Saturday, February 25, 2017

রোজার ফরয


রোজার মধ্যে সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকা ফরজ।
১. কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
২. কিছু পান করা থেকে বিরত থাকা।
৩. যৌন বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকা।
যৌনবাসনা পূরণের মধ্যে ঐসব যৌন সম্ভোগ শামিল যার দ্বারা বীর্যপাত হয়, তা স্ত্রী সংগমের দ্বারা হোক বা যে কোন মানুষ, পশু প্রভৃতির সাথে যৌন ক্রিয়ার দ্বারা হোক। অথবা হস্তমৈথুনের দ্বারা হোক। মোটকথা এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্যি আপন স্ত্রীকে দেখা আদর করা, জড়িয়ে ধরা অথবা চুমু থেকে বিরত থাকা ফরজ নয়। কারণ তাতে বীর্যপাত হয় না।
রোযার সুন্নাত ও মোস্তাহাব
১. সিহরীর ব্যবস্থা করা সুন্নাত, কয়েকটি খেজুর হোক বা এক চুমুক পানি হোক।
২. সিহরীর সময় খাওয়া মোস্তাহাব।সুবহে সাদিক হতে যখন সামান্য বাকি।
৩. রোজার নিয়ত রাতেই করে নেওয়া মোস্তাহাব।
৪. ইফতার তাড়াতাড়ি করা মোস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অথবা বিলম্ব না করা।
৫. খুরমা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা মোস্তাহাব।
৬. গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা বল, রাগ এবং বাড়াবাড়ি না করা সুন্নাত। এ কাজ অবশ্যি অন্য সময় করাও ঠিক নয়। কিন্তু রোজার সময় তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা বেশী করে করা উচিৎ।
কি কি কারণে রোজা নষ্ট হয়
রোযা অবস্থায় তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকা ফরয, যথাঃ
(১) কিছু না খাওয়া (২) কিছু পান না করা এবং (৩) যৌনবাসনা পূর্ণ না করা। এসব থেকে বিরত থাকা ফরয।
অতএব উপরোক্ত তিনটি ফরযের খেলাপ কাজ করলেই রোযা নষ্ট হয়। যেসব জিনিস রোযা নষ্ট করে তা আবার দু প্রকার। এক – যার দ্বারা শুধু কাযা ওয়াজিব হয়। দুই-যার দ্বারা কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়।
কাফফারা ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে কিছু নীতিগত কথা
১. কোনো কিছু ইচ্ছা করে পেটে প্রবেশ করালে এবং তা উপকারী হওয়ার ধারণাও যদি থাকে, তা খাদ্য হোক, ঔষধ হোক অথবা এমন কাজ হোক যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো, তাহলে এসব অবস্থায় কাযা এবং কাফফারা দুই ওয়াজিব হয়।
২. কোনো কিছু যদি আপনা আপনি পেটের মধ্যে চলে যায়, তার উপকারী হওয়ার ধারনাও না থাকে, অথবা এমন কোনো কাজ করা হলো যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো নয়, তাহলে শুধু মাত্রা কাযা ওয়াজিব হবে।
৩. শুধু রমযানের রোযা নষ্ট হলেই তার কাফফারা ওয়াজিব হয়, রমযান ছাড়া অন্য রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, তা ভুলক্রমে নষ্ট হোক অথবা ইচ্ছা করে নষ্ট করা হোক।
৪. রমযানের কাযা রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু রমাযান মাসে রোযা নষ্ট হলে কাফফারা ওয়াজিব হবে।
৫. যাদের মধ্যে রোযা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় না, তাদের রোযা নষ্ট হলেও কাফফারা ওয়াজিব হবে না। যেমন, মুসাফিরের রোযা, হায়েয নেসাফ ওয়ালী মেয়েদের রোযা। যদিও মুসাফির এবং হায়েয নেফাস ওয়ালী মেয়েলোক রোযার নিয়ত সফর শুরু করার আগে এবং হায়েয নিফাস হওয়ার আগে করে থাকে।
৬. যে কোনো কাজ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়, যেমন ভুল করে কেউ কিছু খেয়ে নিলো, অথবা যৌন ক্রিয়া করলো, অথবা কুল্লি করতে হঠাৎ পানি গলার ভেতর চরে গেল, অথবা কেউ জবরদস্তি করে যৌন ক্রিয়া করালো তাহলে এসব অবস্থায় কাফফারা ওয়াজিব হবে না।
৭. যৌনক্রিয়ায় ক্রিয়াকারী এবং যার ওপর কারা হলো এ উভয়ের জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। উভয়ের মধ্যে যে জ্ঞানসম্পন্ন এবং স্বেচ্ছায় এ কাজ করবে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে। নারী জ্ঞানসম্পন্ন হলে কাফফারা তাকে দিতে হবে পুরুষকে নয়। আবার পুরুষ জ্ঞানসম্পন্ন হলে তাকে কাফফারা দিতে হবে, মাথা খারাপ পাগল মেয়ে মানুষের ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না।
৮. কোনো মেয়েলোক নাবালক ছেলে দ্বারা যৌন ক্রিয়া করে নিলে অথবা কোনো পাগলের দ্বারা, তার ওপর কাযা ও কাফফারা দুটিই ওয়াজিব হবে।
৯. রমযানে রোযার নিয়ত ব্যতিরেকে কেউ খানা-পিনা করলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। কাফফারা তখনই ওয়াজিব যদি রোযার নিয়ত করার পর তা নষ্ট করে।
১০. কোনো সন্দেহের কারণে কেউ রোযা নষ্ট করলে কাফফারা দিতে হবে না।

Friday, February 24, 2017

রোজার শর্তাবলী


রোজার শর্ত দুইপ্রকার:
  • রোজা সহীহ হওয়ার শর্ত।
  • রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত।
রোজা ওয়াজিব হওয়ার জন্য যেসব জিনিষের প্রয়োজন তাকে শারায়াতে সিহহাত বলে এবং হওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তাকে শারায়াতে অযুব বলে।
রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত
১. ইসলাম।কাফেরের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।
২. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।
অবশ্যি অভ্যাস সৃষ্টি করার জন্য নাবালেগ ছেলেমেয়েদের উপর রোজা রাখতে বলা উচিৎ। যেমন নামাজ পড়বার অভ্যাস করবার তাগিদ হাদীসে করা হয়েছে। তেমনি রোজা রাখবার জন্যও প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। যারা ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করতে পারে তাদেরকেই শুধু রোজা রাখতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ভালো নয়।
৩. রমজানের রোজা ফরজ হওয়া সম্বন্ধে জানা থাকা।
৪. মাযুর বা অক্ষম না হওয়া। অর্থাৎ এমন কোন ওজর না থাকা যাতে রোজা না থাকার অনুমতি রয়েছে, সফর, বার্ধক্য, রোগ, জিহাদ, ইত্যাদি।
রোজা সহীহ হওয়ার শর্তাবলী
১. ইসলাম। কাফেরের রোজা সহীহ নয়।
২. মহিলাদের হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া।
৩. নিয়ত করা। অর্থাৎ মনে মনে রোজা রাখার ইরাদা করা। রোজা রাখার ইরাদা ছাড়া কেউ সারাদিন যদি ঐসব জিনিস থেকে বিরত থাকে যার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তাহলে তার রোজা হবে না।
 

Thursday, February 23, 2017

রোযার ফযিলত

নবী (স) বলেন, প্রত্যেক নেক আমলে প্রতিদান দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু আল্লাহ এরশাদ হচ্ছে, রোযার ব্যাপারটাই অন্য রকম। তাতো আমার জন্য নির্দিষ্ট। আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব। বান্দা আমার জন্যে তার যৌনবাসনা ও খানাপিনা বন্ধ রাখে। রোযাদারের জন্যে দুটি আনন্দ, একটা হচ্ছে ইফতারের সময় যখন সে এ আবেগ উল্লাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল্লাহর নিয়ামত উপভোগ করতে থাকে যে, আল্লাহ তাকে একটা ফরয আদায় করার তাওফিক দান করেছেন।
দ্বিতীয় আনন্দ আপন পরওয়ারদেগারের সাথে মিলিত হওয়ায় যখন সে আল্লাহর দরবারে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করবে এবং দীদার লাভ করে চক্ষু শীতল করবে।
রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উৎকৃষ্টতর। রোযা গোনাহ থেকে আত্মরক্ষার ঢাল স্বরূপ। তোমাদের মধ্যে কেউ রোযা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা ও হৈ হাংগামা থেকে দূরে থাকে। যদি কেউ গালিগালাজ করতে থাকে অথবা ঝগড়া করতে আসে, তাহলে তার মনে করা উচিত যে, সে রোযা আছে। (বুখারী, মুসলিম)
নবী (স) আরও বলেন, যে ঈমানের অনুভূতি এবং আখিরাতের সওয়াবের আশায় রোযা রাখে তা পূর্বের সব গোনাহ (সগীরা) মাপ করে দেয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম)
রুইয়েতে হেলাল বা চাঁদ দেখার নির্দেশাবলী
১. শাবানের উনত্রিশ তারিখে রমযানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করা মুসলমানদের ওয়াজিবে কেফায়া। (সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব যে, রমযানের চাঁদ দেখার ব্যবস্থা তারা করবে। গোটা সমাজ যদি এর গুরুত্ব অনুভব না করে এবং বিষয়টিকে অবহেলা করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে) পঞ্জিকা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে রোযা রাখা এবং চাঁদ দেখা থেকে বেপরোয়া হওয়া কিছুতেই জায়েয নয়। এমনকি যারা গণনা শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ এবং নেক ও পরহেজগার, তাদেরও নিজের হিসেবের ওপর আমল করা জায়েয নয়। নবী (স) বলেন, চাঁদ দেখা রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা খতম কর। যদি ২৯ শাবান চাঁদ দেখা না যায় তাহলে শাবানের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
২. কোনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চাঁদ দেখা মেনে নেয়া এবং তদনুযায়ী রোযা রাখা জায়েয নয়। যেমন একটা প্রবাদ আছে যেদিনটি রজব মাসের ৪ঠা সে দিনটি রমযানের পয়লা এবং বারবার এটা পরীক্ষা করা হয়েছে।
৩. রজবের উনত্রিশ তারিখে চাঁদ দেখার চেষ্টা ও ব্যবস্থা করা মোস্তাহাব। কারণ রমযানের পয়লা তারিখ জানার জন্যে শাবানের তারিখগুলো জানা জরুরী। যেমন মনে করুন উনত্রিশ রজব চাঁদ উদয় হলো। কিন্তু লোকে তা দেখার কোনো ব্যবস্থা করেনি। তারপর ১লা শাবানকে ৩০শে রজব মনে করে হিসেব করতে থাকলো। এভাবে ৩০শে শাবান এসে গেল। কিন্তু আকাশে মেঘ অথবা ধুলাবালির কারণে চাঁদ দেখা গেল না। যেহেতু তা শাবানের ২৯ তারিখ মনে করা হচ্ছিল। এ জন্যে ১লা রমযানকে লোক ৩০শে শাবান মনে করে বসলো এর ফলে অবহেলার কারণে রমযানের একটা রোযা নষ্ট হয়ে গেল।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) শাবান মাসের দিনগুলো ও তারিখগুলো যেমন চিন্তা ভাবনা ও হিসেবে করে মনে রাখতেন, অন্য কোনো মাসের তারিখ এতো যত্ন সহকারে মনে রাখতেন না, তারপর তিনি রমযানের চাঁদ দেখে রোযা রাখতেন। (আবু দাউদ)
৪. যে ব্যক্তি স্বচক্ষে রমযানের চাঁদ দেখবে, তার কর্তব্য হচ্ছে বস্তির সকল লোক অথবা মুসলমানদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়া তা সে পুরুষ হোক বা নারী হোক।
৫. পশ্চিম আকাশ চাঁদ ওঠার স্থান যদি পরিষ্কার হয়, তাহলে এমন অবস্থায় শুধুমাত্র দুজন দীনদার লোকের সাক্ষ্যে রমযানের চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না আর না ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে। এ অবস্থায় অন্তত এতজন লোকের সাক্ষ্য দরকার যাতে করে তাদের কথায় চাঁদ ওঠা সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।
৬. চাঁদ ওঠার স্থান পরিষ্কার না হলে রমযানের নতুন চাদের প্রমাণের জন্যে শুধু একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট তা সে পুরুষ হোক বা নারী। তবে নিম্নে শর্তে:
ক) সাক্ষ্যদাতা বালেগ, জ্ঞান সম্পন্ন এবং দীনদার মুসলমান হতে হবে।
খ) তাকে বলতে হবে যে, সে নিজ চক্ষে চাঁদ দেখেছে।
৭. আকাশ পরিষ্কার হলে ঈদের নতুন চাঁদের জন্যে একজনের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয় সে যেমন ধরনের বিশ্বস্ত লোক হোক না কেন। ঈদের চাঁদের জন্যে প্রয়োজন দুজন দ্বীনদার মুত্তাকী পুরুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করা অথবা একজন দ্বীনদার পুরুষ এবং দুজন দ্বীনদার নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা। যদি চারজন স্ত্রীলোক সাক্ষ্য দেয় যে তারা চাঁদ দেখেছে তথাপি তার দ্বারা ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না।
৮. যেখানে কোনো মুসলমান কাযী অথবা শাসক নেই, সেখানকার মুসলমানদের উচিত নিজেরাই চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করবে, তার প্রচার করবে এবং তদনুযায়ী কাজ করবে।
৯. সারা শহরে একথা ছড়িয়ে পড়লো যে, চাঁদ দেখা গেছে, কিন্তু বহু অনুসন্ধানের পরেও এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া গেল না যে একথা স্বীকার করবে, সে নিজে চাঁদ দেখেছে। এ অবস্থায় চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না।
১০. যদি এমন ব্যক্তি রমযানের চাঁদ দেখেছে বলে বলা হচ্ছে যার সাক্ষ্য শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। এবং সে ছাড়া আর কেউ চাঁদ দেখেনি, তাহলে তার কথায় শহর বা বস্তির লোক রোযা রাখবে না। কিন্তু সে অবশ্যই রোযা রাখবে তার রোযা রাখা ওয়াজিব। তারপর তার ত্রিশ রোযা হয়ে গেলে এবং ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তখন সে ৩১ রোযা করবে এবং বস্তির লোকের সাথে ঈদ করবে।
১১. কোনো কারণে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেল না এবং অন্য স্থান থেকে চাঁদ দেখার খবর এল। যদি সে খবর শরীয়াতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তার দ্বারা রমযানের চাঁদও প্রমাণিত হবে। এবং ঈদের চাঁদও। মুসলমান দায়িত্বশীলদের প্রয়োজন হবে যে, তারা এসব খবর যাচাই করে দেখবে এবং শরীয়াত মুতাবেক যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে শহরে তার পাবলিসিটি করার এন্তেযাম করবে।
১২. দুজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত লোকের সাক্ষ্য দানে চাঁদ দেখা যদি প্রমাণিত হয় এবং সে অনুযায়ী লোক রোযা রাখে, কিন্তু ৩০ রোযা পুরো হওয়ার পর ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তাহলে ৩১শে দিনে ঈদ করবে। সেদিন রোযা জায়েয হবে না।

Tuesday, February 21, 2017

রোযার বিবরণ ও ফযিলত

 রমজানের রোজা ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কুরআনে শুধু রোজা রাখার হুকুম দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ রোজার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেওয়া হয়েছে। রমজানের মহত্ব ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মাসের রোজা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযিলত ও বরকত প্রথমে আমরা বর্ণনা করবো।
রমজানুল মুবারকের ফযিলত
কুরআনে রমজানের মহত্ব ও ফযিলত
কুরআন পাকে রমজানের মহত্ব ফযিলতের তিনটি কারণ বলা হয়েছেঃ
১. কুরআন নাযিল হওয়া অর্থাৎ এ মাসে কুরআন নাযিল হয়।
২. লায়লাতুল কদর। অর্থাৎ এ মাসে এমন এক রাত আছে যা মঙ্গল ও বরকতের দিক দিয়ে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
৩. রোজা ফরজ হওয়া। অর্থাৎ এ মাসে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ হয়েছে।
এসব ফযিলতের জন্য নবী (স) এ মাসকে ********** আরবী ************বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস থেকে উৎকৃষ্টতম বলেছেন। নিম্নে তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ

রমজানের ফযিলতের কারণ

১. কুরআন নাযিল হওয়াঃ কুরআন বলেন-********** আরবী ************
রমজান এমন এক মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে- যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ। যা সত্য পথ প্রদর্শনকারী, সুস্পষ্ট শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং হকও বাতিলকে সুস্পষ্ট করে উপস্থাপনকারী। (সূরা আল বাকারাঃ১৮৫)
রমজানের মহত্ব ফযিলত বুঝবার জন্য একথাই যথেষ্ট নয় যে, তার মধ্যে আল্লাহর হেদায়েতের সর্বশেষ কেতাব নাযিল করা হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে,মানবতা যদি হেদায়েতের উৎস থেকে বঞ্চিত হতো। তাহলে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির অস্তিত্বের এ বিরাট কারখানাটির সূর্যের আলো ও চাঁদ তারার শুভ্র রশ্মি সত্ত্বেও লন্ড ভণ্ড হয়ে যেত।বিশ্ব প্রকৃতি তার সুনিপুণ কারুকার্য ও সৌন্দর্য সত্বেও অর্থহীন অপূর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়তো। ফলে কুফর নাস্তিকতা শিরক ও সত্ত্বেও মানুষ বনের হিংস্র পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে পড়তো। কুরআনও পৃথিবীতে হেদায়েতের আলোকের একমাত্র উৎস। এর থেকে যে বঞ্চিত সে সে হেদায়েত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
২. লাইলাতুল কদরঃ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, তা রমজান মাসে শামিল করা হয়েছে এবং তা লাইলাতুল কদরে নাযিল করা হয়েছে। তার অনিবার্য অর্থ এই যে, লাইলাতুল কদর রমজানের কোনো একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেনঃ রমজানের শেষ দশ বেজোড় রাতের রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)
৩. রোজা ফরজ হওয়াঃ রোজার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন এবং গোটা মাসের রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন:
********** আরবী ************ অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য অপরিহার্য যে সে পুরো মাস রোজা রাখবে।
রমজানের মহত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে হাদীস
নবী (স) রমজানের মহত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জ্বিনগুলিকে শৃঙ্খল দিয়ে বেধে রাখা হয় এবং দোযখের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার কোন একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার কোনো একটি দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয় না। তারপর আল্লাহর একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে। যারা কল্যাণ ও মঙ্গল চাও তারা সামনের দিকে অগ্রসর হও। যারা বদকাম পাপাচার করতে চাও তারা থাম। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক নাফরমান বান্দা কে দোযখ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। আর এ কাজ রমজানের প্রত্যেক রাতেই করা হয়। (তিরমিযি,ইবনে মাযাহ)
  • এ এমন একটি মাস যে মসে মুমিনদের রুজি বৃদ্ধি করা হয়।(মিশকাত)
  • রমজান মাস সকল মাসের সরদার ।(ইলমুল ফেকাহ)
  • এ মাসের প্রথম অংশ রহমত, দ্বিতীয় অংশ মাগফেরাত, তৃতীয় এবং শেষ অংশ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই ও মুক্তি।(মিশকাত)
  • এ মাসে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপন ইচ্ছায় কোন নফল নেকী করবে সে অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াবের হকদার হবে। (মিশকাত)
ইতিহাসে রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব
ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, হক ও বাতিলের প্রথম সিদ্ধান্তকর যুদ্ধ এ মাসে হয়েছিল। এবং হক কে বাতিল থেকে আলাদা করে দেওয়ার যে দিন কে কুরআনে ইয়ামুল ফোরকান বলা হয়েছে তা ছিলো এ মাসের একটি দিন। এ দিনেই হকের প্রথম বিজয় সূচিত হয় এবং বাতিল পরাজিত হয়। ইতিহাস এ কথাও বলে যে, এ মাসেই মক্কা বিজয় হয়।এসব তথ্য সামনে রেখে চিন্তাভাবনা করুন তাহলে উপলব্ধি করবেন।
  • হকের হেদায়েত এ মাসেই নাযিল হয়।
  • ইসলামের প্রাথমিক বিজয় এ মাসেই হয়।
  • ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় এ মাসেই হয়।
এসব সত্য কে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রমজান মাস প্রতি বছর আসে। শরীয়ত এ মাসে রোজা ফরজ করেছে, রাতের নামাজ ও তেলাওয়াতে কুরআনের ব্যবস্থা করেছে যাতে করে মুমিনের মধ্যে জেহাদের প্রাণ শক্তি নিষ্প্রাণ না হয়ে পড়ে। এবং বছরের অন্তত একবার রমজান মাসে কুরআন শুনে বা পড়ে আপন পদমর্যাদায় দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতি সহকারে মনের মধ্যে তরজমা করতে পারে।কুরআনের নাযিল হওয়া, তার অধ্যয়ন এবং রোজার মুজাহিদ সুলভ তরবিয়ত এ জন্য যে, ইসলামের সন্তানগণ দীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জীবিত রয়েছে এবং কখনো যেন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফিল না হয়।
রোজার অর্থ
রোজাকে আরবী ভাষায় সাওম বা সিয়াম বলে। তার অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা এবং তা পরিত্যাগ করা। শরীয়তের পরিভাষায় সাওমের অর্থ
সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা।
রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম
হিজরতের দেড় বছর পর রমজানের রোজা মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়।
********** আরবী ************
হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো। রোজা ফরজে আইন যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের এবং বিনা ওজরে যে রাখবে না সে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে।
রোজার গুরুত্ব
কুরআন এ সাক্ষ্য দেয় যে, সকল আসমানী শরীয়তের অধীন রোজা ফরজ ছিলো। এবং প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের মধ্যে তা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
********** আরবী ************
যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর।
এ আয়াত শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয়, বরঞ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোজার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার তার একটা স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। বরঞ্চ এমন মনে হয় যে, তরবিয়ত ও তাযকিয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া তা পূর্ণ হতে পারে না। অন্য কোন ইবাদত তার বিকল্প হতেই পারে না।এজন্যই রোজা সকল নবী গনের শরীয়াতে ফরজ ছিল।
রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর অথবা রোগ ছাড়া রমজানের একটি রোজা ছেড়ে দেবে যদি সে সারা জীবন ধরে রোজা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরন হবে না। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
অর্থাৎ রমজানের রোজার মহত্ব, কল্যাণ, বরকত ও গুরুত্ব এইযে, যদি কোন উদাসীন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন রোজা নষ্ট করে বা না রাখে, তার ফলে তার যে ক্ষতি হলো তা জীবনব্যাপী রোজা রাখলেও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তবে তার আইনগত কাযা হতে পারে।
রোযার উদ্দেশ্য
রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া পয়দা করার ……. আরবী …… যাতে করে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া পয়দা হতে পারে। তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর সত্তার ওপর ঈমান,ও তার গুণাবলী দয়া অনুগ্রহের গভীর অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তা অন্য গুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তিদানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাচার সত্যিকার উপায়।
রোযা আল্লাহর সত্তার ওপরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার অনুগ্রহ ও অসন্তোষের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। সারাদিন ক্রমাগত কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রবৃত্তির একেবারে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় দাবী পূরণ থেকে বিরত থাকার কারণে মানুষের ওপর এ প্রভাব পড়ে যে, সে চরম অক্ষম, অসহায় ও মুখাপেক্ষী হয়। সে জীবনের প্রতি মূহুর্তের জন্য আল্লাহর রহম ও করমের ভিখারি হয়। তারপর সে যখন তার জীবনকে আল্লাহর নিয়ামতে সমৃদ্ধ দেখতে পায়, তখন সে আল্লাহর মহব্বতের আবেগ উচ্ছ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয় এবং আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীতে তৎপর হয় তখন সে নিভৃতে তার প্রবল যৌন বাসনাকে সংযত করে রাখে যেখানে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ থাকে না তখন তার মনে আল্লাহর ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ফলে তার মনের ওপর আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন ছাপ পড়ে যে গোনাহের চিন্তা করতেও তার শরীর কেপে ওঠে।
প্রকৃত রোযা
রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসির করা যেতে পারে, যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হয় এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হয় যার প্রভাবে রোযা প্রাণ হীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা তো তাই যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করবে।
নবী (স) বলেন, তুমি যখন রোযা রাখবে তখন তোমার কর্তব্য হবে তোমার কান, চোখ, মুখ, হাত, পা এবং সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা। (কাশফুল মাহজুব)
নবী (স) আরো বলেন, যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন ছিল না। (বুখারী)
এমন বহু রোজাদার আছে যে, রোযায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)