Tuesday, November 1, 2016

নামাযের বয়ান-৬ (সিজদায়ে সাহু,ক্বাযা, কসর এবং অসুস্থ অবস্থার নামায )

সিজদায়ে সহুর বয়ান

সহু অর্থ ভুলে যাওয়া। ভুলে নামাযের মধ্যে কিছু বেশী-কম হয়ে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় তা সংশোধনের জন্যে নামাযের শেষ বৈঠকে দু’টি সিজদা করা ওয়াজেব হয় তাকে বলে সিজদায়ে সহু।
সহু সিজদার নিয়ম
নামাযের শেষ বৈঠকে ‘আত্তাহিয়্যাতেরৎ পর ডান দিকে সালাম ফিরাতে হবে। তারপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সিজদায়ে যেতে হবে। নামাযের অন্যন্য সিজদার নিয়মে দু’সিজদা করে আত্তাহিয়্যাত, দরুদ, প্রভৃতি পড়ে দু’দিকে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতে হবে।যেসব অবস্থায় সিজদা সহু ওয়াজেব হয়
১. ভুলে নামযের কোন ওয়াজেব ছুটে গেলে, যেমন সূরা ফাতেহা পড়া ভুলে যাওয়া অথবা সূরা ফাতেহার পর কোন সূরা পড়তে ভুলে যাওয়া।
২. কোন ওয়াজেব আদায় করতে বিলম্ব হলে, ভুলে হোক কিংবা কিছু চিন্তা করতে গিয়ে হোক যেমন কোন লোক সূরা ফাতেহা পড়ার পর চুপ করে থাকলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবর কোন সূরা পড়লো।
৩. কোন ফরয আদায় করতে বিলম্ব হলে অথব ফরয আগে করা হলো যেমন, কেরায়াত করার পর রুকু করতে বিলম্ব হলো [এখানে বিলম্বের অর্থ এই যে, এ সময়ের মধ্যে এক সিজদা বা রুকু করা যায়।] অথবা রুকুর আগেই সিজদা করা।
৪. কোন ফরয বার বার আদায় করা। যেমন দু’রুকুর পর পর করা হলো।
৫. কোন ওয়অজেবের রূপ পরিবর্তন করা হলো। যেমন সিররী নামাযে জোরে কেরায়াত করা অথবা জাহরী নামাযে আস্তে কেরায়াত করা।
সহু সিজদা মাসয়ালা
১. নামাযের ফরযের কোনটি যদি স্বেচ্ছায় ছুটে যায় অথবা ভুলে, তাহলে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে কোন ওয়াজেব ইচ্ছা করে ছেড়ে দিলে নামায নষ্ট হবে। সিজদা সহু করলেও নামায সহীহ হবে না। নামায পুনরায় পড়তে হবে।
২. এক বা একাধিক ওয়াজেব ছুটে গেলে একই বার দু’ সিজদা করলেই যথেষ্ট হবে। এমন কি নামাযের সকল ওয়াজেব ছুটে গেলেও দু’ সিজদা যথেষ্ট, দু’য়ের বেশী সহু সিজদা করা ঠিক নয়।
৩. যদি কেউ ভুলে দাঁড়ানো অবস্থায় সূরা ফাতেহার আগে আত্তাহিয়্যাত পড়ে তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে না। কারণ ফাতেহার আগে আল্লাহর হামদ ও সানা পড়া হয় এবং আত্তাহিয়্যাতের মধ্যে হামদ ও সানা আছে। তবে যদি কেরায়াতের পর অথা দ্বিতীয় রাকয়অতে কেরায়াতের এগ বা পরে আত্তাহিয়্যাত পড়লে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে।
৪. ভুলৈ কোন ‘কাওমা’ বাদ পড়লে অথবা দু’ সিজদার মাঝখানে জালসা না হলে সহু সিজদা করা জরুরী হয়।
৫. যদি কেউ কা’দা উলা করতে ভুলে যায় এবং বসার পরিবর্তে একেবারে উঠে দাঁড়ায়, তারপর মনে পড়লে যেন বসে না পড়ে, বরঞ্চ নামায পুরা করে নিয়ম মুতাবেক সহু সিজদা করবে। আর যদি পুরাপুরি না দাঁড়ায়, সিজদার নিকটে থাকে তাহলে বসে পড়বে। তখন সহু সিজদার দরকার হবে না।
৬. যদি কেউ দু’ বা চার রাকয়াত বিশিষ্ট ফরয নামাযে কা’দায়ে আখীরা***১ ভুলে গেল এবং বসার পরবর্তে উঠে দাঁড়িয়ে গেল এখন যদি সিজদা করার আগে তার মনে হয় তাহলে বসেই নামায পুরা করে সহু সিজদা করবে। তাতেই ফরয নামায দুরস্ত হবে। যদি সিজদা করার পর মনে হয় যে, ‘কা’দা’ আখীরা করেনি, তাহলে আর বসবে না বরঞ্চ এক রাকয়অত মিলিয়ে চার রাকয়াত বা দু’রাকয়অত পুরা করবে। এ অবস্থায় সিজদা সহুর দরকার নেই। এ রাকায়াতগুলা নফল হয়ে যাবে। ফরয নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। মাগরেবের ফরযে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে পুনরায়
****১ ফেকাহর পরিভাষাগুলো দ্রষ্টব্য-বইয়ের প্রথমে দেয়া আছে।
পঞ্চম রাকায়াত পড়বে না। চতুর্থ রাকয়াতের বসে নামায পুর করবে। কারণ নফল নামায বেজোড় হয় না। নবী (স) বলেন-
নফল নামাযের রাকয়অত দুই দুই করে- (ইলমুল ফেকাহ)।
৭., সূরা ফাতেহা পড়া ভুলে গেলে অথবা দোয়া কুনুত ভুলে গেলে অথবা আত্তাহিয়্যাত পড়া ভুলে গেল অথবা ঈদুল ফেতের-ঈদুল আযহার অতিরিক্ত তাকবীল ভুলে গেলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে।
৮. মাগরেব, এশা বা ফজরের জাহরী নামাযগুলোতে ইমাম যদি ভুলে কেরায়াত আস্তে পড়ে তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে।
৯. ইমামের যদি কোন ওয়াজেব ছুটে যায় এবং সহু সিজদা ওয়াজেব হয় তাহলে মুক্তাদীকেও সহু সিজাদ করতে হবে। আর  ‍মুক্তাদীর যদি কোন ওয়াজেব ছুটে যায় তাহলে না ‍না মুক্তাদীর সহু সিজদা ওয়াজেব হবে আর না ইমামের।
১০. সূরা ফাতেহার পর যদি কেউ সূরা মিলাতে ভুলে যায় অথবা সূরা প্রথমে পড়লো পরে সূরা ফাতেহা, তাহলে সূলা ফাতেহার পর অন্য সূলা পড়বে এবং শেষ কা’দার পর অবশ্যই সহু সিজাদ করবে।
১১. যদি ফরয নামাযের প্রথম দু’রাকায়াতে অথবা এক রাকয়াতে কেউ সূরা মিলাতে ভুলে যায়, তাহলে পরের রাকয়াতগুলোতে সূরা মিলিয়ে সহু সিজদা করে নামায পুরা করবে।
১২. সুন্নাত অথবা নফল নামাযের মধ্যে সূলা মিলাতে কেউ যদি ভুলে যায় তাহলে সিজদা সহু অনিবার্য হবে।
১৩. যদি চার রাকয়অত ফরয নামায কেউ শেষ রাকয়অতে এত সময় পর্যন্ত বসলো যতোক্ষণে ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়া যায়। তারপর তার সন্দেহ হলো যে, এটা তার কাদায়ে উলা এবং সালাম ফেরার পরিবর্তে পঞ্চম রাকায়াতের জন্যে উঠে দাঁড়ালো। এখন সিজদা করার আগে তার মনে হয়, তাহলে বসে নামায পুরা করবে এবং নিয়ম মাফিক সহু সিজদা করবে এবং সালাম ফিরাবে। আর যদি পঞ্চম রাকয়াতের সিজদা করে ফেলে তাহলে ষষ্ঠ রাকয়াত মিলিয়ে নেবে এবং সহু সিজদা করে নামায পুরা করবে। এ অবস্থায় তার ফরয নামায সহীহ হবে অতিরিক্ত ‍দু’রাকায়াত নফল গণ্য হবে।
১৪. চার রাকায়াত ফরয নামাযের শেষ দু’রাকয়াতে কোন একাকী লোক বা ইমাম যদি সূরা ফাতেহা পড়া ভুলে যায়, তাহলে সিজদা সহু ওয়াজেব হবে না। তবে যদি সুন্নাত ও নফল নামাযে ভুলে যায় তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে। এ জন্যে যে, ফরয নামাযের শেষের রাকয়াতগুলোতে ফাতেহা পড়া ওয়াজেব নয় । সুন্নতা নফলে প্রত্যেক রাকয়াতে সূরা ফাতেহা ওয়াজেব।
১৫. যদি কেউ ভুলে এক রাকয়াতে দু’রুকু করে অথবা এক রাকয়াতে তিন সিজদা করে অথবা সূরা ফাতেহা দু’বার পড়ে তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে। কারণ সূরা ফাতেহা একবার পড়া ওয়াজেব।
১৬. যদি ‘কাদায়ে উলাতে’ আত্তাহিয়্যাতের পরে কেউ দরুদ পড়া শুরু করে এবং ‘আল্লাহুম্ম সালে আলা মুহাম্মদ’ এর পরিমাণে পড়ে ফেলে অথবা এতটা সময় চুপচাপ বসে থাকে, তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে।
১৭. যদি কোন মসবুক তার অবশিষ্ট নামায পুরা করতে গিয়ে কোন ভুল করে তাহলে শেষ বৈঠকে তার সহু সিজদা করা ওয়াজেব হবে।
১৮. কেউ যোহর অথবা আসরের ফরয নামাযের দু’রাকায়াত পড়লো, কিন্তু মনে করলো যে চার রাকায়াত পড়েছে এবঙ তরপর সালাম ফিরালো। তারপর মনে হলো যে, দু’রাকয়াত পড়েছে। তাহলে বাকী দু’রাকায়অত পড়ে নামায পুরা করবে এবং সহু সিজদা করবে।
১৯. কারো নামাযে সন্দেহ হলো যে, তিন রাকায়াত পড়লো, না চার রাকায়াত তাহলে এ ধরনের সন্দেহ তার যদি এই প্রথম বার ঘটনাক্রমে হয়ে থাকে এবং সাধারণত এ ধরনের সন্দেহ হয় না, তাহলে সে পুনরায় নামায পড়বে। কিন্তু যদি তার প্রায়ই এরূপ সন্দেহ হয় তাহলে তার প্রবল ধারণা যেদিকে হবে সেদিকে আমল করবে। আর কোন দিকেই যদি ধারা প্রবল না হয় তাহলে কম রাকয়াতই ধরবে। যেমন কেউ যোহর নামাযে সন্দেহ হলো যে, তিন রাকায়অত পড়লো না চার রাকায়াত এবং কোন দিকেই তার ধারণা সুস্পষ্ট হচ্ছে না, তাহলে এমন অবস্থায় তিন রাকায়াতই মনে করে বাকী এক রাকয়াত পুরা করবে। এবং সহু সিজদা দিবে।
২০. নামাযের সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব ছুটে গেলে সহু সিজদা দরকার হয় না। যেমন নামাযের শুরুতে সানা পড়তে কেউ ভুলে গেল, অথবা রুকু এবং সিজদার তসবিহ পড়তে ভুলে গেল, অথবা রুকুতে যেতে এবং উঠতে দোয়া ভুলে গেল অথবা দরুদ শরীফ এবং তার পরের দোয়া ভুলে গেল, তাহলে সহু সিজদা ওয়াজেব হবে না।
২১.নামাযে যদি এমন ভুল হয় যার জন্যে সহু সিজদা ওয়াজেব কিন্তু সহু সিজদা না করেই নাময শেষ করা হলো। তারপর মনে হলো যে ভুলে সহু সিজদা দেয়া হয়নি। যদি মুখ কেবলার দিকে থাকে এবং কারো সাথে কথা বলা না হয় তাহলে সংগে সংগেই সহু সিজদা করে আত্তাহিয়্যাত ও দরুদের পর সালাম ফিরাবে।
২২. কেউ এক রাকায়াতে ভুলে এক সিজদা করলো। এখন যদি কা’দায়ে আখীরায় আত্তাহিয়্যাত পড়ার আগে প্রথম রাকয়াতে অথবা দ্বিতীয় রাকয়অতে অথবা যখনই মনে হবে সিজদা করতে হবে এবং নিয়ম মাফিক সহু সিজদা দিতে হবে। যদি ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়ার পর সিজদার কথা মনে হয় তাহলে সিজদা আদায় করে পুনর্বার ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়বে এবং সহু সিজদা করে কা’দা অনুযায়ী নামায পুরা করতে হবে।
২৩. সফরের মধ্যে কসর করা ওয়াজেব হবে। কিন্তু কেউ যদি ভুলে কসর না করে পুরা চার রাকায়অত পড়লো, তাহলে এ অবস্থায় শেষ রাকয়াতে নিয়ম মুতাবিক সহু সিজদা করা ওয়াজেব হবে। এ অবস্থায় এ নামায এভাবেই সহীহ হবে যে, প্রথম দু’রাকায়াত ফরয এবংশেষ দুরাকায়াত নফল হবে।

কাযা নামায পড়ার বিবরণ

কোন ফরয অথবা ওয়াজেব নামায সময় মতো যদি পড়া না হয় এবং সময় ‍উত্তীর্ণ হওয়ার পর পড়া হলে তাকে কাযা পড়া বলে। ওয়াক্তের ভেতরেই পড়লে তাকে আদা’ বলে।
কাযা নামাযের হুকুম
১. ফরয নামাযের কাযা ফরয এবং ওয়াজেব নামাযের (বেতর) কাযা ওয়াজেব।
২. মানত করা নামাযের কাযাও ওয়াজেব।
৩. নফল নামায শুরু করার পর ওয়াজেব হয়ে যায়। কোন কারণে নফল নামায নষ্ট হলে অথবা শুরু করার পর কোন কারণে যদি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তার কাযা করা ওয়াজেব হবে।
৪. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং নফলের কাযা নেই। অবশ্য ফজরের সুন্নাত যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং হাদীসে তার খুব তাকীদ রয়েছে সে জন্যে যদি ফজরের ফরয এবং সুন্নত উভয়ই কাযা হয়ে যায় তাহলে দুপুরের আগে উভয়েরই কাযা পড়তে হবে। তারপর হলে শুধু ফরয কাযা পড়তে হবে। সুন্নাতের কাযা পড়তে হবে না। আর যদি ফজরের ফরয ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হয় এবং সুন্নাত রয়ে যায় তাহলে বেলা উঠার পর থেকে দুপুরের আগে পর্যন্ত পড়া যায়। বেলা গড়ার পরে নয়। এছাড়া অন্য কোন সুন্নাত বা নফল ওয়াক্তের মধ্যে পড়তে না পারলে তার কাযা ওয়াজেব হবে না।
৫. যোহরের ফরযের আগে যে চার রাকায়অত সুন্নাত তা যদি কোন কারণে পড়া না হয় তাহলে ফরযের পর পড়া যায়। ফরযের পর যে দু’রাকায়াত যোহরের সুন্নাত আছে তার আগেও পড়া যায় এবং পরেও পড়া যায়। তবে যোহরের ওয়াক্ত চলে গেলে কাযা ওয়াজেব হবে না।
কাযা নামাযের মাসয়ালা ও হেদায়াত
১. বিনা কারণ ও ওযরে নামায কাযা করা বড় গুনাহ। তার জন্যে হাদীসে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যদি অবহেলার জন্যে এমন ভুল হয় তাহলে খাঁটি দেলে তওবা করা উচিত এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের জন্যে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
২. কোন ন্যায় সংগত ওযর বা অক্ষমতার জন্যে নামায কাযা হলে তার গাড়িমসি করা ঠিক নয়্ যতো শীঘ্র সম্ভব কাযা আদায় করা উচিত। বিনা করণে বিলম্ব করা গুনাহ। তারপর জীবনেরও তো কোন ভরসা নেই, সুযোগ নাও মিলতে পারে এবং এমন অবস্থায় মানুষ আল্লাহ কাছে হাযির হবে যে, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সে বিলম্ব করে কাযা নামায পড়তে পারেনি।
৩. যদি কোন সমযে কয়েকজনের নামায কাযা হয়ে যায় যেমন এক সাথে সফর করার সময় ওয়াক্তের মধ্যে নামায আদায় করা যায় নি, অথবা কোন মহল্লায় কোন দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে সকলের নামায কাযা হয়ে গেল অথবা কয়েকজন ঘুমিয়ে রইলো এবং সকলের নামায কাযা হলো, এ অবস্থায় জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে। যদি সেররী নামায কাযা হয় তো কাযা জামাতের সেররী কেরায়াত করতে হবে। জাহরী হলে জাহরী কেরায়াত। ****১
৪. কোন ব্যক্তির নামায যদি কখনো কাযা হয়, তাহলে চুপে চুপে ঘরে কাযা পড়ে নেয়া ভালে। যদি অবহেলায় এ কাযা হয়ে থাকে তাহলে এ গুনাহ লোকের মধ্যে প্রকাশ করাও গুনাহ। কোন অক্ষমতায় কাযা হয়ে গেলেও তা মানুষের কাছে প্রকাশ করা দোষণীয় এবং মাকরুহ। যদি মসজিদেও কাযা পড়া হয় তবুও মানুষকে জানতে দেয়া ঠিক নয়।
৫. কাযা নামায পড়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই স্মরণ হবে এবং সুযোগ হবে পড়ে নিতে হবে। তবে নিষিদ্ধ সময়গুলোতে মনে পড়লে অপেক্ষা করতে হবে। সে সময় উত্তীর্ণ হলে পড়তে হবে।
****১ [একবার নবী (স) এর কাফেলা সফরে রাত ভর চললো এবং শেষ রাতে এক স্থানে তাবু গাড়লো। তারপর সকলে এমন ঘুমিয়ে পড়লেন যে, ফজরের নামাযের সময় চলে গেল, তবুও সকলে ঘুমিয়ে রইলেন। তারপর বেলা উঠলে রোদের গরমে সকলের ঘুম ভাঙলো। নবী (স) তৎক্ষণাত আযান দেওয়ালেন এবং জামায়াতে ফজরের নামায আদায় করলেন।]
৬. এক সাথে কয়েক ওয়াক্তের নামায কাযা হয়, তাহলে কাযা আদায় করতে বিলম্ব করা উচিত নয়। যত শীঘ্র কাযা পড়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে একই ওয়াক্তে সমস্ত কাযা পড়ে নিতে হবে। এটা জরুরী নয় যে, যোহরের কাযা যোহারের সময় আসরের কাযা আসরের সময় বরং একই সময় সব কাযা পড়ে নেয়া উচিত।
৭. কেহ অবহেলা করে দীর্ঘ দিন নামায পড়েনি। এভাবে মাসের পর মাস বছরের পর বছর নামায পড়ে কাটিয়েদিয়েছে। তারপর আল্লাহ তাকে তওবা করার সুযোগ দিলেন। তখন ঐ সমস্ত নামাযের কাযা তার উপর ওয়াজেব হবে। তওবা করলে আশা করা যায় না নামায না পড়ার গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু যে নামায পড়া হয়নি তা মাফ ক হবে না। সে জন্যে সব কাযা পড়তে হবে।
৮. কারো যদি কয়েক মাস এবং বছর নামায কাযা হয়ে যায়, তাহলে তার উচিত কাযা নামায একটা অনুমান করে নিয়ে কাযা পড়া শুরু করবে। এ অবস্থায় কাযা নামায পড়ার নিয়ম এই যে, সে যে ওয়াক্তের কাযা পড়তে চাইবে সে ওয়াক্তের নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক ওয়াক্তের সবচেয়ে প্রথম বা শেষ নামায পড়ছি। যেমন কাযা হওয়া নামাযের মধ্যে ফজরের নামাযের কাযা পড়তে চায়। তাহলে বলবে, ফজরের সবচেয়ে প্রথম অথবা শেষ নামায পড়ছি। এভাবে পড়তে থাকবে যাতে সকল কাযা নামায পুরা হয়ে যায়।
৯. সফরে যে নামায কাযা হবে তা মুকীম হয়ে পড়তে গেলে কসর পড়বে। তেমনি মুকীম অবস্থায় কাযা হলে সফরে তা পুরা পড়তে হবে।
১০. শুধু বেতের নামায কাযা হয়েছে এবং আর কোন কাযা নেই। তাহলে বেতরের কাযা পড়া ব্যতীত ফজরের নামায পড়া ঠিক হবে না। যদি বেতরের কাযা স্মরণ রাখা সত্ত্বেও প্রথমে ফজরের নামায পড়ে তারপর বেতর পড়ে তাহলে বেতরের পুর পুনরায় ফজরের নামায পড়তে হবে।
১১. যদি কোন রোগ শয্যায় ইশারা করে নামায পড়া যেতো কিন্তু কিছু নামায কাযা হয়ে গেল। তাহলে এমন ব্যক্তির উচিত হবে যে, সে যেন তার ওয়ারিশদেরকে অসিয়ত করে যায় তার এক তৃতীয়ংশ মাল থেকে কাযা নামাযের ফিদিয়া আদায় করে। এক কাযা নামাযের ফিদিয়া সোয়া সের গম অথবা আড়াই সের যব। এ সবের মূল্য দিলেও হবে।
১২. কোন রোগী যদি এতটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে, ইশারায় নামায পড়ারও শক্তি নেই অথবা বেহুশ হয়ে পড়লো এবং এভাবে ছয় ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে গেল। তাহলে তার কাযা পুরা করা ওয়াজেব হবে না। তবে পাঁচ ওয়াক্তের পর যদি হুঁশ হয় তাহলে সব নামায কাযা পড়তে হবে।
১৩. যারা অজ্ঞাত কারণে জীবনের একটা অংশ অবহেলায় কাটিয়েছে এবং অসংখ্য নামায কাযা হয়েছে। তারপ যদি তওবার তৌফিক হয় তাহলে তার ছুটে যাওয়া নামাযগুলোর কাযা পড়ার সহজ পন্থা এই যে, পাঁচ ওয়াক্তের নামাযের ফরয আদায় করার সাথে সুন্নত নফলের নিয়তে পড়ার পরিবর্তে ছুটে যাওয়া ফরয নামাযের কাযা হিসেবে পড়তে থাকবে। যতোক্ষণ না তার এ প্রবল ধারণা জন্মে যে, সব নামাযের কাযা পড়া হয়েছে ততোদি পড়তে থাকবে। এটা খুব ভাল যে, মানুষ পাঁচ ওয়াক্তের আদা ফরযের সাথে সুন্নাত নফল পড়বে কিন্তু ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা করা অবহেল করবে। ছুটে যাওয়া নামায কর্জের ন্যায়। এটা একেবারে অর্থহীন যে, কর্জ পরিশোধ করার কথা নেই। এদিকে দান খায়রাত চলছে। তবে ছুটে যাওয়া ফরয নামাযের কাযা পড়ার পুরোপুরি ব্যবস্থার সাথে সাথে যদি পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে সুন্নাত-নফল পড়ে, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন।
১৪. জুমা নামাযের কাযা নেই। জুমা পড়তে না পারলে চার রাকায়াত যোহার কাযা পড়তে হবে।
১৫. কোন ব্যক্তি ঈদের নামাযে ইমামের সাথে শরীক হলো। তারপর কোন কারণে তার নামায নষ্ট হয়ে গেল। এখন সে আর ঐ নামাযের কাযা পড়তে পারে না। কারণ ঈদে নামাযের কাযা নেই। [আহলে হাদীসের মতে একাও ঈদের নামায পড়া যায়। ঈদগাহে যদি জামায়াত পাওয়া না যায় অথবা রোগী ঈদগহে যেতে না পারে- তাহলে একা পড়তে পারে।]  ওয়াক্তের মধ্যে একাও আদায় করতে পারে না। এ জন্যে যে, ঈদের নামাযের জন্যে জামায়াত শর্ত।
১৬. যদি ঈদুল ফেরে এবং ঈদুল আযহার নামায কোন কারণে প্রথম দিন পড়তে পারা না যায়, তাহলে ঈদুল ফেতেরের নামায পর দিন এবং ঈদুল আযহার নামায বারো তারিখ পর্যন্ত কাযা পড়া যায়।
সাহেবে তরতীব এবং তার কাযা নামায
বালেগ হওয়ার পর যে মুমেন বান্দাহর কোন নামায কাযা হয়নি, অথব জীবনে প্রথমএক বা দু’নামায কাযা হয়েছে, ক্রমাগত হোক অথা মাঝে মাঝে হোক, অথবা প্রথমে কাযা হয়ে থাকলে তার কাযা পড়া হয়েছে এবং এখন তার এক দুই বা উর্ধে পাঁ নামায কাযা হয়েছে, এমন ব্যক্তিকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘সাহেবে তরতীব’ বলে। সাহেবে তরতীবের কাযা পড়ার ব্যাপারে দু’টি বিষয়ের লক্ষ্য রাখা জরুরী।
প্রথম এই যে, যতোক্ষণ পর্যন্ত ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা না পড়বে, সামনের ওয়াক্তের আদা নামায পড়তে পারবে না। যেমন কারো ফজর, যোহর, আসর, মাগরেব এবং এশা অর্থাৎ একদিন রাতের নামায কাযা হলো। এখন যতোক্ষণ না সে এ পাঁচ ওয়াক্তের কাযা পড়বে, ততোক্ষণ সামনের দিনের ফজর নামায পড়া তার জন্যে দুরস্ত হবে না। যদি জেনে ‍বুজেও পড়ে ফেলে, তাহলে তা আদায় হবে না, কাযা নামায আদায়ের পর ফজরের নামায তাকে পড়তে হবে। তবে যদি সাহেবে তরতীবের কাযা নামায পড়তে মনে না থঅকে এবং ওয়াক্তের নামায পড়ে ফেলে সে তাহলে নামায পুনরায় পড়ার দরকার হবে না। বেতরের কাযারও তাই হুকুম অন্যান্য নামাযের মতো।
দ্বিতীয় কথা এই যে, কাযা হওয়া নামাযগুলো ক্রম অনুসারে পড়তে হবে। অর্থাৎ প্রথমে ফজরের নাময, তারপর যোহরের, তারপর আসরের, তারপর মাগরেবের এবং এরপর এশার। যদি সে ফজরের নামাযের আগে যোহর পড়ে ফেলে, তাহলে ফজরের নামায পড়ার পর যোহরের কাযা আবার পড়তে হবে। এমনি যোহারের নামাযের কাযা পড়ার আগে যদি আসর বা মাগরেবের কাযা পড়া হয়, তাহলে যোহরের কাযা পড়ার পর আবার আসর মাগরেব ড়তে হবে।
যার পাঁচ ওয়াক্তের বেশী নামায কাযা হয়, সে সাহেবে তরতীত নয়। কাযা নামায পড়ার জন্যে তার ক্রম অনুসারে পড়া ওয়াজেব হবে না। যখন সুযোগ পাবে এবং যে ওয়াক্তে নামায কাযা পড়তে চাইবে তা পড়তে পারবে। কাযা নামায পড়ার  আগে আদা নামায পড়াও জায়েয।ক্রম অনুসারে পড়ার বাধ্যবাধকতা শুধু সাহেবে তরতীবের জন্যে।

অক্ষম ও রোগীর নামায

১. রোগ যতোই কঠিন হোক, যতোদূর সম্ভব নামায ওয়াক্তের মধ্যে আদায় করা উচিত। নামাযের সকল আরকান আদায় করার শক্তি না থাকে না থাক, যে আরকান আদায় করার শক্তি হোক, অথবা ইশারায় আদায় করার হোক, তবুও নামায ওয়াক্তের মধ্যে আদায় করা উচিত। ***১
২. যথাসাধ্য দাঁড়িয়ে নামায পড়তে হবে। সমস্ত নামায দাঁড়িয়ে থেকে সম্ভব না হলে যতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হয়  ততোক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এমন কি কোন অক্ষম অথবা রোগী শুধু তাকবীর তাহরীমা বলার জন্যেও যদি দাঁড়াতে পারে, তাহলে দাঁড়িয়ে তাকবীর তাহরীমা বলবে এবং তারপর বসে নামায পুরা করবে। দাঁড়িয়ে নামায পড়ার শক্তি থাকতে বসে পড়া দুরস্ত নয়।
৩. যদি কেউ দাঁড়িয়ে নামায পড়তে কিছুতেই সক্ষম নয়, অথবা দুর্বলতার কারণে পড়ে যাওয়ার আশংকা হয়, অথবা দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যায়, অথবা দাঁড়ালে ভয়ানক কষ্ট হয়, অথবা দাঁড়ালেও রুকু’ সিজদা করার শক্তি নেই এমন সকল অবস্থায় বসে নামায পড়বে।
৪. বসে নামাযা পড়া সম্ভব হলে মসনূন তারিকায় বসতে হবে যেমন ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়ার সময় বসা হয়। এভাবে বসা যদি সম্ভব না হয় তাহলে যেভাবে বসা যায় সেভাবেই বসেই নামায পড়বে। রুকূ’ সিজদা করা সম্ভব না হলে ইশারা করে কাজ সারাবে।
৫. ইশারায় রুকূ’ সিজদা করতে হলে চোখ এবং মুখ দিয়ে ইশারা করা যথেষ্ট হবে না। মাথার দ্বারা ইশারা করতে হবে। রুকূ’তে একটু কম এবং সিজদাতে বেশী মাথা নত করতে হবে।
৬. সিজদা করার জন্যে মাটি পর্যন্ত কপাল ঠেকানো যদি না যায় তাহলে ইশারাই যথেষ্ট। বালিশ প্রভৃতি কপাল পর্যন্ত উঁচু করে তাতে সিজদা করা মাকরূহ।
*****১ [দ্বীনের ফকীহগণ এতটা তাকীদ করেছেন যে, যদি কোন গর্ভবতী নারীর গর্ভবেদনা শুরু হয় তখন নামাযের ওয়াক্ত এসে যায়, আর যদি সে নারীর হুশ-জ্ঞা থাকে, তাহলে দাঁড়িয়ে হোক বসে হাক যেমন করেই হোক তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নেবে। কারণ নেফাসের রক্ত আসার পর তো নামায  কাযা হয়ে যাবে এবং নামায পড়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তা কাযা করা কঠিন গুনাহ।]
৭. নামায পড়ার শক্তিও যদি না হয়, অথবা খুব কষ্ট হয় অথবা রোগ বেড়ে যাওয়ার আশংকা হয়, অথবা ক্ষতস্থানের ব্যাণ্ডেজ খুলে যাওয়ার ভয় হয় তাহলে শুয়ে ‍শুয়ে নামায পড়বে। শুয়ে শুয়ে নামায পড়ার উত্তম পন্থা এই যে, চিত হয়ে কেবলার দিকে পা করতে হবে। তবে পা সটান না করে হাটু উচু রাখতে হবে। মাথার নীচে বালিশ প্রবৃতি দিয়ে মাথা একটু উচু করতে হবে। তারপর ইশারায় রুকু’ সিজদা করবে। তাও সম্ভব না হলে উত্তর দিকে মাথা দিয়ে কেবলার দিকে মুখ ফিরাতে হবে এবং ডান কাত হয়ে নামায আদায় করবে। তাও সম্ভ না হলে যেমন ভাবে সক্ষম হয় তেমনভাবে নামায পড়বে।
৮. রোগীর অবস্থা যদি এমন হয় যে, ইশারায়ও নামায পড়া সম্ভব নয়। তাহলে নামায পড়বে না। ভালো হলে কাযা পড়বে। এমন অবস্থা যদি পাঁচ ওয়াক্তের বেশী সময় পর্যন্ত থাকে তাহলে তার কাযা ওয়াজেব হবে না। এ নামায মাফ হবে। অথবা দুর্বলতার জন্যে জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে এবং এ অবস্থা ছয় ওয়াক্ত নামায পর্যন্ত চলে, তাহলে এসব নামাযের কাযা ওয়াজেব হবে না। ঠিক তেমনি কোন ‍সুস্থ লোক যদি হঠাৎ বেহুশ হয়ে পড়ে এবং এভাবে ছয় ওয়াক্ত নামায পর্য়ন্ত থাকে তাহলে এসব নামায তার মাফ।
৯. যদি নামায পড়া অবস্থায় হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারে, বসে পড়বে, বসে না পারলে শুয়ে, অথবা ইশারা করে। মোট কথা বাকী নামায যেভাবে পারে পড়বে।
১০ চলন্ত নৌকা, জাহায রেলগাড়ী বিমান প্রভৃতিতে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে অসুবিধা হলে বসে পড়বে। অবশ্যি দাঁড়িয়ে পড়তে কোন অসবিধা না হলে দাঁড়িয়ে নামায পড়াই উচিত।
১১. সুস্থ অবস্থায় যদি কারো কিচু নামায কাযা হয় এবং তারপর অসুস্থ হয়ে পড়, েতাহলে রোগ সেরে যাওয়া পর্যন্ত কাযা করার অপেক্ষা করবে না। অসুস্থ অবস্থায় যেমন করেই হোক কাযা পড়ে নিতে হবে।
১২. যদি কোন রোগীর বিছানা নাপাক হয়ে যায় এবং পাক বিছানা জোগাড় করা কঠিন অথবা বিচানা বদলানো সম্ভব নয়, তাহলে নাপাকক বিছানায় নামায পড়া দুরস্ত হবে।

কসর নামাযের বয়ান

শরীয়ত মুসাফিরকে সফরে নামায সংক্ষিপ্ত করার সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ যেসব নামায চার রাকায়াতের তা দু’ রাকয়াত পড়বে। আল্লাহ বলেন- (আরবী*****************)
-যখন তোমরা যমীনে ভ্রমণ করতে বেরুবে, তখন নামায সংক্ষিপত্ করলে কোন দোষ নেই- (নেসা: ১০১)।
নবীর এরশাদ হচ্ছে-
এ একটি সাদকা যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন, এ সদকা তোমরা গ্রহণ কর- (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী প্রভৃতি)।
কসর নামাযের হুকৃম
আপন বস্তি বা জনপদ থেকে বের হওয়ার পর ‍মুসাফিরের জন্যে নামায কসর পড়া ওয়াজেব। পুরা নামায পড়লে গুনাহগার হবে –(এলমুল ফেকাহ, ২য় খণ্ড পৃ. ১৩০, দুররে মুখতার, প্রবৃতি)।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা ) বলেন- আমি নবী (স), আবু বরক (রা), ওমর (রা) এবং ওসমান (রা) এর সাথে সফল করেছি। আমি কখনো দেখিনি যে তাঁরা দু’রাকায়াতের বেশী ফরয নামায পড়েছেন- (বুখারী, মুসলিম)। কসর শুধু ঐসব নামাযে যা চার রাকায়াত ফরয। যেমন যোহর, আসর ও এশা। যার মধ্যে দুই বা তিন রাকায়াত ফরয, তাতে কোন কম করা যাবে না। ফজরের দু এবং মাগরেবে তিন রাকায়াতই পড়তে হবে।
সফরে সুন্নাত এবং নফলের হুকুম
ফজর নামাযের সুন্নাত ত্যাগ করা ঠিক নয়। মাগরেবের সুন্নাতও পড়া উচিত, বাকী ওয়াক্তের সুন্নাতগুলো সম্পর্কে না পড়ার এখতিয়ার আছে। তবে  সফর চলতে থাকলে শুধু ফরয পড়া ভালো এবং সুন্নাত ছেড়ে দেবে। সফরের মধ্যে কোথাও কোথাও অবস্থান করলে পড়ে নেবে। বেতর পুরা পড়তে  হবে- কারণ তা ওয়াজেব। সুন্নাত, নফল ও বেতরে নামাযের কসর নেই। বাড়ীতে যত রাকয়াত, সফরেও তত রাকয়াত পড়তে হবে।
কসরের দুরত্ব
যদি কেউ তার বাড়ী তেকে এমন স্থানে সফর করার জন্যে বের হয় যা তার বাড়ী বা বস্তি থেকেজ তিন দিনের দূরত্ব হয়, তাহলে তার কসর করা ওয়াজেব। তিন দিনের দুরত্ব আনুমানিক ছত্রিশ মাইল। যদি কেউ মধ্যম গতিতে দৈনিক পায়ে হেটে চলে তাহলে ছত্রিশ মাইলের বেশী যেতে পারবে না। যে জন্যে যদি কেউ অন্তত ছত্রিশ মােইল সফর করার উদ্দে্শ্যে বাড়ী থেকে বের হয় তা সে পায়ে হেঁটে তিন দিনে সেখানে পৌছুক অথবা দ্রুতগাম যানবাহনে কয়েক ঘন্টায়-পৌঁছুক সকল অবস্থায় তাকে নামায কসর পড়তে হবে। [আল্লামা মওদূদী (র) –এর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার দ্বারা এ সত্যের প্রতি আলোকপাত করা হয় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে সফর কাকে বলে। কোন এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন-
ইংরেজী মাইলের হিসাব কত দীর্ঘ সফরে কসর নামায ওয়াজেব হবে? তার উত্তরে আল্লামা মওদীদী (র) বলেন, এ বিষয়ে ফকীহগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কসর নামাযের জন্যে কমপক্ষে নয় মাইল এবং উর্ধে ৪৮ মাইল সফরের নেসাব নির্ণয় করা হয়েছে। মতভেদের কারণ এ িযে, নবী পাক (স)-এর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট উক্তি বর্ণিত নেই সুস্পষ্ট নস (***) বা উক্তির অবর্তমানে যেসব দলীলের ভিত্তিতে এন্তেবাদ করা হয়েছে অর্থাৎ শরয়ী সিদ্ধান্ত করা হয়েছে তার মধ্যে মতান্তরের অবকাশ আছ্ এটাই সঠিক একটা বিশেষ বিন্দু অতিক্রম করলেই সফরের হুকুম লাগাতে হবে, কসরের জন্যে এ ধরনের দূরত্ব নির্ধারণ শরীয়ত প্রণেতার অভিলাষ নয়। শরীয়ত প্রণেতা সফর বলতে কি বুঝায় তা সাধারণভাবে প্রচলিত রীতিনীতির উপর ছেড়ে দিয়েছেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তি এটা সহজে বুঝতে পারে যে, কখন সে সফরে এবং কখন নয়। এটা ঠিক যে, যখন আমরা শহর থেকে গ্রামের দিকে আনন্দ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি অথবা গ্রাম তেকে শহরে বেচা কেনার জন্যে যাই, তখন আমাদের মধ্যে মুসাফির হওয়া অনুভূতি কখনো হয় না। পক্ষান্তরে প্রকৃতপক্ষেই যখন আমাদের সফর করতে হয় তখন স্বয়ং সফরের অবস্থা অনুভব করি। এ অনুভূতি অনুযায়ী কসর অথবা পুরা নামায পড়া যেতে পারে। খুব ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, শরীয়তের ব্যাপারে সে ব্যক্তি মনের ফতোয়াই নির্ভরযোগ্য যে শরীয়ত মেনে চলার ইচ্ছা করে, বাহানা খুঁজে বেড়ায় না- (রাসায়েল ও মাসায়েল, ১ম খন্ড পৃ. ১৬৭)।]
কসর শুরু করার স্থান
সফরে রওয়ানা হওয়ার পর মুসাফির যতোক্ষণ তার অধিবাসের ভিতরে থাক,ততোক্ষণ পুনা নামায পড়বে। অধিবাস বা বস্তির বাইরে চলে গেলে কসর পড়বে। বস্তির স্টেশন যদি তার বাসস্থানের ভেতর হয় তাহলে কসর পড়বে না, পুরা নামায পড়বে। আর যদি বাইরে হয় তাহলে কস পড়বে।
কসরের মুদ্দৎ
মুসাফির যতোদিন আর ‘ওয়াতনে আসলীতে’ (পরিভাসা দেখুন) ফিরে না আসবে ততোদিন কসর পড়তে থাকবে। ফরকালে কোথা যদি পনেরো দিন বা তার বেশী সময় অবস্থানের ইচ্ছা করে তাহলে সে স্থান তার ওয়াতনে একামত’ (পরিভাষা দেখুন) বলে বিবেচিত হবে। ‘ওয়াতনে একামতে’ পুরা নামায পড়তে হবে। যদিও পনেরো দিন থাকা নিয়ত করার পর তার কম সময় সেখানে অবস্থঅন করে। আর কোনো স্থানে পনেরো দিনের কম থাকার ইচ্ছঅ কিন্তু কোন কারণে সেখানে বার বার আটকা পড়ছে অর্থাৎ যাবে যাবে করেও যাওয়া হচ্ছে না তাহলে কসরই পড়বে। এভাবে অনিশ্চিয়তার মধ্যে যদি কয়েক মাস অতীত হয় তবুও সে স্থান ‘ওয়াতনে একামত’ বলে বিবেচিত হব না এবং সেখানে কসরই পড়তে হবে।
কসরের বিভিন্ন মাসয়ালা
১. যদি সফরকালে ভুলে কেউ চার রাকয়াত নামায পড়ে ফেলে এমনভাবে যে, দ্বিতীয় রাকয়াতে বসে ‘আত্তাহিয়্যাত’ পড়েছে, তাহসে সহু সিজদা করে নেবে। এ অবস্থায় দু’রাকয়াত ফরয এবং দু’রাকয়াত নফল হবে। এ নাময দুরস্ত হবে। কিন্তু যদি দ্বিতীয় রাকয়াতে বসে ‘আত্তাহিয়্যাত’ না পড়ে থাকে তাহলে এ চার রাকয়াত নফল হবে। করস নামায পুনরায় আদায় করতে হবে।
২. সফলকালে যদি কযেক স্থানে অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে- কোথাও পাঁচ দিন, কোথাও দশদিন, কোথাও বার দিন, কোথাও পনের দিন থাকার ইচ্ছা নেই- তাহলে পুরা সফরে কসর পড়তে হবে।
৩. বিয়ের পর কোন মেয়ে যদি স্থায়ীভাবে শশুর বাড়ী থাকা শুরু করে, তাহলে তার ‘ওয়াতনে আসলী’ তখন ঐ স্থান হবে যেখানে সে তার স্বামীর সাথে থাকবে। এখন যদি সে এখান থেকে বাপের বাড়ী বেড়াতে যায় এবং শ্বশুর বাড়ী থেকে বাপের বাড়ির দূরত্ব যদি ৩৬ মাইল হয় তাহলে বাপের বাড়ীতে কসর পড়তে হবে। তবে হ্যাঁ যদি শ্বশুড় বাড়ী কয়েকদিনের জন্যে যায় এবং বাপের বাড়ী স্থায়ীভাবে থাকার ইচ্ছা হয় তাহলে বিয়ের আগে যেটা ‘ওয়াতনে আসলী’ ছিল, সেটাই তার ওয়াতনে আসলী থাকবে।
৪. কোন মহিলা যদি তার স্বামীর সাথে অথবা কোন কর্মচারী তার মালিকের সাথে অথবা কোন পুত্র তার পিতার সাথে সফর করে, অর্থাৎ সফরকারী যদি এন কোন ব্যক্তি হয় যে, অপরের অধীন এবং অনুগত, তাহলে এ অধীন ব্যক্তির ইচ্ছা বা নিয়ত মূল্যহীন হবে। এ অবস্থায় সে মহিলা, অথবা কর্মচারী অথবা পুত্র যদি কোথাও পনেরো দিন থাকার নিয়তও করে তথাপি সে মুকীম হতে পারবে না, যদি তার স্বামী অথবা মুনিব অথবা পিতা ১৫ দিনের নিয়ত না করে।
৫. মুকীম মুসাফিরের পিছনে নামায পড়তে পারে। ‍মসাফির ইমামের উচিত হবে ঘোষণা করে দেয়া যাতে করে ইমাম দু’রাকয়াত পড়ে সালাম ফিরালে মুকীম ‍মুক্তাদী যেন উঠে বাকী দু’রাকয়াত পুরা করতে পারে।
৬. মুসাফিরের জন্যে মুকীম ইমামের পেছনে নাময পড়া দুরস্ত আছে। এ অবস্থায় ইমামের অনুসরণে চার রাকয়াত ফরযই পড়বে, কসর করবে না।
৭. যদি কেউ কোথাও অবস্থান সম্পর্কে কিছু ঠিক করেনি অথবা ১৫ দিনের কম নিয়ত করেছে কিন্তু নামাযের মধ্যে ১৫ দিনের বেশী থাকার নিয়ত করলো তাহলে সে ব্যক্তি নামায পুরা পড়বে, কসর করবে না।
৮. সফরে যেসব নামায কাযা হবে বাড়ী ফেরার পর তা কসর কাযা পড়বে। ঠিক তেমনি বাড়ী থাকা কালীন কিছু নামায কাযা হলো এবং তঠাৎ সফরে যেতে হলো, তাহলে সফরে কাযা নামায পুরাই পড়তে হবে কসর  পড়বে না।
সফরে একত্রে দু’নামায
হজ্জের সফরের মধ্যে ‘জময়ো বাইনাস সালাতাইন’ অর্থাৎ দু’ওয়াক্ত নামায একত্রে পড়া মসনূন। ৯ই যিলহজ্জ আরাফাতের ময়দানে যোহর ও আসরের নামায যোহরের ওয়াক্তে একত্রে পড়া হয়। আযান একবার দেয়া হয় এবং একামত উভয় নামাযের জন্যে পৃথক পৃথক দেয়া হয় যেহেতু আসরের সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগে পড়া হয় সে জন্যে মানুষকে জানিয়ে দেয়ার জন্যে একামত পৃথকভাবে দেয়া হয়।
তারপর সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ‍মুযদালফার দিকে হাজীগণ রওয়ানা হন। এবং মুযদালাফায় পৌঁছে মাগরেব এবং এশার নামায একত্রে পড়েন। কেউ যদি মুযদালফার পথে মাগরেব পড়েন তাহলে তা দুরস্ত হবে না তা পুনরায় পড়তে হবে।
হজ্জের সফর ব্যতীত অন্য কোন সফরে একত্রে দু’নামায জায়েয নয়। অবশ্য ‘জময়ে’ সূরী’ (পরিভাষা দ্রঃ) জায়েয। জময়ে সূরী অর্থ এই যে, প্রথম নামায বিলম্ব করে শেষ ওয়াক্তে পড়া এবং দ্বিতীয় নামায প্রথম ওয়াক্তে পড়া। এভাবে প্রকাশ্যত এটাই মনে হবেযে, দু’নামায একত্রে পড়া হচ্ছে। কিনন্তু প্রকৃতপক্ষে দু’টি নামায তাদের আপন আপন ওয়াক্তেই পড়া হচ্ছে। [আহলে হাদীসের নিকট প্রত্যেক সফরে একত্রে দু’নামায জায়েয। শুধু জময়ে সূলীই জায়েয নয়, বরঞ্চ ‘জময়ে’ হাকীকিও’। জময়ে হাকীকির অর্থ এই যে, দু’ওয়াক্তের নামায একসাথে একই ওয়াক্তে পড়া। তার দু’টি উপায়।:-
** এক এই যে, দ্বিতীয় নামাযের সময় হওয়ার পূর্বেই প্রথম নামাযের ওয়াক্তে এক সাথে পড়ে নেয়া। যেমন বেলা গড়ার পর যোহরে নামাযর সাথে আসরের নামায পড়া। একে জময়ে’ তাকদমি বলে।
** দ্বিতীয় এই যে, প্রথম নামায বিলম্ব করে দ্বিতীয় নামাযের ওয়াক্তে দুই নামায একত্রে পড়া। যেমন, যোহরের নামা বিলম্ব করে আসরের ওয়াক্তে যোহর এবং আসর নামা একত্রে পড়া। একে জময়ে’ তা’খীর বলে। আহলে হাদীরে মতে জময়ে’ সূরী, জময়ে তাকদীম এবং জময়ে তা’খীর তিনটিই জায়েয। প্রয়োজন অনুসারে মুসাফিরের যাতে সুবিধা হয়, তার উপর আমল করবে। সফর চলা কালেও তা করা যেতে পারে এবং কোথাও অবস্থানকালেও করা যেতে পারে। এ সবই সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) সফরকালে ঘরে থাকতেই যদি বেলা গড়ে যেতো, তাহলে প্রথমে তিনি যোহর এবং আসরের নামায একত্রে পড়ে তারপর রওয়ানা হতেন। আর যদি ঘরে থাকতে বেলা না গড়াতো তাহলে তিনি যাত্রা শুরু করতেন এবং যখন আসরে ওয়াক্ত হতো তখন যোহর এবং আসর একত্রে পড়তেন। ঠিক এমনি রওয়ানা হওয়ার পূর্বে যদি ঘরে থাকতেই বেলা ডুবে যেতো তাহলে তিনি মাগরেব এবং এশা একত্রে পড়ে রওয়ানা হতেন। আর যদি ঘরে থাকতে বেলা না ডুবতো তাহলে তিনি বেরিয়ে পড়তেন এবং যখন এশার সময় হতো তখন সওয়ারী থেকে নেমে মাগরেব এবং এশা একত্রে পড়তেন। -(মুসনাদে আহমদ)।
হযরত মাআয বিন জাবাল (রা) তবুকের একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
নবী (স) তবুক অভিযানকালে সূর্য গড়ার পূর্বে যাত্রা শুরু করতে চাইলে যোহর নামায বিলম্বিত করে আসরের সাথে একত্রে পড়তেন। আর যদি বেলা গড়ার পর রওয়ান হতেন তাহলে যোহরের ওয়াক্তে যোহর এবং আসরে নামায একত্রে পড়তেন এবং তারপর যাত্রা শুরু করতেন। সূর্য ডোবার আগে রওয়ানা হলে মাগরেব নামায বিলম্বিত করে এশার নামাযের সাথে পড়তেন। বেলা ডোবার পরে রওয়ানা হলে এশার নামায মাগরেব নামাযের সাথে মিলিয়ে পড়তেন। (তিরমিযী)।]

0 comments:

Post a Comment