্ট হয় এবং শ্রোতাদের শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাহলে চিন্তা-ভাবনার দিকে মন আকৃষ্ট হবে।
কুরআন বলেঃ
*******আরবী*********
এবং নামায বেশী উচ্চস্বরে পড়ো না, আর না একেবারে নিম্নস্বরে। বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বর অবলম্বন করবে। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১১০)
১০। তাহাজ্জুদে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন
তেলাওয়াত যখনই করা হোক না কেন তা প্রতিদান ও সওয়াবের বিষয় এবং হেদায়াতের কারণ হয়, কিন্তু বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযে কুরআন তেলাওয়াতের ফযিলত সবচেয়ে বেশী। আর একজন মুমিনের এটাই আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত যে, সে উচ্চ থেকে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করে। তাহাজ্জুদের মনোরম সময় রিয়া, প্রদর্শনী ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত; লিল্লাহিয়াত ও আল্লাহর দিকে একমুখী হওয়ার উৎকৃষ্টতম এক পরিবেশ, বিশেষ করে মানুষ যখন আল্লাহর সামনে দাড়িয়ে একনিষ্ঠা ও আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করতে থাকে। নবী (স) তাহাজ্জুদে লম্বা তেলাওয়াত করতেন।
১১। কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন
নামায ছাড়া অন্য সময় কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াত করলে অধিক সওয়াব ও উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়। একেতো তেলাওয়াত করার সওয়াব দ্বিতীয়তঃ কালামুল্লাহকে হাতে স্পর্শ করার এবং স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সওয়াব ও বদলা। (এতকাল)
১২। ক্রমিক পদ্ধতির লক্ষ্য
কুরআনে যে ক্রমিক পদ্ধতি রয়েছে সূরাগুলো সে ক্রমানুসারে পড়া উচিত। অবশ্যই শিশুদের পাট সহজ করার জন্যে এ ক্রমিক ধারা অবলম্বন না করা পড়া জায়েয। যেমন আমপারা সূরা নাস থেকে উল্টো দিকে সূরা নাবা পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে কুরআন পাকের ক্রমিক পদ্ধতির খেলাপ তেলাওয়াত করা সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ।
১৩। মনের গভীর একাগ্রতা
অনেকে অযীফা ও যিকির আযকার গভীর একাগ্রতার সাথে করে থাকেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন। কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত ততোটা একাগ্রতার সাথে করেন না। অথচ কুরআন তেলাওয়াতের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো যিকির অযীফা হতে পারে না। এর চেয়ে ভালো তাযকিয়ার নফসের (আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির) উপায় আর কিছু হতে পারে না, কুরআনের ওপরে অন্য কোনো অযীফাকে প্রাধান্য দেয়া দীনকে ভালোভাবে উপলব্ধি না করারই ফল এবং তা গোনাহও বটে। নবী (স) বলেন, বান্দাহ তেলাওয়াতে কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহর বেশী নিকটবর্তী হতে পারে। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)
নবী (সা) বলেন, আমার উম্মতের জন্যে সবচেয়ে ভালো ইবাদাত হচ্ছে তেলাওয়াতে কুরআন।
১৪। তেলাওয়াতের পর দোয়া
তেলাওয়াতের পর নিম্নের দোয়া পড়া সুন্নাতঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ!তুমি কুরআনের অসিলায় আমার ওপর রহম কর, তাকে আমার পথপ্রদর্শক, নূর, হেদায়াত ও রহমত বানিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তার মধ্যে যা কিছু ভুলে যাই তা স্মরণ করিয়ে দাও, আর যা জানি না তা শিখিয়ে দাও এবং আমাকে তাওফিক দাও যেন রাতের কিছু অংশে এবং সকাল সন্ধ্যায় তা তেলাওয়াত করতে পারি। আর হে রাব্বুল আলামীন তুমি তাকে আমার সপক্ষে দলীল প্রমাণ বানিয়ে দাও।