Thursday, June 29, 2017

তাওয়াফ, রমল, ইযতেবাগ ও ইস্তেলাম

ইস্তেলাম

ইস্তেলামের আভিধানিকদ অর্থ স্পর্শ করা এবং চুমো দেয়া। পারিভাষিক অর্থ হিজরে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এবং রুকনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা। তাওয়াফের প্রত্যেক পাক বা ঘূর্ণন শুরু করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা এবং তাওয়াফ শেষ করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা সুন্নাত। রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলাম মুস্তাহাব।
হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে চুমো দেয়ার সময় মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ না হয়। হিজরে আসওয়াদে শুধু মুখ রাখা মসনুন। এটাও লক্ষ্য  রাখতে হবে যে, অত্যন্ত ভিড়ের কারণে চুমো দেয়া সম্ভব না হরে কোনো ছড়ি প্রভৃতির দ্বারা হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমো দেবে। তাও সম্ভব না হলে দু হাতের তালু হিজরে আসওয়াদের দিকে করে হাত কান পর্যন্ত তুলে হাতে চুমো দেবে।
হিজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলামের ফযীলত সম্পর্কে নবী (স) বলেন-
আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জীবন দান করে ওঠাবেন। তার দুটি চোখ হবে যা দিয়ে সে দেখবে। তার মুখ হবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। যেসব বান্দাহ তার ইস্তেলাম করতে তাদের সপক্ষে সে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
রুকনে ইয়ামেনীর দোয়া
রুকনে ইয়ামেনীর ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- রুকনে ইয়ামেনীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছে। তারা ঐসব প্রত্যেক বান্দার দোয়ার পর আমীন বলে যারা এ দোয়া করেঃ
হে আল্লাহ! আমি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছ থেকে ক্ষমা ও স্বাচ্ছন্দ্য চাই। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর এবং নেক লোকদের সাথে বেহেশতে স্থান দাও।
তাওয়াফের প্রকার ও তার হুকুমাবলী
বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছয় প্রকার এবং প্রত্যেকের হুকুম পৃথক পৃথক।
১. তাওয়াফে যিয়ারতঃ একে তাওয়াফে ইফাদা এবং তাওয়াফে হজ্জও বলে। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের অন্যতম রুকন। কুরআন বলে *******আরবী********* এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করা উচিত। ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে তাওয়াফে যিরারতের কথাই বলা হয়েছে, যা আরাফাতে অবস্থানের পর দশ তারিখে করা হয়। কোনো কারণে যিলহজ্জের দশ তারিখে করতে না পারলে ১১/১২ তারিখেও করা যেতে পারে।
২. তাওয়াফে কুদুমঃ একে তাওয়াফে তাহিয়্যাও বলে। মক্কা প্রবেশের পর প্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। এ তাওয়াফ শুধু তাদের জন্য ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। (ইলমুল ফিকাহ ৫ম এবং কুদুরীতে একে মসনুন বলা হয়েছে। ইমাম মালেক (র) এর নিকট অবশ্য তাওয়াফে কুদুম ওয়াজিব বলা হয়েছ। তার যুক্তি এই যে, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে আসবে তার উচিত তাওয়াফে তাহিয়্যা করা। আয়নুল হেদায়া, প্রথম খন্ড,পৃঃ ৯৯৭) পরিভাষায় একে আফাকী বলে।
৩. তাওয়াফে বেদাঃ বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় নেবার সময় যে শেষ তাওয়াফ করা হয় তাকে বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর বলে। এ তাওয়াফও আফাকীর (মীকাতের বহিরাগত) জন্যে ওয়াজিব। এ তাওয়াফের পর মুলতাযেমের সাথে নিজেকে জড়িত করে বুক ও ডান গাল তাতে লগিয়ে এবং ডান হাতে বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে একান্ত বিনয় সহকারে ও অশ্রু কাতর কন্ঠে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে বিদায়ের সময় এবং বলা যায় না যে আবার কখন এ সৌভাগ্য হবে। এ এ তাওয়াফ সম্পর্কে নবী (স) এর হেদায়াত হচ্ছে-
কেউ যেন বিদায়ী তাওয়াফ না করে বায়তুল্লাহ থকে ফিরে না যায়। শুধু মাত্র ঐ মেয়েলোকের জন্যে অনুমতি আছে যার হায়েয হয়েছে। (বুখারী)
৪. তাওয়াফে উমরাহঃ এ হচ্ছে উমরার তাওয়াফ যা উমরার রুকন।এ তাওয়াফ ছাড়া উমরাহ হবে না।
৫. তাওয়াফে নযরঃ কেউ তাওয়াফে নযর মানলে তা করা ওয়াজিব।
৬. নফল তাওয়াফঃ এটা যে কোনো সময়ে করা যায়। মক্কায় যতদিন থাকার সুযোগ হয়। বেশী বেশী তাওয়াফ করার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর মানুষের কি হতে পারে?
তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ
তাওয়াফের মধ্যে নয়টি জিনিস যত্ন সহকারে পালন করা ওয়াজিব।
১. নাজাসাতে হুকমীঃ অর্থাৎ হাদীসে আসগার ও হাদীসে আকবার থেকে পাক হওয়া। মেয়েদের জন্যে হায়েয, নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। হযরত আয়েশা (রা) এর হজ্জের সময় মাসিক ঋতু শুরু হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। নবী (স) বলেন, এতে কাদার কি আছে? এ এমন জিনিস যা আদম কন্যাদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। তুমি ওসব কাজ করতে থাক যা হাজীদের করতে হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি তার থেকে পাক হবে। (বুখারী, মুসলিম)
২. সতরে আওরতঃ অর্থাৎ শরীরের ঐসব অংশ ঢেকে রাখা যা ঢাকা জরুরী। নবী (স) বলেনঃ *******আরবী********* অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে (সতর খুলে) কেউ যেন তাওয়াফ না করে। (বুখারী)
৩. হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম থেকে তাওয়াফ শুরু করা।
৪. তাওয়াফ ডান দিক থেকে শুরু করা। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) মক্কায় তশরিফ আনার পর সর্বপ্রথম তিনি হিজরে আসওয়াদের নিকট গেলেন, তার ইস্তেলাম করলেন এবং তারপর ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন।
৫. পায়ে হেটে তাওয়াফ করা। ওজর থাকলে সওয়ারীতে তাওয়াফ জায়েয। নফল তাওয়াফ বিনা ওজরে সওয়ারিতে জায়েয। কিন্তু পায়ে হেটে করাই ভালো।
৬. তাওয়াফের প্রথম চার ফরয চক্করের পর বাকী তিন চক্কর (শওত) পুরো করা।
৭. সাত তাওয়াফে শেষ করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা নবী (স) এর সাথে বায়তুল্লাহ পৌছার পর তিনি হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করলেন। প্রথম তিন চক্করে তিনি রমল (পরিভাষা দ্রঃ) করলেন, বাকী চারটি সাধারণভাবে করলেন। তারপর তিনি মাকে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ  (এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী জায়নামায বানিয়ে নাও) তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে মাকামে ইবরাহীম তার ও বায়তুল্লাহর মধ্যখানে রইলো তারপর তিনি নামায পড়লেন। (মুসলিম)
৮. হাতীমের বাইরে থেকে তাওয়াফ করা যাতে করে হাতীম তাওয়াফের মধ্যে শামিল হয়।
৯. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা।
তাওয়াফে দোয়া
খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার জন্য হিজরে আসওয়াদের নিকট পৌছলে *******আরবী********* বলে নিম্ন দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তোমার ওপর ঈমান এনে, তোমার কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে, তোমার নবী (স) এর সুন্নাতের অনুসরণে (এ ইস্তেলাম এবং তাওয়াফের কাজ শুরু করছি)।
তাওয়াফের সময় আস্তে আস্তে এ দোয়া পড়তে হবেঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, সকল প্রশংসা তার জন্যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই যে সৎপথে চালাতে পারে এবং কোনো শক্তি নিই যে পাপাচার থেকে বাচাতে পারে।
যখন রুকনে ইয়ামেনী পৌছবে তখন রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পড়বে।
*******আরবী*********
নিম্নের দোয়াও পড়বে-
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তৃপ্তি দান কর যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তার ওপর এবং তার মধ্যেই আমাকে বরকত দান কর। আর প্রত্যেকটি অদৃশ্য বস্তুতে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণসহ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাও।
তার সাথে নিম্নের দোয়াও পড়া ভালোঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই, প্রশংসা সব তারই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।
তাওয়াফের মাসায়েল
১. প্রত্যেক তাওয়াফ অর্থাৎ চক্কর পুরো করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া ওয়াজিব। দু তাওয়াফ একত্র করা এবং মাঝখানে নামায না পড়া মাকরূহ তাহরিমী।
২. সাত চক্কর দেয়ার পর যদি কেউ অষ্টম চক্কর দেয় তাহরে অতিরিক্ত ছয় চক্কর দিয়ে আর এক তাওয়াফ করা দরকার। এজন্য যে নফল ইবাদাত শুরু করার পর তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৩. যেসব সময়ে নামায মাকরূহ। যেসব সময়ে তাওয়াফ মাকরূহ নয়।
৪. তাওয়াফ করার সময় পাঞ্জেগানা নামাযের মধ্যে কোনো নামাযের সময় এলে, অথবা জানাযা এলে অথবা অযূর প্রয়োজন হলে, এসব থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে তাওয়াফ শুরু করার প্রয়োজন নেই। যেখানে ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই আবার শুরু করে তাওয়াফ পুরো করবে।
৫. তাওয়াফ করতে করতে যদি ভুলে যায় যে, কত চক্কর হলো তাহলো নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে যদি কোনো নির্ভরযোগ্য লোক স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তার কথামতো কাজ করবে।
৬. তাওয়াফের সময় খানাপিনা করা, বেচাকেনা করা, গুনগুন করে কবিতা পাঠ বা গান করা এবং বিনা প্রয়োজনে কথা বলা মাকরূহ।
৭.তাওয়াফকালে নাজাসাতে হাকীকী থেকে পাক হওয়া মসনুন।
৮. হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের প্রথমে যে তাওয়াফ করা হয় তাতে রমল করা মসনুন এবং ইযতেবাগও মসনুন। (এগুলোর জন্যে পরিভাষা দ্রঃ)
রমল
কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলা, যাতে করে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে। একে বলা হয় রমল।
নবী (স) যখন সপ্তম হিজরিতে বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম (রা) সহ ওমরাহ করার জন্যে মক্কায় আসেন, তখন কিছু লোক পরস্পর এভাবে বলাবলি করতে থাকে এদের কি অবস্থা। এরা বড়ো দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে। আসলে মদীনার আবহাওয়া বড্ড খারাপ।
নবী (স) যখন মক্কাবাসীদের এসব কথা শুনতে পান  তখন তিনি হুকুম দেন তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল কর অর্থাৎ দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহদের  সে সময়ের আচরণ এতো পসন্দ করেন যে, তা স্থায়ী সুন্নাত হিসবে গণ্য হয়।
যে তাওয়াফে সায়ী করা হয় শুধু তাতে রমল সুন্নাত। অতএব যদি কেউ তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করতে না চায়, সে এ তাওয়াফে রমল করবে না। কিন্তু তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে যার পরে তাকে সায়ী করতে হয়। তেমনি কেরান হজ্জকারী যদি তাওয়াফে ওমরায় রমর করে থাকে তাহলে তাওয়াফে হজ্জ রমল করবে না। যদি কেউ প্রথম তিন চক্করে রমল করতে ভুলে যায় তাহলে পরে আর মোটেই করবে না। সাত চক্করেই রমল করা মাকরূহ তানযীহি।

ইযতেবাগ

চাদর প্রভৃতি এমন ভাবে গায়ে দেয়া যাতে  করে তার এক কিনারা ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে গায়ে দেয়া এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা। এভাবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।

Monday, June 26, 2017

নফল রোযার ফযিলত ও মাসায়েল


শাওয়ালের ছয় রোযা
এ রোযার অনেক ফযিলত হাদীসে বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং পরপর শাওয়ালের ছয় রোযা করলো, সে যেন হামেশা রোযা রাখলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)
নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং তারপর শাওয়ালের ছটি রোযা রাখলো সে গোনাহ তেকে এমন পাক হলো যেন তার মা তাকে আজই  প্রসব করলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)
এটা জরুরী নয় যে, সে রোযাগুলো ঈদের পর একত্রে করতে হবে। একত্রেও করা যায় এবং মাঝে বাদ দিয়েও করা যায়।
তবে শাওয়ালের ছয় তারিখে এ রোযা শুরু করা ভালো। তবে তা জরুরী নয়। পুরো মাসের মধ্যে যখনই সুবিধা হয় করা যেতে পারে।
আশুরার দিনের রোযা
মহররমের দশ তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বা আশুরার দিন বলে। ঐ দিনে মক্কার কুরাইশরাও রোযা রাখতো এবং কাবা ঘরে নতুন গেলাব চড়াতো। এ রোযাকে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর প্রতি আরোপ করা হতো। নবী (স) নিজেও এ রোযা রাখতেন। তারপর যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন দেখলেন যে, ইহুদীরাও সে রোযা রাখছে। তখন তিনিও ঐ দিন রোযা রাখলেন এবং সকল সাহাবীকে রোযা রাখার তাকীদ করলেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন ইহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাছে এ দিনের কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ? তারা বলল, এ বড় মহত্বপূর্ণ দিন। এ দিনে আল্লাহ হযরত মূসা (আ ) কে এবং তার জাতিকে নাজাত দান করেন ও ফেরাউন এবং তার লোক লস্করকে নিমজ্জিত করেন। এজন্যে মূসা (আ ) আল্লাহর অনুগ্রহের শোকারগুজারির জন্য ঐ দিন রোযা রাখেন। আমরাও এ জন্যে এ দিনে রোযা রাখি।
নবী (স) বলেন, মুসা (আ ) এর সাথে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশী। আর আমরা এ জিনিসের বেশী হকদার যে এ দিন আমরা রোযা রাখি।
তারপর নবী (স) স্বয়ং সে দিন রোযা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোযা রাখার হুকুম দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)
দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ অথবা এগার তারিখ রোযা রাখা ভালো যাতে করে সেদিনের ফযীলতও লাভ করা যায় এবং ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্যও না হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) স্বয়ং এ রোযা রাখা শুরু করেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার তাকীদ করেন। তখন সাহাবীগণ আরজ  করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ দিনকে তো ইহুদী-নাসারাগণ বড় দিন হিসেবে পালন করে। আমরা ঐদিনে রোযা রাখলে তো তাদের সাথে সাদৃশ্য হয়। তখন তিনি বলেন, সামনে বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখে রোযা রাখবো। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কিন্তু সামনে বছর আসার পূর্বেই নবী (স) ইন্তেকাল করেন। (মুসলিম)
আরাফাতের দিনের রোযা
হজ্জের মাসের নয় তারিখকে ইয়াওমে আরফা বা আরাফাতের দিন বলা হয়। হাদীসে এ দিনের রোযার অনেক ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। নবী (স)বলেন, আমি আল্লাহর সত্তা থেকে এ আশা রাখি যে, আরাফাতের দিনের রোযা আগামী বছর ও গত বছর এ উভয় বছরের কাফফারা বলে গণ্য হবে। (তিরমিযি)
আরাফার দিনের রোযার সওয়াব এক হাজার দিনের রোযার সমান। (তিরমিযি)
নবী (স)এ দিনে রোযার যত্ন নিতেন। আরাফার দিনের আগের আট দিনের রোযারও বড়ো সওয়াব আছে।
নবী (স)বলেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের মত আল্লাহর নিকট কোনো দিনই এত প্রিয় নয়। এ দশ দিনের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমান এবং এসব রাতের নফল নামায শবে দকর এর নফরে সমান।
আইয়ামে বীযের রোযা
প্রত্যেক চাঁদ মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীয বলে। এ হচ্ছে শুক্লপক্ষের বিশেষ কয়েকটি দিন। এগুলোকে বলা হয় আইয়ামে বীয- (উজ্জ্বল জোস্না প্লাবিত তারিখগুলো)। নবী (স) এ দিনগুলোর রোযার বড়ো তাকীদ করতেন।
হযরত কাতাদাহ বিন মালহান (রা) বলেন, নবী (সা) আমাদেরকে তাকীদ করতেন যে, আমরা যেন চাঁদের তের, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে রোযা রাখি। তিনি বলতেন, এ তিন রোযা সওয়াবের দিক দিয়ে হামেশা রোযা রাখার বরাবর। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা
নবী (স) স্বয়ং সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন এবং সাহাবীগণকে রাখার তাকীদ করতেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সা) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। (তিরমিযি, নাসায়ী)
উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে নবী (সা) বলেন,সোম ও বৃহস্পতিবার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। আমি চাই যে, যেদিন আমার আমল পেশ করা হয় সেদিন রোযা রাখি। (তিরমিযি)
একবার সাহাবীগণ নবী (স)কে সোমবার রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বললেনঃ ঐদিন আমার জন্ম হয়েছিল এবং ঐদিনই আমার ওপর কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। (মুসলিম)
নফল রোযার বিভিন্ন মাসায়েল
১. নফল রোযা রাখার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোনো কারণে নষ্ট হলে বা নষ্ট করলে কাযা ওয়াজিব হয়ে যায়।
২. বিনা ওজরে নফল রোযাও ভাঙা জায়েয নয়। অবশ্যই নফল রোযা ফরয রোযার তুলনায় সামান্য ওজরে ভাঙা যায়।
৩. কেউ রোযাদারকে খানার দাওয়াত করলো এবং মনে করা হলো যে, মেহমান না খেয়ে মেজবান অসন্তুষ্ট হবে অথবা সে মেহমানকে ছেড়ে খেতে রাজী হবে না অথবা না খেলে মেজবান মনে আঘাত পাবে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয। কিন্তু রোযাদারের উচিত তার কাযা আদায় করা।
৪. মেয়েদের জন্যে রমযানের রোযা ছাড়া অন্য যে কোনো রোযা স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা মাকরূহ তাহরীমি। যদি কেউ রাখে এবং তার স্বামী রোযা ভাঙতে বলে তাহলে ভেঙে দেয়া জরুরী। তারপর সে রোযার কাযাও স্বামীর অনুমতি নিয়ে করবে।
৫. যদি কেউ ঐসব দিনে রোযা রাখার মানত করে যেসব দিনে রোযা রাখা হারাম। যেমন, দু ঈদের দিন। তাহলে অন্য কোনো দিনে রাখবে।
৬. কেউ নফল রোযা রাখলো এবং তার বাড়ীতে মেহমান এলো। এখন সে যদি মেহমানের সাথে খানা না খায় তাহলে মেহমান অসন্তুষ্ট হবে। এমন অবস্থায় নফল রোযা ভাঙা জায়েয।
৭. কেউ ঈদের দিনে রোযার নিয়ত করলো এবং রোযা রাখলো। তারও উচিত রোযা ভেঙে ফেলা এবং তার কাযা করা।
৮. রমযানের এক দুদিন আগে রোযা রাখা ঠিক নয়। নবী (স)বলেন, কেউ যেন রমযানের এক দুদিন আগে রোযা না রাখে। কিন্তু যদি কেউ ঐ দিন রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রাখতে পারে। (বুখারী)

Wednesday, June 14, 2017

লায়লাতুল কদর


রমযানের শেষ দশদিনের মধ্যে এমন এক রাত আছে যাকে লায়লাতুল কদর এবং লায়লাতুম মুবারাকাতুন বলা হয়েছে এবং তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম বলা হয়েছে।
কুরআন বলেঃ
*******আরবী*********
আমরা এ কিতাবকে এর মুবারক রাতে নাযিল করেছি।
দ্বিতীয় আর এক স্থানে কুরআন বলেঃ
*******আরবী*********
অবশ্যই আমরা এ কুরআনকে লায়লাতুল কদরে নাযিল করেছি। তুমি জান, লায়লাতুল কদর কি? তা হচ্ছে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। (সূরা আল কদর)

লায়লাতুল কদরের অর্থ
কদরের দুটি অর্থ
এক- নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
*******আরবী*********
ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় আমাদের নির্দেশক্রমে। (সূরা দুখান)
কুরআনের অন্যত্র আছেঃ
*******আরবী*********
এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং বিশেষ করে জিবরাঈল নাযিল হন যারা তাদের রবের নির্দেশে সকল কার্য সম্পাদনের জন্যে নীচে নেমে আসেন। (সূরা আল কদরঃ ৪)
দুই কদরের দ্বিতীয় অর্থ মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত আল্লাহর নিকট যার বিরাট মহত্ব ও ফযীলত রয়েছে। তার মর্যাদা ও মহত্বের এ প্রমাণই যথেষ্ট যে, আল্লাহ সে রাতে কুরআনের মতো বিরাট নিয়ামত নাযিল করেছেন। এর চেয়ে বৃহত্তর কোনো নিয়ামত না মানুষ ধারণা করতে পারে আর না কামনা করতে পারে। এ মঙ্গল ও বরকত এবং মহত্ব ও ফযীলতের ভিত্তিতেই কুরআন তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে ঘোষণা করেছে।
লায়লাতুল কদর নির্ধারণ
হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, এ রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোনো একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে অথবা ২৯শে রাত। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন- রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)
এ রাতকে সুস্পষ্ট করে চিহ্নিত না করার তাৎপর্য এই যে, রমযানের এ শেষ দশদিনে যাতে করে যিকির ও ইবাদাতের বেশী করে ব্যবস্থাপনা করা যায়।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) রমযানের শেষ দশ দিন যিকির ও ইবাদাতের এমন ব্যবস্থা করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না। (মুসলিম)
এ রাতে বেশী বেশী নামায বন্দেগী, যিকির, তাসবিহ ইত্যাদির প্রেরণা দান করে নবী (স) বলেন, যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহম ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাড়িয়ে বসে আল্লাহর ইয়াদ ও ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী)
নবী (সা) আরও বলেন, লোক সকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে যে ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ)
লায়লাতুল কদরের খাস দোয়া
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি তাকে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি কোন রাতটি লায়লাতুল কদর, তাহলে কি দোয়া করবো? তার জবাবে নবী (স) বলেন, এ দোয়া পড়বে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করেনেওয়ালা এবং বড়োই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমার গুনাহগুলো মাফ করে দাও।
সদকায়ে ফিতরের হুকুম আহকাম
যে বছর মুসলমানদের ওপর রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার জন্যে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেন। আল্লাহর ফরয করা ইবাদাতগুলো বান্দাহ সকল শর্ত ও নিয়মনীতি সহ পালন করার ব্যবস্থা করে, কিন্তু জ্ঞাত অজ্ঞাতসারে তার মধ্যে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে যায়। রোযার মধ্যে যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তার ক্ষতিপূরণের জন্যে রমযানের শেষে সদকায়ে ফিতর শরীয়তে ওয়াজিব করে দিয়েছে। এর দ্বারা তাদের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণও হবে এবং গরীব দুঃখী মুসলমান নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া পরার জিনিস পত্র সংগ্রহ করে সকল মুসলমানদের সাথে ঈদের নামাযে শরীক হতে পারবে।
যেসব সচ্ছল ব্যক্তির কাছে তার প্রয়োজন পূরণের পর এতোটা সম্পদ থাকবে যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ হয়, সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক তাকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
সদকায়ে ফিতর ঈদের দু একদিন আগে দিয়ে দিলে বেশী ভালো হয় নতুবা ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উচিত। ঈদের নামাযের পূর্বে দেয়া মুস্তাহাব।
গম দিতে হলে এক সের তিন ছটাক- যব তার দ্বিগুণ। কারো কারো মতে গম এক সের সারে বারো ছটাক। খুরমা মুনাক্কা গমের দ্বিগুণ দিতে হবে।
সদকায়ে ফিতর ঐ লোককে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া হয়।

এতেকাফের বয়ান


অভিধানে কোনো স্থানে আটকে পড়া অথবা কোনো স্থানে থেমে যাওয়াকে এতেকাফ বলে। শরীয়াতের পরিভাষায় এতেকাফের অর্থ কোনো লোকের দুনিয়ার সংস্রব, সম্বন্ধ ও বিবি বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে মসজিদে অবস্থান করা।
এতেকাফের মর্মকথা
এতেকাফ হচ্ছে এই যে, মানুষ দুনিয়াবি কারবার ও সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সাংসারিক কর্ম ব্যস্ততা ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা ও কাজের শক্তি এবং যোগ্যতাকে আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদাতে লাগিয়ে দেবে। তারপর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর প্রতিবেশী হয়ে পড়বে। এ কাজের দ্বারা একদিকে সে ব্যক্তি সকল প্রকার বেহুদা কথাবার্তা ও মন্দ কাজ থেকে বেচে থাকতে পারবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। তার নৈকট্য লাভ করবে এবং তার ইয়াদ ও ইবাদাতে মনে শান্তি লাভ করবে। কয়েকদিনের তারবিয়াতের এ আমল তার মনের ওপর এমন গভীর ছাপ ফেলবে যে, চারিদিকে দুনিয়ার রং তামাশা ও মন ভুলানো বস্তুসমূহ দেখার পরও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত রাখতে পারবে। আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাচতে পারবে এবং তার হুকুম পালন করে আনন্দ অনুভব করবে। এমনিভাবে সমগ্র জীবন আল্লাহর বন্দেগীতে কাটিয়ে দেবে।
এতেকাফের প্রকারভেদ
এতেকাফ তিন প্রকার ওয়াজিব, মুস্তাহাব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
ওয়াজেব এতেকাফ
মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। কেউ এমনি এতেকাফের মানত করলো অথবা কোনো শর্তসহ মানত করলো যেমন কেউ বললো, যদি আমি পরীক্ষায় পাশ করি, অথবা যদি আমার অমুক কাজ হয়ে যায় তাহলে এতেকাফ করবো। তাহলে এ এতেকাফ ওয়াজিব হবে এবং তা পূরণ করতে হবে।
মুস্তাহাব এতেকাফ
রমযানে শেষ দশদিন ব্যতিরেকে যতো এতেকাফ করা হবে তা মুস্তাহাব হবে তা রমযানের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দশদিনে অথবা যে কোনো মাসে করা হোক।
সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এতেকাফ
রমযানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করা সুন্নাত মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ মুসলমানদের সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাতের ব্যবস্থাপনা করা উচিত কারণ হাদীসগুলোতে এ বিষয়ে তাকীদ করা হয়েছে।
কুরআন পাকে আছেঃ
*******আরবী*********
আপন স্ত্রীদের সাথে মিলিত হইও না যখন তোমরা মসজিদে এতেকাফ থাকবে। (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৭)
নবী (স) নিয়মিতভাবে প্রতি বছর এতেকাফ করতেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তা পালন করেন। একবার কোনো কারণে এতেকাফ করতে পারেননি বলে পরের বছর বিশদিন পর্যন্ত এতেকাফ করেন। এজন্যে মুসলমানগণ যদি সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাত পরিত্যাগ করে তাহরে গোনাহগার হবে। যদি বস্তির কিছু লোকও এ সুন্নাত পালনের ব্যবস্থাপনা করে তাহলে, যেহেতু তা সুন্নাতে কেফায়া, এ অল্প লোকের এতেকাফ সকলের জন্যে যথেষ্ট হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে যদি গোটা মুসলিম সমাজ এর থেকে বেপরোয়া হয়ে পড়ে এবং নবীর এ প্রিয় সুন্নাতটি একেবারে টিমে যাবে।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এ আমল তার মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে। তার এন্তেকালের পর তার বিবিগণ এতেকাফের নিয়ম পালন করেন। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এক বছর তিনি এতেকাফ করতে পারেন নি। সে জন্যে পরের বছর বিশদিন এতেকাফ করেন। (তিরমিযি)
সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ
মসজিদুল হারামে এতেকাফ করলে তা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ। তারপর মসজিদে নববীতে এবং তারপর বায়তুল মাকদেসে। তারপর উৎকৃষ্ট এতেকাফ হয় কোনো জামে মসজিদে করলে যেখানে রীতিমতো জামায়াতে নামায হয়। তারপর মহল্লার মসজিদে যেখানে জামায়াতে নামায হয়।
এতেকাফের শর্ত
এতেকাফের চারটি শর্ত রয়েছে যা ব্যতিরেকে এতেকাফ সহীহ হবে না।
১। মসজিদে অবস্থান
পুরুষের জন্যে জরুরী যে, সে মসজিদে এতেকাফ করবে তাতে পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতসহ নামায হোক বা না হোক। (ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকটে এটা জরুরী যে, যে মসজিদে জামায়াত হয় তাতে এতেকাফ করতে হবে। ইমাম মুহাম্মাদ (রা) ও ইমাম আবু ইউসুফ (র) এর মতে প্রত্যেক মসজিদেই এতেকাফ দুরস্ত হবে। সে যুগে এর ওপরেই ফতোয়া হয়।-দুরুরল মুখতার)মসজিদ ছাড়া পুরুষের এতেকাফ সহীহ হবে না।
২। নিয়ত
অন্যান্য ইবাদাতের জন্যে যেমন নিয়ত শর্ত তেমনি এতেকাফের জন্যে নিয়ত শর্ত। নিয়ত ছাড়া এতেকাফ হবে না নিয়ত ছাড়া এমনি যদি কেউ মসজিদে অবস্থান করে তাহলে এ অবস্থান এতেকাফ হবে না। তারপর এটাও ঠিক যে ইবাদাতের নিয়ত তখন মাত্রই সহীহ হতে পারে যখন নিয়তকারী মুসলমান হয়। তার জ্ঞান থাকতে হবে। বেহুশ বা পাগলের নিয়ত ধরা যাবে না।
৩। হাদীসে আকবর থেকে পাক হওয়া।
অর্থাৎ নারী পুরুষের গোসল ফরয হলে তা করে শরীর পাক করে নেবে এবং নারী হায়েয নেফাস থেকে পাক হবে।
৪। রোযা
এতেকাফ রোযা রাখাও শর্ত। অবশ্য তা শুধু ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে। মুস্তাহাব এতেকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। আর সুন্নাত এতেকাফের জন্যে রোযা শর্ত এজন্য নয় যে, তাও রমযান মাসেই করতে হবে।
এতেকাফের নিয়মনীতি
১. ওয়াজিব এতেকাফ অন্ততপক্ষে একদিনের জন্যে হতে পারে। তার কম সময়ের জন্যে হবে না এজন্য ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত।
২. ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত বটে। কিন্তু এটা জরুরী নয় যে, সে রোযা খাস করে এতেকাফের জন্যে করতে হবে। যেমন কেউ রমযান মাসে এতেকাফের মানত করলো। তাহলে এতেকাফ সহীহ হবে। রমযানের রোযাই এতেকাফের জন্যে যথেষ্ট। অবশ্য এটা জরুরী যে এতেকাফে যে রোযা রাখা হবে তা ওয়াজিব হতে হবে, নফল নয়।
৩. ওয়াজিব এতেকাফের মুদ্দত কমপক্ষে একদিন এবং বেশী যতো ইচ্ছা হতে পারে।
৪. মুস্তাহাব এতেকাফের কম মুদ্দত নির্ধারিত নেই, কয়েক মিনিটের এতেকাফও হতে পারে।
৫. ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে যেহেতু রোযা শর্ত সেজন্যে কেউ যদি রোযা না রাখার নিয়ত করে তবুও রোযা রাখা অপরিহার্য হবে এবং এজন্যে যদি কেউ শুধু রাতের জন্যে এতেকাফের নিয়ত করে তা অর্থহীন হবে।
৬. যদি কেউ রাত ও দিনের এতেকাফের নিয়ত করে অথবা কয়েক দিনের এতেকাফের নিয়ত করে তাহলে রাত তার মধ্যে শামিল মনে করতে হবে এবং রাতেও এতেকাফ করতে হবে। তবে যদি এক দিনের এতেকাফের মানত করা হয় তাহলে সারাদিনের এতেকাফ ওয়াজিব হবে রাতের এতেকাফ ওয়াজিব হবে না।
৭. মেয়েদের নিজ ঘরেই এতেকাফ করা উচিত। তাদের মসজিদে এতেকাফ করা মকরূহ তানযিহী। সাধারণত ঘরে যে স্থানে তারা নামায পড়ে তা পর্দা দিয়ে ঘিরে নেবে এবং এতেকাফের জন্যে তা নির্দিষ্ট করে নেবে।
৮. রমযানের শেষ দশদিনে যেহেতু এতেকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া, এজন্যে সেটা করা উচিত যাতে বাড়ির কিছু লোক অবশ্যই এর ব্যবস্থা করতে পারে। যদি এর প্রতি অবহেলা করা হয় এবং মহল্লার কেউ যদি এতেকাফ না করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে।
৯. ওয়াজিব এতেকাফ যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে তার কাযা ওয়াজিব হবে। অবশ্য সুন্নাত মুস্তাহাব এতেকাফের কাযা নেই।
এতেকাফের মসনুন সময়
এতেকাফের মসনুন সময় রমযানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু পূর্ব থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। তা চাঁদ ২৯শে রমযান উদয় হোক না কেন অথবা ৩০শে রমযানে যে কোনো অবস্থায় মসনুন এতেকাফ পূর্ণ হয়ে যাবে।
এতেকাফকারী ২০শে রমযান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে পৌছবে এবং মেয়ে মানুষ হলে বাড়ীর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাবে যা সে নামাযের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত এতেকাফের স্থান থেকে বের হবে না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, যেমন পেশাব-পায়খানা অথবা ফরয গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরীয়াতের প্রয়োজন যেমন জুমার নামায প্রভৃতির জন্যে বের হওয়া জায়েয। কিন্তু প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই এতেকাফের স্থানে ফিরে যেতে হবে।
ওয়াজিব এতেকাফের সময়
ওয়াজিব এতেকাফের জন্য যেহেতু রোযা শর্ত সে জন্য তার কমসে কম সময় একদিন। একদিনের কম কয়েক ঘন্টার জন্য এতেকাফের মানত অর্থহীন, কারণ রোযার সময়ই হচ্ছে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
মুস্তাহাব এতেকাফের সময়
নফল এতেকাফ যে কোনো সময় হতে পারে। না এর জন্যে রোযা শর্ত আর না কোনো বিশেষ মাস বা সময়। যখনই কেউ মসজিদে থাকে নফল এতেকাফের নিয়ত করতে পারে। মসজিদে যে সময়টুকুই থাকবে তার সওয়াব পাবে।
এতেকাফের সময়ে মুস্তাহাব কাজ
১. যিকির আযকার করা দীনের মাসয়ালা মাসায়েল ও এলেম কালামের উপর চিন্তা ভাবনা করা। তসবিহ তাহলিল লিপ্ত থাকা।
২. কুরআন তেলাওয়াত ও তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা।
৩. দরূদ শরীফ ও অন্যান্য যিকির করা।
৪. দীন সম্পর্কে পড়াশুনা করা ও পড়ানো।
৫. ওয়াজ ও তাবলীগ করা।
৬. দীন সম্পর্কিত বই পুস্তক রচনায় লিপ্ত থাকা।
এতেকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েয
১. পেশাব পায়খানার জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়। মসজিদের নিকটে এমন স্থান আছে কিন্তু তা বেপর্দা অথবা অত্যন্ত নোংরা। তাহলে আপন বাড়ীতে পেশাব পায়খানার জন্যে যাওয়ার অনুমতি আছে।
২. ফরয গোসলের জন্যেও এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদেই গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে।
৩. খানা খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় যদি খানা নিয়ে আসর কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।
৪. জুমা ও ঈদের নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয। আর যদি এমন মসজিদে এতেকাফ করা হয় যেখানে জামায়াত করা হয় না। তাহলে পাঞ্জেগানা নামাযের জন্যে অন্যত্র যাওয়া জায়েয।
৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরঞ্চ জরুরী। কিন্তু এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
৬. কেউ যদি কোনো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাযের জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে কোনো দোষ হবে না।
৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরীয়াতের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।
৮. জুমার নামাযের জন্যে এতটা পূর্বে যাওয়া, যাতে করে তাহিয়্যাতুল মসজিদ এবং জুমার সুন্নাতগুলো নিশ্চিন্তে পড়া যায়, জায়েয আছে। সময়ের আন্দায এতেকাফকারীর ওপর নির্ভর করে।
৯. কাউকে যদি জোর করে এতেকাফের স্থান থেকে বের করে দেয়া হয় অথবা কেউ তাকে যদি বাইরে আটক রাখে তাহলেও এতেকাফ শেষ হয়ে যাবে।
১০. যদি কাউকে কোনো ঋণদাতা বাইরে আটক করে অথবা সে ব্যক্তি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এতেকাফের স্থানে পৌছাতে বিলম্ব হয়ে যায় তবুও এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
১১. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়ীতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা এতেকাফকারীর জায়েয।
১২. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।
১৩. যদি কেউ এতেকাফ করার নিয়ত করতে গিয়ে এ নিয়ত করে যে, সে জানাযার জন্যে যাবে তাহলে যাওয়া জায়েয। অন্য নিয়ত করলে তার জন্যে যাওয়া জায়েয হবে না।
১৪. এতেকাফ অবস্থায় কাউকে দীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।
এতেকাফে যেসব কাজ না জায়েয
১. এতেকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা ও চুমো দেয়াতে বীর্যপাত না হলে এতেকাফ নষ্ট হবে না।
২. এতেকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।
৩. এতেকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।
৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বরা মাকরূহ।
৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া জায়েয নয়। তাতে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।