Monday, August 28, 2017

কুরবানীর আহকাম ও মাসায়েল


কুরবানী দাতার জন্যে মসনূন আমল
যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। এ আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। এ কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।
হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল ও নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এ দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন ঐ বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী (স) বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে এ তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
কুরবানীর পশু ও তার হুকুম
১. কুরবানীর পশু নিম্নরূপ:
উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।
২. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু এক ব্যক্তির জন্যে হতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি তাতে অংশীদার হতে পারবে না।
৩. গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সাতজন অংশীদার হতে পারে, তার বেশী নয়। তবে তার জন্য দুটি শর্তঃ
প্রথম শর্ত এই যে, প্রত্যেক অংশীদারের নিয়ত কুরবানী অথবা আকিকার হতে হবে। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত যেন না হয়।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, প্রত্যেকের অংশ ঠিক এক সপ্তমাংশ হবে। তার কম কেউ অংশীদার হতে পারে না।
এদুটো শর্তের মধ্যে কোনো একটি পূরণ না হলে কুরবানী ঠিক হবে না।
৪. উট ও গরু-মহিষে সাতজনেরও কম অংশীদার হতে পারে, যেমন দুই, চার অথবা তার কম বেশী অংশ কেউ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও এ শর্ত জরুরী যে, কোনো অংশীদার সাত ভাগের এক ভাগ এর কম অংশীদার হতে পারবে না। নতুবা কারো কুরবানী ঠিক হবে না।
৫. এক ব্যক্তি গরু খরিদ করলো এবং তার ইচ্ছা যে অন্য লোককে অংশীদার করে কুরবানী করবে। এটা দুরস্ত হবে। যদি খরিদ করার সময় গোটা গরু নিজের জন্যে খরিদ করার নিয়ত করে পরে অন্য লোককে অংশীদার করার ইচ্ছা করে, তাও জায়েয হবে। অবশ্য এটা করা ভালো যে, সে এমন অবস্থায় তা প্রথম ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা পশু নিজের জন্যই কুরবানী করবে। তবে কাউকে শরীক করতে চাইলে সচ্ছল ব্যক্তিকে শরীক করবে, যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এমন ব্যক্তিকে যদি শরীক করা হয় যার কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।
৬. গরু মহিষের কুরবানীতে কেউ এক বা একাধিক অতিরিক্ত লোকের অংশ নিজে নিজেই ঠিক করলো, অংশীদারদের অনুমতি নেয়া হলো না, তাহলে এ কুরবানী জায়েয হবে না। যাদের অংশ রাখা হবে তাদের তাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। এটা করা যাবে না যে, কুরবানীর অংশীদার মনে মনে ঠিক করে প্রথমে কুরবানী করা হলো এবং তারপর অংশীদারের অনুমতি পরে নেয়া হলো।
৭. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পূর্ণ এক বছর বয়সের হলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে। এক বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। গরু মহিষ পূর্ণ দু বছরের হতে হবে। দু বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। উট পাঁচ বছরের হলে কুরবানী হবে। তার কম হলে জায়েয হবে না।
৮. যে পশুর শিং জন্ম থেকে ওঠেনি, অথবা ওঠার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তাহলে তার কুরবানী করা জায়েয হবে। কিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙ্গে যায় তাহলে তা কুরবানী জায়েয হবে না।
৯. অন্ধ, কানা পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যে পশু তিন পায়ের ওপর চলে এমন ল্যাংড়া পশু কুরবানী করাও জায়েয হবে না। চতুর্থ পা যদি মাটিতে রাখে কিন্তু খুড়িয়ে চলে, তাহলে দুরস্ত হবে।
১০. যে পশুর কান এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা অথবা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
১১. দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হলেও মোটাতাজা ও সুন্দর পশু কোরবানী করা ভালো। পশু যদি এমন দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয় যে, তার হাড় একেবারে মজ্জাহীন হয়ে পড়েছে তাহলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) শিং বিশিষ্ট মোটা তাজা একটা দুম্বা কুরবানী করছিলেন যার চোখের চারপাশে কালো রং ছিল, যার মুখও কালো রঙের ছিল এবং যার পাগুলো ছিল কালো রঙের। (আবু দাউদ)
১২. যে পশুর জন্ম থেকেই কান হয়নি অথবা হয়ে থাকলে খুব ছোট ছোট তা কুরবানী করা দুরস্ত হবে।
১৩. যে পশুর দাঁত মোটেই নেই তার কুরবানী করা দুরস্ত হবে না। কিন্তু দাঁত পড়ে গেছে এবং অধিকাংশ দাঁত আছে তাহলে জায়েয হবে।
১৪. খাসি, পাঠা কুরবানী জায়েয। নবী (স) স্বয়ং খাসি দুম্বা কুরবানী করেছেন।
১৫. যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব এমন এক সচ্ছল ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে একটি পশু খরিদ করলো। খরিদ করার পর তার মধ্যে এমন ত্রুটি পাওয়া গেল, যার জন্যে তা কুরবানী করা দুরস্ত হলো না। তখন সে আর একটি পশু খরিদ করে কুরবানী করবে। তবে কোনো দরিদ্র লোকের এমন অবস্থা হলে- যার ওপর কুরবান ওয়াজিব ছিল না, তার পক্ষে ঐ ত্রুটি পূর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হবে।
১৬. গাই-বকরী গর্ভবতী হলেও তা কুরবানী জায়েয হবে। বাচ্চা জীবিত হলে তাও যবেহ করা উচিত।
কুরবানীর হুকুম
১. কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কে একজন জিজ্ঞেস করলো কুরবানী কি ওয়াজিব? তিন বলেন, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় সে প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছ না যে, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন।
২. কুরবানী কারেন এবং মুতামাত্তার ওপরে ওয়াজিব। তবে মুফরেদের ওপর ওয়াজিব নয়। সে যদি আপন ইচ্ছায় করে তাহলে তার সওয়াব পাবে।
৩. হাজীদের ছাড়া অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত এই যে,যে সচ্ছল হবে। সচ্ছল হওয়ার অর্থ তার ততোটা ধন-সম্পদ থাকতে হবে যে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত এতো সম্পদ থাকবে যে, তার হিসেব করলে নেসাব পরিমাণ হবে।
অর্থাৎ যার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।
দ্বিতীয় শর্ত এই যে, মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।
৫. কোন ব্যক্তির ওপরে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কুরবানী ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়তে পশু খরিদ করেছে। তাহলে সে পশু কুরবানী করা তার ওয়াজিব হবে।
৬. এক ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল, কুরবানীর তিন দিন অতীত হয়ে গেলে কোনো কারণে সে কুরবানী করতে পারলো না। যদি এ উদ্দেশ্যে সে কোনো ছাগল খরিদ করে থাকে তাহলে জীবিত সে ছাগল খয়রাত করে দেবে। খরিদ করে না থাকলে একটি ছাগলের মূল্য খয়রাত করবে।
৭. কেউ এ বলে মানত মানলো যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে কুরবানী করবো। আল্লাহর ফযলে তার সে কাজ হয়ে গেল। এখন সে ব্যক্তি সচ্ছল হোক অথবা অসচ্ছল তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। মানত কুরবানীর হুকুম এই যে, তার সমস্ত গোস্ত গরীব ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে- না কুরবানীকারী খাবে এবং না কোনো সচ্ছল ব্যক্তিকে খাওয়াবে।
কুরবানীর দিনগুলো ও সময়
১. ঈদুল আযহা অর্থাৎ যুলহজ্জের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে কোনো দিনে সুযোগ সুবিধা মতো কুরবানী করা জায়েয। তবে কুরবানী করর সবচেয়ে উত্তম দিন হলো ঈদুল আযহার দিন। তারপর এগারো তারিখে এবং তার বারো তারিখে।
২. শহর ও বন্দরের অধিবাসীদের জন্যে ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী জায়েয নয়। নামাযের পর কুরবানী করবে। তবে গ্রামাঞ্চলের লোক ফজর নামাযের পরও কুরবানী করতে পারে। (সম্ভবত এজন্যে যে, বহু দুর দূরান্তের ঈদগাহ থেকে নামা পড়ে আসতে বহু বিলম্ব হবে এমন কি বিকেল হয়ে যেতে পারে।)
৩. শহরের অধিবাসী যদি তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে করায় তাহলে তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে ফজরের পরও হতে পারে। ঈদের নামাযের পূর্বই যদি গোস্ত এসে যায় তাহলেও কুরবানী জায়েয হবে।
৪. কুরবানীর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময়ে দিনে বা রাতে, কুরবানী করা জায়েয।
তবে রাতে কুরবানী না করা ভালো। কারণ কোনো রগ হয়তো ভালোভাবে কাটা নাও যেতে পারে যার জন্যে কুরবানী দুরস্ত হবে না।
৫. কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত মুকীম হওয়া এবং সচ্ছল হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি সফরে থাকে এবং বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী পৌঁছে এবং সে যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে; সে যদি মুকীম এবং দরিদ্র হয়, কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যদি আল্লাহ তাকে মালদার বানিয়ে দেয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।
কুরবানীর বিভিন্ন মাসায়েল
১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়। শুধু মনের নিয়ত ও ইরাদা কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে মুখে দোয়া পড়া ভালো।
২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার। যেমন নবী (স) হযরত ফাতেমা (রা) কে বলেছিলেন ফাতেমা চল, তোমার কুরবানীর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। এ জন্যে যে, তার প্রতিটি রক্ত কণার বদলায় তোমার পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ফাতেমা বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। একি আমাদের আহলে বায়তের জন্যে নির্দিষ্ট, না সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের জন্যেও এবং সকল মুসলমানদের জন্যেও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)
৩. গরু মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোস্ত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, গুর্দা, কলিজী প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যেতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।
৪. কুরবানীর গোস্ত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বণ্টন করা যায়। এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করলেও কোন দোষ নেই।
৫. গরু মহিষ বা উটে কয়েক ব্যক্তি অংশীদার রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোস্ত ভাগ করে নেয়ার পরিবর্তে যদি সব একত্রে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে।
৬. কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।
৭. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।
৮. কুরবানীর চামড়া নিজের কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন জায়নামাজ বানানো হলো।
৯. কসাইকে গোস্ত বানাবার মজুরী স্বরূপ গোস্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে। রশি, চামড়া প্রভৃতি খয়রাত করতে হবে।
১০. যার ওপর কুরবানী ওয়াজেব তাকে তো করতেই হবে। যার ওপর ওয়াজিব নয়, তার যদি খুব বেশী কষ্ট না হয় তাহলে তারও করা উচিত। অবশ্য ধার কর্জ করে কুরবানী করা ঠিক নয়।
মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানী
আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন সে শুধু তার ওয়াজিব কুরবানী করেই ক্ষান্ত হবে না। বরঞ্চ কুরবানীর অফুরন্ত সওয়াব পাওয়ার জন্যে আপন মুরব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো। এমন কি যার বদৌলতে হেদায়াত ও ঈমানের সম্পদ লাভ সম্ভব হয়েছে এমন হাদী ও মুরশিদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তো মুমিনের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এভাবে আযওয়াজে মুতাহহেরা অর্থাৎ রূহানী মা-দের পক্ষ থেকে কুরবানী করাও অশেষ সৌভাগ্যের কথা।
হাদীর বয়ান
হাদী শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদীয়া তোহফা, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যাকে হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পাঠিয়ে দেয়।
১. হাদী তিন প্রকারঃ উট, গরু, ছাগল। উট সর্বোৎকৃষ্ট হাদী এবং ছাগল সর্বনিম্ন। ভেড়া, দুম্বা প্রভৃতি ছাগলের পর্যায়ে এবং মহিষ প্রভৃতি গরু গাভীর পর্যায়ে।
২. হাদীর পশুর বয়স, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে হুকুম ও শর্ত তাই যা কুরবানীর পশু সম্পর্কে রয়েছে।
৩. হাদী যদি ইচ্ছাকৃত হয়,যেমন ইফরাদ হজ্জকারী আপন  ইচ্ছায় নফল কুরবানী করে। তাহলে সে কুরবানীর গোস্ত হাদীকারী নিজেও খেতে পারে। তেমনি কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারী আপন আপন কুরবানীর গোস্ত খেতে পারে। যেমন সাধারণ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া জায়েয। কারণ কেরান এবং তামাত্তুর হাদী কোনো অপরাধ অথবা ত্রুটি বিচ্যুতির কাফফারা নয়। বরঞ্চ শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারীর ওপর ওয়াজিব করেছেন। এজন্যে সাধারণ কুরবানীর গোস্তের মতো তা খাওয়া জায়েয। নবী (স) তার হাদীর প্রত্যেকটি পশুর এক এক টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন এবং তার শুরবাও পান করেছেন। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের (রা) এর বর্ণনা এবং অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত আছে যে, নবী (স) হজ্জে কয়েকটি কুরবানী করেন।
প্রকাশ থাকে যে, কেরান এবং তামাত্তু তো একটি কুরবানীই হয়ে থাকে এবং বাকীগুলো নফলই হয়ে থাকবে। তিনি যখন প্রত্যেকটি থেকে এক একটা টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন তাহলে জানা গেল যে, তামাত্তু, কেরান এবং নফল তিন প্রকারের গোস্ত কুরবানীকারী স্বয়ং খেতে পারে।
৪. তামাত্তু, কেরান ও ইচ্ছাকৃত নফল কুরবানীর গোস্ত ছাড়া কোনো হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয়। তা সে কোনো অপরাধের কাফফারার হাদী হোক কিংবা মানতের অথবা ইহসাবের দমের (পরিভাষা দ্রষ্টব্য) কুরবানী হোক। নবী (স) যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, তখন তিনি নাজিরা আসালামীর মাধ্যমে ইহসারের হাদী পাঠিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, তার গোস্ত সে যেন না খায় এবং সঙ্গীকেও খেতে না দেয়।
৫. যে হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয় তার সমস্ত গোশত ফকীর মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে এবং তা করা ওয়াজিব। হেরেমের গরীবদের মধ্যে হোক অথবা তার বাইরের হোক উভয়ই জায়েয। হেরেমের গরীবদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। (আয়নুল হেদায়া)
৬. যে হাদীর গোস্ত খাওয়া জায়েয তার সমস্ত গোস্ত ফকীর মিসকিনকে সদকা করা ওয়াজিব নয়। বরঞ্চ মুস্তাহাব। তার তিন ভাগ করা উচিত। এক ভাগ নিজের জন্যে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্যে এবং এক ভাগ ফকীর মিসকিনের জন্যে। তবে এমন করা জরুরী নয়। সমস্তই ফকীর মিসকিনকে দিলেও তা জায়েয হবে।
আবে যমযম, আদব কায়দা ও দোয়া
বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে একটি ঐতিহাসিক কূপ আছে যাকে যমযম বলে। হাদীসে এ কুয়ার অনেক ফযিলত ও তার পানির অনেক বরকত ও ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ ) আল্লাহর হুকুমে যখন হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মা হযরত হাজেরা (আ ) কে মক্কার বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মাতা ও সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্যে যমযম প্রস্রবণ প্রবাহিত করে ছিলেন। হাদীসে আছে-
*******আরবী*********
এ হচ্ছে জিবরাঈলের তৈরী করা কূপ এবং ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের ছোট হাউজ। (দারু কুতনী)
সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন প্রভৃতি শেষে পেট ভরে যমযমের পানি পান করা উচিত। এমন বেশী করে পানি পান করা, যাতে পাঁজরাগুলো ডুবে যায়, এটা ঈমানের আলামত। ঈমান থেকে বঞ্চিত মুনাফিক এতোটা পান করতে পারে না। নবী (স) বলেন আমাদের এবং মুনাফিকদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন এই যে, মুনাফিক যমযমের পানি পেটভরে পান করতে পারে না যাতে পাঁজরা ডুবে যায়। (ইবনে মাজাহ)
আবে যমযমের বরকত ও ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, আবে যমযম যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয় তার জন্যেই ফলদায়ক হয়। রোগ আরোগ্যের জন্য পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। তৃপ্তি লাভের জন্যে পান করা হলে আল্লাহ তৃপ্তিদান করবেন। পিপাসা নিবারণের জন্যে পান করলে আল্লাহ পিপাসা নিবারণ করবেন। এ হচ্ছে সেই কুয়া যা জিবরাঈল (আ ) পায়ের গোড়ালির আঘাতে খনন করেন এবং এ হচ্ছে ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের উন্মুক্ত জলাধার। (দারু কুতনী)
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ )বিশেষভাবে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরা (আ )এর জন্যে বারিহীন অনুর্বর প্রান্তরে যমযম বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে যায়।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সকল পানি থেকে উৎকৃষ্ট যমযমের পানি। ক্ষুধার্তদের জন্যে এ আহার, রোগীর জন্য আরোগ্য। (ইবনে আব্বাস)
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ও উদ্দেশ্যে যমযমের পানি পান করে যে, সে দুশমন থেকে আশ্রয় লাভ করবে- তাহলে সে আশ্রয় পাবে।(হাকেম)
যমযমের পানি দাড়িয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে পান করা উচিত এবং পেটভরে পান করা উচিত। পান করার সময় এ দোয়া পড়বে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ আমি তোমার কাছে মঙ্গলকর ইলম চাই, প্রশস্ত রুজি চাই এবং প্রত্যেক রোগ থেকে আরোগ্য চাই। (নায়লুল আওতার)

Thursday, August 24, 2017

কুরবানীর বর্ণনা


কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানীর, পূজা অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর হযরত আদম (আ ) এর দু পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।
*******আরবী*********
এবং তাদেরকে আদমের দু পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুজন কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না। (সূরা আল মায়েদাঃ ২৭)
প্রকৃতপক্ষে একজন যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে।
অপর ব্যক্তির নাম ছির কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো। হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।
সকল খোদায়ী শরীয়াতে কুরবানী
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবেরও মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
*******আরবী*********
আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। (সূরা হজ্জঃ৩৪)
অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমুহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তার নাম নিয়েই।
*******আরবী*********
অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।
পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তার নাম নিয়েই তার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মঙ্গল নিহিত রেখেছেন।
কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু
আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইসলাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প,দৃঢ় বিশ্বাস,আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তার পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।
*******আরবী*********
যখন সে (ইসমাঈল) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌছলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো প্রিয় পুত্র। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি রা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে) তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আরআমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সুরা আস সাফফাতঃ ১০২-১১১)
অর্থাৎ যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ ) এ ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তার উৎসর্গীকৃত বন্দাগণ টিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ ) আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতের জীবন দানকারী মুমিনগণ।
নবী (স) এর প্রতি নির্দেশ।
কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
*******আরবী*********
বল, হে মুহাম্মাদ (স) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমা বরদার। (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)
আল্লাহর ওপর পাকা পোক্ত ঈমান এবং তার তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা চরিত্র তারই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তোর ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।
কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন,  নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)
নবী (স) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (জামাউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাযের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহেতেই কুরবানী করতেন।
কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।
১. কুরবানীর পশু আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন
*******আরবী*********
আর কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমার জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৬)
……. শব্দ ………… এর বহুবচন। …….. (শারীয়াহ) ঐ বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা কোনো আধ্যাত্মিক ও অর্থপূর্ণ তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা স্মরণ করার কারণ ও আলামত হয়ে পড়ে, কুরবানীর পশু ঐ আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূত আলামত। কুরবানীকারী আসলে এ আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে যে, কুরবানীর পশুর রক্ত তার আপন রক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। সে আবেগও প্রকাশ করে যে, তার জীবনও আল্লাহর পথে ঐভাবে কুরবানী করা হবে, যেভাবে এ পশু সে কুরবানী করেছে।
২. কুরবানী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
*******আরবী*********
এভাবে এসব পশুকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূর আল হজ্জঃ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা পশুকে মানুষের বশীভূত করে দিয়ে তাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। মানুষ এসব থেকে বহু উপকার লাভ করে। তার দুধ পান করে, গোশত খায়। তার হাড়, চামড়া, পশম প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরী করে। চাষাবাদে তার সাহায্য নেয়। তাদের পিঠে বোঝা বহন করে, তাদেরকে বাহন হিসেবেও ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও প্রকাশ করে। কুরআন এসবের উপকারের দিকে ইংগিত করে ও তাদেরকে মানুষের বশীভূত করার উল্লেখ করে আল্লাহ পুরস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চার করতে চায়। সেই সাথে এ চিন্তাধারাও সৃষ্টি করতে চায় যে, যে মহান আল্লাহ এ বিরাট নিয়ামত দান করেছেন- তার নামেই কুরবানী হওয়া উচিত। কুরবানী আল্লাহর বিরাট নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
৩. কুরবানী আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ
*******আরবী*********
আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তার দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৭)
অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা প্রকৃতপক্ষে একথারই ঘোষণা যে, যে আল্লাহ এসব নিয়ামত দান করেছেন এবং যিনি এসব আমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছেন- তিনিই এসবের প্রকৃত মালিক। কুরবানী সেই আসল মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং একথারও বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মুমিনের অন্তর থেকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে।
পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে সে উপরোক্ত সত্যের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ও ঘোষণা করে এবং মুখে বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবার বলে এ সত্যের স্বীকৃতি দান করে।
কুরবানীর প্রাণ শক্তি
প্রাক ইসলামী যুগে লোক কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহর সম্মুখে এনে রেখে দিত। তার রক্ত বায়তুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। কুরআন বললো, তোমাদের এ গোশত ও রক্তের কোনোই প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তার কাছে তো কুরবানীর সে আবেগ অনুভূতি পৌঁছে যা যবেহ করার সময় তোমাদের মনে সঞ্চারিত হয় অথবা হওয়া উচিত। গোশত ও রক্তের নাম কুরবানী নয়। বরঞ্চ কুরবানী এ তত্ত্বেরই নাম যে, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্যে এবং তার পথেই উৎসর্গ করার জন্য।
কুরবানীকারী শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না। বরঞ্চ তার সকল কু প্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয়, তা হযরত ইবরাহীম (আ ) ও হযরত ইসমাঈল (আ ) এর সুন্নাত নয়, একটা জাতীয় রসম মাত্র। তাতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু সেই তাকওয়ার অভাব দেখা যায় যা কুরবানীর প্রাণ শক্তি।
*******আরবী*********
ওসব পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে।
যে কুরবানীর পেছনে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই আল্লাহর দৃষ্টিতে সে কুরবানীর কোনোই মূল্যে নেই। আল্লাহর কাছে সে আমলই গৃহীত হয় যার প্রেরণা দান করে তাকওয়া।
*******আরবী*********
আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন।
উট কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
এবং কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের জন্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল। অতএব, তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও এবং যখন (পড়ে গিয়ে) তাদের পার্শ্বদেশ যমীনে লেগে যাবে তখন তোমাদের স্বয়ং তা (গোস্ত) খাও এবং খাইয়ে দাও তাদেরকে যারা চায় না এবং তাদেরকেও যারা চায়। (সূরা হজ্বঃ ৩৬)
উট কুরবানী করার নিয়ম এই যে, তাদেরকে এক সারিতে দাড় করিয়ে তাদের হলকুমে (কণ্ঠদেশে) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার থেকে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। রক্ত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে যায়। কুরবানীর এ দৃশ্য একবার মনের মধ্যে অংকিত করুন এবং চিন্তা করুন যে, পশুর এ কুরবানী কোন বস্তু। এটা তো এই যে, এভাবে আমাদেরও জীবন আল্লাহর পথে কুরবান হওয়ার জন্যে তৈরী আছে। প্রকৃতপক্ষে এ কুরবানী আপনজনের কুরবানীরই স্থলাভিষিক্ত। এ অর্থেই উট কুরবানীর চিন্তা করুন। তার আহত হওয়া, রক্ত প্রবাহিত হওয়া, মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার দৃশ্যটা একবার ভেবে দেখুন, যেন মনে হবে যে, জেহাদের ময়দানে আল্লাহর সৈনিকগণ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। তাদের কণ্ঠদেশে শত্রুর তীর অথবা গুলি বিদ্ধ হচ্ছে, তারপর খুনের ঝর্ণা ছুটছ। তারপর খুনরাঙা যমীন তাদের জীবনদানের সাক্ষ্য  দিচ্ছে এবং তারা একজন মাটিতে পড়ে আল্লাহর হাতে তাদের জান পেশ করছে।
কুরবানীর পদ্ধতি ও দোয়া
যবেহ করার জন্য পশুকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তা কেবলামুখী হয়, ছুরি খুব ধারালো করতে হবে। যথাসম্ভব কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করতে হবে। কোনো কারণে নিজ যবেহ করতে না পারলে তার নিকটে দাড়িয়ে থাকতে হবে।
যবেহ করার সময় প্রথম এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবরাহীমের তরীকার ওপরে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি যিনি আসমান যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি কখনো শিরককারীদের মধ্যে নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যে তার কোনো শরীক নেই। এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমি অনুগতদের মধ্যে একজন। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া। (মেশকাত)
তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবাইয়ের পর এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মাদ (স) এবং তোমার খলীল ইবরাহীম (আ ) এর কুরবানী কবুল করেছিলে।
দোয়ার প্রথমে ………… শব্দ আছে। নিজের কুরবানী হলে …… বলতে হবে। আর অন্য বা একাধিক লোকের পক্ষ থেকে হলে তাদের নাম বলতে হবে।
কুরবানীর ফযিলত ও তাকীদ
নবী (স) কুরবানীর ফযিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন,
১. নাহারের দিন অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুর সহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, মনের আগ্রহ সহ এবং সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর। (তিরমিযি ইবনে মাজাহ)
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানী কি বস্তু? নবী বলেন, এ তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ ) এর সুন্নাত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী (স) বলেন, তার প্রত্যেক পশমের জন্যে এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) হযরত ফাতেমা যোহরা (রা) কে বলেন, ফাতেমা! এসো, তোমার কুরবানীর পশুর কাছে দাড়িয়ে থাক। এজন্যে যে, তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যেও। (জামউল ফাওয়োদে)
৪. হযরত ইবনে বারীদাহ (রা) তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন, নবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে নামাযে যেতেনে না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদুল আযহার নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, আহমাদ)
তারপর নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর কলিজী খেতেন।
 

Thursday, August 10, 2017

মুলতাযেম ও তার দোয়া


মুলতাযেম বায়তুল্লাহর ও দেয়ালের সে অংশকে বলে যা কাবার দরজা এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ প্রায় ছফুটের অংশ এবং দোয়া কবুলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এর সাথে দেহ বুক ও মুখ লাগিয়ে বিনয় ও নম্রতার সাথে ও কাতর কণ্ঠে দোয়া করা হজ্জের একটি মসনুন আমল । তাওয়াফ শেষ করার পর মুলতাযেমের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া ও দোয়া করা বিশেষ করে এমন এক অনুভূতি ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করে যে, এটা বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হওয়ার এক বেদনা দায়ক মুহূর্ত।
হযরত আমর ইবনে শোয়াইব বলেন, আমার পিতা শুয়াইব বর্ণনা করেছেন, আমি আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আস (রা) এর সাথে তাওয়াফ করার সময় কিছু লোক কে বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে বললাম, আমাকে একটু ঔ জায়গায় নিয়ে চলুন। লোকদের সাথে আমরাও বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গন করি। তিনি বললেন আউযুবিল্লাহে মিনশ শায়তানির রাজিম। তারপর যখন তিনি তাওয়াফ শেষ করলেন তখন হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী বায়তুল্লাহের ঐ অংশের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম এটা ঐ স্থান যার সাথে নবী (স) কে আলিংগনাবস্থায় দেখেছি। (বায়হাকী)
আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ বিন আমের (রা) হিজরে আসওয়াদ এবং বাবে কাবার মাঝে দাড়িয়ে গেলেন এবং আপন বক্ষ মুখ মণ্ডল ও দুহাত প্রসারিত করে কাবার দেওয়ালে রাখলেন এবং বললেন নবী (স) এমন করতে দেখেছি। (আবু দাউদ)
মুলতাযেমের দোয়া সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিপদাপন্ন হয়ে এখানে দোয়া চাইবে সে অবশ্যই নিরাপদ হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
মুলতাযেমের সাথে দেহ আবিষ্ট করে প্রথমে নিম্নের দোয়া পড়বে। তারপর দ্বীন দুনিয়ার জায়েজ মনস্কামনা পূরণের দোয়া করবে:
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! প্রশংসার হকদার তুমিই, এমন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা যার দ্বারা তোমার নিয়ামতের কিছু হক আদায় হতে পারে। আর এ সব নিয়ামতের উপর  কিছু এহসান কিছু এনামের কিছু বিনিময় হতে পারে। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব গুণাবলীর সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব নিয়ামতের সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। সকল অবস্থায় আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আয় আল্লাহ! দরুদ ও সালাম মুহাম্মদ (স) এর উপরে এবং মুহাম্মদের বংশধরের উপর। আয় আল্লাহ! মরদূদ শয়তান থেকে তোমার পানাহ চাই এবং প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে আমাকে আশ্রয় দাও।তুমি যা কিছু আমাকে দিয়েছ তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে দাও। আমার জন্য তাতে বরকত দাও। আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার সম্মানিত মেহমানদের মধ্যে শামিল কর। আর তুমি আমাকে সোজা পথে চলবার তাওফীক দাও, রাব্বুল আলামীন, যতক্ষণ না আমি তোমার সাথে মিলিত হই।
দোয়া কবুলের স্থানসমূহ
হজ্জের সময় প্রত্যেক আমল করতে গিয়ে যিকর তসবীতে মশগুল থাকা এবং প্রত্যেক স্থানে বেশী করে দোয়া করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অধিক পরিমাণ দোয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত হাসান বসরী যখন মক্কা থেকে বসরায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মক্কাবাসীদের নিকট একখানা পত্র লেখেন। তাতে তিনি মক্কায় অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযিলত বয়ান করেন এবং বিশেষ করে বলেন যে, নিম্নের এগারটি স্থানে বিশেষভাবে মুমিনের দোয়া কবুল হয়ঃ
১. মুলতাযেমের সাথে দেহ মন আবিষ্ট করে দোয়া করা। নবী (স) বলেন, মুলতাযেম এমন এক স্থান যেখানে দোয়া কবুল হয়। এখানে বান্দাহ যে দোয়াই করে তা কবুল হয়।
২. মিযআবের নিচে।
৩. পাক কাবার ভিতরে।
৪. যমযমের নিকটে।
৫. সাফা-মারওয়ায়।
৬. সাফা-মারওয়ায় যেখানে দৌড়ে চলতে হয়।
৭. মাকামে ইবরাহীমের নিকটে।
৮. আরাফাতের ময়দানে।
৯. মুযদালফায়ে।
১০. মিনায়।
১১. জুমরাতের পাশে।

Tuesday, August 1, 2017

তালবিয়ার হিকমত ও ফযীলত


কাবা নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হুকুম করেন-
এবং মানুষকে হজ্জের জন্যে সাধারণ আহবান জানিয়ে দাও যেন তারা তোমার কাছে দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেটে অথবা উটের পিঠে চড়ে আসে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই য আহবান, বান্দার পক্ষ থেকে তার জবাব হচ্ছে এই তালবিয়া।  বান্দাহ বলে, পরওয়ারদেগার তোমার ডাক শুনেছি এবং তুমি যে তলব করেছ তার জন্যে তামার দরবারে হাজির হয়েছি। আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী কিছুক্ষণ পরপর এ ধ্বনি বুলন্দ করেছে। প্রকৃতপক্ষে সে বলেছে, পরওয়ারদেগার! তুমি তোমার ঘরে হাজিরা দেয়ার জন্যে ডেকেছ এবং আমরা শুধু তোমার মহব্বতে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাগলের মতো এসে হাজির হয়েছি। আমরা তোমার সে দয়া অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করছি। তোমার তাওহীদের স্বীকৃতি দিচ্ছি। এ তালবিয়া ধ্বনি মুমিনের শিরায় শিরায় তাওহিদের বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত করে এবং তাকে এভাবে তৈরী করে যে, দুনিয়াতে তার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র এই যে, সে তাওহীদের বাণী সর্বত্র পৌছিয়ে দেবে।
নবী (স) তালবিয়ার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন কোনো মুমিন বান্দাহ লাব্বায়েক ধ্বনি করে, তখন তার ডানে বামে যাকিছু আছে সবই লাব্বায়েক ধ্বনি করে তা পাথর হোক, বৃক্ষলতা হোক কিংবা মাটি হোক। এমনি কি যমীনের এক প্রান্ত থেকে তা অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। (তিরমিযি)
নবী (স) আরও বলেন, যে মুহররম ব্যক্তি সারাদিন লাব্বায়েক লাব্বায়েক ধ্বনি করে এবং এভাবে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন তার সকল গুনাহ মিটে যায় এবং সে এমন পাক হয়ে যায় যেন সে সদ্য তার মায়ের পেট থেকে জন্ম লাভ করেছে।
তালবিয়ার পর দোয়া
*******আরবী*********
হে আল্লাহ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রার্থী এবং জাহান্নাম থেকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় চাই।
হযরত আম্মার বিন খুযায়মা তার পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী (স) যখন ইহরাম বাধার জন্যে তালবিয়া পড়তেন, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত ভিক্ষা চাইতেন এবং তার রহমতের বদৌলতে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। (মুসনাদে শায়েফী)
ইহরামের পর বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারী যে দোয়া ইচ্ছা করতে পারে এবং যতো খুশী করতে পারে। কিন্তু প্রথমে ওপরের মসনুন অবশ্যই করবে। কারণ এ এক সার্বিক দোয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাত লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ তিনটি বস্তু একজন মুমিনের চরম আকাঙ্ক্ষা এবং তার সকল চেষ্টার চরিত্রের ফল।
ওয়াকুফ ও তার মাসয়ালা
১.  ওয়াকুফ অর্থ দাঁড়ানো ও অবস্থান করা। হজ্জর সময় তিন স্থানে অবস্থান করতে হয় এবং তিন স্থানের হুকুম বিভিন্ন রকমের। উপরন্তু এসব স্থানে অবস্থানকালে যেসব আমল করতে হয় তার জন্যে সেখানে পৌছাতে হয়। এর নিয়ত করা এবং দাঁড়ানো জরুরী নয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে নিয়ত করা শর্ত।
২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরাফাত, যেখানে অবস্থান করতে হয়। আরাফাত এক অতি প্রকাণ্ড ময়দান। হেরেমের সীমা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাত এলাকা শুরু হয় এ ময়দান মক্কা মুকাররামা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূর। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্জের রুকনগুলোর বড়ো একটা রুকন। বরঞ্চ নবী (স) একবার আরাফাতের অবস্থানকেই হজ্জ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ *******আরবী********* আরাফাতের দিনে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ একই পোশাক পরিধান করে আল্লাহর দরবারে বিনয় নম্রতার মূর্ত ছবি হয়ে দাড়ায় তখন তারা যেন এ সময়ের জন্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে হাশরের ময়দানে পৌঁছে যায়। এ এক বিরাট ঈমান উদ্দীপক দৃশ্য। এখানে অবস্থানের ফলে হাশরের ময়দানের কথা মনে জাগ্রত হয়।
এর গুরুত্ব এই যে, যদি কোনো কারণে হাজী ৯ই যুলহজ্জের দিনে অথবা দিনগত রাতে আরাফায় পৌছাতে না পারে তাহলে তার হজ্জ হবে না। হজ্জের অন্যান্য অনুষ্ঠান যথা তাওয়াফ, সায়ী, রামি প্রভৃতি যদি বাদ পড়ে তাহলে তার ক্ষতি পূরণ সম্ভব। কিন্তু আরাফাতে অবস্থান করা না হলে তার ক্ষতিপূরণ কোনো উপায় নেই।
৩. আরাফাতে অবস্থানের সময় ৯ই যুলহজ্জ বেলা পড়ে গড়ে যাওয়ার পর (যোহর ও আসরের নামায পড়ার পর)। কিন্তু যেহেতু এ হজ্জের সবচেয়ে বড়ো রুকন এবং এর ওপরেই হজ্জ নির্ভরশীল, সে জন্যে এ সময়কে প্রশস্ত করে দিয়ে এ সুযোগ দেয়া দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ নয় ও দশ যুলহজ্জের মধ্যবর্তী রাত সুবেহ সাদেকের পূর্বে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্যে হরেও আরাফাতে পৌছা যায় তাহলে তার অবস্থান নির্ভরযোগ্য হবে এবং তার হজ্জ হয়ে যাবে। (আবদুর রহমান বিন ইয়ামার ওয়াবলী বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হজ্জের ওয়াকুফ হচ্ছে আরাফাত। যে ব্যক্তি মুযদালফার রাতে ফজর হওয়ার পূর্বে পৌছবে, তার হজ্জ হয়ে যাবে। তিরমিযি, আবু দাউদ)
৪. আরাফাতের অবস্থান যতো দীর্ঘ হয় ততো ভালো। এ ধারণা ও অনুভূতি সহ আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো যেন হাশরের ময়দান। বান্দার নিজের মনে বলবে আমি সকল কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী নিজের মামলা মিটাবার জন্যে ও তার অনুগ্রহ ভিক্ষা করার জন্য তার দরবারে দাঁড়িয়েছি। এ হচ্ছে মুমিনের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কে জানে জীবনে এ সৌভাগ্য আর হবে কিনা। এজন্যে ঈমান ও আত্মবিশ্লষণের শক্তি জাগ্রত রেখে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এ দিন রাতের এক একটি মুহূর্তের গুরুত্ব অনুভব করতে হবে। নবী (স) এর ব্যাপারে হযরত জাবের (রা) বলেন, যোহর ও আসর নামাযের পর নবী (স) তার উটনী কাসওয়ার পিঠে সওয়ার হলেন এবং আরাফাতের ময়দানের বিশেষ অবস্থানের জায়গায় এলেন। তারপর যেদিকে পাথরের বড়বড় খন্ড পড়েছিল তার উটনীকে সে মুখী করলেন। তারপর জনতাকে সামনে রেখে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। এভাবে যখন সূর্য অস্ত গেল তখন তিনি মুযদালফার দিকে রওয়ানা হলেন। – (মুসলিম)
৫. আরাফাতে অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, বছরের ৩৬০ দিনের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই যে দিনে আল্লাহ তায়ালা আরাফাতের দিনের চেয়ে অধিক পরিমাণে বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন।  এ দিন আল্লাহ বান্দার অতি নিকটবর্তী হন। ফেরেশতাদের কাছে তিনি বান্দাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! দেখছ এ বান্দারা কি চায় (মুসলিম)? হযরত আনাস বিন মালেক (রা) বলেন, নবী (স) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করলেন। সূর্য অস্ত যাবে এমন সময় তিনি হযরত বেলাল (রা) এর প্রতি ইশারায় বললেন, চুপ কর। তখন নবী (স) বললেন, হে লোক সব। এই মাত্র জিবরাঈল আমার কাছে এসে আল্লাহ তায়ালার সালাম ও এ পয়গাম পৌঁছে গেলেন আল্লাহ আরাফাতের ময়দানের সকলকে মাফ করে দিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ!এ পয়গাম কি আমরা সাহাবীদের জন্যে খাস না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বললেন, এ তোমাদের জন্যে এবং ঐসব লোকের জন্যেও যারা তোমাদের পরে এখানে আসবে।(আত তারগীব)
আরাফাতের ময়দানের দোয়া
আরাফাতের ময়দানের দোয়ার বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার এবং  ওখানে অবস্থানকালে সর্বদা আল্লাহর দিকে একাগ্রচিত্ত হয়ে থাকতে হবে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে ভালো দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। নিম্নে কিছু মসনুন দোয়া দেয়া হলোঃ
(ক) নিম্নের দোয়া নবী (স) আরাফাতের ময়দানে খুব বেশী করে করতেনঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তুমি এমন প্রশংসার অধিকারী যেমন তুমি নিজে তোমার প্রশংসা করেছ এবং আমরা যতোটা করতে পারি তার চেয়ে অনেক ভালো প্রশংসার হকদার তুমি। হে আল্লাহ! তোমার জন্যেই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু। তোমার দিকেই আমাকে ফিরে যেতে হবে এবং তোমার জন্যেই আমার সবকিছু। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই কবর আযাব থেকে, মনে মধ্যে সৃষ্ট কুমন্ত্রণা (অসঅসা) থেকে কাজকর্মের কুফল ও বিভেদ থেকে। হে আল্লাহ! আমি তামার আশ্রয় গ্রহণ করছি ওসব বিপদ থেকে যা বাতাসে বয়ে নিয়ে আসে। (তিরমিযি)
(খ) আল হিযবুল মকবুলে এক সার্বিক দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা করলে বরকত পাওয়া যাবে।
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সেই কল্যাণ চাই যা তোমার নবী (স) তোমার কাছে চেয়েছেন ঐসব অমঙ্গল তেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই যেসব থেকে তোমার নবী (স) তোমার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। পরওয়ারদেগার! আমরা আমাদের জীবনের ওপরে বড়ো যুলুম করেছি। তুমি যদি মাফ না কর এবং আমাদের ওপর রহম না কর তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবো। হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানাও এবং আমার সন্তানদেরকেও তার তাওফীক দাও। পরওয়ারদেগার! আমার দোয়া কবুল কর। আমার মা-বাপকে মাফ করে দাও। সেদিন সকল মুসলমানকে মাফ করে দিও যেদিন হবে হিসাব কেতাবের দিন। হে আমার রব! আমার মা-বাপ উভয়ের ওপর রহম কর যেমন তারা আমার শৈশবকালে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আমার প্রতিপালন করেছে। হে রব! আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের ঐসব ভাইদেরকে মাফ করে দাও যারা ঈমান আনার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগামী ছিল, এবং আমাদের মনের মধ্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা বিদ্বেষ হতে দিও না। যারা ঈমান এনেছে। হে আল্লাহ! তুমি বড়ো মেহেরবান ও দয়াশীল! পরওয়ারদেগার! তুমি সবকিছু শুন এবং জান, তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, তুমি তাওবা কবুলকারী ও দয়াশীল। গুনাহ থেকে বাচার কোনো শক্তি এবং হুকুম পালন করার সামর্থ অতীব উচ্চ ও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে না।
(গ) নবী (স) এ দোয়া বেশী করে করতে বলেছেনঃ
*******আরবী*********
হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।
এসব মসনুন দোয়া ছাড়াও আরও কিছু মসনুন দোয়া আছে যা পড়া যেতে পারে। তাছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে কল্যাণ মানুষ আল্লাহর কাছে চাইতে পারে তা চাইবে এবং বারবার চাইবে। কারণ ঐ সময়ে আল্লাহ বান্দার ওপর বড়ো দয়াশীল হয়ে যান এবং তিনি তার মেহমানকে বঞ্চিত করেন না।
৭. মুযদালফার অবস্থান করা ওয়াজিব। মুযদালফার সীমানায় পায়ে হেটে প্রবেশ করা মসনুন। এখানে অবস্থানের সময় মাঝে মাঝে তালবিয়া, তাহলীল ও তাহমীদ পড়া মুস্তাহাব। এখানে একরাত্রি কাটানো মসনুন। হাদীসে আছে নবী (স) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাত থেকে মুযদালাফা রওয়ানা হন এবং এখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়েন। তারপর শুয়ে পড়েন এবং ফজর পর্যন্ত বিশ্রাম করেন।
৮. যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে কোনো সময়ে মিনাতে পৌছা মসনুন। সূর্য উঠার পর ওখানে পৌছা যোহর ওখানে পড়া এবং ওখানেই রাত্রি যাপন করা মুস্তাহাব।
তাওয়াফ ও তার মাসায়েল
তাওয়াফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর চারদিকে চক্কর দেয়া ও প্রদক্ষিণ করা। ইসলামী পরিভাষায় তার অর্থ বায়তুল্লাহর চার ধারে ভক্তি সহকারে প্রদক্ষিণ করা ও চক্কর দেয়া।
বায়তুল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা
বায়তুল্লাহ ইট পাথরের নিছক একটা ঘর নয়। বরঞ্চ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর মহত্বের বিশেষ নিদর্শন ও তার দীনের বিশেষ অনুভূত কেন্দ্র যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার আপন তত্ত্বাবধানে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য পয়গাম্বর দ্বারা নির্মাণ করান যার নেতৃত্ব ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান সমভাবে মেনে নিয়েছে। *******আরবী********* এবং স্মরণ করো সে সময়টি যখন আমরা ইবরাহীমকে এ ঘরের (কাবা) স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। (সূরা হজ্জঃ ২৬)
কুরআন পাক একথার সাক্ষ্য দান করে যে, আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয় তাহলো এ বায়তুল্লাহ (কাবা ঘর)।
*******আরবী*********
নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ইবাদাতের ঘর যা মানুষের জন্যে তৈরী করা হয় তা ঐ ঘর যা মক্কায় রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে বায়তুল্লাহ দীনের উৎস কেন্দ্র।কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ তাওহীদের উৎস এবং নামাযের প্রকৃত স্থান, আর এ তাওহীদ এবং নামায গোটা দীনের মস্তিষ্ক ও সারাংশ। আকীদার দিক দিয়ে তাওহীদ দীনের আসল  বুনিয়াদ এবং আমলের দিক দিয়ে নামায দীনের স্তম্ভ। বায়তুল্লাহর নির্মাণ এদু বুনিয়াদী উদ্দেশ্যের জন্যেই। এক জন্যে আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকতের এবং হেদায়াতের উৎস বলে ঘোষণা করেছেন। *******আরবী*********এতে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছে এবং বিশ্ববাসীর জন্যে তাকে হেদায়াতের উৎস বানিয়ে দেয়া হয়েছে। (সূরা আল বাকারার ১২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন-
*******আরবী*********
এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অসিয়ত করেছিলাম এই বলে আমার এ ঘরকে রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে পাক রেখো। সূরা হজ্জের ২৬ আয়াতে বলা হয়-
*******আরবী*********
এবং স্মরণ কর যে সময়কে যখন আমি ইবরাহীম এর জন্যে এ ঘর নির্ধারিত করেছিলাম হেদায়াত সহ যে, আমার সাথে যেন কাউকে শরীক করা না হয় এবং আমার ঘরকে তাওয়াফ, কিয়াম, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে যেন পাক রাখা হয়।)
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দু স্থানে তাকে *******আরবী********* (আমার ঘর) বলে উল্লেখ করেছেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ ) তার বংশধরকে মক্কার প্রস্তরময় মরু প্রান্তরে পুনর্বাসিত করার সময় বলেন হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে তোমার ঘরের প্রতিবেশী করে পুনর্বাসিত করেছি। (সূরা ইবরাহীমের ৩৭  আয়াতে বলা হয়েছে-
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! পানি ও তরুলতাহীন মরুপ্রান্তরে তোমার পবিত্র ঘরের পাশে আমার সন্তানদেরকে পুনর্বাসিত করলাম।)বায়তুল্লাহর মহত্ব এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ঘর যিয়ারত করে হজ্জ করাকে মুসলমানদের ওপরে তার এক অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। আর হজ্জ এই যে, মুমিন ইহরাম বেধে অর্থাৎ নিজেকে বায়তুল্লাহতে হাজির হওয়ার যোগ্য জানিয়ে ভক্তি ভরে তার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করবে। তাতে লাগানো হিজরে আসওয়াদের চুমো দেবে। মুলতাযেমের সাথে দেহমন নিবিড় করে দেবে। মসজিদুল হারামে নামায পড়বে এবং আরাফাতে অবস্থান করবে।
তাওয়াফের ফযীলত
আল্লাহর ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই যে, তার তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ ) কে এর জন্যে তাকীদ করেছেন এবং এ তাকীদ কুরআনে দু স্থানে করা হয়েছে।
*******আরবী*********
*******আরবী*********
১. আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্যে পাক রাখ। (সূরা আল বাকারাঃ ১২৫)
২. এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করতে হবে। (সুরা আল হাজ্জঃ ২৬)
তাওয়াফের ফযীলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ নামাযের মতোই এক ইবাদত। পার্থক্য শুধু এই যে, তাওয়াফে তোমরা কথা বলতে পার এবং নামাযে তার অনুমতি নেই। অতএব তাওয়াফের সময় কেউ কথা বলতে চাইলে মুখ থেকে যেন ভালো কথা বের হয়। (তিরমিযি, নাসায়ী)
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হিজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামেনী হাত দিয়ে স্পর্শ করা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আমি তাকে একথাও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এ ঘর সাতবার তাওয়াফ করেছে এবং পূর্ণ অনুভূতি ও নিবিষ্ট মনে করেছে তার প্রতিদান এক টি গোলাম আযাদ করার সমান। নবী (স) কে আরও বলতে শুনেছি যে, তাওয়াফের সময় যে কদম ওঠাবে তার প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে একটি করে গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি করে নেকী লিখে দেবেন। (তিরমিযি)