Friday, July 21, 2017

হজ্জের ওয়াজিবসমুহ


হজ্জের ওয়াজিব নয়টি
১. সায়ী করা। অর্থাৎ সাফা মারওয়ার মাঝে দ্রুত চলা। (কুরআন পাকের বয়ান থেকে তাই মনে করা হয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে সায়ী ফরয। তার দলীল নিম্নোক্ত হাদীসঃ
*******আরবী*********
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির হজ্জ ও ওমরাহ পরিপূর্ণ বলে গণ্য করেন না যে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলো না। (মুসলিম)
২. মুযদালফার অবস্থান করা। অর্থাৎ ফজর শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো সময়ে সেখানে পৌছা।
৩. রামী করা। অর্থাৎ জুমরাতে পাথর মারা।
৪. তাওয়াফে কুদুম করা। অর্থাৎ মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তাওয়াফ করা। তাওয়াফে কুদুম তাদের জন্যে ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরে থাকে যাদেরকে আফাকী বলা হয়।
৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। অর্থাৎ খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় তাওয়াফ করা। এটাও শুধু আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।
৬. মাথা মুড়ানো বা চুল ছাটা। হাজ্জের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাটা। যুলহজ্জের দশ তারিখে জুমরাতে ওকবায় পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছাটা ওয়াজিব।
৭. কুরবানী একত্রে পড়া। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে যোহর আসর একত্রে এবং মুযদালাফায় মাগরিব এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।
৯. রামী, মস্তক মুণ্ডন ও কুরবানী ক্রমানুসারে করা।
সায়ী
অভিধানে সায়ী শব্দের অর্থ যত্ন সহকারে চলা, দৌড়ানো এবং চেষ্টা করা। পারিভাষিক অর্থে সায়ী বলতে হজ্জের সেই ওয়াজিব আমল বুঝায় যাতে হেরেম যিয়ারতকারী সাফা ও মারওয়া নামাক দুটি পাহাড়ের মাঝে দৌড়ায়।সাফা বায়তুল্লাহর দক্ষিণে এবং মারওয়া উত্তর দিকে অবস্থিত। আজকাল এ দুটি পাহাড়ের নামমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট আছে এবং তাদের মধ্যবর্তী স্থানে দুটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে এবং অপরটি মারওয়া থেকে সাফা আসার জন্যে। অর্থাৎ দুটি পাশাপাশি আপ ডাউন সড়ক। এ সড়ক দুটির ওপর বিরাট ছাদ তৈরী করে সড়ক দুটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে যাতে করে সায়ীকারীগণ রৌদ্রে কষ্ট না পায়।
সায়ীর হাকীকত ও হিকমত
কুরআন পাক বলে-
*******আরবী*********
সাফা ও মারওয়া নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশাবলীর মধ্য গণ্য।…….. শব্দের বহুবচন। কোনো আধ্যাত্মিক মর্ম এবং কোনো ধর্মীয় স্মৃতি অনুভব ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে জিনিস নিদর্শন স্বরূপ নির্ধারিত করা হয় তাকে ……… বলে। প্রকৃতপক্ষে এসব স্থান (সাফা মারওয়া) আল্লাহ পুরস্তি এবং ইসলামের বাস্তব বহিঃপ্রকাশের স্মরণীয় স্থান। মারওয়া হচ্ছে সেই স্থান যেখানে আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ ) তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ ) কে উপুড় করে শুইয়ে তার গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাতে করে তার দেখা স্বপ্ন কার্যে পরিণত করতে পারেন। সেই সাথে তার জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করে তার স্বীয় উক্তির *******আরবী********* (আমি পুরোপুরি নিজেকে রাব্বুল আলামীনের অধীন করে দিয়েছি) বাস্তব সাক্ষ্যদান করেন।
ইসলাম বা আত্মসমর্পণ করার এ অভিনব দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছ। এত কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ছিল এক বিরাট পরীক্ষা।
*******আরবী*********
এবং আমরা তাকে এ বলে ডাকলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমরা নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটা সত্য যে এ হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
সাফা ও মারওয়ার ওপর দৃষ্টি পড়তেই স্বাভাবিকভাবেই মুমিনের মনে কুরবানীর এ গোটা ইতিহাস ভেসে ওঠে। আর সেই সাথে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের চিত্রও ভেসে ওঠে।
এ সত্যটিকে মনে বদ্ধমূল করার জন্যে এবং এ প্রেরণাদায়ক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য সায়ীকে আল্লাহ তায়ালা মানাসেকের মধ্য শামিল করে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেনঃ
*******আরবী*********
অতএব যে ব্যক্তি হজ্জেও ওমরা করে, তার এ দুয়ের মধ্যে সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। আর যে আগ্রহ সহকারে কোনো ভালো কাজ করে, আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন এবং তার মূল্য দান করেন।
জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার মুশরিকগণ এ দুটি পাহাড়ের ওপর তাদের প্রতিমার বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। সাফার ওপরে আসাফের এবং মারওয়ার ওপরে নায়েলার প্রতিমা ছিল। তাদের চারধারে তাওয়াফ করা হতো। এজন্যে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল যে, এ দু পাহাড়ের মাঝে তারা সায়ী করবে কিনা। তখন আল্লাহ বলেন এ সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। এজন্যে যে, সায়ী বলতে হজ্জের মানাসেকের (করণীয় অনুষ্ঠানাদি) মধ্য গণ। হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হজ্জের যেসব মানাসেক শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সায়ী করার নির্দেশও ছিল। এজন্যে কোনো প্রকার ঘৃণা অনীহা ব্যতিরেকেই মুসলমানগণ যেন মনের আগ্রহ সহকারে সাফা মারওয়ার সায়ী করে। আল্লাহ মনের অবস্থা ভালোভাবে জানেন এবং মানুষের সৎ আবেগ অনুভূতি ও সৎকাজ সম্মানের চোখে দেখেন।
সায়ীর মাসায়েল
১. কাবার তাওয়াফের পর সায়ী করা ওয়াজিব। তাওয়াফের পূর্বে সায়ী জায়েয নয়।
২. সায়ী করার সময় হাদাসে আসগার ও হাদাসে আকবার থেকে পাক হওয়া ওয়াজিব নয় বটে, কিন্তু মসনুন।
৩. সায়ী তে সাতবার দৌড় দিতে হয়। এ সাতবারই ওয়াজিব।
৪. তাওয়াফ শেষ করার সাথে সাথেই সায়ী শুরু করা মসনুন, তবে ওয়াজিব নয়।
৫. সায়ী সাফা থকে শুরু করা ওয়াজিব।
৬. সায়ী পায় হেটে করা ওয়াজিব। বিশেষ কারণে সওয়ারীতে করা যায়।
৭. গোটা হজ্জে একবারই সায়ী করা উচিত। তা তাওয়াফে কুদুমের পরে অথবা তাওয়াফে যিয়ারতের পরে হোক। তাওয়াফে যিয়ারতের পর করা ভালো।
৮. সাফা মারওয়ার ওপরে ওঠা বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু হাত দোয়ার জন্যে ওঠানো এবং দোয়া করা মাসনুন।
৯. সায়ী করার সময় কেনাবেচা মাকরূহ। প্রয়োজন হলে কথা বলা যায়।
সায়ী করার পদ্ধতি ও দোয়া
তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে যিয়ারত যার পরেই সায়ী করা হোক, তাওয়াফ শেষ করে সাফা পাহাড়ে ওঠতে হবে। তারপর এ আয়াত পড়তে হয় *******আরবী********* (সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত)। সাফার এতোটা উচ্চতায় চড়তে হবে যেন বায়তুল্লাহ চোখে পড়ে। তারপর বায়তুল্লাহর দিক মুখ করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক এবং তার কোনো শরীক নেই।  শাসন কর্তৃত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসাও তার। তিনি প্রত্যেক বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ শক্তিশালী। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি একক। তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করে দেখিয়েছেন, তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি  একাই সমস্ত কাফের দলকে পরাজিত করছেন। (মুসলিম)
তারপর দরূদ শরীফ পড়ে যে দোয়া করার ইচ্ছা তা করা উচিত। নিজের জন্যে, আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনের জন্যে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান। সে জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্যে প্রাণভরে দোয়া করা উচিত। তারপর আবার নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! তুমি বলেছ আমার কাছে চাও আমি দিব। আর তুমি কখনো ওয়াদা খেলাফ করো না। তোমার কাছ আমার চাওয়া এই যে, তুমি যেমন আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দান করেছ, তেমনি এ সম্পদ থেকে তুমি কখনও আমাকে বঞ্চিত করো না এভাবে আমার যেন মৃত্যু হয় এবং আমি যেন মুসলমান হয়ে মরতে পারি। (মুয়াত্তা)
তারপর সাফা থেকে নেমে মারওয়ার দিকে চলতে হবে এবং এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
হে রব! আমাকে মাফ কর এবং রহম কর। তুমি পরম পরাক্রান্ত-শালী ও মহান।
সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন পাওয়া যায়। এ দুটি চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো সুন্নাত। এটা শুধু পুরুষদের জন্যে। মেয়েরা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তারা দৌড়ালে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে।
তারপর মারওয়া পাহাড়ে ওঠার পর ঐসব দোয়া পড়তে হয় যা সাফার ওপরে পড়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যিকির ও তসবিহতে মশগুল থাকা উচিত। কারণ এটা হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান।
তারপর মারওয়া থেকে নেমে পুনরায় সাফার দিকে যেতে হবে এবং ঐসব দোয়া পড়তে হবে যা আসবার সময় পড়া হয়েছে। আর এভাবে দু সবুজ চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াতে হবে। এভাবে সাতবার সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
রামী
রামীর আভিধানিক অর্থ নিক্ষেপ করা ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো। পরিভাষা হিসেবে রামী বলে সেই আমলকে যাতে হাজীগণ তিনটি স্তম্ভের ওপর পাথর মারে। জুমরাতে রামী করা ওয়াজিব। জুমরাতে জিমার অথবা জুমরাহ শব্দের বহুবচন। প্রস্তর খণ্ডকে জুমরাহ বলে। মিনার পথে কিছু দূরে দূরে অবস্থিত মানুষ সমান তিনটি স্তম্ভ আছে। সে সবের ওপরে যেহেতু পাথর মারা হয় সে জন্যে এগুলোকেও জুমরাত বলা হয়। এ তিনটিকে জুমরায় উলা, জুমরায়ে উস্তা এবং জুমরায়ে ওকবাহ বলে। মক্কার নিকটবর্তী যেটি, তাকে জুমরায়ে ওকবাহ বলে। তার পরেরটিকে বলে জুমরায়ে উস্তা এবং তার পরেরটি যা মসজিদে খায়েফের নিকটবর্তী তাকে জুমরায়ে উলা বলে।
রামীর মর্মকথা ও হিকমত
নবী পাক (স) এর জন্মের কিছুদিন পূর্বে (অধিকাংশের মতে পঞ্চাশ দিন হবে) হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহ ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে আগ্রাসন পরিচালনা করে। সে হস্তীবাহিনী সহ বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হতে থাকে। মক্কার অতি নিকটবর্তী মহার উপত্যকা পর্যন্ত সে উপনীত হয়। আল্লাহ তায়ালা তার এ অসৎ উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তাদের প্রত্যেকে ঠোটে একটি করে এবং দু পায়ে দুটি করে ছোট ছোট পাথর নিয়ে এসেছিল এবং গোটা সেনাবাহিনীর ওপরে এমন মুষলধারে বর্ষণ করলো যে, অধিকাংশ ঘটনাস্থলেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং অবশিষ্ট পথে পড়ে পড়ে মরতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আবরাহার দুরভিসন্ধি নির্মূল করে দেন।
জুমরাতে পাথর মারা সেই ধ্বংসকারী প্রস্তর বর্ষণের স্মৃতি বহন করে। জুমরাতের ওপরে আল্লাহ আকবার বলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে পাথর নিক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এ সত্য সম্পর্কে দুনিয়াকে হুশিয়ার করে দেয়া এবং আপন সংকল্পের ঘোষণা করা যে, মুমিনের অস্তিত্ব দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার জন্য।
কোনো শক্তি যদি দুরভিসন্ধি সহকারে দীনের প্রতি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং তাকে মুলোৎপাটনের চেষ্টা করে তাহলে তাকে নির্মূল করে দেয়া হবে জুমরাতে পাথর নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এ সংকল্পের ঘোষণা করা হয়।
রামীর মাসায়েল
১. রামী করা ওয়াজিব। ইমাম মালেকের নিকট জুমরাতে ওকবায় রামী ফরয়। এ রামী না করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
২. নিচু স্থানে দাড়িয়ে রামী করা মসনুন। উঁচু স্থান থেকে করা মাকরূহ।
৩. প্রত্যেক পাথর মারার সময় আল্লাহু আকবার বলা মসনুন।
৪. পাথর যদি জুমরাতে না লাগে অর্থাৎ লক্ষ্যচ্যুত হয় তাহলে তাতে দোষ হবে না।
৫. যুলহজ্জের দশ তারিখে অর্থাৎ প্রথম দিন শুধু জুমরায়ে ওকবাতে পাথর মারবে। তারপর এগারো বারো তারিখে তিনটি জুমরাতেই পাথর মারতে হবে। তের তারিখে পাথর মারা মুস্তাহাব। সর্বমোট সাতবার পাথর মারা হচ্ছে। সাতটি করে উনপঞ্চাশটি পাথর মারতে হয়।
৬. একটি বড়ো পাথর ভেঙ্গে সাতটি করা মাকরূহ।
৭. সাতবারের বেশী পাথর মারা মাকরূহ।
৮. সাতটি পাথর সাতবার মারা ওয়াজিব। কেউ এক সাথে সাতটি পাথর মারলে তা একবারই মারা হবে।
৯. রামীর জন্যে মুযদালাফা থেকে আসার সময়ে মুহাসসার প্রান্তর থেকে ছোট ছোট পাথর সাথে নিয়ে আসা মুস্তাহাব। জুমরাতের আশপাশ থেকে পাথর কুড়িয়ে নেয়া মাকরূহ।
উল্লেখ্য যে, জুমরাতের পাশে যেসব প্রস্তর কণা রয়ে যায় সেগুলো আল্লাহ কবুল করেন। যেগুলো তার দরবারে কবুল হয় তা ফেরেশতাগণ ওঠিয়ে নিয়ে যান। এজন্য ওখানে পড়ে থাকা পাথর কণা দিয়ে রামী করা মাকরূহ।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী নবী (স) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রতি বছর আমরা যেসব পাথর কনা দিয়ে রামী করি তার সংখ্যা তো কমে যায় বলে মনে হয়। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ, এসবের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ কবুল করেন, তা ওঠিয়ে নেয়া হয়। নতুবা তোমরা দেখতে পেতে যে, পাথর কণাগুলো পাহাড়ের মত স্তূপ হয়ে যেতো। (দারে কুতনী)
১০. যে পাথর কণা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা হয় যে, তা নাপাক, তার দ্বারা রামী করা মাকরূহ।
১১. দশ তারিখে রামী শুরু করতেই তালবিয়া বন্ধ করা উচিত। বুখারী শরীফে আছে যে, হুজুর (স) জুমরায়ে ওকবাতে রামী করা পর্যন্ত তালবিয়া করতে থাকেন।
১২. দশই যুলহজ্জ রামী করার মসনূন সময় হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত। তারপরেও সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়েয, কিন্তু সূর্যাস্তের পর মাকরূহ। অন্য তারিখগুলোতে বেলা গড়া তেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রামী করার মসনূন সময়।
১৩. রামী করার জন্যে এক রাত্র মিনাতে কাটানো মসনূন।
১৪. দশ তারিখে জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর অন্য তারিখগুলোতে নিম্ন ক্রম অনুসারে রামী করা মসনূনঃ
প্রথমে জুমরায়ে উলাতে রামী করতে হবে যা মসজিদে খায়েফের নিকটে অবস্থিত। তারপর জুমরায়ে উস্তা এবং তারপর জুমরায়ে ওকবা।
১৫. জুমরায়ে উলা ও জুমরায়ে উস্তায় রামী পায়ে হেটে করা ভালো এবং জুমরায়ে ওকবার সওয়ারীতে থেকে করা ভালো।
১৬. জুমরায়ে উলা ও উস্তায় রামী করার পর এতটুকু সময় দাড়িয়ে থাকা, যে সময়ে সূরা ফাতেহা তেলাওয়াত করা যায় এবং তাহমীদ, তাহলীল, তাকবীর, দরূদ প্রভৃতি পড়াতে মশগুল থাকা এবং হাত তুলে দোয়া করা মসনূন।
১৭. মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তীস্থানে এক প্রান্তর ছিল যাকে মুহাসসাব বলা হতো। এখন সেখানে বসতি হয়ে গেছে। আজকাল তাকে মুয়াহেদা বলে। বিদায় হজ্জে নবী পাক (স) এখানে অবস্থান করেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) এখানে যোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামায আদায় করেন। তারপর কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম করেন। তারপর এখান থেকে রওয়ানা হয়ে বায়তুল্লাহ পৌঁছে তওয়াফ করেন। (বুখারী)
অবশ্য এখানে অবস্থান করা সুন্নাত, ওয়াজিব এবং অপরিহার্য নয়। না করলে কোনো দোষ নেই।
১৮. রামী ওসব বস্তুর দ্বারা করা যায় যার দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয। যেমন ইট, পাথর, পোড়া মাটি, পাথর কণা, মাটি, ঢিল প্রভৃতি। কাঠ বা কোনো ধাতব দ্রব্য দ্বারা রামী জায়েয নয়।
রামী করার পদ্ধতি ও দোয়া
জুমরায়ে ওকবাতে প্রথম রামি করার পূর্বে তালবিয়া ছেড়ে দিয়ে রামী করা উচিত। রামী করার মসনূন পদ্ধতি এই যে, কোনো নিচু স্থানে দাড়িয়ে প্রথমে এ দোয়া পড়বে-
*******আরবী*********
আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। শয়তানের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে (এ কাজ করছি) হে আল্লাহ এ হজ্জকে হজ্জে মাবরুর বানিয়ে দাও। গোনাহ মাফ করে দাও এবং এ চেষ্টা কবুল কর।
তারপর প্রস্তর কণা আঙ্গুল দিয়ে ধরে প্রত্যেকটি আল্লাহু আকবার বরে মারবে, জুমরাতে লক্ষ্য করে মারবে। জুমরায়ে ওকবাতে পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর মারা অথবা বড়ো বড়ো ইট বা পাথর দিয়ে মারা জুমরাতের নিকটে পড়ে থাকা কণা দিয়ে মারা মাকরূহ।
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাসায়েল
মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছাটা হজ্জের আমলসমূহের একটি অপরিহার্য আমল। আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী*********
তোমরা ইনশাআল্লাহ মসজিদুল হারামে মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছেঁটে নিরাপদে প্রবেশ করবে। আর তোমাদের কোনো প্রকারের ভয় ভীতি থাকবে না। (সূরা ফাতাহ: ২৭)
আসলে মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এবং হালাল হওয়ার একটা নির্ধারিত শরীয়াতের পন্থা। এর তাৎপর্য সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে শাহ অলীউল্লাহ (র) বলেন, মাথা মোড়ানোর তাৎপর্য এই যে, এ ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এক বিশেষ নির্ধারিত পদ্ধতি। এমন পদ্ধতি যদি নির্ধারিত করা হতো যা মর্যাদার পরিপন্থী, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন ইচ্ছামতো তার ইহরাম খতম করতো এবং পৃথক পৃথক পদ্ধতি প্রবর্তন করতো। (হুজ্জাতুল্লাহেল বালেগা)
১. দশই যুলহজ্জ কুরবানীর দিন জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ওয়াজিব।
২. পুরুষদের জন্যে মাথা মোড়ানো অথবা চুল ছাটা উভয়ই জায়েয। তবে মস্তক মুন্ডানোর ফযীলত বেশী। এজন্যে যে, নবী (স) মস্তক মুন্ডনকারীদের জন্যে দুবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন এবং যারা চুল ছাটে তাদের জন্য একবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন। (আবু দাউদ, জামাউল ফাওয়ায়েদ)
৩. মেয়েলোকদের কিছুটা চুল কেটে ফেলা উচিত। তাদের জন্যে মস্তক মুণ্ডন জায়েয নয়। হযরত আলী (রা) বলেন, নবী (স) মেয়েদের মস্তক মুণ্ডন করতে নিষেধ করেছেন।
৪. পুরুষরা সমস্ত মাথার চুলের এক আঙ্গুল পরিমাণ কেটে ফেললে তা জায়েয হবে এবং এক চতুর্থাংশ চুলের কিছু ছেঁটে ফেলাও জায়েয। মেয়েদের জন্যে তাদের চুলের অগ্রভাগ কিছুটা ছেঁটে ফেললেই যথেষ্ট হবে।
৫.কারো মাথায় যদি চুল মোটেই গজায়নি অথবা টাক থাকে, তাহলে মাথার উপর শুধু খুর বুলালেই যথেষ্ট হবে।
৬. চুল সাফ করার কোনো ওষুধ দ্বারা যদি কেউ চুল সাফ করে তাহলে তাও জায়েয হবে।
৭. মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরামের অবস্থার অবসান হয় এবং তারপর তার জন্যে ওসব কাজ হালাল হয়ে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তবে স্ত্রী সহবাস তখনও জায়েয হবে না যতক্ষণ না তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করা হয়েছে।

Thursday, July 20, 2017

ইহরাম ও তার মাসয়ালা


১. হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোষাক পরিধান করা ও তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। হজ্জের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার পর লোক মুহরেম হয়ে যায়। যেমন নামাজে তাকবীর বলার পর লোক নামাজে প্রবেশ করে এবং তারপর খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায়, তেমনি ইহরাম বাধার পর হজ্জ শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু জিনিষ যা ইহরাম বাধার পরে জায়েয ও মুবাহ ছিল, ইহরাম অবস্থায় সেসব কাজ হারাম হয়ে যায়। এজন্য একে ইহরাম বলে।
২. যে কোন কারণে মক্কা যেতে হোক ভ্রমণ ব্যবসা বাণিজ্য অথবা যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধা অত্যাবশ্যক। ইহরাম ছাড়া মীকাত থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরুহে তাহরীমা।
৩. ইহরাম বাধার পূর্বে গোসল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। শিশুদের গোসল করাও মসনুন। মেয়েলোক হায়েয নেফাস অবস্থায় তাদের গোসল করাও মসনুন। হ্যাঁ তবে গোসল করতে অসুবিধা হলে বা কষ্ট হলে অযু অবশ্য করে নেওয়া উচিৎ। এ অযু বা গোসল শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য, পাক পবিত্রতার জন্য নয়। এ জন্য পানি না পেলে তায়াম্মুম করার দরকার নেই।
৪. ইহরামের জন্য গোসল করার জন্য চুল কাটা, নখ কাটা ও সাদা চাদর ও তহবন্দ পরা এবং খসবু লাগানো মুস্তাহাব।
৫. মীকাতে পৌছার পূর্বেও ইহরাম বাধা জায়েয। ইহরামের সম্মান রক্ষা করতে পারলে তা ভালো। নতুবা মীকাতে পৌছার পর ইহরাম বাধা ওয়াজিব।
৬. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজঃ এসবের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সব সময় নিষিদ্ধ। কিন্তু ইহরাম অবস্থায় যে সব কাজ করা অধিকতর গোনাহের কাজঃ
১. যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়া অথবা যৌন সম্পর্কিত আলাপ আলোচনা করা, আপন স্ত্রীর সাথেও এ ধরনের কথাবার্তায় আনন্দ উপভোগ করা নিষিদ্ধ।
২. আল্লাহর নাফরমানী ও গোনাহ করা।
৩. লড়াই-ঝগড়া ও গালাগালি করা। কর্কশ কথা বলা।
৪. বন্য পশু শিকার করা। শিকার শুধু হারাম নয়। বরঞ্চ শিকারির সাথে কোন প্রকার সহযোগীতা করা অথবা শিকারিকে পথ দেখানো অথবা শিকারের দিকে ইংগিত করাও হারাম।
৫. সিলাই করা জামা কাপড়। যেমন শার্ট, পাঞ্জাবী, পায়জামা, শিরওয়ানী, কোট-প্যান্ট, টুপি, বেনিয়ান, দস্তানা প্রভৃতি পরিধান করা। মেয়েরা মিলওয়ার কামিজ পড়তে পারে। মোজাও পরতে পারে এবং ইচ্ছা করলে অলংকার ব্যবহার করতে পারে।
৬. রঙিন ও খোশবুদার রঙে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা। মেয়েরা রেশমী কাপড় পড়তে পারে এবং রঙিন কাপড়ও। অবশ্য খুশবুদার হওয়া চলবে না।
৭. মাথা ও মুখমন্ডল ঢাকা।মেয়েরা মাথার চুল ডেকে রাখবে।
৮. মাথা দাড়ি সাবান প্রভৃতি দিয়ে ধোয়া।
৯. শরীরে কোনে স্থানের চুল কামানো। কোন কিছুর সাহায্যে চুল উঠিয়ে ফেলা।
১০. নখ কাটা অথবা পাথর প্রভৃতিতে ঘসে সাফ করা।
১১. খুশবু লাগানো।
১২. তৈল ব্যবহার করা।
৭. ইহরাম অবস্থায় জায়েয কাজঃ
ওপরে যেসব বিষয় বলা হল তা ছাড়া সব কিছু কর জায়েয। যেমনঃ
১. কোনো ছায়ায় আরাম করা।
২. গোসল করা, মাথা ধোয়া, তবে সাবান ব্যবহার না করা।
৩. শরীর বা মাথা চুলকানো। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে চুল উঠে না যায় অথবা চুলের উকুন পড়ে না যায়।
৪. টাকা পয়সা অস্ত্র প্রভৃতি সাথে রাখা
৫. অবসর সময়ে ব্যবসা করতে দোষ নেই। কুরআনে আছেঃ
 ******আরবী********
হজ্জের সময় তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (ব্যবসার দ্বারা মুনাফা) তালাশ কর, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।
৬. ইহরামের কাপড় বদলানো বা ধোয়া।
৭. আংটি ঘড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করা।
৮. সুরমা লাগানো তবে খুশবু সুরমা নয়।
৯. খাতনা করা।
১০. নিকাহ করা।
১১. অনিষ্টকর জীব হত্যা করা। যেমন চিল, কাক, ইঁদুর, সাপ, বিচ্ছু, বাঘ, কুকুর, প্রভৃতি। নবী (স) বলেন, হেরেমে বা ইহরামের অবস্থায় পাঁচ প্রকারের জীব হত্যায় কোন দোষ নেই। যেমন, ইঁদুর, কাক, চিল, বিচ্ছু, আক্রমণকারী কুকুর।
১২. সামুদ্রিক শিকার জায়েয। কোনো গায়ের মুহররম (যে ইহরাম অবস্থায় নেই)যদি স্থলের কোন শিকার তোহফা দেয় তাহলে খাওয়া জায়েয।
৮. ইহরামের পদ্ধতি:
ভালোভাবে চুল নখ কেটে গোসল করে খুশবু লাগিয়ে ইহরামের পোশাক পরবে। অর্থাৎ এক চাদর, এক তহবন্দ পরে দু রাকায়াত নফল নামায পড়বে। তারপর হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়বে। (মুফরেদ হলে শুধু হজ্জের নিয়ত করবে। কারেন হলে হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করবে। মুতায়াত্তা হলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করবে এবং ওমরাহ শেষ করে হজ্জের নিয়ত করবে। এসব পরিভাষার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য।) হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার সাথে সাথে ইহরাম বাধা হয়ে যায়। তারপর সে মুহররম হয়ে যায়। তারবিয়ার পরিবর্তে যদি কুরবানীর উট মক্কার দিকে রওয়ানা করে দেয়া হয় তাহলে তা তালবিয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়।
তালবিয়া ও তার মাসয়ালা
হজ্জের নিয়ত করার পরই হেরেম যিয়ারতাকারী যেসব কথা বলে তাকে তালবিয়া বলে, যথাঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি তোমার ডাকে হাজির। আমি তোমার দরবারে হাজির আছি, তোমার কোনো শরীক নেই। এটা সত্য যে, প্রশংসা ও শোকর পাবার অধিকারী তুমি। দান ও অনুগ্রহ করা তোমারই কাজ। তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বে কেউ শরীক নেই।
১. ইহরাম বাধার পর একবার তালবিয়া পড়া ফরয। বেশী বলা সুন্নাত।
২. ইহরাম বাধার পর থেকে ১০ই যুলহাজ্জ তারিখে প্রথম জুমরায় পাথর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকতে হবে। প্রত্যেক নীচুতে নামার সময় এবং ওপরে ওঠার সময় প্রত্যেক কাফেলার সাথি মিলিত হবার সময় প্রত্যেক নামাযের পর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তালবিয়া পড়তে হবে।
৩. জোরে জোরে তালবিয়া পড়া সুন্নাত। নবী (স) বলেন, আমার কাছে জিবরাঈল (আ ) এসে এ ফরমান পৌছিয়ে দেয় যে, আমি যেন আমার সঙ্গীদেরকে হুকুম দেই তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়ে। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক (র) তিরমিযি, আবু দাউদ প্রভৃতি। কিন্তু মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়বে না। হেদায়ায় আছে মেয়েরা তালবিয়া পড়ার সময় আওয়াজ বুলন্দ করবে না। এজন্যে যে এতে করে ফেতনার আশংকা সহতে পারে। তারা রমলও করবে না এবং সায়ী করার সময় দৌড়াবে না। এজন্যে যে, এতে পর্দা নষ্ট হবে।)
৪. তালবিয়া পড়লে তিনবার পড়তে হবে। তিনবার পড়া মুস্তাহাব।
৫. তালবিয়া পড়ার সময় কথা বলা মাকরূহ। সালামের জবাব দেয়া যেতে পারে।
৬. যে তালবিয়া পড়ছে তাকে সালাম না দেয়া উচিত। তাকে সালাম করা মাকরূহ।
৭. তালবিয়ার পর দরুদ পড়া মুস্তাহাব।

হজ্জের বিবরণ


হজ্জ ইসলামের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজ্জের একটা ঈমান উদ্দীপনা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর প্রতি লক্ষ্য না রাখলে হজ্জের মহত্ব, তাৎপর্য ও মূল উদ্দেশ্যে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কুফর ও শিরক পরিবেশিত এক শক্তিশালী পরিবেশে এক মুমিন বান্দাহ খালেস তাওহীদের ঘোষণা করেন। তারপর বাতিল যালেম শক্তির চরম বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈমান, তাকওয়া, ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, এশক ও মহব্বত, ত্যাগ ও কুরবানী নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ আল্লাহর আনুগত্য ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নজিরবিহীন প্রেরণা ও আমলের দ্বারা ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস তৈরী করেন এবং তাওহীদ ও এখলাসের এমন এক কেন্দ্র তৈরী করেন যা দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার থেকে বিশ্ব মানবতা তাওহীদের পয়গাম পেতে থাকবে।
এ ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করার জন্যে এবং মানুষের মনে আবেগ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করার জন্যে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে তাওহীদের প্রেম পাগল পতঙ্গসমূহ ঐ কেন্দ্রে জমায়েত হয়ে ঐসব কিছুই করে যা তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ) করেছিলেন। তারা কখনো দু খন্ড কাপড় পরিধান করে আবেগ উচ্ছ্বাসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং কখনো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাদেরকে দৌড়াতে দেখা যায়। কখনো আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং কখনো কুরবানীগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর সাথে মহব্বতের শপথ গ্রহণ করে। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সকাল সন্ধ্যায় তাদের এ একই ধ্বনিতে হেরেমের গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে আয় আল্লাহ! তোমার দরবারে তোমার গোলাম হাজির আছে। প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র তোমারই, দয়া করা তোমারই কাজ, তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কেউ শরীক নেই।
প্রকৃতপক্ষে এসব অবস্থা সৃষ্টি করার এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ওপর সোপর্দ করারই নাম হজ্জ।
হজ্জের অর্থ
হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো যিয়ারতের এরাদা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় হজ্জের অর্থ হলো সেই সার্বিক ইবাদাত যা একজন বায়তুল্লাহ পৌঁছে করে থাকে। যেহেতু হজ্জে মুসলমান আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের এরাদা করে সে জন্যে একে হজ্জ বলা হয়।
হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত
ইসলামী ইবাদাত দুই প্রকারের। এক – দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা। দুই – মালের ইবাদত, যেমন সদকা যাকাত দান খয়রাত ইত্যাদি। হজ্জের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। অন্যান্য স্থায়ী ইবাদতগুলোর দ্বারা এখলাস, তাকওয়া, বিনয়, নম্রতা, বন্দেগীর পিপাসা। আনুগত্য, কুরবানী, ত্যাগ, আত্মসর্মপন, আল্লাহর নৈকট্য প্রভৃতির যে, প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথক পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে, হজ্জের সার্বিকতা এই যে, এ সকল অনুভূতি ভাবাবেগ ও মানসিক অবস্থা একই সময়ে এবং একই সাথে তৈরী হয় ও বিকাশ লাভ করে।
যে নামাজ দ্বীনের উৎস, তা কায়েম করার জন্য যমীনের উপর যে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরী করা হয়, হজ্জে মুমিনগণ সে মসজিদের চারপাশে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে তওয়াফ করে। সারা জীবন দূরদূরান্ত থেকে যে মসজিদের দিকে মুখ করে মুসলমান নামাজ পড়ে, হজ্জে তার এ সৌভাগ্য হয় যে, সে ঐ মসজিদে দাড়িয়ে নামাজ সমাধা করে।
যে রোজা মন ও চরিত্রের সংশোধনের উপযোগী ও অনিবার্য উপায় এবং যে রোজায় একজন মুমিন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় শক্তি লাভ করে ও আল্লাহর সিপাহী ও মুজাহিদ হওয়ার অভ্যাস করে।
হজ্জে ইহরাম বাধার সময় থেকে ইহরাম খোলা পর্যন্ত ঐরূপ সংগ্রাম সাধনায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, মন থেকে এক একটা চিত্র মুছে ফেলে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতের চিত্র অংকিত করে। দীন রাত তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত করে শুধু মাত্র তওহীদের পতাকাবাহী হয়ে যায়।
সদকা ও যাকাতে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ দান করে মুমিন বান্দাহ ধনলিপ্সার প্রবণতা মুছে ফেলে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করে । হজ্জেও লোক তার সারাজীবনের সঞ্চিত ধন শুধু আল্লাহর মহব্বতে মুক্ত হস্তে দান করে এবং তার পথে কুরবানী করে তার সাথে কৃত ওয়াদা চুক্তি পূরণ করে। মোটকথা, হজ্জের দ্বারা আল্লাহর সাথে প্রেমপূর্ন সম্পর্ক, মন, চরিত্রের সংশোধন এবং আধাত্নিক উন্নতির সকল উদ্দেশ্য একই সাথে পূর্ণ হয়। তবে শর্ত এই যে, হজ্জ শুধু মাত্র যেন হজ্জের অনুষ্ঠান পালনের কাজ না হয়।
হজ্জের হাকীকত
হজ্জের হাকীকত বা মর্মকথা এই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতে সোপর্দ করে দেবে এবং একনিষ্ঠ মুসলমান হয়ে যাবে। আসলে আল্লাহ তায়ালার পাত সত্তা থেকে এ শক্তি আশা করা যায় যে, সংস্কার সংশোধনের সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য প্রচেষ্টা সত্বেও বান্দাহর জীবনে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তা হজ্জের করনীয় কাজগুলো এবং হজ্জের স্থানগুলোর বরকতে দূর হয়ে এবং সে হজ্জের মাধ্যমে এমন পাক সাফ হয়ে ফিরে আসবে যেন সে আজই জন্ম গ্রহণ করেছে। সেই সাথে প্রকৃত অবস্থার একটা কষ্টিপাথর ও বটে। অর্থাৎ কার হজ্জ প্রকৃত হজ্জ এবং কে হজ্জের সকল আরকান পালন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা সত্ত্বেও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আর এটাও সত্য যে, হজ্জের তাওফীক লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সম্পর্কে খুব কম আশাই করা যেতে পারে যে, অন্য কোনো উপায়ে তার সংশোধন হতে পারবে। এজন্য হজ্জ পালনকারীর জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, সে যেন তার আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনার পর্যালোচনা করে এবং এবং হজ্জের এক একটি রুকন আমল পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও অনুভূতির সাথে আদায় করে হজ্জের সেসব ফায়দা হাসিল করে যার জন্য ফরয করা হয়েছে।
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ) এর কাছে এক ব্যক্তি হাজির হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করে (হজ্জ করে) ফিরে এসেছে কিন্তু তার জীবনের উপর হজ্জের কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? সে বললো আমি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে  আসছি।
হযরত জুনাইদ (র) খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন। তুমি হজ্জ করেছ নাকি ?
মুসাফির –জি হ্যাঁ, আমি হজ্জ করেছি।
হযরত – যখন তুমি হজ্জের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হয়েছিলে, তখন তুমি গোনাহ থেকে দূরে ছিলে কি না ?
মুসাফির – হযরত আমি এভাবে চিন্তা করেনি।
হযরত – তাহলে তুমিতো হজ্জের জন্য মোটেও বের হওনি। আচ্ছা বলোতো তুমি এ পবিত্র ছফরে তুমি যেসব মনযিল অতিক্রম করেছ এবং যেখানে যেখানে রাত কাটিয়েছে তখন তুমি কি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনযিলগুলোও অতিক্রম করেছ কি না ?
মুসাফির – হযরত, আমারতো এসব খেয়ালই হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো না বায়তুল্লাহর দিকে কোনো সফর করেছ। আর না সেদিকে কোন মনযিল অতিক্রম করেছ। আচ্ছা বল তো তুমি যখন ইহরাম বাধলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক খুলে ফেললে তখন তার সাথে সাথে তোমার মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলো তোমার জীবন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলে কিনা?
মুসাফির- হযরত, এভাবে তো আমি চিন্তা করে দেখিনি।
হযরত জুনাইদ তখন খুব দুঃখ করে বললেন। তাহলে তুমি ইহরামই বা বাধলে কোথায়? আচ্ছা বলত যখন তুমি আরাফাতের ময়দানে দাড়ালে তখন কিছু মুশাহাদার অনুভূতি হয়েছিল কি?
মুসাফির- হযরত, এর অর্থই বুঝলাম না
হযরত -তার অর্থ এই যে, আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার সময় তুমি তোমার মধ্য এ অবস্থা কি অনুভব করেছ যে, তোমার রব তোমার সামনে এবং তুমি তাকে দেখছ?
মুসাফির- হযরত, এ অবস্থা তো আমার হয়নি।
হযরত – তাহলে তুমি তো আরাফাতে পৌঁছাওনি। আচ্ছা তারপর বল দেখি, মুযদালাফায় পৌছার পর তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পরিহার করেছ কিনা?
মুসাফির- হযরত, আমি এ বিষয় তো কোনো মনোযোগ দেইনি।
হযরত তাহলে তুমি তো মুযদালাফাও যাওনি। আচ্ছা, বল দেখি, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের জ্যোতি ও অলৌকিক শক্তি লক্ষ্য করেছ কি?
মুসাফির- হযরত আমি এর থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
হযরত -তাহলে তুমি মোটেই তাওয়াফ করনি। আচ্ছা, তারপর তুমি যখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে তখন সাফা মারওয়া ও তার মধ্যে সায়ী করার হিকমত, মর্মকথা ও তার উদ্দেশ্যে হাসিল করেছ কি?
মুসাফির এসবের তো কোনো অনুভূতিই আমার ছিল না।
হযরত-তাহলে তুমি বলতে গেলে সায়ীও করনি। তারপর তুমি কুরবানগাহে গিয়ে যে কুরবানী কররে, তখন তুমি তোমার প্রবৃত্তি ও তার কামনা বাসনাকেও কুরবানী করেছ কি?
মুসাফির- হযরত এদিক আমি লক্ষ্যই করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি কুরবানীই বা করলে কোথায়? আচ্ছা বল দেখি, তুমি জমরাতে পাথর মারলে, তখন তুমি তোমার অসৎ সহকর্মী, সাথী ও কুপ্রবৃত্তিকেও তোমার কাছ থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছ কি?
মুসাফির- তাতো করিনি।
হযরত – তাহলে তুমি রামীও করোনি।
তারপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র) বড় দুঃখের সাথে বলেন, যাও ফিরে যাও এবং এরূপ মনে অবস্থাসহ আবার হজ্জ কর। যাতে করে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় যার ঈমান ও ওয়াদা পালনের স্বীকৃতি করতে গিয়ে কুরআন এ সাক্ষ্য দেয়-
*******আরবী*********
এবং তিনি ইবরাহীম (আ ) যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন।
হজ্জের মহত্ব ও গুরুত্ব
কুরআন ও সুন্নাতে হজ্জের হিকমত, দীনের মধ্যে হজ্জের মর্যাদা, তার মহত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছ। কুরআন বলে
*******আরবী*********
মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবার শক্তি সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ্জ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)
১. হজ্জ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারই বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাবার শক্তি সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্যে আল্লাহর হক আদায় করা ফরয। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, সেসব যালেম আল্লাহর হক নষ্ট করে। আয়াতের এ কথার দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত হযরত আলী (রা) এর বয়ান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবী (স) এর পক্ষ থেকে হজ্জ ফরয হওয়ার ঘোষণা তখনই করা হয় যখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযি-কিতাবুল হজ্জ)
এ অর্থে সহীহ মুসলিমেও একটি রেওয়ায়েত আছে, যাতে নবী (স) বলেন-
হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব হজ্জ আদায় কর।
২. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যের প্রতি এ আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে, সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করা কুফরী আচরণ, যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কুরআনে নামায ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছেঃ
*******আরবী*********
এবং  নামায কায়েম কর এবং (নামায ত্যাগ করে) মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।
ঠিক তেমনি আলোচ্য আয়াতের এ স্থানে হজ্জ না করাকে কুফরী আচরণ বলা হয়েছে। নবী (স) ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের জরুরী খরচের অর্থ সামগ্রী মওজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌছাতে পারে, তারপর সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ জন্যে যে আল্লাহ বলেন-
*******আরবী*********
হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য এই যে যারা হজ্জ করে না নবী (স) তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য বলেছেন। হজ্জ যারা করে না তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য এবং নামায যারা পড়ে না তাদেরকে মুশরিকদের সমতুল্য ঘোষণা করার মর্ম এই যে, আহলে কিতাব হজ্জ একবারে পরিত্যাগ করেছিল এবং মুশরিকগণ হজ্জ করলেও নামায পরিত্যাগ করেছিল। এজন্যে নামায পরিত্যাগ করাকে মুশরিকী ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জ পরিত্যাগ করাকে ইহুদী খৃষ্টানের ক্রিয়াকর্ম বলা হয়েছ। অতএব এটাও এক মোক্ষম সত্য যে, স্বয়ং কুরআনেও এ ধরনের লোককে এ সতর্কবাণীও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী আয়াতের শুধু প্রথম অংশ পাঠ করেছেন। নতুবা যে সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আয়াতের এ অংশে রয়েছে। যথাঃ
*******আরবী*********
যারা অর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ করতে অস্বীকার করার আচরণ দেখাবে তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। অর্থাৎ হজ্জ পরিত্যাগকারীর কুফরী আচরণের কোনো পরোয়া তিনি করেন না। তিনি ঐসব লোকের কোনো পরোয়া করেন না যে, তারা কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এ হচ্ছে সতর্কবাণীর বড়ো কঠিনতম প্রকাশভঙ্গী। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর তার অসন্তোষ ও মুখাপেক্ষহীনতার কথা ঘোষণা করেন, যে ঈমান ও হেদায়াত দ্বারা কি করে ভূষিত হতে পারে?
হযরত হাসান (রা) বলেন, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) বলেছেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা এই যে যেসব শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেসব শহরে কিছু লোক পাঠিয়ে দেব তারা খোজ খবর নিয়ে দেখবে যে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ করছে না। তাদের ওপর আমি জিযিয়া (জিযিয়া এমন এক প্রতিরক্ষা কর যা অমুসলিমদের নিকট থেকে তার জানমালের নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়) নির্ধারিত করে দেব। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়। (আল মুনতাকা)
মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর হজ্জের মর্মও এ ই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে। এরা যদি মুসলিম হতো তাহলে কি করে হজ্জের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতো এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও কি করে হজ্জ থেকে উদাসীন থাকতো?
হজ্জের ফযীলত ও প্রেরণা
হজ্জের এ গুরুত্বকে সামনে রেখে নবী (স) বিভিন্নভাবে এর প্রেরণা দান করেছেন। বিভিন্নভাবে এর অসাধারণ ফযীলত বর্ণনা করে এর জন্যে প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টি করেছেন।
১. যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে এলো, তারপর কোনো অশ্লীল যৌন ক্রিয়া করলো না, আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ করলো না, তাহলে সে গোনাহ থেকে এমনভাবে পাকসাফ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন পাকসাফ সে ঐদিন ছিল যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল। (বুখারী মুসলিম)
২. হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। সে তার মেযবান আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন, সে তার কাছে মাগফেরাত চাইলে তিনি তাকে মাগফেরাত দান করেন। (ইবনে মাজাহ)
৩. হ্জ্জ ও ওমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র ও অভাব এবং গোনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা দূর করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো একমাত্র জান্নাত। (তিরমিযি, নাসায়ী)
হজ্জে মাবরুর বলে এমন হজ্জকে যা পরিপূর্ণ এখলাস (নিষ্ঠা) অনুভূতি ও শর্তাবলীর পালনসহ আদায় করা হয় এবং যার মধ্যে হজ্জকারী আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেচে থাকার পুরোপুরি ব্যবস্থা করে।
৪. যদি কোনো হেরেম শরীফ যিয়ারতকারীর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়, তাহলে তার বাড়ী  পৌঁছাবার আগেই তাকে সালাম কর, তার সাথে মুসাফা কর এবং তাকে অনুরোধ কর তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাতের দোয়া করার। এজন্যে যে, তার গোনাহের মাগফেরাতের ফায়সালা করা হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ)
৫. হযরত হুসাইন (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর কাছে আরজ করলো, হুজুর, আমার শরীর মন উভয়ই দুর্বল। ইরশাদ হলো, তুমি এমন জেহাদ কর যাতে একটা কাটাও গায়ে না লাগে। প্রশ্নকারী বলে হুজুর, এমন জেহাদ আবার কেমন, যাতে কোনো আঘাত ও দুঃখ কষ্টের আশংকা নেই? নবী (স) ইরশাদ করেন, তুমি হজ্জ কর। (তাবারানী)
৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে নবী (স) এর একেবারে নিকটে সওয়ারীর উপরে ছিল এমন সময়ে হঠাৎ সে নীচে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে। নবী (স) বললেন, তাকে গোসল দিয়ে ইহরামের পোষাকসহই দাফন কর। এ কিয়ামতের দিনে তালবিয়া পড়া অবস্থায় ওঠবে। (তালবিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য)। তার মাথা ও মুখমন্ডল খোলা থাকতে দাও। (বুখারী, মুসলিম)
৭. হযরত আবু যর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ ) আল্লাহর কাছে আরয করে বলেন, পরওয়ারদেগার! যে বান্দাহ তোমার ঘর যিয়ারত করতে আসবে তাকে কি প্রতিদান দেয়া হবে? আল্লাহ বলেন, হে দাউদ! সে আমার মেহমান। তার অধিকার হচ্ছে এই যে, দুনিয়াতে আমি তার ভুলত্রুটি মাফ করে দেই এবং আখিরাতে যখন সে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে আমি আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি।