Tuesday, November 1, 2016

নামাযের বয়ান-১

নামাযের বয়ান
ঈমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামায। উচিত হলো এই যে, আকায়েদের অধ্যায়ের পরেই নামাযের হুকুম ও মাসয়ালা বয়ান করা। কিন্তু যেহেতু নামায আদায় করার জন্যে সকল প্রকার নাজাসাত থেকে পাক হওয়া অপরিহার্য, সে জন্য তাহারাতের বিশদ বিবরণের পর নামাযের হুকুম ও মাসয়ালা বয়ান করা হচ্ছে।

নামাযের অর্থ

নামায আমাদের একটি সুপরিচিত শব্দ। কুরআনের পরিভাষায় ‘সালাতের‘ স্থলে নামায ব্যবহৃত হয়। সালাত صلوة এর আভিধানিক অর্থ কারো দিকে মুখ করা, অগ্রসর হওয়া, দোয়া করা এবং নিকটর্তীত হওয়া। কুরআনের পরিভাষায় নামাযের অর্থ হলো আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেয়া, তাঁর দিকে অগ্রসর হওয়া, তাঁর কাছেই চাওয়া এবং তাঁর একেবারে নিকট হওয়া। এ এবাদত পদ্ধতির আরকানের শিক্ষা কুরআন দিয়েছে এবং তার বিস্তারিত ও খুটিনাটি পদ্ধতি নবী পাক (সা) শিখিয়ে দিয়েছেন।
قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ وَأَقِيمُواْ وُجُوهَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ 
“এবং প্রত্যেক নামাযে নিজের দৃষ্টি ঠিক আল্লাহর দিকে রাখ এবং আন্তরিক আনুগত্যের সাথে তাঁকে ডাকো।” (আ’রাফ: ২৯)
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ 
এবং সিজদা কর এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হও” (আলাক : ১৯)
হাদীসে আছে :
-বান্দাহ ঐ সময়ে তার আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যখন সে আল্লাহর সামনে সিজাদায় থাকে (মুসলিম)।
-তোমাদের মধ্যে যখন কেউ নামাযে রত হয়, তখন সে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে। (বুখারী)।
কিন্তু আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেয়া, তাঁর নিকটবর্তী হওয়া ও তাঁর কাছে চাওয়ার তরীকা কি? তার একটি মাত্র উত্তরই সঠিক। তা ছাড়া আর যতো উত্তর তা সব ভুল এবং পথভ্রষ্টকারী। নবী (সা) যে তরীকা বলে দিয়েছেন তাই হচ্ছে সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং গৃহীত। নামাযের আরকান, নামাযের আযকার, সময়, রাকয়াতাদি এবং বিস্তারিত পদ্ধতি নবী (সা) শুধু মুখ দিয়েই শিক্ষা দিননি, বরঞ্চ সারা জীবন তার উপর আমল করে দেখিয়েছেন। েএ ব্যাপারে তাঁর কথা ও আমল হাদীসে অতি নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে সংরক্ষিত আছে। এ নিয়ম পদ্ধতিতে হরহামেশা গোটা উম্মত নামায আদায় করে সকল রকম সন্দেহ থেকে একে পবিত্র রেখেছেন।
নামাযের ফযীলত ও গুরুত্ব
ঈমান আনার পরে একজন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে প্রথম দাবী এই যে, সে নামায কায়েম করবে। আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে :-
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
“নিশ্চয় আমি আল্লহ। আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। অতএব শুধু আমারই বন্দেগী কর এবং আমার ঈয়াদের জন্যে নামায কায়েম কর। “(তাহা : ১৪)
আকায়েদের ব্যাপারে যেমন আল্লাহর সত্তা ও গুনাবলীর উপর ঈমান গোটা দ্বীনের উত্স, তেমনি আমলের ব্যাপারে নামায হচ্ছে গোটা দ্বীনের আমলের ভিত্তি। এটাই কারণ যে, কুরআন পাকে সকল এবাদতের মধ্যে নামাযের সব চেয়ে বেশী তাকীদ করা হয়েছে। এবং তা কায়েম কারার উপরে এত জোর দেয়া হয়েছে যে, তার উপরই যেন গোটা দ্বীন নির্ভরশীল।
নামায ব্যতীত অন্য এবাদতগুলো বিশেষ বিশেষ লোকের উপর বিশেষ বিশেষ সময়ে ফরয হয়। যেমন হজ্জ এবং যাকাত শুধু ঐসব মুসলমানদের উপর ফরয যারা মালদার। রোযা বছরে শুধু একমাস ফরয। কিন্তু নামায এমন এক আমল যার জন্যে ঈমান ছাড়া আর কোন শর্ত নেই। ঈমান আনার সাথে সাথেই প্রত্যেক বালেগ ও আকেল লোকের উপর নামায ফরয হয় সে নারী হোক বা পুরুষ হোক আমীর হোক বা ফকীর হোক, স্বাস্থ্যবান হোক অথবা রোগী এবং মুকীম হোক বা মুসাফির। দিনে পাঁচাবার নামায ফরযে আইন। এমন কি সশস্ত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে যখন দুশমনের মুকাবিলার প্রতি মুহূর্তে আশংকা হয়, ঠিক তখনও নামায শুধু ফরযই নয়, বরঞ্চ জামায়াতে পড়ার তাকীদ আছে। সালাতে খওফের নামাযও জামায়াতে আদায় করার পদ্ধতি স্বয়ং কুরআনে রয়ান করা হয়েছে।
নামাযের তাকীদ ও প্রেরণার সাথে সাথে তার গুরুত্ব মনে বদ্ধমূল করার জন্যে কুরআন ভয়ানক পরিণাম [দক্ষিণ হস্তের অধিকারী লোক ব্যতীত প্রত্যেক লোক তার আমলের পরিণামে জাহান্নামে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। দক্ষিন হস্তধারী লোকেরা বেহেশতের বাগানে অবস্থান করবে এবং পাপীদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, কোন জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এলো? তারা জবাবে দেবে, আমরা নামায পড়তাম না (মুদ্দাসসের ৩৮)] এবং বিরাট লাঞ্ছনার [যে দিন ভয়ানক কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হবে (কেয়ামতের দিন), তখন তাদেরকে (বেনামাযী পাপীদেরকে) সিজদার জন্যে ডাকা হবে। তখন তারা সিজদা করতে পারবেনা। তাদের দৃষ্টি নিম্ন দিকে হবে এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে ছেয়ে ফেলবে। এরা ঐসব লোক যাদেরকে (দুনিয়ায়) সিজদা করার জন্যে (নামাযের জন্যে) ডাকা হতো তখন তারা সুস্থ থাকা সত্ত্বেও সিজদা করতো না (কলম : ৪২-৪৩)]  এমন ভয় দেখানো হয়েছে, যা নামায পরিত্যাগকারীগণ ভোগ করবে।
নবী (সা) নামাযের অসাধারণ গুরুত্ব ও ফযীলত এবং তা ত্যাগ করার ভয়ানক শাস্তির উপর বিভিন্নভাবে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন:
-মুমেন এবং কুফরের মধ্যে নামাযই পার্থক্যকারী – (মুসলিম)।
-যে ব্যক্তি নিয়মিত ভাবে নামায পড়বে, কেয়ামতের দিন সে নামায তার জন্যে নূর এবং ঈমানের প্রমাণ হবে এবং নাজাতের কারণ প্রমাণিত হবে।
যে ব্যক্তি মনোযোগ সহকারে নামায আদায় করবে না, তাহলে সে নামায না তার জন্যে নূর এবং ঈমানের প্রমাণ হবে, আর না সে নামায তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাবে। এমন লোক কেয়ামতের দিন ফেরাউন, কারুন, হামান, উবাই বিন খালফের সাহচার্য লাভ করবে- (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)।
হযরত আবুযর (রা) বয়ান করেন, একবার শীতের সময় যখন গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল, নবী (সা) বাইরে তশরীফ আনলেন এবং একটি গাছের দুটি ডাল ধরে ঝাঁকি দেয়া শুরু করলেন, এবং ঝরঝর করে (শুকনো) পাতা পড়তে লাগলো। তখন নবী (সা) বললেন, হে আবু যর যখন কোন মুসলমান একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকতার সাথে নামায পড়ে, তার গুনাহ ঠিক এভাবে ঝরে পড়ে যেমন এ গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ছে- (মুসনাদে আহমদ)।
একাবার নবী পাক (সা) সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, যদি তোমাদের মধ্যে কারো ঘরের পাশ দিয়ে কোন নদী প্রবাহিত হয় যার মধ্যে সে দৈনিক পাঁচ বার গোসল করে, তাহলে বল, তার শরীরে কোন ময়লা থাকবে কি? সাহাবীগণ (সা) আরয করলেন, না তবে শরীরে কোন ময়লাই থাকবে না। নবী (সা) বললেন, এ অবস্থা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের। আল্লাহ তায়ালা এসব নামাযের বদৌলতে তার গুনাগুলো মিটিয়ে দেবেন- (বুখারী, মুসলিম)।
হযরত আলী (রা) বলেন, নবী পাক (সা)এর জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁর মুখ দিয়ে এ কাথাগুলো বেরয়-নামায, নামায- (আল-আদাবুল মুফরেদ)।
দ্বীনের মধ্যে নামাযের গুরুত্ব ও ফযীলত জানার জন্যে কুরআন ও সুন্নাতের এসব সুস্পষ্ট এবং তাকীদসহ হেদায়াতের সাথে সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, স্বয়ং নবী পাক (সা) এর নামাযের সাথে কত গভীর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি নামাযে চোখের শীতলতা অনুভব করতেন। যেমন তেমন কারণে তিনি মসজিদে গিয়ে এতো বেশী নফল নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত।
যা হোক, কুরআন ও সুন্নাতের এসব বিশদ বিবরণের পর এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, নামায ঈমানের এক অপরিহার্য নিদর্শন। ঈমান হলে সেখানে অবশ্যই নামায হবে এবং যেখানে নামায হবে সেখানে গোটা দ্বীন আছে বুঝতে হবে। যদি নামায না থাকে তাহলে সেখানে দ্বীনের অস্তিত্ব ধারণা করা যায়না। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রা) তাঁর সরকারের দায়িত্বশীলদের লিখিত হেদায়েত দিতে গিয়ে এ সত্যের দিকেই তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, ব্যাপার এই যে, আমার কাছে তোমাদের সকল সমস্যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো নামায। যে ব্যক্তি তার নামাযের পুরাপুরি রক্ষনাবেক্ষণ করলো, সে তার দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণ করলো। আর যে তার নামায নষ্ট করলো, সে অবশিষ্ট দ্বীনকে আরও বেশী করে নষ্ট করবে। (মেশকাত)।

একামতে সালাতের শর্ত ও আদব

উপরে যে ফযীলত ও গুরুত্ব বয়ান করা হলো তা কিন্তু ঐ নামাযের যা সত্যিকার অর্থে নামায, যে নামায সকল বাহ্যিক আদব লেহায ও আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য রেখে পূর্ণ অনুভূতির সাথে আদায় করা হয়। এ জন্যে কুরআন নামায আদায় করার জন্যে আদায় করার মতো সাদাসিধে প্রকাশভঙ্গি অবলম্বন করার পরিবর্তে একামাত [(وَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ)- এবং নামায কায়েম কর। (বাকারাহ-৪৩)] (প্রতিষ্ঠা করণ) এবং মুহাফেযাত [(وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ)- এবং যারা তাদের নামাযের রক্ষণাবেক্ষন করে (মুমেনুণ-৯) ] (সংরক্ষণ) শব্দগুলো ব্যবহার করেছে। একামাত ও মুহাফেযাতের অর্থ এই যে, নামায আদায় করতে গিয়ে ঐ সব যাহেরী আদব লেহাযের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যার সম্পর্ক নামাযের বাহ্যিক দিক ঠিক করার সাথে। সাথে সাথে ঐসব বাতেনী গুণাবলীরও পুরাপুরি ব্যবস্থা করতে হবে যার সম্পর্ক নামাযীর অন্তর ও তার আবেগ অনুভূতির সাথে।

নিম্নে সংক্ষেপে এসব আদাব (শিষ্টাচার) ও গুণাবলী বয়ান করা হচ্ছে:

১. তাহারাত বা পবিত্রতা
শরিয়ত পবিত্রতার যে পদ্ধতি ও হুকুমাবলী শিক্ষা দিয়েছে। তদুনযায়ী শরীর ও কাপড় ভালভাবে পাক সাফ করে আল্লাহর দরবারে হাযেরি দিতে হবে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُواْ وَإِن كُنتُم مَّرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاء أَحَدٌ مَّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاء فَلَمْ تَجِدُواْ مَاء فَتَيَمَّمُواْ صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُواْ بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ مَا يُرِيدُ اللّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَـكِن يُرِيدُ لِيُطَهَّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ


হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।
                                                                                                                                            (মায়েদাহ: ৬)
অন্য স্থানে এরশাদ হয়েছে
 وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ
“এবং তোমার লেবাস-পোষাক ভালো করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পাক করে নাও। (মুদ্দাসসির : ৪)
২. সময়ের নিয়মানুবর্তিতা
অর্থাৎ ঠিক সময়ে নামায আদায় করতে হবে। এ জন্যে নামায সময় নিষ্ঠার সাথে ফরয করা হয়েছে
إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا
“অতএব নামায কায়েম কর। বস্তুত: নামায মুমেনদের উপর সময় নিষ্ঠার সাথে ফরয করা হয়েছে“। (নিসা: ১০৩)।
নবী (সা) বলেন : সর্বোত্কৃষ্ট বান্দাহ তারাই যারা সূর্যের রোদ এবং চাঁদ তারকারাজির গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে যাতে করে নামাযের সময় বয়ে না যায়।– (মুস্তাদরাকে হাকেমা)।
৩. নামাযের সময় নিষ্ঠা
অর্থাৎ কোন নামায নষ্ট না করে ক্রমাগত হরহামেশা নামায পড়তে হবে। প্রকৃতপক্ষে নামাযী তাদেরকে বলা যেতে যারা সময নিষ্ঠার সাথে এবং কোন নামায বাদ না দিয়ে নামায আদায় করে।
       الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ  (23     إِلَّا الْمُصَلِّينَ  (22
“কিন্তু ঐসব নামায আদায়কারী যারা সময় নিষ্ঠার সাথে সর্বদা নামায আদায় করে।“- (মাআরিজ : ২২-২৩)।
৪. কাতার বন্দীর ব্যবস্থাপনা
নামাযের কাতার সোজা রাখার রীতিমত ব্যবস্থা করতে হবে। নামাযের কাতার দুরস্ত করা ভালভাবে নামায পড়ার অংশ।
হযরত নু‘মান বিন বশীর বলেন, বনী (সা) আমাদের কাতার সোজা রাখার এমন ব্যবস্থা করতেন যেন তার দ্বারা তিনি তীরের লক্ষ্য সোজা করবেন। তারপর তিনি অনুভব করতেন যে, আমরা কাতার সোজা করার গুরুত্ব বুঝে ফেলেছি। আর একদিন তিনি বাইরে তশরীফ আনলেন এবং নামায পড়াবার জন্যে দাঁড়ালেন। তিনি তাকবীর বলতে যাবেন এমন সময় তাঁর নজর এমন এক ব্যক্তির উপর পড়লো যার বুক কাতার থেকে একটুখানি সামনে বেড়ে গিয়েছিল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর বান্দাহ, কাতার সোজা এবং বরাবর রাখ। নতুবা আল্লাহ তোমাদের মুখ একে অপরের বিরুদ্ধে করে দেবেন। (মুসলিম)
-নামাযের মধ্যে কাতার সোজা এবং বরাবর কর। কারণ কাতার সোজা করা একামাতে সালাতের অংশ বিশেষ- (বুখরী)।
অর্থাৎ কাতার দুরন্ত না করলে নামায পড়ার হক ভালভাবে আদায় হয় না।
কাতার সোজা ও বরাবর রাখার সাথে সাথে কাতারবন্দীর ব্যবস্থাও করতে হবে। অর্থাৎ বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ ঈমামের নিকটবর্তী থাকবেন। এটা তখনই সম্ভব যখন আহলে এলম লোকদের প্রতি সমাজের শ্রদ্ধাবোধ জাগবে এবং তাঁদের নিজেদেরও বিশিষ্ট মর্যাদার অনুভূতি থাকতে হবে এবং আগেভাগেই মসজিদে হাযির হয়ে ইমামের নিকট স্থান করে নেবেন।
হযরত আবু সমউদ (রা) বলেন, নবী (সা) এসে আমাদের কাতার সোজা ও বরাবর করার জন্যে আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন, সোজা হও, কাতার বরাবর কর, আগে পিছে হয়ো না। তা না হলে তোমার একে অপরের প্রতি নারাজ হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলতেন, যারা জ্ঞান-বুদ্ধি রাখে তারা আমার নিকটে দাঁড়াবে, তারপর তারা যারা মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের নিকটে, তারপর তারা যারা জ্ঞানবুদ্ধি দিক দিয়ে দ্বিতীয় দলের নিকটবর্তী। (বুখারী)
৫. মনের প্রশান্তি ও মধ্যবর্তীতা
অর্থাৎ নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত মনে থেমে থেমে নামায আদায় করা দরকার যাতে করে কেরায়াত, কেয়াম, রুকু, সিজদা ও নামাযের যাবতীয় রুকন প্রভৃতির হক আদায় করা যায়।
قُلِ ادْعُواْ اللّهَ أَوِ ادْعُواْ الرَّحْمَـنَ أَيًّا مَّا تَدْعُواْ فَلَهُ الأَسْمَاء الْحُسْنَى وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلاً  (110
নামায না বেশী আওয়ায করে আর না একেবারে অল্প আওয়ায পড়বে। বরঞ্চ মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করবে-(বনী ইসরাঈল : ১১০)
হযরত আবু হুরায়ারা (রা) বলেন, একবার নবী পাক (স) মসজিদের একধারে বসেছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে এলো এবং নামায পড়লো। তারপর নবী (স)-এর কাছে এলো এবং সালাম করলো। নবী (স) সালামের জবাব দিয়ে বললেন, আবার গিয়ে নামায পড়, তুমি ঠিকমত নামায পড়নি। সে ব্যক্তি পুনরায় নামায পড়ে এসে নবীকে সালাম করলো। নবী (স) বললেন, আবার গিয়ে নামায পড়, তোমার নামায ঠিক হয়নি। সে ব্যক্তি তৃতীয়বার নামায পড়ে অথবা তারপর আরয করলো, হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে নামায পড়বো। নবী (স) বললেন, যখন তুমি নামায পড়ার ইরাদা কর তখন প্রথমে খুব ভালো করে অযু কর। তারপর কেবলার দিকে মুখ কর। তারপর তাকবীর তাহরীমা বলে নামায শুরু কর এবং কুরআনের যে অংশ সহজে পড়তে পার তা পড়। (কোন বর্ণনায় আছে, সূরায়ে ফাতেহা পড় এবং তারপর যা চাও পড়)। তারপর তুমি নিশ্চন্তি মনে রুকুতে যাও। তারপর রুকু থেকে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর নিশ্চিন্ত মনে সিজদা কর এবং সিজদা থেকে নিশ্চিন্ত মনে সোজা হয়ে বস। পুরা নামায এভাবে নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত মনে আদায় কর। (বুখারী ও মুসলিম)
নবী পাক (স)-এর উপরোক্ত হেদায়াতের মর্ম এই যে, নামায মাথার কোন বোঝা নয় যে, মাথা থেকে কোন রকমে নামিযে ফেললৈই হলো এবং তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করলো। বরঞ্চ এ হচ্ছে আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট এবাদত। তার হক এই যে, পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়বে। যে নামায নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত মনে পড়া হয় না, নবী পাক (স)-এর নিকটে তা নামাযই নয়।
হযরত আয়েশা (রা) নবী (স) এর নামাযের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, নবী (স) তাকবীর তাহরীমা বলে নামায শুরু করতেন এবং ‘আলহামদুল্লিাহি রাব্বিল আলামীন’ থেকে কুরআন পড়া শুরু করতেন।যখন তিনি রুকুতে যেতেন তখন মথা না উপরে উঠিয়ে রাখতেন আর না নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখতেন, বরঞ্চ মধ্যম অবস্থায় অর্থাৎ কোমর বরাবর সোজা রাখতেন, তারপর যখন রুকু’ থেকে উঠতেন তখন যতোক্ষণ না সোজা হয়ে দাঁড়াতেন, ততোক্ষণ সিজদায় যেতেন না। তারপর প্রথমে সিজদা থেকে যখন মাথা উঠাতেন তখন যতোক্ষণ না একেবারে সোজা হয়ে বসতেন, দ্বিতীয় সিজদায় যেতেন না। প্রতি দু’রাকায়াত পর ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়তেন। ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়ার সময় বাম পা বিছিয়ে রাখতেন এবং ডান পা খাড়া রাখতেন এবং শয়তানের মতো বসতে নিষেধ করতেন। অন্য রেওয়াতে আছে, কুকুরের মতো বসতে নিষেধ করতেন। তিনি এভাবে সিজদা করতেও নিষেধ করেন যেভাবে হিংস্র পশু সামনের দু’পা বিছিয়ে বসে। তারপর তিনি (****) বলে নামায শেষ করতেন। -(মুসলিম)।
৬. জামায়াতে নামাযের ব্যবস্থাপনা
ফরয নামায অবশ্যই জামায়াতে পড়তে হবে। অবশ্যি যদি জান-মালের ক্ষতির আশংকা না থাকে।
 وَارْكَعُواْ مَعَ الرَّاكِعِينَ
-রুকু’কারীদের সাথে মিলে রুকু’ কর-(বাকারাহ : ৪৩)
وَإِذَا كُنتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلاَةَ فَلْتَقُمْ طَآئِفَةٌ مِّنْهُم مَّعَكَ وَلْيَأْخُذُواْ أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُواْ فَلْيَكُونُواْ مِن وَرَآئِكُمْ وَلْتَأْتِ طَآئِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّواْ فَلْيُصَلُّواْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُواْ حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُم مَّيْلَةً وَاحِدَةً وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن كَانَ بِكُمْ أَذًى مِّن مَّطَرٍ أَوْ كُنتُم مَّرْضَى أَن تَضَعُواْ أَسْلِحَتَكُمْ وَخُذُواْ حِذْرَكُمْ إِنَّ اللّهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا

 (102

যখন আপনি তাদের মধ্যে থাকেন, অতঃপর নামাযে দাঁড়ান, তখন যেন একদল দাঁড়ায় আপনার সাথে এবং তারা যেন স্বীয় অস্ত্র সাথে নেয়। অতঃপর যখন তারা সেজদা সম্পন্ন করে, তখন আপনার কাছ থেকে যেন সরে যায় এবং অন্য দল যেন আসে, যারা নামায পড়েনি। অতঃপর তারা যেন আপনার সাথে নামায পড়ে এবং আত্মরক্ষার হাতিয়ার সাথে নেয়। কাফেররা চায় যে, তোমরা কোন রূপে অসতর্ক থাক, যাতে তারা একযোগে তোমাদেরকে আক্রমণ করে বসে। যদি বৃষ্টির কারণে তোমাদের কষ্ট হয় অথবা তোমরা অসুস্থ হও তবে স্বীয় অস্ত্র পরিত্যাগ করায় তোমাদের কোন গোনাহ নেই এবং সাথে নিয়ে নাও তোমাদের আত্নরক্ষার অস্ত্র। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের জন্যে অপমানকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
                                                                                                                                   (নিসা: ১০২)
এ হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে নামায আদায় করা সম্পর্কে নির্দেশ। এ নাযুক পরিস্থিতিতেও যুদ্ধের সৈনিকগণ আলাদা আলাদা নামায পড়বে না। বরং নবী (স) নামায পড়িয়ে দেবেন। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা নবী (স) –এর পেছনে জামায়াতে নামায পড়বেন।
নবী (স) বলেন:
 যে ব্যক্তি জামায়াতে নামাযের জন্যে মুয়াযযিনের আযান শুনলো এবং তার আহবানে সাড়া দিতে তার কোন ওযরও নেই, তথাপি সে জামায়াতে নামাযের জন্যে গেলা না, একাকী নামায পড়লো, তাহলে সে নামায আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলেন ‘ওযরের’ অর্থ কি? তিনি বলেন, জান মালের আশংকা অথবা রোগ (আবু দাউদ)।
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি বরারবর ৪০ দিন প্রত্যেক নামায এভাবে আদায় করলো যে, প্রথম তাকবীরে শরীক হলো, তাহলে দুটি জিনিস থেকে তাকে অব্যহতি দেয়া হবে। এক-দোযখের আগুন থেকে অব্যাহতি, দুই-মুনাফেকী থেকে অব্যহতি –(জামে’ তিরমিযী)
৭. কুরআন তেলাওয়াতে তারতীল ও চিন্তাভাবনা
নামাযে কুরআন তেলাওয়াতের হক আদায় হয় যদি তা পড়া হয় একটু থেমে থেমে, আন্তরিকতা এবং মনোযোগ বা মনের উপস্থিতি সহকারে এবং অতি আগ্রহের সাথে। তারপর এক এক আয়াতের উপর চিন্তাভাবনা করতে হবে। নবী পাক (স) এক একটি অক্ষর সুস্পষ্ট করে এবং এক এক আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন।
এবং কুরআন একটু থেমে থেমে পড়ুন-(মুজ্জাম্মিল : ৪)
এ কিতাব আপনার উপর নাযিল করেছি এবং তা বরকতপূর্ণ এ জন্যে যে, মানুষ যেন তার আয়াতগুলোর উপর চিন্তাভাবনা করে এবং জ্ঞানবান তার থেকে শিক্ষা লাভ করে। (সোয়াদ : ২৯)।
৮. আগ্রহ ও মনোযোগ
প্রকৃত নামায তাকেই বলে যার মধ্যে লোক মন-মস্কিষ্ক, আবেগ-অনুভূতি এবং চিন্তা-ভাবনার সাথে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লঅহর দিকে মনোযোগ দেয় এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত এবং তাঁর কাছে চাওয়ার আগ্রহ এমন বেশী হয় যে, এক নামায আদায় করার পর দ্বিতীয় নামাযের প্রতীক্ষায় অন্তর অধীর হয়ে থাকে।
“প্রত্যেক নামাযের জন্যে নিজের কেবলা ঠিক রাখ এবং তাঁকে (আল্লাহকে)ডাক এবং আনুগত্য-দাসত্ব তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট করে দাও” (আরাফ: ২৯)
“হে মুমেনগণ! যখন জুমার দিনে নামাযের জন্যে ডাকা হয়, তখন সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে দিয়ে যিকিরের দিকে দৌড়াও –(জুমা: ৯)।
৯. শিষ্টাচার ও আত্মসমর্পণ
অর্থাৎ একজন অনুগত গোলামের মত নামাযী লোক অতিশয় বিনয় ও আত্মসমর্পনের প্রতীক হিসাবে আল্লাহর দরবারে দাঁড়াবে যেন অন্তর আল্লাহর মহত্ব ও পরাক্রমে প্রকম্পিত হতে থাকে এবং অঙ্গ প্রতঙ্গেও যেন বিনয় নম্রতার ছাপ পরষ্ফুট হয়।

“নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ কর, বিশেষ করে সর্বোৎকৃষ্ট নামাযের এবং আল্লাহর সামনে শিষ্টাচার ও আত্মসমর্পণের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াও।” (বাকারা: ২৩৮)
“এবং (হে নবী) সুসংবাদ নি ঐসব লোকদেরকে যারা বিনয় ও শিষ্টাচর অবলম্বন করে এবং যাদের অবস্থা এই যে, যখন তারা আল্লাহর যিকির  শুনে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, বিপদ আপদ অটল-অচল হয়ে বরদাশত করে এবং নামায কায়েক করে-(হজ্জ: ৩৪-৩৫)।
‘এবং আপনার রবকে সকাল সন্ধ্যায় স্মরণ করুন মনে মনে বিনয় গদগদ হয়ে এবং তাঁর ভয়ে এবং অনুচ্চস্বরে এবং গাফেলদের মধ্যে শামিল যেন না হন। -(আ’রাফ: ২০৫)।
হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (র) যখন নামাযের জন্যে অযু করতেন তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। ঘরের লোকজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, অযুর সময় আপনার একি অবস্থা হয়? তিনি বলতেন, তোমরা জাননা, আমি কোন্ সত্তার সামনে দাঁড়াতে চাই? (এহইয়া্যুল উলুম)।
১০. বিনয় নম্রতা
বিনয় নম্রতা নামাযের প্রাণ। যে নামাযে বিময় নম্রতা নেই সে নামায নামায নয়। কুরআনে ‘খুশু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে- তার অর্থ ছোট হওয়া, দমিত হওয়া, নম্রতার সাথে ঝুঁকে পড়া। নামাযে এ ‘খুশু’ অবলম্বন করার অর্থ এই যে, শুধু শরীরই নয়, বরঞ্চ মন-মস্তিষ্ক সব কিছুই আল্লাহর সামনে হীন দীন হয়ে ঝুঁকে যাওয়া বা অবনত হওয়া। মনের মধ্যে আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব এমন ভয় সঞ্চার করে যে, মন্দ আবেগ, অনুরাগ ও অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা মনে আসতে পারে না। শরীরের উপরেও তার ছাপ পড়ে। এমন এক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ হবে যা হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর মহ্ত্ব ও পরাক্রমের উপযোগী।

ঐ সব মুমেন কল্যাণ লাভ করেছে যারা তাদের নামাযে নিনয় নম্র। (আল মু’মেনূন: ১-২)।
১১. আল্লাহর নৈকট্যের অনভূতি
নামা মানুষকে আল্লাহর এতোটা নিকটবর্তী করে দেয় যে, অন্য কোন আমল দ্বারা এতোটা নিকট হওয়ার ধারণা করা যেতে পারে না। নবী (স) বলেন, বান্দাহ ঐ সময় তার আল্লাহর অতি নিকট হয়ে যায় যখন সে সিজদায় থাকে (মুসলিম)।
একামাতে সালাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত এই যে, নামাযীর মনে যেন নৈকট্যের অনুভূতি হয। তার অন্তরে েএ নৈকট্যের কামনা বাসনাও থাকে এবং সে এমনভাবে নামায পড়ে যেন আল্লাহকে দেখছে অথবা নিদেন পক্ষে এ অনুভূতি হয় যে, আল্লাহ তার দিকে দেখছেন।
এবং সিজদা কর ও তাঁর নিকট হয়ে যাও- (আলাক: ১৯)
১২.আল্লাহর স্মরণ
নামাযের সত্যিকার গুণই হলো আল্লাহর স্মরণ। আল্লাহর ইয়াদের সার্বিক এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি নামায। এ জন্যে যে, এ হচ্ছে তাঁরই শিখানো পদ্ধতি যাঁর স্মরণ কাম্য। যে নামায আল্লাহর স্মরণের গুণ থেকে খালি তা মুমেনের নামায নয়, মুনাফেকের নামায। নামায কায়েমের উদ্দেশ্যেই তো হচ্ছে আল্লাহকে ইয়াদ করা।
এবং নাময কায়েম করুন আমাকে ইয়াদ করার জন্যে (তাহা : ১৪)

(মনে রাখতে হবে এ আয়াত সিজদার আয়াত)।
আমাদের আয়াতের উপরে তো প্রকৃতপক্ষে তারাই ঈমান আনে, যাদেরকে এ সব আয়াতের দ্বারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলে সিজদায় পড়ে যায় এবং নিজেদের প্রভূর প্রশংসা ও পবিত্রতা বয়ান করতে থাকে এবং তারা গর্ব অহংকার করে না –(আস-সিজদাহ: ১৫:)।
অর্থাৎ তাদের রুকু’ সিজদা অনুভূতির রুকু’ সিজদা হয়। তারা বেপরোয়া হয়ে শুধু মুখে তাসবীহ পাঠ করে না, বরঞ্চ যেসব কালেমাই উচ্চারণ করে তা আল্লাহর ইয়াদেই করে এবং তাদের নামায সরাসরি আল্লাহর হয়।
১৩. রিয়া থেকে দূরে থাকা
নামায রক্ষণাবেক্ষণের একটি বড় শর্ত এই যে, তা রিয়া, লোক দেখানো প্রদর্শনী অথবা অন্যান্য নীচতাপূর্ণ প্রবণতা থেকে দূরে রাখা হবে। নইলে তা হবে আন্তরিকতার পরিপন্থী, রিয়ার দ্বারা শুধু নামায নষ্টই হয়ে যায় না, বরঞ্চ এ ধরনের নামাযীও ধ্বংস হয়।
ধ্বংস ঐ সব নামাযীরেদ জন্যে যারা তাদের নামায থেকে গাফেল হয় এবং মানুষকে দেখাবার জন্যে নামায পড়ে (মাউন: ৪)।
হযরত শাদ্দাদ বিন উস (রা) বয়ান করেন, নবী (স) বললেন, যে ব্যক্তি মানুষকে দেখাবার জন্যে নামায পড়ে, সে শির্ক করলো- (মুসনাদে আহমদ)।
১৪. পূর্ণ আত্মসমর্পণ
একামাতে সালাতের শেষ এবং সার্বিক শর্ত এই যে, মুমেন নামাযে তার নিজকে পুরাপুরি তার আল্লাহর উপর সঁপে দেবে। যতোদিন সে জীবিত থাকবে আল্লাহর অনুগত গোলাম হয়ে থাকবে এবং যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হবে তখন মৃত্যুও হবে আল্লাহর জন্যে।
অবশ্য অবশ্যই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই এবং এ জন্যেই আমাকে আদশে করা হয়েছে। এবং আমি সকলের প্রথমে নিজেকে আল্লাহতে সমর্পণকারী –(আনআম : ১৬৩-১৬৩)।
আয়াতটিতে এক বিশেষ ক্রমানুসারে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে নামায এবং কুরবানী, তারপর নামাযের সাথে জীবন এবং কুরবানীর সাথে মৃত্যু উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নামায এবং কুরবানী দু’টি সার্বিক বিষয় যা মুমেনের গোটা জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। নামায আসলে এ সত্যেরই প্রতিফলন যে, মুমেন শুধু নামাযেই নয় বরঞ্চ নামাযের বাইরে তার গোটা জীবনেই একমাত্র আল্লাহর অনুগত বান্দাহ। কুরবানী এ সত্যেরই বাহিঃপ্রকাশ যে, মুমেনের জান-মাল সব কিছুই আল্লাহর পথে কুরবান হবার জন্যেই তার কাছে গচ্ছিত আছে।
পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের সাথে যে নামায পড়া হয়, তা হবে প্রকৃত নামায। গোটা জীবনের উপর তা এমন প্রভাব বিস্তার করবে যে, একদিকে নামাযী ব্যক্তি অনাচার অশ্লীতা থেকে বেঁচে থাকার জন্যে অত্যন্ত সজাগ থাকবে- অনাচার করা তো দূরের কথা তার চিন্তা করতেও ঘৃষণা আসবে এবং অপরদিকে ভালো কাজ করার জন্যে বরং সবচেয়ে ভাল কাজ করার জন্যে উৎসাহী ও তৎপর হবে।
একামাতে সালাতের হক পুরাপুরি আদায় করার এবং নামাযকে সত্যিকার নামায বানাবার জন্যে উপরের চৌদ্দটি শর্ত মেনে চলতে হবে। সেই সাথে তাহাজ্জুদ, অন্যান্য নফল নামায এবং যিকির আযকারেরও নিয়মিত অভ্যাস করতে হবে যা মসনূন। উপরন্তু নিবৃত স্থানে সর্বদা আত্মসমালোচনা  ও অশ্রু গদ গদ হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করার অভ্যাসও করতে হবে।
নামায ফরয হওয়ার সময়কাল
নামায তো নবী (স) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা) শুরু থেকেই পড়তেন। তবে পাঁচ ওয়াক্তের নামায শবে মে’রাজে ফরয করা হয়। হিজরতের এক বছর পূর্বে নবী পাক (স) মে’রাজের মর্যাদা লা্যভ করেন এবং আল্লাহর সান্নিধ্যে হাযির হন। এ সময়ে এ নামায উপহার দেয়া হয়। তারপর হযরত জিবরাইল (আ) এসে তাঁকে নামাযের ময় এবং পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। নামায যে ফরয তা কুরআনে সুস্পষ্টরূপে বলা হয়েছে এবং সকল এবাদতের মধ্যে নামাযের জন্যে বেশী বেশী তাকীদ করা হয়েছ। নামায ফরয এ কথা যে অস্বীকার করে সে নিশ্চয় মুসলমান নয়।

নামাযের সময়

নামাযের সময় নিয়মানুবর্তিতার সাথে ফরয করা হয়েছে। [কুরআনে আছে-
-অতএব নামায কায়েম কর। বস্তুতঃ নামায মুমেনদের উপরে নিয়মানুবর্তিতার সাথে ফরয করা হয়েছে –(নিসা : ১: ১০৩)] ফরয নামাযগুলোর সময় কুরআন ও সুন্নাতের বিশ্লেষণ মুতাবিক পাঁচটি, যথা ফজর, যোহর, আসর, মাগরেব ও এশা। [নামাযের সময় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
নামায কায়েম কর সূর্য ঢলে যাওয়ার সময়ে, রাতের অন্ধকার পর্যন্তহ এবং ফজরে কুরআন পাঠ কর নিয়মানুবর্তিতার সাথে। ন্যিশ্চয় ফজরের পাঠ মশহুদ হয় (অর্থাৎ ফেরেশতাগণ এ নামাযের সাক্ষী থাকেন)। -(বনী ইসরাঈল: ৭৮)
সূর্য ঢলে যাওয়ার অর্থ মধ্যাহ্নের পর থেকে ক্রমশঃ তার তীব্রতা কম হতে থাকা। এ পরিবর্তন দিনে চারবার হয় এবং ‘দুলুক’ শব্দের দ্বারা তাই বুঝানো হয়েছে। যেমন:
(১) মধ্যাহ্নের পর যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে।
(২) দিনের শেষের কিদে যখন তার রশ্মি কমে আসে বেং তার মধ্যে হলুদ আভা দেখা যায়।
(৩) যে সময়ে সূর্য অস্ত যায়।
(৪) এমন সময় যখন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর লাল আভাটুকু বিলিন হয়ে অন্ধকার নেমে আসে।
এ হচ্ছে চার সময়, যখন যোহর, আসর, মাগরেব এবং এশার নামায কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফজরে কুরআন পাঠের অর্থ ‘ফজরের নামায’। কুরআনে নামাযের জন্যে ‘সালাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও আবর তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে নামায মনে করা হয়েছে। এর দ্বারা নামাযের এ অংশের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। ফজরের পাঠ মশহুদ হয়-অর্থাৎ রাতের নিদ্রা ও বিশ্রামের পর তখন মন-মেযাজ বড় প্রশান্ত থাকে, মানুষ তখন সজীবতা লাভ করে এবং সময়টাও বড়োই মনোরম ও নীরব থাকে।
উপরোক্ত আয়াতে যে চার নামাযের সদিকে সামগ্রিকভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে, কুরআনের অন্যত্র সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে।
-এবং নামায কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে এবং রাত কিছুটা অতীত হওয়ার পর –(হুদ :১১৪)।
দিনের দুই প্রান্তে নামাযের সুস্পষ্ট মর্ম ফযর এবং মাগরেবের নামায। রাত কিছুটা গভীর হওয়ার পর যে নামায তাহলো এশার নামায।
এবং তোমার রবের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ কর সূর্য উদিত হওয়ার আগে এবং অস্ত যাওয়ার পূর্বে এবং রাতের কিচু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর। পুনরায় তসবীহ পাঠ কর এবং দিনের প্রান্তসমূহে। (তোয়াহা: ১৩০)
সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ ফজরের নামায, অস্ত যাওয়ার আগে অর্থাৎ এশার নামায পড়ার কথা বলা হয়েছে। তারপর দিনের প্রান্তসমূহ হলো তিনটি, যথা, প্রাতঃকাল দুপুরের পর এবং সূর্যাস্তের পর। অর্থাৎ ফজর, যোহর এবং মাগরেব।

অতএব আল্লাহর তসবীহ পাঠ কর যখন তোমার সন্ধ্যা হয়, এবং যখন তোমার সকাল হয়। আসমান এবং যমীনের প্রশংসা শুথু তাঁরই। (এবং তার তাসবীহ পাঠ কর)। তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমার যোহরের সময় আসে- (রুম: ১৭-১৮)।
এখানে তাসবীহ অর্থ নামায। কুরআন এভাবে সময়ের নির্ধারণও করা হয়েছে। নতুবা শুধু তাসবীহ পাঠের সময় নির্ধারণের কি অর্থ হতে পারে? অতপর আল্লাহ তায়ালা নামাযের সময় সম্পর্কে বিশ্লেষণের জন্যে হযরত জিবরাঈল (আ) কে পাঠান। তিনি বনী (স)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে প্রত্যেক ওয়াক্তের সঠিক সময় বলে দেন।
নবী করীম (স) এরশাদ করেন,
জিবরাইল (আ) দু’বার বায়তুল্লাহর নিকটে আমাকে নামায পড়িয়ে দেন। প্রথম দিন যোহরের নামা এমন সময়ে পড়ান যখন সবেমাত্র পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে এবং চায়া জুতার তলা থেকে বড় ছিল না। তারপর আসরের নামায এমন সময় পড়ালেন যখন প্রতিটি জিনিসের ছায়া তার সমান ছিল তারপর মাগরেবের নামায পড়ালেন যখন রোযাদার ইফতার করে। এশার নামায পশ্চিম আকাশের আভা বিলীন হওয়ার সাথে সাথে পড়ালেন তারপর ফজরের নামায এমন সময় পড়ালেন যখন রোযাদারদের জন্যে খানাপিনা হারামহয়ে যায়। দ্বিতীয়বার যোহর নামায তিনি এমন সময় পড়ালেন যখন প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার সমান ছিল এবং আসর পড়ালেন এমন সময় যখন বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ ছিল। মাগরেবের নামায পড়ালেন রোযাদারদের ইফতার করার সময় এবং এশা রাত এবং তৃতীয়াংশ অতীত হওয়ার পর। ফজরের নাময পড়ালেন উষার আলো ভালোভবে ছড়িয়ে পড়ার পর। অতপর তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ (স), নবীদের নামায পড়ার এই হলো সময়সূচী। নামাযের সঠিক সময় ্ দু’সময়ের মধ্যে।
ফযরের সময়
উষার আলো প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সুর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত থাকে।

যোহরের সময়

সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পর শুরু হয়। সময় তখন পর্যন্ত থাকে যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার আসল ছায়া ব্যতীত দিগুণ হয়। যেমন এক হাত লম্বা, একটা লাকড়ির আসল ছায়া দুপুর বেলা চর আঙ্গুল ছিল। তারপর সে লাকড়ির ছায়া যখন দু’হাত চার আঙ্গুল হবে তখন যোহরের ওয়াক্ত চলে যাবে। কিন্তু সাবধানতার জন্যে যোহরের নামায এমন সময়ের মধ্যে পড়া উচিত যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার আসল ছায়া বাদে সমান হয় জুমার নামাযেরও এই সময়। তবে গরমের সময় একটু বিলম্বে পড়া ভাল। কিন্তু জুমার নামায সকল ঋতুতে প্রথম সময়ে পড়াই উত্তম।

আসরের সময়

যোহরের ওয়াক্ত খতম হলেই আসরের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় পর্যন্ত থাকে। অবশ্যি সূর্যে হলুদ বর্ণ এসে যাওয়ার পূর্বে আসরের নামায পড়া উচিত। হলুদ বর্ণ আসার পর নামায মাকরুহ হয়। কোন কারণে যদি আসরের নামায বিলম্বিত হয়ে যাওয়ার কারণে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে, তাহলে নামায কাযা না করেই তখনই পড়ে নেয়া উচিত।

মাগরেবের সময়

সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় এবং পশ্চিমাকাশের লাল বর্ণ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাকী থাকে। মাগরেবের সময় হওয়ার সাথে সাথে পড়া মুস্তাহাব।

এশার সময়

পশ্চিামাকাশের লাল বর্ণের পর সাদা বর্ণ চলে যাওয়অর পর শুরু হয় এবং সুবহে সাদেক পর্যন্ত বাকী থাকে। পশ্চিমাকাশের সাদা বর্ণ সুর্যাস্তের আনুমানিক সোয়া ঘন্টা পর অন্ধকারে ঢেকে যায়। কিন্তু এশার নামায সাবধানতার জন্যে দেড় ঘন্টা পর পড়া উচিত।
এসব ফরয নামায ছাড়াও তিন নামায ওয়াজেব। নিম্নে সে সবের ওয়াক্ত বলা হলো।

বেতরের নামাযের সময়

এশার নামাযের পরেই বেতের পড়া উচিত। অবশ্যি যারা নিয়মিতভাবে শেষ রাতে উঠতে অভ্যস্ত তাদের জন্যে শেষ রাতে পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু যদি সন্দেহ হয় যে, কি জানি যদি ঘুম না ভাঙে তাহলে মুস্তাহাব এই যে, এশার নামাযের পরেই তা পড়ে নিতে হবে।

দু’ঈদের নামাযের সময়

যখন সূর্যোয়ের পর তার হলুদ বর্ণ শেষ হওয়ার পর রৌদ্র তেজ হয়ে পড়ে তখন দু’ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং বলা পড়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। তবে সর্বদা ঈদের নামায তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব। [বেতেরের নামায ওয়াজেব। শরীয়তের শুধু তিন নাময ওয়অজেব। বেতের এবং দু’ঈদের নামায। অবশ্য মানতের নামাযও ওয়াজেব। প্রত্যেক নফল শুরু করার পর তা ওয়াজেব হয়ে যায়। কোন কারণে নামায নষ্ট হলে তা কাযা পড়া জরুরী হয়ে পড়ে।
নামাযের এ সময়গুলো সারা বিশ্বের জন্যে
নামাযের সময় নির্ধারণের যে নিয়ম উপরে বলা হলো তা দুনিয়ার সকল দেশের জন্যে। যেখানে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয় রাত ও দিন ছোটো হোক অথবা বড়ো হোক, নামাযের সময় সেখানে উপরোক্ত নিয়মেই নির্ধারণ করতে হবে। [মেরু প্রদেশগুলোর নিকটবর্তী ভুখণ্ডে যেখানে রাত ও দিনের মধ্যে অসাধারণ দূরত্ব হয় সেখানে নামাযের সময় নির্ধারণের ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা মওদূদী একটি প্রশ্নের জবাবে যা বলেছেন তা প্রনিধানযোগ্য। নিম্নের রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খন্ড থেকে প্রশ্ন ও উত্তর উদ্ধৃত করা হলো।
মরু অঞ্চলদ্বয়ের নিকটবর্তী দেশগুলোতে নামায রোযার সময়

প্রশ্ন: আমার এক ছেলে ট্রেনিং উপলক্ষে ইংলণ্ডে আছে। সে রোযার সময় সূচীল জন্যে মৌলিক নিয়ম পদ্ধতি জানতে চায়। বৃষ্টি, বাদল, কুয়াশা প্রভৃতির কারণে সেখানে সূর্য খুব কমই দেখা যায়। দিন কখনো খুব বড়ো, কখনও খুব ছোট হয়। কখনওআবার সূর্যোদয় ও সূর্য়াস্তের মধ্যে বিশ ঘন্টার তফাৎ হয়। তাহলে এমন অবস্থায় বিশ ঘন্টা বা বেশী সময় রোযা রাখতে হবে?

উত্তর: যেসব দেশে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সূর্য উদয় হয় ও অস্ত যায়, তা সেখানে রাত ছোটো অথবা বড়ো হোক সেখানে নামাযের সময় ঠিক ঐ নিয়মে নির্ধারণ করতে হবে যা কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ফজরের নামায সূর্যোগয়ের আগে যোহর বেলা গড়ার পর, আসর সূর্যাস্তেরে আগে মাগরেবের নামায সূর্যাস্তের পর এবং এশা রাত কিছুটা অতীত হওয়ার পর। এভাবে রোজা সুবহে সাদেক হওয়ার সময় থেকে শুরু হবে এবং সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করতে হবে। যেখানে যোহর এবং আসরের মধ্যে অথবা মাগরেব এবং এশার মধ্যে সময় ক্ষেপণ সম্ভব নয়, সেখানে দু’ওয়াক্তের নামায এক সাথে পড়বে।
আপনার ছেলে যেন তা সুবিধামতো আবহাওয়া অফিস থেকে জেনে নেয় যে, সেখানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত কখন হয় এবং বেলা গড়ে কখন। সে অনুযায়ী নামাযের সময় ঠিক করে নেবে।
রোযার সময়ের ওখানকার দিন বড়ো হওয়ার জ্যন্যে ঘাসড়াবার দরকার নেই। ইবনে বতুতা রাশিয়ার বুলগেরিয়া শহর সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন গ্রীষ্মকালে সেখানে পৌছেন তখন রমযান মাস ছিল। সেখানে ইফতারের সময় নিয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত মাত্র দু’ঘন্টা সময় পাওয়া যায়। এ অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে মুসলমানগণ ইফতারও করে, খানাও খায় এবং এশার নামাযও পড়ে। এশার নামাযর কিছুক্ষণ পরেই সুবহে সাদেক হয়ে যায়। তারপর ফজরের নামায পড়ে।

নামাযের রাকয়াতসমূহ

ফজরের নামায

প্রথম দু’রাকয়াতের সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ [সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ঐ নামাযকে বলে যার বেশী তাকী করা হয়েছে। কোন ওযর ব্যতীত কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছা করে এ নামায ত্যাগ করে তাহলে শক্ত গুনাহগার হবে। সুন্নাতে গায়ের মুয়াক্কাদাহ (নফল) নামাযের অর্থ এই যে, এ জরুরী তো নয়, কিন্তু পড়লে খুব বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। সময় সুযোগ এবং মনের আগ্রহ থাকলে পড়া ভালো। না পড়লে গুনাহ হবে না।]  তারপর দু’রাকয়াত ফরয নামায। হাদীসগুলোকে ফজরের সুন্নাতের জন্যে খুব তাকীদ করা হয়েছে। যদিও নবী (স) অন্যান্য সুন্নাতের জন্যেও তাকীদ করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশী ফজরের সুন্নাতের জন্যে করেছেন। নিজেও তিনি এব্যাপারে খুব বেশী যত্নশীল ছিলেন। তিনি বলেন, ফজরের সুন্নাত কিছুতেই ছাড়বে না যদিও ঘোড়া তোমাদেরকে পদদলিত করে। [(আহমদ আবু  দাউদ) এ হাদীসের অর্থ এ নয় যে, জীবন গেলেও এ সুন্নাত আদায় করতে হবে। জানের ভয়ে তো ফরয নামাযও ছেড়ে দেয়া জায়েয। খুব বেশী তাকীদের; জন্যে এমন বলা হয়েছে।]
তিনি আরও বলেন, ফজরের সুন্নাত আমার কাছে দুনিয়া ও তার যাবতীয় সম্পদ থেকে বেশী প্রিয়। [মুসলিম, তিরমিযি, নাসায়ী।]
সুন্নাত নামাওগুলোর মধ্যে নবী পাক (স) ফজরের সুন্নাতের যতো পাবন্দি করতেন, অন্য কোন নামাযের সুন্নাতের এতটা করতেন না। [বুখারী, মুসলিম, আহমদ।]  হযরত হাফসা (রা) বলেন নবী (স) ফজরের সুন্নাত আমার ঘরে পড়তেন এবং হালকা পড়তেন। [আহমদ, বুখারী, মুসলিম।] ফজরের সুন্নাতে তিনি প্রথম রাকয়অতে (*****) এবং দ্বিতীয় রাকয়াতে (*****) পড়তেন। [আহমদ, তাহাবী, তিরমিযী।]]

যোহরের নামায

প্রথম চার রাকয়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (এক সালামসহ), তারপর চার রাকয়াত ফরয। তারপর দু’রাকয়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং তারপর দু’রাকয়াত নফল।

জুমার নামায

প্রথমে চার রাকয়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (এক সালামসহ), তারপর দু’রাকায়াত ফরয জামায়াতসহ, তারপর চার রাকয়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এক সালামসহ। [এ হচ্ছে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মত। তাঁর সাহেবাইন (দুজন শাগরেদ) বলেন, ফরযের পর দু’রাকয়াত পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। প্রথমে এক সালামে চার রাকয়াত, পরে দু’রাকয়াত। উভয় মতেরই সমর্থন হাদীস থেকে পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, জুমার নামাযের পর চার রাকয়াত পড় (তিরমিযী)। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) জুমার নামায বাদে ঘরে বসে দু’রাকয়াত সুন্নাত পড়তেন এবং বলতেন নবী (স)ও এমন করতেন। হযরত ইসহাকের অভিমত এই যে, যদি নামাযে জুমার পর মসজিদে পড়া যায় তাহলে চার রাকয়াত। এ জন্যে যে, নবী (স) বলতেন, জুমার নামায বাদে চার রাকয়াত পড়। আর যদি ঘরে পড়া হয় তাহলে দু’রাকয়াত। এ জন্যে যে, নবী (স) দু’রাকয়াত পড়তেন।]

আসরের নামায

প্রথম চার রাকয়াত সুন্নাতে গায়ের মুয়াক্কাতাহ অথবা মুস্তাহাব, তারপর চার রাকয়াত ফরয।

মাগরেব

প্রথমে তিন রাকয়াত ফরয তারপর দু’রাকয়অত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তারপর দু’রাকয়াত নফল।

এশা

প্রথমে চার রাকয়াত সুন্নাতে গায়ে মুয়াক্কাদাহ, তারপর চার রাকয়াত ফরয, তারপর দু’রাকয়অত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, তারপর তিন রাকয়াত বেতের, তারপর দু’রাকয়াত নফল। [বেতেরের পর দু’রাকয়াত নফল। নবী (স)বলেন, যাদের পক্ষে রাতে উঠা কষ্টকর তাদের বলে দাও যেন বেতেরের পর দু’রাকয়াত পড়ে। রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ হলে ভালো কথা। নতুবা এ দু’রাকয়াত তাহাজ্জুদ ধরা হবে। (মিশকাত)।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহর সংখ্যা ফজরে দুই, যোহরে ছয়, মাগরেবে দুই, এশায় দুই মোট বার (তিরমিযী)। পৃথক পৃথক হাদীসে তাদের ফজীলত বয়ন করে তাকীদ করা হয়েছে। যারা বিনা কারণে এসব ছেড়ে দেবে তারা শক্ত গুনাহগার হবে। নবী (স) বলেন, যে মুসলমান ফরয ছাড়াও দৈনিক বারো রাকয়াত আল্লাহর জন্যে পড়বে, তাদের জন্যে তিনি জান্নাতে ঘর দৈরী করবেন (মুসলিম)।

নামাযের মাকরুহ সময়

এ সময় তিন প্রকারের। এক- যে সময় প্রত্যেক নামায নিষিদ্ধ। দুই- যে সময়ে প্রত্যেক নামায মাকরুহ। তিন- যে সময়ে শুধু নফল নামায মাকরুহ।
যে যে সময়ে প্রত্যেক নামায নিষিদ্ধ
১. সূর্য যখন উঠতে থাকে এবং যতোক্ষণ না তার হলুদ রং ভালোভাবে চলে যায় এবং আলো ভালোভাবে ছড়িয়ে না পড়ে।
২. ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়-যতোক্ষণ বেলা গড়ে না যায়।ভ
৩. সূর্য লালবর্ণ ধারণ করার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে যদি কোন কারণে ঐ দিনের আসর নামায পড়া হয়ে না থাকে, তাহলে পড়তে হবে, কাযা করা চলবে না।
উপরোক্ত তিন সময়ে প্রত্যেক নামায নিষিদ্ধ তা সে ফরয হোক সুন্নাত কিংবা নফল, ওয়াজেব হোক বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এ সময়ে শুকরিয়া সিজদা এবং সিজদা তেলাওয়াতও নিষিদ্ধ। প্রথম থেকে নামায শুরু করার পর যদি এ মাকরুহ সময় এসে পড়ে তাহলে নামায বাতিল হয়ে যাবে। তবে জানাযা এলে তা বিলম্ব না করে পড়ে নিতে হবে।
যে যে সময়ে নামায পড়া মাকরুহ
১. যখন পেশাব পায়খানার চাপ পড়ে অথবা বায়ু নিঃসরণের প্রয়োজন হয়।
২. ভয়ানক ক্ষুধা লেগেছে এবং খানা সামনে হাযির। যদি মনে হয় যে, খানা না খেলে নামাযে মন বসবে না। এ অবস্থায় নামায পড়লে হয়ে যাবে কিন্তু মাকরুহ হবে। এ সব প্রয়োজন সেরে নামায পড়া উচিত, যাতে করে নিবিষ্ট মনে নামায পড়া যায়।
যে যে সময় শুধু নফল নামায মাকরুহ
১. যখন ইমাম খুতবা দেয়ার জন্যে নিজের জায়গা থেকে উঠবেন। তা জুমার খুতবা হোক, ঈদের হোক, বিয়ের হোক বা হজ্জের হোক।
২. ফজরের নামাযের পর সূর্য উদয় এবং তাঁর আলো ছড়িয়ে পড়া পর্যন্ত সময়ে।
৩. আসরের নামযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
৪. ফজরের সময় ফজরের সুন্নাত ব্যতীত অন্য কোন নফল নামায।
৫. ফরয নামাযর সময় তাকবীর বলা হয়।
৬. ঈদের নামযের আগে ঘরে হোক বা মাঠে।
৭. ঈদের নামাযের পর ইদগাহে নফল নামায।
৮. আরাফাতে যোহর আসরের মাঝে এবং আসরের পরে।
৯. মুযদালফায় মাগরেবে এশার মাঝে এবং পরে।
১০. মাগরেবের সয় মাগরেবের নামাযের প্রথমে।
এশার নামায বেশী বিলম্বে পড়া এবং অর্ধেক রাতের পরে পড়াও মাকরুহ। মাগরেবে নামায বিলম্বে পড়া যখন তারকা পুঞ্জ ভালোভাবে বের হয়ে আসে।

0 comments:

Post a Comment