Monday, August 28, 2017

কুরবানীর আহকাম ও মাসায়েল


কুরবানী দাতার জন্যে মসনূন আমল
যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। এ আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। এ কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।
হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল ও নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এ দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন ঐ বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী (স) বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে এ তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
কুরবানীর পশু ও তার হুকুম
১. কুরবানীর পশু নিম্নরূপ:
উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।
২. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু এক ব্যক্তির জন্যে হতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি তাতে অংশীদার হতে পারবে না।
৩. গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সাতজন অংশীদার হতে পারে, তার বেশী নয়। তবে তার জন্য দুটি শর্তঃ
প্রথম শর্ত এই যে, প্রত্যেক অংশীদারের নিয়ত কুরবানী অথবা আকিকার হতে হবে। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত যেন না হয়।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, প্রত্যেকের অংশ ঠিক এক সপ্তমাংশ হবে। তার কম কেউ অংশীদার হতে পারে না।
এদুটো শর্তের মধ্যে কোনো একটি পূরণ না হলে কুরবানী ঠিক হবে না।
৪. উট ও গরু-মহিষে সাতজনেরও কম অংশীদার হতে পারে, যেমন দুই, চার অথবা তার কম বেশী অংশ কেউ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও এ শর্ত জরুরী যে, কোনো অংশীদার সাত ভাগের এক ভাগ এর কম অংশীদার হতে পারবে না। নতুবা কারো কুরবানী ঠিক হবে না।
৫. এক ব্যক্তি গরু খরিদ করলো এবং তার ইচ্ছা যে অন্য লোককে অংশীদার করে কুরবানী করবে। এটা দুরস্ত হবে। যদি খরিদ করার সময় গোটা গরু নিজের জন্যে খরিদ করার নিয়ত করে পরে অন্য লোককে অংশীদার করার ইচ্ছা করে, তাও জায়েয হবে। অবশ্য এটা করা ভালো যে, সে এমন অবস্থায় তা প্রথম ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা পশু নিজের জন্যই কুরবানী করবে। তবে কাউকে শরীক করতে চাইলে সচ্ছল ব্যক্তিকে শরীক করবে, যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এমন ব্যক্তিকে যদি শরীক করা হয় যার কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।
৬. গরু মহিষের কুরবানীতে কেউ এক বা একাধিক অতিরিক্ত লোকের অংশ নিজে নিজেই ঠিক করলো, অংশীদারদের অনুমতি নেয়া হলো না, তাহলে এ কুরবানী জায়েয হবে না। যাদের অংশ রাখা হবে তাদের তাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। এটা করা যাবে না যে, কুরবানীর অংশীদার মনে মনে ঠিক করে প্রথমে কুরবানী করা হলো এবং তারপর অংশীদারের অনুমতি পরে নেয়া হলো।
৭. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পূর্ণ এক বছর বয়সের হলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে। এক বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। গরু মহিষ পূর্ণ দু বছরের হতে হবে। দু বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। উট পাঁচ বছরের হলে কুরবানী হবে। তার কম হলে জায়েয হবে না।
৮. যে পশুর শিং জন্ম থেকে ওঠেনি, অথবা ওঠার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তাহলে তার কুরবানী করা জায়েয হবে। কিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙ্গে যায় তাহলে তা কুরবানী জায়েয হবে না।
৯. অন্ধ, কানা পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যে পশু তিন পায়ের ওপর চলে এমন ল্যাংড়া পশু কুরবানী করাও জায়েয হবে না। চতুর্থ পা যদি মাটিতে রাখে কিন্তু খুড়িয়ে চলে, তাহলে দুরস্ত হবে।
১০. যে পশুর কান এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা অথবা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
১১. দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হলেও মোটাতাজা ও সুন্দর পশু কোরবানী করা ভালো। পশু যদি এমন দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয় যে, তার হাড় একেবারে মজ্জাহীন হয়ে পড়েছে তাহলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) শিং বিশিষ্ট মোটা তাজা একটা দুম্বা কুরবানী করছিলেন যার চোখের চারপাশে কালো রং ছিল, যার মুখও কালো রঙের ছিল এবং যার পাগুলো ছিল কালো রঙের। (আবু দাউদ)
১২. যে পশুর জন্ম থেকেই কান হয়নি অথবা হয়ে থাকলে খুব ছোট ছোট তা কুরবানী করা দুরস্ত হবে।
১৩. যে পশুর দাঁত মোটেই নেই তার কুরবানী করা দুরস্ত হবে না। কিন্তু দাঁত পড়ে গেছে এবং অধিকাংশ দাঁত আছে তাহলে জায়েয হবে।
১৪. খাসি, পাঠা কুরবানী জায়েয। নবী (স) স্বয়ং খাসি দুম্বা কুরবানী করেছেন।
১৫. যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব এমন এক সচ্ছল ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে একটি পশু খরিদ করলো। খরিদ করার পর তার মধ্যে এমন ত্রুটি পাওয়া গেল, যার জন্যে তা কুরবানী করা দুরস্ত হলো না। তখন সে আর একটি পশু খরিদ করে কুরবানী করবে। তবে কোনো দরিদ্র লোকের এমন অবস্থা হলে- যার ওপর কুরবান ওয়াজিব ছিল না, তার পক্ষে ঐ ত্রুটি পূর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হবে।
১৬. গাই-বকরী গর্ভবতী হলেও তা কুরবানী জায়েয হবে। বাচ্চা জীবিত হলে তাও যবেহ করা উচিত।
কুরবানীর হুকুম
১. কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কে একজন জিজ্ঞেস করলো কুরবানী কি ওয়াজিব? তিন বলেন, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় সে প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছ না যে, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন।
২. কুরবানী কারেন এবং মুতামাত্তার ওপরে ওয়াজিব। তবে মুফরেদের ওপর ওয়াজিব নয়। সে যদি আপন ইচ্ছায় করে তাহলে তার সওয়াব পাবে।
৩. হাজীদের ছাড়া অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত এই যে,যে সচ্ছল হবে। সচ্ছল হওয়ার অর্থ তার ততোটা ধন-সম্পদ থাকতে হবে যে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত এতো সম্পদ থাকবে যে, তার হিসেব করলে নেসাব পরিমাণ হবে।
অর্থাৎ যার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।
৫. কোন ব্যক্তির ওপরে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কুরবানী ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়তে পশু খরিদ করেছে। তাহলে সে পশু কুরবানী করা তার ওয়াজিব হবে।
৬. এক ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল, কুরবানীর তিন দিন অতীত হয়ে গেলে কোনো কারণে সে কুরবানী করতে পারলো না। যদি এ উদ্দেশ্যে সে কোনো ছাগল খরিদ করে থাকে তাহলে জীবিত সে ছাগল খয়রাত করে দেবে। খরিদ করে না থাকলে একটি ছাগলের মূল্য খয়রাত করবে।
৭. কেউ এ বলে মানত মানলো যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে কুরবানী করবো। আল্লাহর ফযলে তার সে কাজ হয়ে গেল। এখন সে ব্যক্তি সচ্ছল হোক অথবা অসচ্ছল তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। মানত কুরবানীর হুকুম এই যে, তার সমস্ত গোস্ত গরীব ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে- না কুরবানীকারী খাবে এবং না কোনো সচ্ছল ব্যক্তিকে খাওয়াবে।
কুরবানীর দিনগুলো ও সময়
১. ঈদুল আযহা অর্থাৎ যুলহজ্জের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে কোনো দিনে সুযোগ সুবিধা মতো কুরবানী করা জায়েয। তবে কুরবানী করর সবচেয়ে উত্তম দিন হলো ঈদুল আযহার দিন। তারপর এগারো তারিখে এবং তার বারো তারিখে।
২. শহর ও বন্দরের অধিবাসীদের জন্যে ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী জায়েয নয়। নামাযের পর কুরবানী করবে। তবে গ্রামাঞ্চলের লোক ফজর নামাযের পরও কুরবানী করতে পারে। (সম্ভবত এজন্যে যে, বহু দুর দূরান্তের ঈদগাহ থেকে নামা পড়ে আসতে বহু বিলম্ব হবে এমন কি বিকেল হয়ে যেতে পারে।)
৩. শহরের অধিবাসী যদি তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে করায় তাহলে তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে ফজরের পরও হতে পারে। ঈদের নামাযের পূর্বই যদি গোস্ত এসে যায় তাহলেও কুরবানী জায়েয হবে।
৪. কুরবানীর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময়ে দিনে বা রাতে, কুরবানী করা জায়েয।
তবে রাতে কুরবানী না করা ভালো। কারণ কোনো রগ হয়তো ভালোভাবে কাটা নাও যেতে পারে যার জন্যে কুরবানী দুরস্ত হবে না।
৫. কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত মুকীম হওয়া এবং সচ্ছল হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি সফরে থাকে এবং বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী পৌঁছে এবং সে যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে; সে যদি মুকীম এবং দরিদ্র হয়, কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যদি আল্লাহ তাকে মালদার বানিয়ে দেয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।
কুরবানীর বিভিন্ন মাসায়েল
১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়। শুধু মনের নিয়ত ও ইরাদা কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে মুখে দোয়া পড়া ভালো।
২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার। যেমন নবী (স) হযরত ফাতেমা (রা) কে বলেছিলেন ফাতেমা চল, তোমার কুরবানীর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। এ জন্যে যে, তার প্রতিটি রক্ত কণার বদলায় তোমার পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ফাতেমা বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। একি আমাদের আহলে বায়তের জন্যে নির্দিষ্ট, না সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের জন্যেও এবং সকল মুসলমানদের জন্যেও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)
৩. গরু মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোস্ত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, গুর্দা, কলিজী প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যেতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।
৪. কুরবানীর গোস্ত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বণ্টন করা যায়। এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করলেও কোন দোষ নেই।
৫. গরু মহিষ বা উটে কয়েক ব্যক্তি অংশীদার রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোস্ত ভাগ করে নেয়ার পরিবর্তে যদি সব একত্রে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে।
৬. কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।
৭. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।
৮. কুরবানীর চামড়া নিজের কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন জায়নামাজ বানানো হলো।
৯. কসাইকে গোস্ত বানাবার মজুরী স্বরূপ গোস্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে। রশি, চামড়া প্রভৃতি খয়রাত করতে হবে।
১০. যার ওপর কুরবানী ওয়াজেব তাকে তো করতেই হবে। যার ওপর ওয়াজিব নয়, তার যদি খুব বেশী কষ্ট না হয় তাহলে তারও করা উচিত। অবশ্য ধার কর্জ করে কুরবানী করা ঠিক নয়।
মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানী
আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন সে শুধু তার ওয়াজিব কুরবানী করেই ক্ষান্ত হবে না। বরঞ্চ কুরবানীর অফুরন্ত সওয়াব পাওয়ার জন্যে আপন মুরব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো। এমন কি যার বদৌলতে হেদায়াত ও ঈমানের সম্পদ লাভ সম্ভব হয়েছে এমন হাদী ও মুরশিদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তো মুমিনের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এভাবে আযওয়াজে মুতাহহেরা অর্থাৎ রূহানী মা-দের পক্ষ থেকে কুরবানী করাও অশেষ সৌভাগ্যের কথা।
হাদীর বয়ান
হাদী শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদীয়া তোহফা, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যাকে হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পাঠিয়ে দেয়।
১. হাদী তিন প্রকারঃ উট, গরু, ছাগল। উট সর্বোৎকৃষ্ট হাদী এবং ছাগল সর্বনিম্ন। ভেড়া, দুম্বা প্রভৃতি ছাগলের পর্যায়ে এবং মহিষ প্রভৃতি গরু গাভীর পর্যায়ে।
২. হাদীর পশুর বয়স, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে হুকুম ও শর্ত তাই যা কুরবানীর পশু সম্পর্কে রয়েছে।
৩. হাদী যদি ইচ্ছাকৃত হয়,যেমন ইফরাদ হজ্জকারী আপন  ইচ্ছায় নফল কুরবানী করে। তাহলে সে কুরবানীর গোস্ত হাদীকারী নিজেও খেতে পারে। তেমনি কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারী আপন আপন কুরবানীর গোস্ত খেতে পারে। যেমন সাধারণ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া জায়েয। কারণ কেরান এবং তামাত্তুর হাদী কোনো অপরাধ অথবা ত্রুটি বিচ্যুতির কাফফারা নয়। বরঞ্চ শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারীর ওপর ওয়াজিব করেছেন। এজন্যে সাধারণ কুরবানীর গোস্তের মতো তা খাওয়া জায়েয। নবী (স) তার হাদীর প্রত্যেকটি পশুর এক এক টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন এবং তার শুরবাও পান করেছেন। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের (রা) এর বর্ণনা এবং অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত আছে যে, নবী (স) হজ্জে কয়েকটি কুরবানী করেন।
প্রকাশ থাকে যে, কেরান এবং তামাত্তু তো একটি কুরবানীই হয়ে থাকে এবং বাকীগুলো নফলই হয়ে থাকবে। তিনি যখন প্রত্যেকটি থেকে এক একটা টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন তাহলে জানা গেল যে, তামাত্তু, কেরান এবং নফল তিন প্রকারের গোস্ত কুরবানীকারী স্বয়ং খেতে পারে।
৪. তামাত্তু, কেরান ও ইচ্ছাকৃত নফল কুরবানীর গোস্ত ছাড়া কোনো হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয়। তা সে কোনো অপরাধের কাফফারার হাদী হোক কিংবা মানতের অথবা ইহসাবের দমের (পরিভাষা দ্রষ্টব্য) কুরবানী হোক। নবী (স) যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, তখন তিনি নাজিরা আসালামীর মাধ্যমে ইহসারের হাদী পাঠিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, তার গোস্ত সে যেন না খায় এবং সঙ্গীকেও খেতে না দেয়।
৫. যে হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয় তার সমস্ত গোশত ফকীর মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে এবং তা করা ওয়াজিব। হেরেমের গরীবদের মধ্যে হোক অথবা তার বাইরের হোক উভয়ই জায়েয। হেরেমের গরীবদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। (আয়নুল হেদায়া)
৬. যে হাদীর গোস্ত খাওয়া জায়েয তার সমস্ত গোস্ত ফকীর মিসকিনকে সদকা করা ওয়াজিব নয়। বরঞ্চ মুস্তাহাব। তার তিন ভাগ করা উচিত। এক ভাগ নিজের জন্যে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্যে এবং এক ভাগ ফকীর মিসকিনের জন্যে। তবে এমন করা জরুরী নয়। সমস্তই ফকীর মিসকিনকে দিলেও তা জায়েয হবে।
আবে যমযম, আদব কায়দা ও দোয়া
বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে একটি ঐতিহাসিক কূপ আছে যাকে যমযম বলে। হাদীসে এ কুয়ার অনেক ফযিলত ও তার পানির অনেক বরকত ও ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ ) আল্লাহর হুকুমে যখন হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মা হযরত হাজেরা (আ ) কে মক্কার বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মাতা ও সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্যে যমযম প্রস্রবণ প্রবাহিত করে ছিলেন। হাদীসে আছে-
*******আরবী*********
এ হচ্ছে জিবরাঈলের তৈরী করা কূপ এবং ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের ছোট হাউজ। (দারু কুতনী)
সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন প্রভৃতি শেষে পেট ভরে যমযমের পানি পান করা উচিত। এমন বেশী করে পানি পান করা, যাতে পাঁজরাগুলো ডুবে যায়, এটা ঈমানের আলামত। ঈমান থেকে বঞ্চিত মুনাফিক এতোটা পান করতে পারে না। নবী (স) বলেন আমাদের এবং মুনাফিকদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন এই যে, মুনাফিক যমযমের পানি পেটভরে পান করতে পারে না যাতে পাঁজরা ডুবে যায়। (ইবনে মাজাহ)
আবে যমযমের বরকত ও ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, আবে যমযম যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয় তার জন্যেই ফলদায়ক হয়। রোগ আরোগ্যের জন্য পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। তৃপ্তি লাভের জন্যে পান করা হলে আল্লাহ তৃপ্তিদান করবেন। পিপাসা নিবারণের জন্যে পান করলে আল্লাহ পিপাসা নিবারণ করবেন। এ হচ্ছে সেই কুয়া যা জিবরাঈল (আ ) পায়ের গোড়ালির আঘাতে খনন করেন এবং এ হচ্ছে ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের উন্মুক্ত জলাধার। (দারু কুতনী)
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ )বিশেষভাবে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরা (আ )এর জন্যে বারিহীন অনুর্বর প্রান্তরে যমযম বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে যায়।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সকল পানি থেকে উৎকৃষ্ট যমযমের পানি। ক্ষুধার্তদের জন্যে এ আহার, রোগীর জন্য আরোগ্য। (ইবনে আব্বাস)
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ও উদ্দেশ্যে যমযমের পানি পান করে যে, সে দুশমন থেকে আশ্রয় লাভ করবে- তাহলে সে আশ্রয় পাবে।(হাকেম)
যমযমের পানি দাড়িয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে পান করা উচিত এবং পেটভরে পান করা উচিত। পান করার সময় এ দোয়া পড়বে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ আমি তোমার কাছে মঙ্গলকর ইলম চাই, প্রশস্ত রুজি চাই এবং প্রত্যেক রোগ থেকে আরোগ্য চাই। (নায়লুল আওতার)

Thursday, August 24, 2017

কুরবানীর বর্ণনা


কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানীর, পূজা অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর হযরত আদম (আ ) এর দু পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।
*******আরবী*********
এবং তাদেরকে আদমের দু পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুজন কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না। (সূরা আল মায়েদাঃ ২৭)
প্রকৃতপক্ষে একজন যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে।
অপর ব্যক্তির নাম ছির কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো। হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।
সকল খোদায়ী শরীয়াতে কুরবানী
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবেরও মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
*******আরবী*********
আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। (সূরা হজ্জঃ৩৪)
অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমুহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তার নাম নিয়েই।
*******আরবী*********
অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।
পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তার নাম নিয়েই তার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মঙ্গল নিহিত রেখেছেন।
কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু
আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইসলাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প,দৃঢ় বিশ্বাস,আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তার পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।
*******আরবী*********
যখন সে (ইসমাঈল) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌছলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো প্রিয় পুত্র। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি রা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে) তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আরআমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সুরা আস সাফফাতঃ ১০২-১১১)
অর্থাৎ যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ ) এ ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তার উৎসর্গীকৃত বন্দাগণ টিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ ) আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতের জীবন দানকারী মুমিনগণ।
নবী (স) এর প্রতি নির্দেশ।
কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
*******আরবী*********
বল, হে মুহাম্মাদ (স) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমা বরদার। (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)
আল্লাহর ওপর পাকা পোক্ত ঈমান এবং তার তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা চরিত্র তারই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তোর ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।
কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন,  নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)
নবী (স) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (জামাউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাযের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহেতেই কুরবানী করতেন।
কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।
১. কুরবানীর পশু আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন
*******আরবী*********
আর কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমার জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৬)
……. শব্দ ………… এর বহুবচন। …….. (শারীয়াহ) ঐ বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা কোনো আধ্যাত্মিক ও অর্থপূর্ণ তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা স্মরণ করার কারণ ও আলামত হয়ে পড়ে, কুরবানীর পশু ঐ আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূত আলামত। কুরবানীকারী আসলে এ আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে যে, কুরবানীর পশুর রক্ত তার আপন রক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। সে আবেগও প্রকাশ করে যে, তার জীবনও আল্লাহর পথে ঐভাবে কুরবানী করা হবে, যেভাবে এ পশু সে কুরবানী করেছে।
২. কুরবানী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
*******আরবী*********
এভাবে এসব পশুকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূর আল হজ্জঃ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা পশুকে মানুষের বশীভূত করে দিয়ে তাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। মানুষ এসব থেকে বহু উপকার লাভ করে। তার দুধ পান করে, গোশত খায়। তার হাড়, চামড়া, পশম প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরী করে। চাষাবাদে তার সাহায্য নেয়। তাদের পিঠে বোঝা বহন করে, তাদেরকে বাহন হিসেবেও ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও প্রকাশ করে। কুরআন এসবের উপকারের দিকে ইংগিত করে ও তাদেরকে মানুষের বশীভূত করার উল্লেখ করে আল্লাহ পুরস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চার করতে চায়। সেই সাথে এ চিন্তাধারাও সৃষ্টি করতে চায় যে, যে মহান আল্লাহ এ বিরাট নিয়ামত দান করেছেন- তার নামেই কুরবানী হওয়া উচিত। কুরবানী আল্লাহর বিরাট নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
৩. কুরবানী আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ
*******আরবী*********
আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তার দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৭)
অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা প্রকৃতপক্ষে একথারই ঘোষণা যে, যে আল্লাহ এসব নিয়ামত দান করেছেন এবং যিনি এসব আমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছেন- তিনিই এসবের প্রকৃত মালিক। কুরবানী সেই আসল মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং একথারও বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মুমিনের অন্তর থেকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে।
পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে সে উপরোক্ত সত্যের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ও ঘোষণা করে এবং মুখে বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবার বলে এ সত্যের স্বীকৃতি দান করে।
কুরবানীর প্রাণ শক্তি
প্রাক ইসলামী যুগে লোক কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহর সম্মুখে এনে রেখে দিত। তার রক্ত বায়তুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। কুরআন বললো, তোমাদের এ গোশত ও রক্তের কোনোই প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তার কাছে তো কুরবানীর সে আবেগ অনুভূতি পৌঁছে যা যবেহ করার সময় তোমাদের মনে সঞ্চারিত হয় অথবা হওয়া উচিত। গোশত ও রক্তের নাম কুরবানী নয়। বরঞ্চ কুরবানী এ তত্ত্বেরই নাম যে, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্যে এবং তার পথেই উৎসর্গ করার জন্য।
কুরবানীকারী শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না। বরঞ্চ তার সকল কু প্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয়, তা হযরত ইবরাহীম (আ ) ও হযরত ইসমাঈল (আ ) এর সুন্নাত নয়, একটা জাতীয় রসম মাত্র। তাতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু সেই তাকওয়ার অভাব দেখা যায় যা কুরবানীর প্রাণ শক্তি।
*******আরবী*********
ওসব পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে।
যে কুরবানীর পেছনে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই আল্লাহর দৃষ্টিতে সে কুরবানীর কোনোই মূল্যে নেই। আল্লাহর কাছে সে আমলই গৃহীত হয় যার প্রেরণা দান করে তাকওয়া।
*******আরবী*********
আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন।
উট কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
এবং কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের জন্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল। অতএব, তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও এবং যখন (পড়ে গিয়ে) তাদের পার্শ্বদেশ যমীনে লেগে যাবে তখন তোমাদের স্বয়ং তা (গোস্ত) খাও এবং খাইয়ে দাও তাদেরকে যারা চায় না এবং তাদেরকেও যারা চায়। (সূরা হজ্বঃ ৩৬)
উট কুরবানী করার নিয়ম এই যে, তাদেরকে এক সারিতে দাড় করিয়ে তাদের হলকুমে (কণ্ঠদেশে) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার থেকে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। রক্ত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে যায়। কুরবানীর এ দৃশ্য একবার মনের মধ্যে অংকিত করুন এবং চিন্তা করুন যে, পশুর এ কুরবানী কোন বস্তু। এটা তো এই যে, এভাবে আমাদেরও জীবন আল্লাহর পথে কুরবান হওয়ার জন্যে তৈরী আছে। প্রকৃতপক্ষে এ কুরবানী আপনজনের কুরবানীরই স্থলাভিষিক্ত। এ অর্থেই উট কুরবানীর চিন্তা করুন। তার আহত হওয়া, রক্ত প্রবাহিত হওয়া, মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার দৃশ্যটা একবার ভেবে দেখুন, যেন মনে হবে যে, জেহাদের ময়দানে আল্লাহর সৈনিকগণ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। তাদের কণ্ঠদেশে শত্রুর তীর অথবা গুলি বিদ্ধ হচ্ছে, তারপর খুনের ঝর্ণা ছুটছ। তারপর খুনরাঙা যমীন তাদের জীবনদানের সাক্ষ্য  দিচ্ছে এবং তারা একজন মাটিতে পড়ে আল্লাহর হাতে তাদের জান পেশ করছে।
কুরবানীর পদ্ধতি ও দোয়া
যবেহ করার জন্য পশুকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তা কেবলামুখী হয়, ছুরি খুব ধারালো করতে হবে। যথাসম্ভব কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করতে হবে। কোনো কারণে নিজ যবেহ করতে না পারলে তার নিকটে দাড়িয়ে থাকতে হবে।
যবেহ করার সময় প্রথম এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবরাহীমের তরীকার ওপরে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি যিনি আসমান যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি কখনো শিরককারীদের মধ্যে নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যে তার কোনো শরীক নেই। এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমি অনুগতদের মধ্যে একজন। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া। (মেশকাত)
তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবাইয়ের পর এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মাদ (স) এবং তোমার খলীল ইবরাহীম (আ ) এর কুরবানী কবুল করেছিলে।
দোয়ার প্রথমে ………… শব্দ আছে। নিজের কুরবানী হলে …… বলতে হবে। আর অন্য বা একাধিক লোকের পক্ষ থেকে হলে তাদের নাম বলতে হবে।
কুরবানীর ফযিলত ও তাকীদ
নবী (স) কুরবানীর ফযিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন,
১. নাহারের দিন অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুর সহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, মনের আগ্রহ সহ এবং সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর। (তিরমিযি ইবনে মাজাহ)
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানী কি বস্তু? নবী বলেন, এ তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ ) এর সুন্নাত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী (স) বলেন, তার প্রত্যেক পশমের জন্যে এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) হযরত ফাতেমা যোহরা (রা) কে বলেন, ফাতেমা! এসো, তোমার কুরবানীর পশুর কাছে দাড়িয়ে থাক। এজন্যে যে, তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যেও। (জামউল ফাওয়োদে)
৪. হযরত ইবনে বারীদাহ (রা) তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন, নবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে নামাযে যেতেনে না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদুল আযহার নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, আহমাদ)
তারপর নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর কলিজী খেতেন।
 

Thursday, August 10, 2017

মুলতাযেম ও তার দোয়া


মুলতাযেম বায়তুল্লাহর ও দেয়ালের সে অংশকে বলে যা কাবার দরজা এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ প্রায় ছফুটের অংশ এবং দোয়া কবুলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এর সাথে দেহ বুক ও মুখ লাগিয়ে বিনয় ও নম্রতার সাথে ও কাতর কণ্ঠে দোয়া করা হজ্জের একটি মসনুন আমল । তাওয়াফ শেষ করার পর মুলতাযেমের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া ও দোয়া করা বিশেষ করে এমন এক অনুভূতি ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করে যে, এটা বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হওয়ার এক বেদনা দায়ক মুহূর্ত।
হযরত আমর ইবনে শোয়াইব বলেন, আমার পিতা শুয়াইব বর্ণনা করেছেন, আমি আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আস (রা) এর সাথে তাওয়াফ করার সময় কিছু লোক কে বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে বললাম, আমাকে একটু ঔ জায়গায় নিয়ে চলুন। লোকদের সাথে আমরাও বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গন করি। তিনি বললেন আউযুবিল্লাহে মিনশ শায়তানির রাজিম। তারপর যখন তিনি তাওয়াফ শেষ করলেন তখন হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী বায়তুল্লাহের ঐ অংশের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম এটা ঐ স্থান যার সাথে নবী (স) কে আলিংগনাবস্থায় দেখেছি। (বায়হাকী)
আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ বিন আমের (রা) হিজরে আসওয়াদ এবং বাবে কাবার মাঝে দাড়িয়ে গেলেন এবং আপন বক্ষ মুখ মণ্ডল ও দুহাত প্রসারিত করে কাবার দেওয়ালে রাখলেন এবং বললেন নবী (স) এমন করতে দেখেছি। (আবু দাউদ)
মুলতাযেমের দোয়া সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিপদাপন্ন হয়ে এখানে দোয়া চাইবে সে অবশ্যই নিরাপদ হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
মুলতাযেমের সাথে দেহ আবিষ্ট করে প্রথমে নিম্নের দোয়া পড়বে। তারপর দ্বীন দুনিয়ার জায়েজ মনস্কামনা পূরণের দোয়া করবে:
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! প্রশংসার হকদার তুমিই, এমন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা যার দ্বারা তোমার নিয়ামতের কিছু হক আদায় হতে পারে। আর এ সব নিয়ামতের উপর  কিছু এহসান কিছু এনামের কিছু বিনিময় হতে পারে। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব গুণাবলীর সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব নিয়ামতের সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। সকল অবস্থায় আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আয় আল্লাহ! দরুদ ও সালাম মুহাম্মদ (স) এর উপরে এবং মুহাম্মদের বংশধরের উপর। আয় আল্লাহ! মরদূদ শয়তান থেকে তোমার পানাহ চাই এবং প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে আমাকে আশ্রয় দাও।তুমি যা কিছু আমাকে দিয়েছ তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে দাও। আমার জন্য তাতে বরকত দাও। আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার সম্মানিত মেহমানদের মধ্যে শামিল কর। আর তুমি আমাকে সোজা পথে চলবার তাওফীক দাও, রাব্বুল আলামীন, যতক্ষণ না আমি তোমার সাথে মিলিত হই।
দোয়া কবুলের স্থানসমূহ
হজ্জের সময় প্রত্যেক আমল করতে গিয়ে যিকর তসবীতে মশগুল থাকা এবং প্রত্যেক স্থানে বেশী করে দোয়া করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অধিক পরিমাণ দোয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত হাসান বসরী যখন মক্কা থেকে বসরায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মক্কাবাসীদের নিকট একখানা পত্র লেখেন। তাতে তিনি মক্কায় অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযিলত বয়ান করেন এবং বিশেষ করে বলেন যে, নিম্নের এগারটি স্থানে বিশেষভাবে মুমিনের দোয়া কবুল হয়ঃ
১. মুলতাযেমের সাথে দেহ মন আবিষ্ট করে দোয়া করা। নবী (স) বলেন, মুলতাযেম এমন এক স্থান যেখানে দোয়া কবুল হয়। এখানে বান্দাহ যে দোয়াই করে তা কবুল হয়।
২. মিযআবের নিচে।
৩. পাক কাবার ভিতরে।
৪. যমযমের নিকটে।
৫. সাফা-মারওয়ায়।
৬. সাফা-মারওয়ায় যেখানে দৌড়ে চলতে হয়।
৭. মাকামে ইবরাহীমের নিকটে।
৮. আরাফাতের ময়দানে।
৯. মুযদালফায়ে।
১০. মিনায়।
১১. জুমরাতের পাশে।

Tuesday, August 1, 2017

তালবিয়ার হিকমত ও ফযীলত


কাবা নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হুকুম করেন-
এবং মানুষকে হজ্জের জন্যে সাধারণ আহবান জানিয়ে দাও যেন তারা তোমার কাছে দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেটে অথবা উটের পিঠে চড়ে আসে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই য আহবান, বান্দার পক্ষ থেকে তার জবাব হচ্ছে এই তালবিয়া।  বান্দাহ বলে, পরওয়ারদেগার তোমার ডাক শুনেছি এবং তুমি যে তলব করেছ তার জন্যে তামার দরবারে হাজির হয়েছি। আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী কিছুক্ষণ পরপর এ ধ্বনি বুলন্দ করেছে। প্রকৃতপক্ষে সে বলেছে, পরওয়ারদেগার! তুমি তোমার ঘরে হাজিরা দেয়ার জন্যে ডেকেছ এবং আমরা শুধু তোমার মহব্বতে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাগলের মতো এসে হাজির হয়েছি। আমরা তোমার সে দয়া অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করছি। তোমার তাওহীদের স্বীকৃতি দিচ্ছি। এ তালবিয়া ধ্বনি মুমিনের শিরায় শিরায় তাওহিদের বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত করে এবং তাকে এভাবে তৈরী করে যে, দুনিয়াতে তার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র এই যে, সে তাওহীদের বাণী সর্বত্র পৌছিয়ে দেবে।
নবী (স) তালবিয়ার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন কোনো মুমিন বান্দাহ লাব্বায়েক ধ্বনি করে, তখন তার ডানে বামে যাকিছু আছে সবই লাব্বায়েক ধ্বনি করে তা পাথর হোক, বৃক্ষলতা হোক কিংবা মাটি হোক। এমনি কি যমীনের এক প্রান্ত থেকে তা অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। (তিরমিযি)
নবী (স) আরও বলেন, যে মুহররম ব্যক্তি সারাদিন লাব্বায়েক লাব্বায়েক ধ্বনি করে এবং এভাবে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন তার সকল গুনাহ মিটে যায় এবং সে এমন পাক হয়ে যায় যেন সে সদ্য তার মায়ের পেট থেকে জন্ম লাভ করেছে।
তালবিয়ার পর দোয়া
*******আরবী*********
হে আল্লাহ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রার্থী এবং জাহান্নাম থেকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় চাই।
হযরত আম্মার বিন খুযায়মা তার পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী (স) যখন ইহরাম বাধার জন্যে তালবিয়া পড়তেন, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত ভিক্ষা চাইতেন এবং তার রহমতের বদৌলতে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। (মুসনাদে শায়েফী)
ইহরামের পর বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারী যে দোয়া ইচ্ছা করতে পারে এবং যতো খুশী করতে পারে। কিন্তু প্রথমে ওপরের মসনুন অবশ্যই করবে। কারণ এ এক সার্বিক দোয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাত লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ তিনটি বস্তু একজন মুমিনের চরম আকাঙ্ক্ষা এবং তার সকল চেষ্টার চরিত্রের ফল।
ওয়াকুফ ও তার মাসয়ালা
১.  ওয়াকুফ অর্থ দাঁড়ানো ও অবস্থান করা। হজ্জর সময় তিন স্থানে অবস্থান করতে হয় এবং তিন স্থানের হুকুম বিভিন্ন রকমের। উপরন্তু এসব স্থানে অবস্থানকালে যেসব আমল করতে হয় তার জন্যে সেখানে পৌছাতে হয়। এর নিয়ত করা এবং দাঁড়ানো জরুরী নয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে নিয়ত করা শর্ত।
২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরাফাত, যেখানে অবস্থান করতে হয়। আরাফাত এক অতি প্রকাণ্ড ময়দান। হেরেমের সীমা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাত এলাকা শুরু হয় এ ময়দান মক্কা মুকাররামা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূর। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্জের রুকনগুলোর বড়ো একটা রুকন। বরঞ্চ নবী (স) একবার আরাফাতের অবস্থানকেই হজ্জ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ *******আরবী********* আরাফাতের দিনে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ একই পোশাক পরিধান করে আল্লাহর দরবারে বিনয় নম্রতার মূর্ত ছবি হয়ে দাড়ায় তখন তারা যেন এ সময়ের জন্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে হাশরের ময়দানে পৌঁছে যায়। এ এক বিরাট ঈমান উদ্দীপক দৃশ্য। এখানে অবস্থানের ফলে হাশরের ময়দানের কথা মনে জাগ্রত হয়।
এর গুরুত্ব এই যে, যদি কোনো কারণে হাজী ৯ই যুলহজ্জের দিনে অথবা দিনগত রাতে আরাফায় পৌছাতে না পারে তাহলে তার হজ্জ হবে না। হজ্জের অন্যান্য অনুষ্ঠান যথা তাওয়াফ, সায়ী, রামি প্রভৃতি যদি বাদ পড়ে তাহলে তার ক্ষতি পূরণ সম্ভব। কিন্তু আরাফাতে অবস্থান করা না হলে তার ক্ষতিপূরণ কোনো উপায় নেই।
৩. আরাফাতে অবস্থানের সময় ৯ই যুলহজ্জ বেলা পড়ে গড়ে যাওয়ার পর (যোহর ও আসরের নামায পড়ার পর)। কিন্তু যেহেতু এ হজ্জের সবচেয়ে বড়ো রুকন এবং এর ওপরেই হজ্জ নির্ভরশীল, সে জন্যে এ সময়কে প্রশস্ত করে দিয়ে এ সুযোগ দেয়া দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ নয় ও দশ যুলহজ্জের মধ্যবর্তী রাত সুবেহ সাদেকের পূর্বে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্যে হরেও আরাফাতে পৌছা যায় তাহলে তার অবস্থান নির্ভরযোগ্য হবে এবং তার হজ্জ হয়ে যাবে। (আবদুর রহমান বিন ইয়ামার ওয়াবলী বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হজ্জের ওয়াকুফ হচ্ছে আরাফাত। যে ব্যক্তি মুযদালফার রাতে ফজর হওয়ার পূর্বে পৌছবে, তার হজ্জ হয়ে যাবে। তিরমিযি, আবু দাউদ)
৪. আরাফাতের অবস্থান যতো দীর্ঘ হয় ততো ভালো। এ ধারণা ও অনুভূতি সহ আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো যেন হাশরের ময়দান। বান্দার নিজের মনে বলবে আমি সকল কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী নিজের মামলা মিটাবার জন্যে ও তার অনুগ্রহ ভিক্ষা করার জন্য তার দরবারে দাঁড়িয়েছি। এ হচ্ছে মুমিনের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কে জানে জীবনে এ সৌভাগ্য আর হবে কিনা। এজন্যে ঈমান ও আত্মবিশ্লষণের শক্তি জাগ্রত রেখে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এ দিন রাতের এক একটি মুহূর্তের গুরুত্ব অনুভব করতে হবে। নবী (স) এর ব্যাপারে হযরত জাবের (রা) বলেন, যোহর ও আসর নামাযের পর নবী (স) তার উটনী কাসওয়ার পিঠে সওয়ার হলেন এবং আরাফাতের ময়দানের বিশেষ অবস্থানের জায়গায় এলেন। তারপর যেদিকে পাথরের বড়বড় খন্ড পড়েছিল তার উটনীকে সে মুখী করলেন। তারপর জনতাকে সামনে রেখে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। এভাবে যখন সূর্য অস্ত গেল তখন তিনি মুযদালফার দিকে রওয়ানা হলেন। – (মুসলিম)
৫. আরাফাতে অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, বছরের ৩৬০ দিনের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই যে দিনে আল্লাহ তায়ালা আরাফাতের দিনের চেয়ে অধিক পরিমাণে বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন।  এ দিন আল্লাহ বান্দার অতি নিকটবর্তী হন। ফেরেশতাদের কাছে তিনি বান্দাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! দেখছ এ বান্দারা কি চায় (মুসলিম)? হযরত আনাস বিন মালেক (রা) বলেন, নবী (স) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করলেন। সূর্য অস্ত যাবে এমন সময় তিনি হযরত বেলাল (রা) এর প্রতি ইশারায় বললেন, চুপ কর। তখন নবী (স) বললেন, হে লোক সব। এই মাত্র জিবরাঈল আমার কাছে এসে আল্লাহ তায়ালার সালাম ও এ পয়গাম পৌঁছে গেলেন আল্লাহ আরাফাতের ময়দানের সকলকে মাফ করে দিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ!এ পয়গাম কি আমরা সাহাবীদের জন্যে খাস না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বললেন, এ তোমাদের জন্যে এবং ঐসব লোকের জন্যেও যারা তোমাদের পরে এখানে আসবে।(আত তারগীব)
আরাফাতের ময়দানের দোয়া
আরাফাতের ময়দানের দোয়ার বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার এবং  ওখানে অবস্থানকালে সর্বদা আল্লাহর দিকে একাগ্রচিত্ত হয়ে থাকতে হবে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে ভালো দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। নিম্নে কিছু মসনুন দোয়া দেয়া হলোঃ
(ক) নিম্নের দোয়া নবী (স) আরাফাতের ময়দানে খুব বেশী করে করতেনঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তুমি এমন প্রশংসার অধিকারী যেমন তুমি নিজে তোমার প্রশংসা করেছ এবং আমরা যতোটা করতে পারি তার চেয়ে অনেক ভালো প্রশংসার হকদার তুমি। হে আল্লাহ! তোমার জন্যেই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু। তোমার দিকেই আমাকে ফিরে যেতে হবে এবং তোমার জন্যেই আমার সবকিছু। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই কবর আযাব থেকে, মনে মধ্যে সৃষ্ট কুমন্ত্রণা (অসঅসা) থেকে কাজকর্মের কুফল ও বিভেদ থেকে। হে আল্লাহ! আমি তামার আশ্রয় গ্রহণ করছি ওসব বিপদ থেকে যা বাতাসে বয়ে নিয়ে আসে। (তিরমিযি)
(খ) আল হিযবুল মকবুলে এক সার্বিক দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা করলে বরকত পাওয়া যাবে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সেই কল্যাণ চাই যা তোমার নবী (স) তোমার কাছে চেয়েছেন ঐসব অমঙ্গল তেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই যেসব থেকে তোমার নবী (স) তোমার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। পরওয়ারদেগার! আমরা আমাদের জীবনের ওপরে বড়ো যুলুম করেছি। তুমি যদি মাফ না কর এবং আমাদের ওপর রহম না কর তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবো। হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানাও এবং আমার সন্তানদেরকেও তার তাওফীক দাও। পরওয়ারদেগার! আমার দোয়া কবুল কর। আমার মা-বাপকে মাফ করে দাও। সেদিন সকল মুসলমানকে মাফ করে দিও যেদিন হবে হিসাব কেতাবের দিন। হে আমার রব! আমার মা-বাপ উভয়ের ওপর রহম কর যেমন তারা আমার শৈশবকালে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আমার প্রতিপালন করেছে। হে রব! আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের ঐসব ভাইদেরকে মাফ করে দাও যারা ঈমান আনার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগামী ছিল, এবং আমাদের মনের মধ্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা বিদ্বেষ হতে দিও না। যারা ঈমান এনেছে। হে আল্লাহ! তুমি বড়ো মেহেরবান ও দয়াশীল! পরওয়ারদেগার! তুমি সবকিছু শুন এবং জান, তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, তুমি তাওবা কবুলকারী ও দয়াশীল। গুনাহ থেকে বাচার কোনো শক্তি এবং হুকুম পালন করার সামর্থ অতীব উচ্চ ও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে না।
(গ) নবী (স) এ দোয়া বেশী করে করতে বলেছেনঃ
*******আরবী*********
হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।
এসব মসনুন দোয়া ছাড়াও আরও কিছু মসনুন দোয়া আছে যা পড়া যেতে পারে। তাছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে কল্যাণ মানুষ আল্লাহর কাছে চাইতে পারে তা চাইবে এবং বারবার চাইবে। কারণ ঐ সময়ে আল্লাহ বান্দার ওপর বড়ো দয়াশীল হয়ে যান এবং তিনি তার মেহমানকে বঞ্চিত করেন না।
৭. মুযদালফার অবস্থান করা ওয়াজিব। মুযদালফার সীমানায় পায়ে হেটে প্রবেশ করা মসনুন। এখানে অবস্থানের সময় মাঝে মাঝে তালবিয়া, তাহলীল ও তাহমীদ পড়া মুস্তাহাব। এখানে একরাত্রি কাটানো মসনুন। হাদীসে আছে নবী (স) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাত থেকে মুযদালাফা রওয়ানা হন এবং এখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়েন। তারপর শুয়ে পড়েন এবং ফজর পর্যন্ত বিশ্রাম করেন।
৮. যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে কোনো সময়ে মিনাতে পৌছা মসনুন। সূর্য উঠার পর ওখানে পৌছা যোহর ওখানে পড়া এবং ওখানেই রাত্রি যাপন করা মুস্তাহাব।
তাওয়াফ ও তার মাসায়েল
তাওয়াফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর চারদিকে চক্কর দেয়া ও প্রদক্ষিণ করা। ইসলামী পরিভাষায় তার অর্থ বায়তুল্লাহর চার ধারে ভক্তি সহকারে প্রদক্ষিণ করা ও চক্কর দেয়া।
বায়তুল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা
বায়তুল্লাহ ইট পাথরের নিছক একটা ঘর নয়। বরঞ্চ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর মহত্বের বিশেষ নিদর্শন ও তার দীনের বিশেষ অনুভূত কেন্দ্র যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার আপন তত্ত্বাবধানে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য পয়গাম্বর দ্বারা নির্মাণ করান যার নেতৃত্ব ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান সমভাবে মেনে নিয়েছে। *******আরবী********* এবং স্মরণ করো সে সময়টি যখন আমরা ইবরাহীমকে এ ঘরের (কাবা) স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। (সূরা হজ্জঃ ২৬)
কুরআন পাক একথার সাক্ষ্য দান করে যে, আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয় তাহলো এ বায়তুল্লাহ (কাবা ঘর)।
*******আরবী*********
নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ইবাদাতের ঘর যা মানুষের জন্যে তৈরী করা হয় তা ঐ ঘর যা মক্কায় রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে বায়তুল্লাহ দীনের উৎস কেন্দ্র।কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ তাওহীদের উৎস এবং নামাযের প্রকৃত স্থান, আর এ তাওহীদ এবং নামায গোটা দীনের মস্তিষ্ক ও সারাংশ। আকীদার দিক দিয়ে তাওহীদ দীনের আসল  বুনিয়াদ এবং আমলের দিক দিয়ে নামায দীনের স্তম্ভ। বায়তুল্লাহর নির্মাণ এদু বুনিয়াদী উদ্দেশ্যের জন্যেই। এক জন্যে আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকতের এবং হেদায়াতের উৎস বলে ঘোষণা করেছেন। *******আরবী*********এতে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছে এবং বিশ্ববাসীর জন্যে তাকে হেদায়াতের উৎস বানিয়ে দেয়া হয়েছে। (সূরা আল বাকারার ১২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন-
*******আরবী*********
এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অসিয়ত করেছিলাম এই বলে আমার এ ঘরকে রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে পাক রেখো। সূরা হজ্জের ২৬ আয়াতে বলা হয়-
*******আরবী*********
এবং স্মরণ কর যে সময়কে যখন আমি ইবরাহীম এর জন্যে এ ঘর নির্ধারিত করেছিলাম হেদায়াত সহ যে, আমার সাথে যেন কাউকে শরীক করা না হয় এবং আমার ঘরকে তাওয়াফ, কিয়াম, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে যেন পাক রাখা হয়।)
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দু স্থানে তাকে *******আরবী********* (আমার ঘর) বলে উল্লেখ করেছেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ ) তার বংশধরকে মক্কার প্রস্তরময় মরু প্রান্তরে পুনর্বাসিত করার সময় বলেন হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে তোমার ঘরের প্রতিবেশী করে পুনর্বাসিত করেছি। (সূরা ইবরাহীমের ৩৭  আয়াতে বলা হয়েছে-
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! পানি ও তরুলতাহীন মরুপ্রান্তরে তোমার পবিত্র ঘরের পাশে আমার সন্তানদেরকে পুনর্বাসিত করলাম।)বায়তুল্লাহর মহত্ব এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ঘর যিয়ারত করে হজ্জ করাকে মুসলমানদের ওপরে তার এক অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। আর হজ্জ এই যে, মুমিন ইহরাম বেধে অর্থাৎ নিজেকে বায়তুল্লাহতে হাজির হওয়ার যোগ্য জানিয়ে ভক্তি ভরে তার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করবে। তাতে লাগানো হিজরে আসওয়াদের চুমো দেবে। মুলতাযেমের সাথে দেহমন নিবিড় করে দেবে। মসজিদুল হারামে নামায পড়বে এবং আরাফাতে অবস্থান করবে।
তাওয়াফের ফযীলত
আল্লাহর ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই যে, তার তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ ) কে এর জন্যে তাকীদ করেছেন এবং এ তাকীদ কুরআনে দু স্থানে করা হয়েছে।
*******আরবী*********
*******আরবী*********
১. আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্যে পাক রাখ। (সূরা আল বাকারাঃ ১২৫)
২. এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করতে হবে। (সুরা আল হাজ্জঃ ২৬)
তাওয়াফের ফযীলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ নামাযের মতোই এক ইবাদত। পার্থক্য শুধু এই যে, তাওয়াফে তোমরা কথা বলতে পার এবং নামাযে তার অনুমতি নেই। অতএব তাওয়াফের সময় কেউ কথা বলতে চাইলে মুখ থেকে যেন ভালো কথা বের হয়। (তিরমিযি, নাসায়ী)
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হিজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামেনী হাত দিয়ে স্পর্শ করা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আমি তাকে একথাও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এ ঘর সাতবার তাওয়াফ করেছে এবং পূর্ণ অনুভূতি ও নিবিষ্ট মনে করেছে তার প্রতিদান এক টি গোলাম আযাদ করার সমান। নবী (স) কে আরও বলতে শুনেছি যে, তাওয়াফের সময় যে কদম ওঠাবে তার প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে একটি করে গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি করে নেকী লিখে দেবেন। (তিরমিযি)

Friday, July 21, 2017

হজ্জের ওয়াজিবসমুহ


হজ্জের ওয়াজিব নয়টি
১. সায়ী করা। অর্থাৎ সাফা মারওয়ার মাঝে দ্রুত চলা। (কুরআন পাকের বয়ান থেকে তাই মনে করা হয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে সায়ী ফরয। তার দলীল নিম্নোক্ত হাদীসঃ
*******আরবী*********
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির হজ্জ ও ওমরাহ পরিপূর্ণ বলে গণ্য করেন না যে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলো না। (মুসলিম)
২. মুযদালফার অবস্থান করা। অর্থাৎ ফজর শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো সময়ে সেখানে পৌছা।
৩. রামী করা। অর্থাৎ জুমরাতে পাথর মারা।
৪. তাওয়াফে কুদুম করা। অর্থাৎ মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তাওয়াফ করা। তাওয়াফে কুদুম তাদের জন্যে ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরে থাকে যাদেরকে আফাকী বলা হয়।
৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। অর্থাৎ খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় তাওয়াফ করা। এটাও শুধু আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।
৬. মাথা মুড়ানো বা চুল ছাটা। হাজ্জের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাটা। যুলহজ্জের দশ তারিখে জুমরাতে ওকবায় পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছাটা ওয়াজিব।
৭. কুরবানী একত্রে পড়া। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে যোহর আসর একত্রে এবং মুযদালাফায় মাগরিব এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।
৯. রামী, মস্তক মুণ্ডন ও কুরবানী ক্রমানুসারে করা।
সায়ী
অভিধানে সায়ী শব্দের অর্থ যত্ন সহকারে চলা, দৌড়ানো এবং চেষ্টা করা। পারিভাষিক অর্থে সায়ী বলতে হজ্জের সেই ওয়াজিব আমল বুঝায় যাতে হেরেম যিয়ারতকারী সাফা ও মারওয়া নামাক দুটি পাহাড়ের মাঝে দৌড়ায়।সাফা বায়তুল্লাহর দক্ষিণে এবং মারওয়া উত্তর দিকে অবস্থিত। আজকাল এ দুটি পাহাড়ের নামমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট আছে এবং তাদের মধ্যবর্তী স্থানে দুটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে এবং অপরটি মারওয়া থেকে সাফা আসার জন্যে। অর্থাৎ দুটি পাশাপাশি আপ ডাউন সড়ক। এ সড়ক দুটির ওপর বিরাট ছাদ তৈরী করে সড়ক দুটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে যাতে করে সায়ীকারীগণ রৌদ্রে কষ্ট না পায়।
সায়ীর হাকীকত ও হিকমত
কুরআন পাক বলে-
*******আরবী*********
সাফা ও মারওয়া নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশাবলীর মধ্য গণ্য।…….. শব্দের বহুবচন। কোনো আধ্যাত্মিক মর্ম এবং কোনো ধর্মীয় স্মৃতি অনুভব ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে জিনিস নিদর্শন স্বরূপ নির্ধারিত করা হয় তাকে ……… বলে। প্রকৃতপক্ষে এসব স্থান (সাফা মারওয়া) আল্লাহ পুরস্তি এবং ইসলামের বাস্তব বহিঃপ্রকাশের স্মরণীয় স্থান। মারওয়া হচ্ছে সেই স্থান যেখানে আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ ) তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ ) কে উপুড় করে শুইয়ে তার গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাতে করে তার দেখা স্বপ্ন কার্যে পরিণত করতে পারেন। সেই সাথে তার জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করে তার স্বীয় উক্তির *******আরবী********* (আমি পুরোপুরি নিজেকে রাব্বুল আলামীনের অধীন করে দিয়েছি) বাস্তব সাক্ষ্যদান করেন।
ইসলাম বা আত্মসমর্পণ করার এ অভিনব দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছ। এত কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ছিল এক বিরাট পরীক্ষা।
*******আরবী*********
এবং আমরা তাকে এ বলে ডাকলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমরা নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটা সত্য যে এ হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
সাফা ও মারওয়ার ওপর দৃষ্টি পড়তেই স্বাভাবিকভাবেই মুমিনের মনে কুরবানীর এ গোটা ইতিহাস ভেসে ওঠে। আর সেই সাথে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের চিত্রও ভেসে ওঠে।
এ সত্যটিকে মনে বদ্ধমূল করার জন্যে এবং এ প্রেরণাদায়ক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য সায়ীকে আল্লাহ তায়ালা মানাসেকের মধ্য শামিল করে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেনঃ
*******আরবী*********
অতএব যে ব্যক্তি হজ্জেও ওমরা করে, তার এ দুয়ের মধ্যে সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। আর যে আগ্রহ সহকারে কোনো ভালো কাজ করে, আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন এবং তার মূল্য দান করেন।
জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার মুশরিকগণ এ দুটি পাহাড়ের ওপর তাদের প্রতিমার বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। সাফার ওপরে আসাফের এবং মারওয়ার ওপরে নায়েলার প্রতিমা ছিল। তাদের চারধারে তাওয়াফ করা হতো। এজন্যে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল যে, এ দু পাহাড়ের মাঝে তারা সায়ী করবে কিনা। তখন আল্লাহ বলেন এ সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। এজন্যে যে, সায়ী বলতে হজ্জের মানাসেকের (করণীয় অনুষ্ঠানাদি) মধ্য গণ। হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হজ্জের যেসব মানাসেক শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সায়ী করার নির্দেশও ছিল। এজন্যে কোনো প্রকার ঘৃণা অনীহা ব্যতিরেকেই মুসলমানগণ যেন মনের আগ্রহ সহকারে সাফা মারওয়ার সায়ী করে। আল্লাহ মনের অবস্থা ভালোভাবে জানেন এবং মানুষের সৎ আবেগ অনুভূতি ও সৎকাজ সম্মানের চোখে দেখেন।
সায়ীর মাসায়েল
১. কাবার তাওয়াফের পর সায়ী করা ওয়াজিব। তাওয়াফের পূর্বে সায়ী জায়েয নয়।
২. সায়ী করার সময় হাদাসে আসগার ও হাদাসে আকবার থেকে পাক হওয়া ওয়াজিব নয় বটে, কিন্তু মসনুন।
৩. সায়ী তে সাতবার দৌড় দিতে হয়। এ সাতবারই ওয়াজিব।
৪. তাওয়াফ শেষ করার সাথে সাথেই সায়ী শুরু করা মসনুন, তবে ওয়াজিব নয়।
৫. সায়ী সাফা থকে শুরু করা ওয়াজিব।
৬. সায়ী পায় হেটে করা ওয়াজিব। বিশেষ কারণে সওয়ারীতে করা যায়।
৭. গোটা হজ্জে একবারই সায়ী করা উচিত। তা তাওয়াফে কুদুমের পরে অথবা তাওয়াফে যিয়ারতের পরে হোক। তাওয়াফে যিয়ারতের পর করা ভালো।
৮. সাফা মারওয়ার ওপরে ওঠা বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু হাত দোয়ার জন্যে ওঠানো এবং দোয়া করা মাসনুন।
৯. সায়ী করার সময় কেনাবেচা মাকরূহ। প্রয়োজন হলে কথা বলা যায়।
সায়ী করার পদ্ধতি ও দোয়া
তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে যিয়ারত যার পরেই সায়ী করা হোক, তাওয়াফ শেষ করে সাফা পাহাড়ে ওঠতে হবে। তারপর এ আয়াত পড়তে হয় *******আরবী********* (সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত)। সাফার এতোটা উচ্চতায় চড়তে হবে যেন বায়তুল্লাহ চোখে পড়ে। তারপর বায়তুল্লাহর দিক মুখ করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক এবং তার কোনো শরীক নেই।  শাসন কর্তৃত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসাও তার। তিনি প্রত্যেক বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ শক্তিশালী। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি একক। তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করে দেখিয়েছেন, তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি  একাই সমস্ত কাফের দলকে পরাজিত করছেন। (মুসলিম)
তারপর দরূদ শরীফ পড়ে যে দোয়া করার ইচ্ছা তা করা উচিত। নিজের জন্যে, আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনের জন্যে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান। সে জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্যে প্রাণভরে দোয়া করা উচিত। তারপর আবার নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! তুমি বলেছ আমার কাছে চাও আমি দিব। আর তুমি কখনো ওয়াদা খেলাফ করো না। তোমার কাছ আমার চাওয়া এই যে, তুমি যেমন আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দান করেছ, তেমনি এ সম্পদ থেকে তুমি কখনও আমাকে বঞ্চিত করো না এভাবে আমার যেন মৃত্যু হয় এবং আমি যেন মুসলমান হয়ে মরতে পারি। (মুয়াত্তা)
তারপর সাফা থেকে নেমে মারওয়ার দিকে চলতে হবে এবং এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
হে রব! আমাকে মাফ কর এবং রহম কর। তুমি পরম পরাক্রান্ত-শালী ও মহান।
সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন পাওয়া যায়। এ দুটি চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো সুন্নাত। এটা শুধু পুরুষদের জন্যে। মেয়েরা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তারা দৌড়ালে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে।
তারপর মারওয়া পাহাড়ে ওঠার পর ঐসব দোয়া পড়তে হয় যা সাফার ওপরে পড়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যিকির ও তসবিহতে মশগুল থাকা উচিত। কারণ এটা হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান।
তারপর মারওয়া থেকে নেমে পুনরায় সাফার দিকে যেতে হবে এবং ঐসব দোয়া পড়তে হবে যা আসবার সময় পড়া হয়েছে। আর এভাবে দু সবুজ চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াতে হবে। এভাবে সাতবার সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
রামী
রামীর আভিধানিক অর্থ নিক্ষেপ করা ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো। পরিভাষা হিসেবে রামী বলে সেই আমলকে যাতে হাজীগণ তিনটি স্তম্ভের ওপর পাথর মারে। জুমরাতে রামী করা ওয়াজিব। জুমরাতে জিমার অথবা জুমরাহ শব্দের বহুবচন। প্রস্তর খণ্ডকে জুমরাহ বলে। মিনার পথে কিছু দূরে দূরে অবস্থিত মানুষ সমান তিনটি স্তম্ভ আছে। সে সবের ওপরে যেহেতু পাথর মারা হয় সে জন্যে এগুলোকেও জুমরাত বলা হয়। এ তিনটিকে জুমরায় উলা, জুমরায়ে উস্তা এবং জুমরায়ে ওকবাহ বলে। মক্কার নিকটবর্তী যেটি, তাকে জুমরায়ে ওকবাহ বলে। তার পরেরটিকে বলে জুমরায়ে উস্তা এবং তার পরেরটি যা মসজিদে খায়েফের নিকটবর্তী তাকে জুমরায়ে উলা বলে।
রামীর মর্মকথা ও হিকমত
নবী পাক (স) এর জন্মের কিছুদিন পূর্বে (অধিকাংশের মতে পঞ্চাশ দিন হবে) হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহ ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে আগ্রাসন পরিচালনা করে। সে হস্তীবাহিনী সহ বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হতে থাকে। মক্কার অতি নিকটবর্তী মহার উপত্যকা পর্যন্ত সে উপনীত হয়। আল্লাহ তায়ালা তার এ অসৎ উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তাদের প্রত্যেকে ঠোটে একটি করে এবং দু পায়ে দুটি করে ছোট ছোট পাথর নিয়ে এসেছিল এবং গোটা সেনাবাহিনীর ওপরে এমন মুষলধারে বর্ষণ করলো যে, অধিকাংশ ঘটনাস্থলেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং অবশিষ্ট পথে পড়ে পড়ে মরতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আবরাহার দুরভিসন্ধি নির্মূল করে দেন।
জুমরাতে পাথর মারা সেই ধ্বংসকারী প্রস্তর বর্ষণের স্মৃতি বহন করে। জুমরাতের ওপরে আল্লাহ আকবার বলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে পাথর নিক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এ সত্য সম্পর্কে দুনিয়াকে হুশিয়ার করে দেয়া এবং আপন সংকল্পের ঘোষণা করা যে, মুমিনের অস্তিত্ব দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার জন্য।
কোনো শক্তি যদি দুরভিসন্ধি সহকারে দীনের প্রতি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং তাকে মুলোৎপাটনের চেষ্টা করে তাহলে তাকে নির্মূল করে দেয়া হবে জুমরাতে পাথর নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এ সংকল্পের ঘোষণা করা হয়।
রামীর মাসায়েল
১. রামী করা ওয়াজিব। ইমাম মালেকের নিকট জুমরাতে ওকবায় রামী ফরয়। এ রামী না করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
২. নিচু স্থানে দাড়িয়ে রামী করা মসনুন। উঁচু স্থান থেকে করা মাকরূহ।
৩. প্রত্যেক পাথর মারার সময় আল্লাহু আকবার বলা মসনুন।
৪. পাথর যদি জুমরাতে না লাগে অর্থাৎ লক্ষ্যচ্যুত হয় তাহলে তাতে দোষ হবে না।
৫. যুলহজ্জের দশ তারিখে অর্থাৎ প্রথম দিন শুধু জুমরায়ে ওকবাতে পাথর মারবে। তারপর এগারো বারো তারিখে তিনটি জুমরাতেই পাথর মারতে হবে। তের তারিখে পাথর মারা মুস্তাহাব। সর্বমোট সাতবার পাথর মারা হচ্ছে। সাতটি করে উনপঞ্চাশটি পাথর মারতে হয়।
৬. একটি বড়ো পাথর ভেঙ্গে সাতটি করা মাকরূহ।
৭. সাতবারের বেশী পাথর মারা মাকরূহ।
৮. সাতটি পাথর সাতবার মারা ওয়াজিব। কেউ এক সাথে সাতটি পাথর মারলে তা একবারই মারা হবে।
৯. রামীর জন্যে মুযদালাফা থেকে আসার সময়ে মুহাসসার প্রান্তর থেকে ছোট ছোট পাথর সাথে নিয়ে আসা মুস্তাহাব। জুমরাতের আশপাশ থেকে পাথর কুড়িয়ে নেয়া মাকরূহ।
উল্লেখ্য যে, জুমরাতের পাশে যেসব প্রস্তর কণা রয়ে যায় সেগুলো আল্লাহ কবুল করেন। যেগুলো তার দরবারে কবুল হয় তা ফেরেশতাগণ ওঠিয়ে নিয়ে যান। এজন্য ওখানে পড়ে থাকা পাথর কণা দিয়ে রামী করা মাকরূহ।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী নবী (স) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রতি বছর আমরা যেসব পাথর কনা দিয়ে রামী করি তার সংখ্যা তো কমে যায় বলে মনে হয়। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ, এসবের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ কবুল করেন, তা ওঠিয়ে নেয়া হয়। নতুবা তোমরা দেখতে পেতে যে, পাথর কণাগুলো পাহাড়ের মত স্তূপ হয়ে যেতো। (দারে কুতনী)
১০. যে পাথর কণা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা হয় যে, তা নাপাক, তার দ্বারা রামী করা মাকরূহ।
১১. দশ তারিখে রামী শুরু করতেই তালবিয়া বন্ধ করা উচিত। বুখারী শরীফে আছে যে, হুজুর (স) জুমরায়ে ওকবাতে রামী করা পর্যন্ত তালবিয়া করতে থাকেন।
১২. দশই যুলহজ্জ রামী করার মসনূন সময় হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত। তারপরেও সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়েয, কিন্তু সূর্যাস্তের পর মাকরূহ। অন্য তারিখগুলোতে বেলা গড়া তেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রামী করার মসনূন সময়।
১৩. রামী করার জন্যে এক রাত্র মিনাতে কাটানো মসনূন।
১৪. দশ তারিখে জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর অন্য তারিখগুলোতে নিম্ন ক্রম অনুসারে রামী করা মসনূনঃ
প্রথমে জুমরায়ে উলাতে রামী করতে হবে যা মসজিদে খায়েফের নিকটে অবস্থিত। তারপর জুমরায়ে উস্তা এবং তারপর জুমরায়ে ওকবা।
১৫. জুমরায়ে উলা ও জুমরায়ে উস্তায় রামী পায়ে হেটে করা ভালো এবং জুমরায়ে ওকবার সওয়ারীতে থেকে করা ভালো।
১৬. জুমরায়ে উলা ও উস্তায় রামী করার পর এতটুকু সময় দাড়িয়ে থাকা, যে সময়ে সূরা ফাতেহা তেলাওয়াত করা যায় এবং তাহমীদ, তাহলীল, তাকবীর, দরূদ প্রভৃতি পড়াতে মশগুল থাকা এবং হাত তুলে দোয়া করা মসনূন।
১৭. মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তীস্থানে এক প্রান্তর ছিল যাকে মুহাসসাব বলা হতো। এখন সেখানে বসতি হয়ে গেছে। আজকাল তাকে মুয়াহেদা বলে। বিদায় হজ্জে নবী পাক (স) এখানে অবস্থান করেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) এখানে যোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামায আদায় করেন। তারপর কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম করেন। তারপর এখান থেকে রওয়ানা হয়ে বায়তুল্লাহ পৌঁছে তওয়াফ করেন। (বুখারী)
অবশ্য এখানে অবস্থান করা সুন্নাত, ওয়াজিব এবং অপরিহার্য নয়। না করলে কোনো দোষ নেই।
১৮. রামী ওসব বস্তুর দ্বারা করা যায় যার দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয। যেমন ইট, পাথর, পোড়া মাটি, পাথর কণা, মাটি, ঢিল প্রভৃতি। কাঠ বা কোনো ধাতব দ্রব্য দ্বারা রামী জায়েয নয়।
রামী করার পদ্ধতি ও দোয়া
জুমরায়ে ওকবাতে প্রথম রামি করার পূর্বে তালবিয়া ছেড়ে দিয়ে রামী করা উচিত। রামী করার মসনূন পদ্ধতি এই যে, কোনো নিচু স্থানে দাড়িয়ে প্রথমে এ দোয়া পড়বে-
*******আরবী*********
আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। শয়তানের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে (এ কাজ করছি) হে আল্লাহ এ হজ্জকে হজ্জে মাবরুর বানিয়ে দাও। গোনাহ মাফ করে দাও এবং এ চেষ্টা কবুল কর।
তারপর প্রস্তর কণা আঙ্গুল দিয়ে ধরে প্রত্যেকটি আল্লাহু আকবার বরে মারবে, জুমরাতে লক্ষ্য করে মারবে। জুমরায়ে ওকবাতে পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর মারা অথবা বড়ো বড়ো ইট বা পাথর দিয়ে মারা জুমরাতের নিকটে পড়ে থাকা কণা দিয়ে মারা মাকরূহ।
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাসায়েল
মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছাটা হজ্জের আমলসমূহের একটি অপরিহার্য আমল। আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী*********
তোমরা ইনশাআল্লাহ মসজিদুল হারামে মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছেঁটে নিরাপদে প্রবেশ করবে। আর তোমাদের কোনো প্রকারের ভয় ভীতি থাকবে না। (সূরা ফাতাহ: ২৭)
আসলে মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এবং হালাল হওয়ার একটা নির্ধারিত শরীয়াতের পন্থা। এর তাৎপর্য সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে শাহ অলীউল্লাহ (র) বলেন, মাথা মোড়ানোর তাৎপর্য এই যে, এ ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এক বিশেষ নির্ধারিত পদ্ধতি। এমন পদ্ধতি যদি নির্ধারিত করা হতো যা মর্যাদার পরিপন্থী, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন ইচ্ছামতো তার ইহরাম খতম করতো এবং পৃথক পৃথক পদ্ধতি প্রবর্তন করতো। (হুজ্জাতুল্লাহেল বালেগা)
১. দশই যুলহজ্জ কুরবানীর দিন জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ওয়াজিব।
২. পুরুষদের জন্যে মাথা মোড়ানো অথবা চুল ছাটা উভয়ই জায়েয। তবে মস্তক মুন্ডানোর ফযীলত বেশী। এজন্যে যে, নবী (স) মস্তক মুন্ডনকারীদের জন্যে দুবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন এবং যারা চুল ছাটে তাদের জন্য একবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন। (আবু দাউদ, জামাউল ফাওয়ায়েদ)
৩. মেয়েলোকদের কিছুটা চুল কেটে ফেলা উচিত। তাদের জন্যে মস্তক মুণ্ডন জায়েয নয়। হযরত আলী (রা) বলেন, নবী (স) মেয়েদের মস্তক মুণ্ডন করতে নিষেধ করেছেন।
৪. পুরুষরা সমস্ত মাথার চুলের এক আঙ্গুল পরিমাণ কেটে ফেললে তা জায়েয হবে এবং এক চতুর্থাংশ চুলের কিছু ছেঁটে ফেলাও জায়েয। মেয়েদের জন্যে তাদের চুলের অগ্রভাগ কিছুটা ছেঁটে ফেললেই যথেষ্ট হবে।
৫.কারো মাথায় যদি চুল মোটেই গজায়নি অথবা টাক থাকে, তাহলে মাথার উপর শুধু খুর বুলালেই যথেষ্ট হবে।
৬. চুল সাফ করার কোনো ওষুধ দ্বারা যদি কেউ চুল সাফ করে তাহলে তাও জায়েয হবে।
৭. মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরামের অবস্থার অবসান হয় এবং তারপর তার জন্যে ওসব কাজ হালাল হয়ে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তবে স্ত্রী সহবাস তখনও জায়েয হবে না যতক্ষণ না তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করা হয়েছে।

Thursday, July 20, 2017

ইহরাম ও তার মাসয়ালা


১. হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোষাক পরিধান করা ও তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। হজ্জের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার পর লোক মুহরেম হয়ে যায়। যেমন নামাজে তাকবীর বলার পর লোক নামাজে প্রবেশ করে এবং তারপর খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায়, তেমনি ইহরাম বাধার পর হজ্জ শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু জিনিষ যা ইহরাম বাধার পরে জায়েয ও মুবাহ ছিল, ইহরাম অবস্থায় সেসব কাজ হারাম হয়ে যায়। এজন্য একে ইহরাম বলে।
২. যে কোন কারণে মক্কা যেতে হোক ভ্রমণ ব্যবসা বাণিজ্য অথবা যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধা অত্যাবশ্যক। ইহরাম ছাড়া মীকাত থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরুহে তাহরীমা।
৩. ইহরাম বাধার পূর্বে গোসল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। শিশুদের গোসল করাও মসনুন। মেয়েলোক হায়েয নেফাস অবস্থায় তাদের গোসল করাও মসনুন। হ্যাঁ তবে গোসল করতে অসুবিধা হলে বা কষ্ট হলে অযু অবশ্য করে নেওয়া উচিৎ। এ অযু বা গোসল শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য, পাক পবিত্রতার জন্য নয়। এ জন্য পানি না পেলে তায়াম্মুম করার দরকার নেই।
৪. ইহরামের জন্য গোসল করার জন্য চুল কাটা, নখ কাটা ও সাদা চাদর ও তহবন্দ পরা এবং খসবু লাগানো মুস্তাহাব।
৫. মীকাতে পৌছার পূর্বেও ইহরাম বাধা জায়েয। ইহরামের সম্মান রক্ষা করতে পারলে তা ভালো। নতুবা মীকাতে পৌছার পর ইহরাম বাধা ওয়াজিব।
৬. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজঃ এসবের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সব সময় নিষিদ্ধ। কিন্তু ইহরাম অবস্থায় যে সব কাজ করা অধিকতর গোনাহের কাজঃ
১. যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়া অথবা যৌন সম্পর্কিত আলাপ আলোচনা করা, আপন স্ত্রীর সাথেও এ ধরনের কথাবার্তায় আনন্দ উপভোগ করা নিষিদ্ধ।
২. আল্লাহর নাফরমানী ও গোনাহ করা।
৩. লড়াই-ঝগড়া ও গালাগালি করা। কর্কশ কথা বলা।
৪. বন্য পশু শিকার করা। শিকার শুধু হারাম নয়। বরঞ্চ শিকারির সাথে কোন প্রকার সহযোগীতা করা অথবা শিকারিকে পথ দেখানো অথবা শিকারের দিকে ইংগিত করাও হারাম।
৫. সিলাই করা জামা কাপড়। যেমন শার্ট, পাঞ্জাবী, পায়জামা, শিরওয়ানী, কোট-প্যান্ট, টুপি, বেনিয়ান, দস্তানা প্রভৃতি পরিধান করা। মেয়েরা মিলওয়ার কামিজ পড়তে পারে। মোজাও পরতে পারে এবং ইচ্ছা করলে অলংকার ব্যবহার করতে পারে।
৬. রঙিন ও খোশবুদার রঙে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা। মেয়েরা রেশমী কাপড় পড়তে পারে এবং রঙিন কাপড়ও। অবশ্য খুশবুদার হওয়া চলবে না।
৭. মাথা ও মুখমন্ডল ঢাকা।মেয়েরা মাথার চুল ডেকে রাখবে।
৮. মাথা দাড়ি সাবান প্রভৃতি দিয়ে ধোয়া।
৯. শরীরে কোনে স্থানের চুল কামানো। কোন কিছুর সাহায্যে চুল উঠিয়ে ফেলা।
১০. নখ কাটা অথবা পাথর প্রভৃতিতে ঘসে সাফ করা।
১১. খুশবু লাগানো।
১২. তৈল ব্যবহার করা।
৭. ইহরাম অবস্থায় জায়েয কাজঃ
ওপরে যেসব বিষয় বলা হল তা ছাড়া সব কিছু কর জায়েয। যেমনঃ
১. কোনো ছায়ায় আরাম করা।
২. গোসল করা, মাথা ধোয়া, তবে সাবান ব্যবহার না করা।
৩. শরীর বা মাথা চুলকানো। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে চুল উঠে না যায় অথবা চুলের উকুন পড়ে না যায়।
৪. টাকা পয়সা অস্ত্র প্রভৃতি সাথে রাখা
৫. অবসর সময়ে ব্যবসা করতে দোষ নেই। কুরআনে আছেঃ
 ******আরবী********
হজ্জের সময় তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (ব্যবসার দ্বারা মুনাফা) তালাশ কর, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।
৬. ইহরামের কাপড় বদলানো বা ধোয়া।
৭. আংটি ঘড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করা।
৮. সুরমা লাগানো তবে খুশবু সুরমা নয়।
৯. খাতনা করা।
১০. নিকাহ করা।
১১. অনিষ্টকর জীব হত্যা করা। যেমন চিল, কাক, ইঁদুর, সাপ, বিচ্ছু, বাঘ, কুকুর, প্রভৃতি। নবী (স) বলেন, হেরেমে বা ইহরামের অবস্থায় পাঁচ প্রকারের জীব হত্যায় কোন দোষ নেই। যেমন, ইঁদুর, কাক, চিল, বিচ্ছু, আক্রমণকারী কুকুর।
১২. সামুদ্রিক শিকার জায়েয। কোনো গায়ের মুহররম (যে ইহরাম অবস্থায় নেই)যদি স্থলের কোন শিকার তোহফা দেয় তাহলে খাওয়া জায়েয।
৮. ইহরামের পদ্ধতি:
ভালোভাবে চুল নখ কেটে গোসল করে খুশবু লাগিয়ে ইহরামের পোশাক পরবে। অর্থাৎ এক চাদর, এক তহবন্দ পরে দু রাকায়াত নফল নামায পড়বে। তারপর হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়বে। (মুফরেদ হলে শুধু হজ্জের নিয়ত করবে। কারেন হলে হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করবে। মুতায়াত্তা হলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করবে এবং ওমরাহ শেষ করে হজ্জের নিয়ত করবে। এসব পরিভাষার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য।) হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার সাথে সাথে ইহরাম বাধা হয়ে যায়। তারপর সে মুহররম হয়ে যায়। তারবিয়ার পরিবর্তে যদি কুরবানীর উট মক্কার দিকে রওয়ানা করে দেয়া হয় তাহলে তা তালবিয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়।
তালবিয়া ও তার মাসয়ালা
হজ্জের নিয়ত করার পরই হেরেম যিয়ারতাকারী যেসব কথা বলে তাকে তালবিয়া বলে, যথাঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি তোমার ডাকে হাজির। আমি তোমার দরবারে হাজির আছি, তোমার কোনো শরীক নেই। এটা সত্য যে, প্রশংসা ও শোকর পাবার অধিকারী তুমি। দান ও অনুগ্রহ করা তোমারই কাজ। তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বে কেউ শরীক নেই।
১. ইহরাম বাধার পর একবার তালবিয়া পড়া ফরয। বেশী বলা সুন্নাত।
২. ইহরাম বাধার পর থেকে ১০ই যুলহাজ্জ তারিখে প্রথম জুমরায় পাথর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকতে হবে। প্রত্যেক নীচুতে নামার সময় এবং ওপরে ওঠার সময় প্রত্যেক কাফেলার সাথি মিলিত হবার সময় প্রত্যেক নামাযের পর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তালবিয়া পড়তে হবে।
৩. জোরে জোরে তালবিয়া পড়া সুন্নাত। নবী (স) বলেন, আমার কাছে জিবরাঈল (আ ) এসে এ ফরমান পৌছিয়ে দেয় যে, আমি যেন আমার সঙ্গীদেরকে হুকুম দেই তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়ে। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক (র) তিরমিযি, আবু দাউদ প্রভৃতি। কিন্তু মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়বে না। হেদায়ায় আছে মেয়েরা তালবিয়া পড়ার সময় আওয়াজ বুলন্দ করবে না। এজন্যে যে এতে করে ফেতনার আশংকা সহতে পারে। তারা রমলও করবে না এবং সায়ী করার সময় দৌড়াবে না। এজন্যে যে, এতে পর্দা নষ্ট হবে।)
৪. তালবিয়া পড়লে তিনবার পড়তে হবে। তিনবার পড়া মুস্তাহাব।
৫. তালবিয়া পড়ার সময় কথা বলা মাকরূহ। সালামের জবাব দেয়া যেতে পারে।
৬. যে তালবিয়া পড়ছে তাকে সালাম না দেয়া উচিত। তাকে সালাম করা মাকরূহ।
৭. তালবিয়ার পর দরুদ পড়া মুস্তাহাব।

হজ্জের বিবরণ


হজ্জ ইসলামের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজ্জের একটা ঈমান উদ্দীপনা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর প্রতি লক্ষ্য না রাখলে হজ্জের মহত্ব, তাৎপর্য ও মূল উদ্দেশ্যে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কুফর ও শিরক পরিবেশিত এক শক্তিশালী পরিবেশে এক মুমিন বান্দাহ খালেস তাওহীদের ঘোষণা করেন। তারপর বাতিল যালেম শক্তির চরম বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈমান, তাকওয়া, ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, এশক ও মহব্বত, ত্যাগ ও কুরবানী নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ আল্লাহর আনুগত্য ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নজিরবিহীন প্রেরণা ও আমলের দ্বারা ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস তৈরী করেন এবং তাওহীদ ও এখলাসের এমন এক কেন্দ্র তৈরী করেন যা দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার থেকে বিশ্ব মানবতা তাওহীদের পয়গাম পেতে থাকবে।
এ ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করার জন্যে এবং মানুষের মনে আবেগ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করার জন্যে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে তাওহীদের প্রেম পাগল পতঙ্গসমূহ ঐ কেন্দ্রে জমায়েত হয়ে ঐসব কিছুই করে যা তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ) করেছিলেন। তারা কখনো দু খন্ড কাপড় পরিধান করে আবেগ উচ্ছ্বাসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং কখনো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাদেরকে দৌড়াতে দেখা যায়। কখনো আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং কখনো কুরবানীগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর সাথে মহব্বতের শপথ গ্রহণ করে। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সকাল সন্ধ্যায় তাদের এ একই ধ্বনিতে হেরেমের গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে আয় আল্লাহ! তোমার দরবারে তোমার গোলাম হাজির আছে। প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র তোমারই, দয়া করা তোমারই কাজ, তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কেউ শরীক নেই।
প্রকৃতপক্ষে এসব অবস্থা সৃষ্টি করার এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ওপর সোপর্দ করারই নাম হজ্জ।
হজ্জের অর্থ
হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো যিয়ারতের এরাদা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় হজ্জের অর্থ হলো সেই সার্বিক ইবাদাত যা একজন বায়তুল্লাহ পৌঁছে করে থাকে। যেহেতু হজ্জে মুসলমান আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের এরাদা করে সে জন্যে একে হজ্জ বলা হয়।
হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত
ইসলামী ইবাদাত দুই প্রকারের। এক – দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা। দুই – মালের ইবাদত, যেমন সদকা যাকাত দান খয়রাত ইত্যাদি। হজ্জের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। অন্যান্য স্থায়ী ইবাদতগুলোর দ্বারা এখলাস, তাকওয়া, বিনয়, নম্রতা, বন্দেগীর পিপাসা। আনুগত্য, কুরবানী, ত্যাগ, আত্মসর্মপন, আল্লাহর নৈকট্য প্রভৃতির যে, প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথক পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে, হজ্জের সার্বিকতা এই যে, এ সকল অনুভূতি ভাবাবেগ ও মানসিক অবস্থা একই সময়ে এবং একই সাথে তৈরী হয় ও বিকাশ লাভ করে।
যে নামাজ দ্বীনের উৎস, তা কায়েম করার জন্য যমীনের উপর যে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরী করা হয়, হজ্জে মুমিনগণ সে মসজিদের চারপাশে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে তওয়াফ করে। সারা জীবন দূরদূরান্ত থেকে যে মসজিদের দিকে মুখ করে মুসলমান নামাজ পড়ে, হজ্জে তার এ সৌভাগ্য হয় যে, সে ঐ মসজিদে দাড়িয়ে নামাজ সমাধা করে।
যে রোজা মন ও চরিত্রের সংশোধনের উপযোগী ও অনিবার্য উপায় এবং যে রোজায় একজন মুমিন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় শক্তি লাভ করে ও আল্লাহর সিপাহী ও মুজাহিদ হওয়ার অভ্যাস করে।
হজ্জে ইহরাম বাধার সময় থেকে ইহরাম খোলা পর্যন্ত ঐরূপ সংগ্রাম সাধনায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, মন থেকে এক একটা চিত্র মুছে ফেলে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতের চিত্র অংকিত করে। দীন রাত তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত করে শুধু মাত্র তওহীদের পতাকাবাহী হয়ে যায়।
সদকা ও যাকাতে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ দান করে মুমিন বান্দাহ ধনলিপ্সার প্রবণতা মুছে ফেলে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করে । হজ্জেও লোক তার সারাজীবনের সঞ্চিত ধন শুধু আল্লাহর মহব্বতে মুক্ত হস্তে দান করে এবং তার পথে কুরবানী করে তার সাথে কৃত ওয়াদা চুক্তি পূরণ করে। মোটকথা, হজ্জের দ্বারা আল্লাহর সাথে প্রেমপূর্ন সম্পর্ক, মন, চরিত্রের সংশোধন এবং আধাত্নিক উন্নতির সকল উদ্দেশ্য একই সাথে পূর্ণ হয়। তবে শর্ত এই যে, হজ্জ শুধু মাত্র যেন হজ্জের অনুষ্ঠান পালনের কাজ না হয়।
হজ্জের হাকীকত
হজ্জের হাকীকত বা মর্মকথা এই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতে সোপর্দ করে দেবে এবং একনিষ্ঠ মুসলমান হয়ে যাবে। আসলে আল্লাহ তায়ালার পাত সত্তা থেকে এ শক্তি আশা করা যায় যে, সংস্কার সংশোধনের সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য প্রচেষ্টা সত্বেও বান্দাহর জীবনে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তা হজ্জের করনীয় কাজগুলো এবং হজ্জের স্থানগুলোর বরকতে দূর হয়ে এবং সে হজ্জের মাধ্যমে এমন পাক সাফ হয়ে ফিরে আসবে যেন সে আজই জন্ম গ্রহণ করেছে। সেই সাথে প্রকৃত অবস্থার একটা কষ্টিপাথর ও বটে। অর্থাৎ কার হজ্জ প্রকৃত হজ্জ এবং কে হজ্জের সকল আরকান পালন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা সত্ত্বেও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আর এটাও সত্য যে, হজ্জের তাওফীক লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সম্পর্কে খুব কম আশাই করা যেতে পারে যে, অন্য কোনো উপায়ে তার সংশোধন হতে পারবে। এজন্য হজ্জ পালনকারীর জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, সে যেন তার আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনার পর্যালোচনা করে এবং এবং হজ্জের এক একটি রুকন আমল পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও অনুভূতির সাথে আদায় করে হজ্জের সেসব ফায়দা হাসিল করে যার জন্য ফরয করা হয়েছে।
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ) এর কাছে এক ব্যক্তি হাজির হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করে (হজ্জ করে) ফিরে এসেছে কিন্তু তার জীবনের উপর হজ্জের কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? সে বললো আমি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে  আসছি।
হযরত জুনাইদ (র) খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন। তুমি হজ্জ করেছ নাকি ?
মুসাফির –জি হ্যাঁ, আমি হজ্জ করেছি।
হযরত – যখন তুমি হজ্জের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হয়েছিলে, তখন তুমি গোনাহ থেকে দূরে ছিলে কি না ?
মুসাফির – হযরত আমি এভাবে চিন্তা করেনি।
হযরত – তাহলে তুমিতো হজ্জের জন্য মোটেও বের হওনি। আচ্ছা বলোতো তুমি এ পবিত্র ছফরে তুমি যেসব মনযিল অতিক্রম করেছ এবং যেখানে যেখানে রাত কাটিয়েছে তখন তুমি কি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনযিলগুলোও অতিক্রম করেছ কি না ?
মুসাফির – হযরত, আমারতো এসব খেয়ালই হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো না বায়তুল্লাহর দিকে কোনো সফর করেছ। আর না সেদিকে কোন মনযিল অতিক্রম করেছ। আচ্ছা বল তো তুমি যখন ইহরাম বাধলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক খুলে ফেললে তখন তার সাথে সাথে তোমার মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলো তোমার জীবন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলে কিনা?
মুসাফির- হযরত, এভাবে তো আমি চিন্তা করে দেখিনি।
হযরত জুনাইদ তখন খুব দুঃখ করে বললেন। তাহলে তুমি ইহরামই বা বাধলে কোথায়? আচ্ছা বলত যখন তুমি আরাফাতের ময়দানে দাড়ালে তখন কিছু মুশাহাদার অনুভূতি হয়েছিল কি?
মুসাফির- হযরত, এর অর্থই বুঝলাম না
হযরত -তার অর্থ এই যে, আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার সময় তুমি তোমার মধ্য এ অবস্থা কি অনুভব করেছ যে, তোমার রব তোমার সামনে এবং তুমি তাকে দেখছ?
মুসাফির- হযরত, এ অবস্থা তো আমার হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো আরাফাতে পৌঁছাওনি। আচ্ছা তারপর বল দেখি, মুযদালাফায় পৌছার পর তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পরিহার করেছ কিনা?
মুসাফির- হযরত, আমি এ বিষয় তো কোনো মনোযোগ দেইনি।
হযরত তাহলে তুমি তো মুযদালাফাও যাওনি। আচ্ছা, বল দেখি, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের জ্যোতি ও অলৌকিক শক্তি লক্ষ্য করেছ কি?
মুসাফির- হযরত আমি এর থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
হযরত -তাহলে তুমি মোটেই তাওয়াফ করনি। আচ্ছা, তারপর তুমি যখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে তখন সাফা মারওয়া ও তার মধ্যে সায়ী করার হিকমত, মর্মকথা ও তার উদ্দেশ্যে হাসিল করেছ কি?
মুসাফির এসবের তো কোনো অনুভূতিই আমার ছিল না।
হযরত-তাহলে তুমি বলতে গেলে সায়ীও করনি। তারপর তুমি কুরবানগাহে গিয়ে যে কুরবানী কররে, তখন তুমি তোমার প্রবৃত্তি ও তার কামনা বাসনাকেও কুরবানী করেছ কি?
মুসাফির- হযরত এদিক আমি লক্ষ্যই করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি কুরবানীই বা করলে কোথায়? আচ্ছা বল দেখি, তুমি জমরাতে পাথর মারলে, তখন তুমি তোমার অসৎ সহকর্মী, সাথী ও কুপ্রবৃত্তিকেও তোমার কাছ থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছ কি?
মুসাফির- তাতো করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি রামীও করোনি।
তারপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র) বড় দুঃখের সাথে বলেন, যাও ফিরে যাও এবং এরূপ মনে অবস্থাসহ আবার হজ্জ কর। যাতে করে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় যার ঈমান ও ওয়াদা পালনের স্বীকৃতি করতে গিয়ে কুরআন এ সাক্ষ্য দেয়-
*******আরবী*********
এবং তিনি ইবরাহীম (আ ) যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন।
হজ্জের মহত্ব ও গুরুত্ব
কুরআন ও সুন্নাতে হজ্জের হিকমত, দীনের মধ্যে হজ্জের মর্যাদা, তার মহত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছ। কুরআন বলে
*******আরবী*********
মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবার শক্তি সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ্জ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)
১. হজ্জ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারই বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাবার শক্তি সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্যে আল্লাহর হক আদায় করা ফরয। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, সেসব যালেম আল্লাহর হক নষ্ট করে। আয়াতের এ কথার দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত হযরত আলী (রা) এর বয়ান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবী (স) এর পক্ষ থেকে হজ্জ ফরয হওয়ার ঘোষণা তখনই করা হয় যখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযি-কিতাবুল হজ্জ)
এ অর্থে সহীহ মুসলিমেও একটি রেওয়ায়েত আছে, যাতে নবী (স) বলেন-
হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব হজ্জ আদায় কর।
২. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যের প্রতি এ আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে, সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করা কুফরী আচরণ, যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কুরআনে নামায ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছেঃ
*******আরবী*********
এবং  নামায কায়েম কর এবং (নামায ত্যাগ করে) মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।
ঠিক তেমনি আলোচ্য আয়াতের এ স্থানে হজ্জ না করাকে কুফরী আচরণ বলা হয়েছে। নবী (স) ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের জরুরী খরচের অর্থ সামগ্রী মওজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌছাতে পারে, তারপর সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ জন্যে যে আল্লাহ বলেন-
*******আরবী*********
হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য এই যে যারা হজ্জ করে না নবী (স) তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য বলেছেন। হজ্জ যারা করে না তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য এবং নামায যারা পড়ে না তাদেরকে মুশরিকদের সমতুল্য ঘোষণা করার মর্ম এই যে, আহলে কিতাব হজ্জ একবারে পরিত্যাগ করেছিল এবং মুশরিকগণ হজ্জ করলেও নামায পরিত্যাগ করেছিল। এজন্যে নামায পরিত্যাগ করাকে মুশরিকী ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জ পরিত্যাগ করাকে ইহুদী খৃষ্টানের ক্রিয়াকর্ম বলা হয়েছ। অতএব এটাও এক মোক্ষম সত্য যে, স্বয়ং কুরআনেও এ ধরনের লোককে এ সতর্কবাণীও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী আয়াতের শুধু প্রথম অংশ পাঠ করেছেন। নতুবা যে সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আয়াতের এ অংশে রয়েছে। যথাঃ
*******আরবী*********
যারা অর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ করতে অস্বীকার করার আচরণ দেখাবে তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। অর্থাৎ হজ্জ পরিত্যাগকারীর কুফরী আচরণের কোনো পরোয়া তিনি করেন না। তিনি ঐসব লোকের কোনো পরোয়া করেন না যে, তারা কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এ হচ্ছে সতর্কবাণীর বড়ো কঠিনতম প্রকাশভঙ্গী। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর তার অসন্তোষ ও মুখাপেক্ষহীনতার কথা ঘোষণা করেন, যে ঈমান ও হেদায়াত দ্বারা কি করে ভূষিত হতে পারে?
হযরত হাসান (রা) বলেন, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) বলেছেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা এই যে যেসব শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেসব শহরে কিছু লোক পাঠিয়ে দেব তারা খোজ খবর নিয়ে দেখবে যে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ করছে না। তাদের ওপর আমি জিযিয়া (জিযিয়া এমন এক প্রতিরক্ষা কর যা অমুসলিমদের নিকট থেকে তার জানমালের নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়) নির্ধারিত করে দেব। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়। (আল মুনতাকা)
মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর হজ্জের মর্মও এ ই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে। এরা যদি মুসলিম হতো তাহলে কি করে হজ্জের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতো এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও কি করে হজ্জ থেকে উদাসীন থাকতো?
হজ্জের ফযীলত ও প্রেরণা
হজ্জের এ গুরুত্বকে সামনে রেখে নবী (স) বিভিন্নভাবে এর প্রেরণা দান করেছেন। বিভিন্নভাবে এর অসাধারণ ফযীলত বর্ণনা করে এর জন্যে প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টি করেছেন।
১. যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে এলো, তারপর কোনো অশ্লীল যৌন ক্রিয়া করলো না, আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ করলো না, তাহলে সে গোনাহ থেকে এমনভাবে পাকসাফ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন পাকসাফ সে ঐদিন ছিল যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল। (বুখারী মুসলিম)
২. হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। সে তার মেযবান আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন, সে তার কাছে মাগফেরাত চাইলে তিনি তাকে মাগফেরাত দান করেন। (ইবনে মাজাহ)
৩. হ্জ্জ ও ওমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র ও অভাব এবং গোনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা দূর করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো একমাত্র জান্নাত। (তিরমিযি, নাসায়ী)
হজ্জে মাবরুর বলে এমন হজ্জকে যা পরিপূর্ণ এখলাস (নিষ্ঠা) অনুভূতি ও শর্তাবলীর পালনসহ আদায় করা হয় এবং যার মধ্যে হজ্জকারী আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেচে থাকার পুরোপুরি ব্যবস্থা করে।
৪. যদি কোনো হেরেম শরীফ যিয়ারতকারীর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়, তাহলে তার বাড়ী  পৌঁছাবার আগেই তাকে সালাম কর, তার সাথে মুসাফা কর এবং তাকে অনুরোধ কর তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাতের দোয়া করার। এজন্যে যে, তার গোনাহের মাগফেরাতের ফায়সালা করা হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ)
৫. হযরত হুসাইন (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর কাছে আরজ করলো, হুজুর, আমার শরীর মন উভয়ই দুর্বল। ইরশাদ হলো, তুমি এমন জেহাদ কর যাতে একটা কাটাও গায়ে না লাগে। প্রশ্নকারী বলে হুজুর, এমন জেহাদ আবার কেমন, যাতে কোনো আঘাত ও দুঃখ কষ্টের আশংকা নেই? নবী (স) ইরশাদ করেন, তুমি হজ্জ কর। (তাবারানী)
৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে নবী (স) এর একেবারে নিকটে সওয়ারীর উপরে ছিল এমন সময়ে হঠাৎ সে নীচে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে। নবী (স) বললেন, তাকে গোসল দিয়ে ইহরামের পোষাকসহই দাফন কর। এ কিয়ামতের দিনে তালবিয়া পড়া অবস্থায় ওঠবে। (তালবিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য)। তার মাথা ও মুখমন্ডল খোলা থাকতে দাও। (বুখারী, মুসলিম)
৭. হযরত আবু যর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ ) আল্লাহর কাছে আরয করে বলেন, পরওয়ারদেগার! যে বান্দাহ তোমার ঘর যিয়ারত করতে আসবে তাকে কি প্রতিদান দেয়া হবে? আল্লাহ বলেন, হে দাউদ! সে আমার মেহমান। তার অধিকার হচ্ছে এই যে, দুনিয়াতে আমি তার ভুলত্রুটি মাফ করে দেই এবং আখিরাতে যখন সে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে আমি আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি।

Thursday, June 29, 2017

তাওয়াফ, রমল, ইযতেবাগ ও ইস্তেলাম

ইস্তেলাম

ইস্তেলামের আভিধানিকদ অর্থ স্পর্শ করা এবং চুমো দেয়া। পারিভাষিক অর্থ হিজরে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এবং রুকনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা। তাওয়াফের প্রত্যেক পাক বা ঘূর্ণন শুরু করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা এবং তাওয়াফ শেষ করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা সুন্নাত। রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলাম মুস্তাহাব।
হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে চুমো দেয়ার সময় মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ না হয়। হিজরে আসওয়াদে শুধু মুখ রাখা মসনুন। এটাও লক্ষ্য  রাখতে হবে যে, অত্যন্ত ভিড়ের কারণে চুমো দেয়া সম্ভব না হরে কোনো ছড়ি প্রভৃতির দ্বারা হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমো দেবে। তাও সম্ভব না হলে দু হাতের তালু হিজরে আসওয়াদের দিকে করে হাত কান পর্যন্ত তুলে হাতে চুমো দেবে।
হিজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলামের ফযীলত সম্পর্কে নবী (স) বলেন-
আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জীবন দান করে ওঠাবেন। তার দুটি চোখ হবে যা দিয়ে সে দেখবে। তার মুখ হবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। যেসব বান্দাহ তার ইস্তেলাম করতে তাদের সপক্ষে সে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
রুকনে ইয়ামেনীর দোয়া
রুকনে ইয়ামেনীর ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- রুকনে ইয়ামেনীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছে। তারা ঐসব প্রত্যেক বান্দার দোয়ার পর আমীন বলে যারা এ দোয়া করেঃ
হে আল্লাহ! আমি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছ থেকে ক্ষমা ও স্বাচ্ছন্দ্য চাই। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর এবং নেক লোকদের সাথে বেহেশতে স্থান দাও।
তাওয়াফের প্রকার ও তার হুকুমাবলী
বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছয় প্রকার এবং প্রত্যেকের হুকুম পৃথক পৃথক।
১. তাওয়াফে যিয়ারতঃ একে তাওয়াফে ইফাদা এবং তাওয়াফে হজ্জও বলে। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের অন্যতম রুকন। কুরআন বলে *******আরবী********* এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করা উচিত। ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে তাওয়াফে যিরারতের কথাই বলা হয়েছে, যা আরাফাতে অবস্থানের পর দশ তারিখে করা হয়। কোনো কারণে যিলহজ্জের দশ তারিখে করতে না পারলে ১১/১২ তারিখেও করা যেতে পারে।
২. তাওয়াফে কুদুমঃ একে তাওয়াফে তাহিয়্যাও বলে। মক্কা প্রবেশের পর প্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। এ তাওয়াফ শুধু তাদের জন্য ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। (ইলমুল ফিকাহ ৫ম এবং কুদুরীতে একে মসনুন বলা হয়েছে। ইমাম মালেক (র) এর নিকট অবশ্য তাওয়াফে কুদুম ওয়াজিব বলা হয়েছ। তার যুক্তি এই যে, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে আসবে তার উচিত তাওয়াফে তাহিয়্যা করা। আয়নুল হেদায়া, প্রথম খন্ড,পৃঃ ৯৯৭) পরিভাষায় একে আফাকী বলে।
৩. তাওয়াফে বেদাঃ বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় নেবার সময় যে শেষ তাওয়াফ করা হয় তাকে বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর বলে। এ তাওয়াফও আফাকীর (মীকাতের বহিরাগত) জন্যে ওয়াজিব। এ তাওয়াফের পর মুলতাযেমের সাথে নিজেকে জড়িত করে বুক ও ডান গাল তাতে লগিয়ে এবং ডান হাতে বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে একান্ত বিনয় সহকারে ও অশ্রু কাতর কন্ঠে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে বিদায়ের সময় এবং বলা যায় না যে আবার কখন এ সৌভাগ্য হবে। এ এ তাওয়াফ সম্পর্কে নবী (স) এর হেদায়াত হচ্ছে-
কেউ যেন বিদায়ী তাওয়াফ না করে বায়তুল্লাহ থকে ফিরে না যায়। শুধু মাত্র ঐ মেয়েলোকের জন্যে অনুমতি আছে যার হায়েয হয়েছে। (বুখারী)
৪. তাওয়াফে উমরাহঃ এ হচ্ছে উমরার তাওয়াফ যা উমরার রুকন।এ তাওয়াফ ছাড়া উমরাহ হবে না।
৫. তাওয়াফে নযরঃ কেউ তাওয়াফে নযর মানলে তা করা ওয়াজিব।
৬. নফল তাওয়াফঃ এটা যে কোনো সময়ে করা যায়। মক্কায় যতদিন থাকার সুযোগ হয়। বেশী বেশী তাওয়াফ করার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর মানুষের কি হতে পারে?
তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ
তাওয়াফের মধ্যে নয়টি জিনিস যত্ন সহকারে পালন করা ওয়াজিব।
১. নাজাসাতে হুকমীঃ অর্থাৎ হাদীসে আসগার ও হাদীসে আকবার থেকে পাক হওয়া। মেয়েদের জন্যে হায়েয, নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। হযরত আয়েশা (রা) এর হজ্জের সময় মাসিক ঋতু শুরু হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। নবী (স) বলেন, এতে কাদার কি আছে? এ এমন জিনিস যা আদম কন্যাদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। তুমি ওসব কাজ করতে থাক যা হাজীদের করতে হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি তার থেকে পাক হবে। (বুখারী, মুসলিম)
২. সতরে আওরতঃ অর্থাৎ শরীরের ঐসব অংশ ঢেকে রাখা যা ঢাকা জরুরী। নবী (স) বলেনঃ *******আরবী********* অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে (সতর খুলে) কেউ যেন তাওয়াফ না করে। (বুখারী)
৩. হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম থেকে তাওয়াফ শুরু করা।
৪. তাওয়াফ ডান দিক থেকে শুরু করা। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) মক্কায় তশরিফ আনার পর সর্বপ্রথম তিনি হিজরে আসওয়াদের নিকট গেলেন, তার ইস্তেলাম করলেন এবং তারপর ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন।
৫. পায়ে হেটে তাওয়াফ করা। ওজর থাকলে সওয়ারীতে তাওয়াফ জায়েয। নফল তাওয়াফ বিনা ওজরে সওয়ারিতে জায়েয। কিন্তু পায়ে হেটে করাই ভালো।
৬. তাওয়াফের প্রথম চার ফরয চক্করের পর বাকী তিন চক্কর (শওত) পুরো করা।
৭. সাত তাওয়াফে শেষ করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা নবী (স) এর সাথে বায়তুল্লাহ পৌছার পর তিনি হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করলেন। প্রথম তিন চক্করে তিনি রমল (পরিভাষা দ্রঃ) করলেন, বাকী চারটি সাধারণভাবে করলেন। তারপর তিনি মাকে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ  (এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী জায়নামায বানিয়ে নাও) তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে মাকামে ইবরাহীম তার ও বায়তুল্লাহর মধ্যখানে রইলো তারপর তিনি নামায পড়লেন। (মুসলিম)
৮. হাতীমের বাইরে থেকে তাওয়াফ করা যাতে করে হাতীম তাওয়াফের মধ্যে শামিল হয়।
৯. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা।
তাওয়াফে দোয়া
খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার জন্য হিজরে আসওয়াদের নিকট পৌছলে *******আরবী********* বলে নিম্ন দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তোমার ওপর ঈমান এনে, তোমার কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে, তোমার নবী (স) এর সুন্নাতের অনুসরণে (এ ইস্তেলাম এবং তাওয়াফের কাজ শুরু করছি)।
তাওয়াফের সময় আস্তে আস্তে এ দোয়া পড়তে হবেঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, সকল প্রশংসা তার জন্যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই যে সৎপথে চালাতে পারে এবং কোনো শক্তি নিই যে পাপাচার থেকে বাচাতে পারে।
যখন রুকনে ইয়ামেনী পৌছবে তখন রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পড়বে।
*******আরবী*********
নিম্নের দোয়াও পড়বে-
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তৃপ্তি দান কর যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তার ওপর এবং তার মধ্যেই আমাকে বরকত দান কর। আর প্রত্যেকটি অদৃশ্য বস্তুতে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণসহ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাও।
তার সাথে নিম্নের দোয়াও পড়া ভালোঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই, প্রশংসা সব তারই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।
তাওয়াফের মাসায়েল
১. প্রত্যেক তাওয়াফ অর্থাৎ চক্কর পুরো করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া ওয়াজিব। দু তাওয়াফ একত্র করা এবং মাঝখানে নামায না পড়া মাকরূহ তাহরিমী।
২. সাত চক্কর দেয়ার পর যদি কেউ অষ্টম চক্কর দেয় তাহরে অতিরিক্ত ছয় চক্কর দিয়ে আর এক তাওয়াফ করা দরকার। এজন্য যে নফল ইবাদাত শুরু করার পর তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৩. যেসব সময়ে নামায মাকরূহ। যেসব সময়ে তাওয়াফ মাকরূহ নয়।
৪. তাওয়াফ করার সময় পাঞ্জেগানা নামাযের মধ্যে কোনো নামাযের সময় এলে, অথবা জানাযা এলে অথবা অযূর প্রয়োজন হলে, এসব থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে তাওয়াফ শুরু করার প্রয়োজন নেই। যেখানে ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই আবার শুরু করে তাওয়াফ পুরো করবে।
৫. তাওয়াফ করতে করতে যদি ভুলে যায় যে, কত চক্কর হলো তাহলো নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে যদি কোনো নির্ভরযোগ্য লোক স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তার কথামতো কাজ করবে।
৬. তাওয়াফের সময় খানাপিনা করা, বেচাকেনা করা, গুনগুন করে কবিতা পাঠ বা গান করা এবং বিনা প্রয়োজনে কথা বলা মাকরূহ।
৭.তাওয়াফকালে নাজাসাতে হাকীকী থেকে পাক হওয়া মসনুন।
৮. হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের প্রথমে যে তাওয়াফ করা হয় তাতে রমল করা মসনুন এবং ইযতেবাগও মসনুন। (এগুলোর জন্যে পরিভাষা দ্রঃ)
রমল
কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলা, যাতে করে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে। একে বলা হয় রমল।
নবী (স) যখন সপ্তম হিজরিতে বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম (রা) সহ ওমরাহ করার জন্যে মক্কায় আসেন, তখন কিছু লোক পরস্পর এভাবে বলাবলি করতে থাকে এদের কি অবস্থা। এরা বড়ো দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে। আসলে মদীনার আবহাওয়া বড্ড খারাপ।
নবী (স) যখন মক্কাবাসীদের এসব কথা শুনতে পান  তখন তিনি হুকুম দেন তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল কর অর্থাৎ দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহদের  সে সময়ের আচরণ এতো পসন্দ করেন যে, তা স্থায়ী সুন্নাত হিসবে গণ্য হয়।
যে তাওয়াফে সায়ী করা হয় শুধু তাতে রমল সুন্নাত। অতএব যদি কেউ তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করতে না চায়, সে এ তাওয়াফে রমল করবে না। কিন্তু তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে যার পরে তাকে সায়ী করতে হয়। তেমনি কেরান হজ্জকারী যদি তাওয়াফে ওমরায় রমর করে থাকে তাহলে তাওয়াফে হজ্জ রমল করবে না। যদি কেউ প্রথম তিন চক্করে রমল করতে ভুলে যায় তাহলে পরে আর মোটেই করবে না। সাত চক্করেই রমল করা মাকরূহ তানযীহি।

ইযতেবাগ

চাদর প্রভৃতি এমন ভাবে গায়ে দেয়া যাতে  করে তার এক কিনারা ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে গায়ে দেয়া এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা। এভাবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।