Tuesday, November 1, 2016

অযুর বিস্তারিত বিবরণ


অযুর ফযীলত ও বরকত

অযুর মহত্ব ও গুরুত্ব এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, স্বয়ং কুরআনে তার শুধু হুকুমই নেই, বরঞ্চ তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, অযুতে দেহের কোন কোন অংগ ধুতে হবে। আর এ কথাও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, অযু নামাযের অপরিহার্য শর্ত।

যারা তোমরা ঈমান এনেছো জেনে রাখো, যখন তোমরা নামাযের জন্যে দাঁড়াবে তার আগে নিজেদের মুখ-মণ্ডল ধুয়ে নেবে এবং তোমাদের দু‘হাত কুনুই পর্যন্ত ধুয়ে নেবে এবং মাথা মাসেহ করবে এবং তারপর দু‘পা চাখনু পর্যন্ত ধুয়ে ফেলবে- (মায়েদাহ: ৬)।
নবী (সা) অযুর ফযীলত ও বরকত বয়ান করতে গিয়ে বলেন-
"আমি কোয়ামতের দিন আমার উম্মতের লোকদেরকে চিনে ফেলবো। কোন সাহাবী জিজ্ঞাস করলেন- কেমন করে, হে আল্লাহর রসূল? নবী (সা) বলেন, এ জন্যে তাদেরকে চিনতে পারব যে, অযুর বদৌলতে আমার উম্মতের মখমণ্ডল এবং হাত-পা উজ্জ্বলতায় ঝকঝক করবে।"
অন্য এক সময়ে নবী পাক (সা) অযুর মহত্ব বয়ান করতে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি আমার বলে দেয়া পদ্ধতি অনুযায়ী ভালোবাবে অযু করবে এবং অযুর পর এ কালেমা শাহাদাত পাড়বে-

তার জন্যে জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। তারপর সে যে দরজা দিয়ে খুশী জান্নাতে প্রবেশ করবে (মুসলিম)।

উপরন্তু তিনি আরও বলেন,
অযু করার কারণে ছোটো খাটো গুনাহ মাফ হয়ে যায় এবং অযুকারীকে আখেরাতে উচ্চ মর্যাদায় ভুষিত করা হব এবং অযুর দ্বারা শরীরের সমস্ত গুনাহ ঝরে পড়ে (বুখারী, মুসলিম)
আর একবার নবী (সা) অযুকে ঈমানের আলামত বলে অভিহিত করে বলেন, হকের রাস্তায় ঠিকভাবে কায়েম থাক, আর তোমরা কখনো সত্য পথে অটল থাকার হক আদায় করতে পারবে না। (সে জন্যে নিজেদের ভুলত্রুটি ও অক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ থাক) এবং ভাল করে বুঝে রাখ যে, তোমাদের সকল আমলের মধ্যে নামায উত্কৃষ্টতম এবং অযুর পুরোপুরি রক্ষণাবেক্ষণ তো শুধু মু‘মেনই কারতে পারে- (মুয়াত্তায়ে ঈমাম মালেক, ইবনে মাজাহ)

অযুর মসনুন তরিকা


 

অযুকারী প্রথেমে মনে মনে এ নিয়ত করবে, আমি শুধু আল্লাহকে খুশী করার জন্যে এবং তাঁর কাছ থেকে আমলের প্রতিদান পাবার জন্যে অযু করছি। তারপর
 বলে অযু শুরু করবে এবং নিম্নের দোয়া পড়বে (আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ী)

হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ কর, আমার বাসস্থান আমার জন্যে প্রশস্ত করে দাও এবং রুযীতে বরকত দাও।– (নাসায়ী)।
 

হযরত আবু মুসা আশয়ারী বলেন, আমি নবী (সা) এর জন্যে অযুর পানি আনলাম। তিনি অযু করা শুরু করলেন। আমি শুনলাম যে, তিনি অযুতে এ দোয়া পড়ছিলেন
 আমি জিজ্ঞাস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহু! আপনি এ দোয়া পড়ছিলেন? তিনি বললেন, আমি দ্বীন ও দুনিয়ার কোন জিনিস তাঁর কাছে চাওয়া ছেড়ে দিয়েছি?
অযুর জন্যে প্রথমে ডানে হাতে পানি নিয়ে দু‘হাত কব্জি পর্যন্ত খুব ভাল করে তিনবার ঘষে ধুতে হবে। তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে তিনবার কুল্লি করতে হবে। মিসওয়াকও করতে হবে। [নবী (সা) মিসওয়াককে অসাধারণ গুরুত্ব দিতেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সা) দিনে বা রাতে যখনই ঘুম থেকে উঠতেন, তাঁর অভ্যাস ছিল, অযুর পূর্বে অবশ্যই মিসওয়াক করতেন (আবু দাউদ (আবু দাউদ)। হুযায়ফা (রা) বলেন, নবী (সা) যখন রাতে তাহাজ্জুদের জন্যে ঘুম থেকে উঠতেন, তখন তাঁর অভ্যাস এই ছিল যে, মিসওয়াক দিয়ে ভাল করে মুখ দাঁত পরিস্কার করতেন তারপর অযু করে তাহাজ্জুদ নামাযে মশগুল হতেন।
নবী (সা) উম্মাতকে  মিসওয়াকের জন্যে উদ্বুদ্ধ করে বলতেন, মিসওয়াক মুখ ভালোভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে এবং আল্লাহকে অত্যন্ত খুশী করে (বুখারী, নাসায়ী)।
নবী (সা) আরও বলেন, আমার উম্মতের কষ্টের প্রতি যদি খেয়াল না করতান, তাহলে প্রত্যেক অযুতে মিসওয়াক করার হুকুম দিতাম। (বুখারী, মুসলিম) ]
কোন সময়ে মিসওয়াক না থাকলে শাহাদৎ অঙ্গুরি দিয়ে ভালো করে ঘষে দাঁত সাফ করতে হবে। রোযা না থাকলে তিনবারই গড়গড়া করে কুল্লি করতে হবে। তার উদ্দেশ্যে গলদেশের ভেতর পর্যন্ত পানি পৌছানো। তারপর তিনবার এমনভাবে নাকে পানি দিতে হবে যেন নাসিকার ভেতর পর্যন্ত পৌছে। অবশ্য রোযার সময় সাবধানে কাজ করতে হবে। তারপর বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে নাক সাফ করতে হবে। প্রত্যেকবার নাকে নতুন পানি দিতে হবে। তারপর দু‘হাতের তালু ভরে পানি নিয়ে তিনবার সমস্ত মুখমণ্ডল (চেহেরা) এমনভাবে ধুতে হবে যেন চুর পরিমাণ স্থানও শুকনো না থাকে। দাঁড়ি ঘন হলে তার মধ্যে খেলাল করতে হবে যেন চুলের গোড়া পর্যন্ত পানি পৌছে যায়। চেহেরা ধুবার সময় এ দোয়া পড়তে হবে

হে আল্লাহ ! আমার চেহেরা সেদিন উজ্জ্বল করে দাও যেদিন কিছু লোকের চেহেরা উজ্জ্বল হবে এবং কিছু লোকের মলিন হবে।
তারপর দু‘হাত কনুই পর্যন্ত ভালো করে ঘষে ধুবে। প্রথম ডান হাত এবং পরে বাম হাত তিন তিনবার করে ধুতে হবে। হাতে আংটি থাকলে এবং মেয়েদের হাতে চুড়ি-গয়না থাকলে তা নাড়াচাড়া করতে হবে যেন ভালোভাবে পানি সবখানে পৌছে। হাতের আঙ্গুলগুলিতে আঙ্গুল দিয়ে খেলাল করতে হবে। তারপর দু‘হাত ভিজিয়ে মাথা এবং কান মাসেহ করতে হবে।

মুসেহ করার পদ্ধতি

মুসেহ করার পদ্ধতি এই যে, বড়ো এবং শাহাদাত আঙ্গুলি আলাদা রেখে বাকী দু‘হাতের তিন তিন অংগুলি মিলিয়ে অংগুলিগুলোর ভেতর দিক দিয়ে কপালের চুলের গোড়া থেকে পেছন দিকে মাথার এক চতুর্থাংশ মুসেহ করতে হবে। তারপর দুহাতের হাতুলির পেছন দিক থেকে সামনের দিকে টেনে মাথার তিন চতুর্থাংশ মুসেহ করতে হবে। তারপর শাহাদাত অংগুলি দিয়ে কানের ভেতরের অংশ এবং বুড়ো অংগুলি দিয়ে কানের বাইরের অংশ মুসেহ করতে হবে। তারপর দু‘হাতের অংগুলিগুলোর পিঠ দিয়ে ঘাড় মুসেহ করতে হবে। গলা মুসেহ করতে হবে না। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এই যে, এভাবে কোন অংশ মুসেহ করতে হাতের ঐ অংশ দ্বিতীয় বার ব্যবহার করতে হয় না যা একবার ব্যবহার করা হয়েছে।
মুসেহ করার পর দু‘পা টাখনু পর্যন্ত তিন তিনবার এমনভাবে ধুতে হবে যে, ডান হাত দিয়ে পানি ঢালতে হবে এবং বাম হাত দিয়ে ঘষতে হবে। বাম হাতের ছোট আংগুল দিয়ে পায়ের আংগুলগুলোর মধ্যে খেলাল করতে হবে। ডান পায়ে খেলাল ছোট আংগুল থেকে শুরু করে বুড়ো আংগুলে শেষ করতে হবে। বাম পায়ে খেলাল বুড়ো আংগুল থেকে ছোট আংগুল পর্যন্ত করতে হবে। অযুর কাজগুলো পর পর কর যেতে হবে। অর্থাৎ একটার পর সংগে সংগে অন্যটি ধুতে হবে। খানিকক্ষণ থেমে থেমে করা যেন না হয়।
অযু শেস করে আসমানের দিকে মুখ করে তিন বার এ দোয়া পড়তে হবে।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দাহ ও রাসূল। হে আল্লাহ, আমাকে ঐসব লোকের মধ্যে শামিল কর যারা বেশী বেশী তওবাকারী এবং আমাকে ঐসব লোকের মধ্যে শামিল করা যারা বেশী বেশী পাক সাফ থাকে।

অযুর হুকুম

যে যে অবস্থায় অযু ফরয হয়
১. প্রত্যেক নামাযের জন্যে অযু ফরয, সে নামায ফরয হোক অথবা ওয়াজেব। সুন্নাত বা নফল হোক।
২. জানাযার নামাযের জন্যে অযু ফরয।
৩. সিজদায়ে তেলাওয়াতের জন্যে অযু ফরয।
যে সব অবস্থায় অযু ওয়াজেব
১. বায়তুল্লাহ তওয়াফের জন্যে।
২. কুরআন পাক স্পর্শ করার জন্যে।
যে সব কারণে অযু সুন্নাত
১. শোবার পূর্বে অযু সুন্নাত।
২. গোসলের পূর্বে অযু সুন্নাত।
যে সব অবস্থায় অযু মুস্তাহাব
১. আযান ও তাকবীরের জন্যে অযু মুস্তাহাব।
২. খুতবা পড়ার সময়-জুমার খুতবা হোক বা নেকাহের খুতবা।
৩. দ্বীনি তালিম দেয়ার সময়।
৪. যিকরে এলাহীর সময়।
৫. ঘুম থেকে উঠার পর।
৬. মাইয়েত গোসল দেবার পর।
৭. নবী (সা) এর রওযা মুবারক যিয়ারতের সময়।
৮. আরাফার ময়দানে অবস্থানের সময়।
৯. সাফা ও মারওয়া সায়ী করার সময়।
১০. জানাবাত অবস্থায় খাবার পূর্বে।
১১. হায়েয নেফাসের সময়ে প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্তে।
১২. সব সময় অযু থাকা মুস্তাহাব।

অযুর ফরযসমূহ


অযুর চারটি ফরয এবং প্রকৃতপক্ষে এ চারটির নামই অযু। এ চারের মধ্যে কোন একটি বাদ গেলে অথবা চুল পরিমাণ কোন স্থান শুকনো থাকলে অযু হবে না।
১. একবার গোটা মুখমণ্ডল ধোয়া। অর্থাৎ কপালের উপর মাথার চুলের গোড়া থেকে থুতনির নীচ এবং এক কানের গোড়া থেকে অপর কানের গোড়া পর্যন্ত সমস্ত মুখমণ্ডল ধোয়া ফরয।
২. দু‘তাহ অন্তত: একবার কুনুই পর্যন্ত ধোয়া।
৩. একবার মাথা এক চতুর্থাংশ মুসেহ করা।
৪. একবার দু‘পা টাখনু পর্যন্ত ধোয়া।

অযুর সুন্নাতসমূহ



অযুর কিছু সুন্নাত আছে। অযু করার সময় তা রক্ষা করা দরকার। অবশ্য যদিও তা ছেড়ে দিলে কিংবা তার বিপরীত কিছু করলেও অযু হয়ে যায়, তথাপি ইচ্ছা করে এমন করা এবং বার বার করা মারাত্মক ভুল। আশংকা হয় এমন ব্যক্তি গুনাহগার হয়ে যেতে পারে।
অযুর সুন্নাত পনেরটি
১. আল্লাহর সন্তষ্টি এবং আখেরাতের প্রতিদানের নিয়ত করা।
২. বিসমিল্লাহির রাহমানিররাহিম বলে অযু শুরু করা।
৩. মুখ ধোয়ার আগে কব্জি পর্যন্ত দু‘হাত ধোয়া।
৪. তিন পার কুলি করা।
৫. মিসওয়াক করা।
৬. নাকে তিনবার পানি দেওয়া।
৭. তিনবার দাড়ি খেলাল করা। [ইহরাম অবস্থায় দাড়ি খেলাল করা ঠিক হবে না যদি হঠাৎ কোন দাড়ি উপড়ে যায়। ইহরামকারীর জন্যে চুল উপড়ানো নিষেধ।]
৮. হাত পায়ের আংগুলে খেলাল করা।
৯. গোটা মাথা মুসেহ করা।
১০. দু‘কান মুসেহ করা। [কান মুসেহ করার জন্যে নতুন পানিতে তাহ ভেজাবার দরকার নেই। তবে, টুপি, পাগড়ি, রুমাল প্রভৃতি স্পর্শ করার কারণে হাত শুকিয়ে গেলে দ্বিতীয় বার হাত ভিজিয়ে নিতে হবে।]
১১. ক্রমানুসারে করা।
১২. প্রথমে ডান দিকের অংগ ধোয়া তারপর বাম দিকের।
১৩. একটি অংগ ধোয়ার পর পর দ্বিতীয়টি ধোয়া। একটির পর একটি ধুতে এত বিলম্ব না করা যে, প্রথমটি শুকিয়ে যায়।
১৪. প্রত্যেক অংগ তিন তিনবার ধোয়া।
১৫. অযুর শেষে মসনুন দোয়া পড়া (পূর্বে দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে)।

অযুর মুস্তাহাব

অর্থাৎ এমন কিছু খুটিনাটি যা পালন করা অযুর মুস্তাহাব।
১. এমন উঁচু স্থানে বসে অযু করা যাতে পানি গড়িয়ে অন্য দিকে যায় এবং ছিটা গায়ে না পড়ে।
২. কেবলার দিকে মুখ করে অযু করা।
৩. অযুর সময় অপরের সাহায্য না নেয়া। অর্থাৎ নিজেই পানি নেয়া এবং নিজ নিজেই অংগাদি ধোয়া। [যদি কেউ অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে পাত্র ভরে পানি দিয়ে দেয় তাতে কোন দোষ নেই। কারো কাছে সাহায্যের প্রতীক্ষায় থাকা ঠিক নয়। রোগী বা অক্ষম ব্যক্তির অপরের অংগপ্রত্যংগাদি ধয়ে নেয়া মোটেই দুষণীয় নয়।]
৪. ডান হাতে পানি নিয়ে কুলি করা এবং নাকে পানি দেয়া।
৫. বাম হাত দেয়ে নাক সাফ করা।
৬. পা ধোবার সময় ডান হাতে পানি ঢালা এবং বাম হাতে ঘষে ধোয়া।
৭. অঙ্গ ধোবার সময় মসনূন দোয়া পড়া।
৮. অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঘষে ঘষে ধোয়া যেন কোন স্থানে শুকনো না থাকে এবং ময়লা থেকে না যায়।
অযুর মাকরুহ কাজগুলো
১. অযুর শিষ্টাচার ও মুস্তাহাব ছেড়ে দেয়া অথবা তার বিপরীত করা।
২. প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় করা।
৩. এতো কম পরিমাণ পানি ব্যবহার করা যে, অঙ্গাদি ধুতে কিছু শুকনো থেকে যায়।
৪. অযুর সময় আজে বাজে কথা বলা।
৫. জোরে জোরে পানি মেরে অঙ্গাদি ধোয়া।
৬. তিন তিনবারের বেশী ধোয়া।
৭. নতুন পানি নিয়ে তিনবার মুসেহ করা।
৮. অযুর পরে হাতের পানি ছিটানো।
৯. বিনা কারণে অযুর মধ্যে ঐসব অঙ্গ ধোয়া যা জরুরী নয়।

ব্যাণ্ডেজ এবং ক্ষত প্রভৃতির উপর মুসেহ


১. ভাঙ্গা হাড়ের উপর কাঠ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ বা প্লাষ্টার করা আছে। অথচ সে স্থান ধোয়া অযুর জন্যে জরুরী। এখন তার উপর মুসেহ করলেই চলবে।
২. ক্ষত স্থানে ব্যাণ্ডেজ বা প্লাষ্টার করা আছে। তাতে পানি লাগলে ক্ষতির আশংকা। এ অবস্থায় মুসেহ করলেই চলবে এবং তাতেও ক্ষতির আশংকা হলে তাও মাফ করা হয়েছে।
৩. যদি যখমের অবস্থা এমন হয় যে, ব্যাণ্ডেজ করতে দেহের কিচু সুস্থ অংশও তার মধ্যে আছে। এখন ব্যাণ্ডজ খুললে বা খুলে ভালো অংশ ধুতে গেলে ক্ষতির আশংকা রয়েছে, তাহলে মুসেহ করলেই চলবে।
৪. ব্যাণ্ডেজ খুলে দেহের ঐ অংশ ধুলে কোন ক্ষাতির আশংকা নেই কিন্তু খুললে আবার বাঁধাবার কেউ নেই। এমন অবস্থায় মুসেহ করার অনুমতি আছে।
৫. ব্যাণ্ডেজের উপর আর এক ব্যাণ্ডেজ করা হরে তার উপরও মুসেহ করা যায়।
৬. কোন অঙ্গে আঘাত বা যখম হয়েছে। পানি লাগালে ক্ষতির সম্ভবনাব। তখন মুসেহ করলেই যথেষ্ট হবে।
৭. যদি চেহারা বা হাত-পা কেটে গিয়ে থাকে কিংবা কোন অংগে ব্যাথা হলে এবং পানি লাগালে ক্ষতির আশংকা, তাহলে মুসেহ করলেই হবে। আর যদি মুসেহ করলেও ক্ষতি হয় তাহলে মুসেহ না করলেও চলবে।
৮. হাত-পা ফাটার কারণে তার উপর মোম অথবা ভেসলিন অথবা অন্য কোন ওষুধ লাগানো হয়েছে তাহলে উপর দিয়ে পানি ঢেলে দিলেই হবে। ভেসেলিন প্রভৃতি দূর করা জরুরী নয়। পানি দেয়াও যদি ক্ষতিকারক হয় তাহলে মুসেহ করলেই হবে।
৯. যখম অথবা আঘাতের উপর ওষুধ লাগানো হলো অথবা পট্টির উপর পানি দেয়া হলো অথবা মুসেহ করা হলো। তারপর পট্টি খলে গেল অথবা যখম ভালো হয়ে গেল, তখন ধুতেই হবে মুসেহ আর চলবে না।

যে সব জিনিসের উপর মুসেহ জায়েয নয়

১. দস্তানার উপর।
২. টুপির উপর।
৩. মাথার পাগড়ি অথবা মাফলারের উপর।
৪. দুপাট্টা অথবা বোরকার উপর।
যেসব করণে অযু নষ্ট হয়

যেসব করণে অযু নষ্ট হয় তা দু‘প্রকার:

এক- যা দেহের ভেতর থেকে বের হয়।
দুই- যা বাইর থেকে মানুষের উপর পসে পড়ে।

প্রথম প্রকার

১. পেশাব পায়খানা বের হওয়া।
২. পায়খানার দ্বার দিয়ে বায়ু নি:সরণ হওয়া।
৩. পেশাব পায়খানার দ্বার দিয়ে অন্য কিছু বের হওয়া, যেমন ক্রিমি, পাথর, রক্ত, মুযী প্রভৃতি।
৪. দেহের কোন অংশ থেকে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে যাওয়া।
৫. থুথু কাশি ব্যতীত বমির সাথে রক্ত, পুঁজ, খাদ্য অথবা অন্য কিছু বের হলে এবং মুখ ভরে বমি হলে।
৬. মুখ ভলে বমি না হলে বার বার হলেও এবং হলে এবং তার পরিমাণ মুখ ভরে হওয়ার সমান হলে অযু নষ্ট হবে।
৭. থুথুর সাথে রক্ত এলে এবং রক্তের পরিমাণ বেশী হলে।
৮. কামভাব ছাড়া বীর্যপাত হলে, যেমন ভারী বোঝা উঠালে, উঁচু স্থান থেকে নীচে নামতে, অথবা ভীষণ দু:খ পেলে যদি বীর্য বের হয় অযু নষ্ট হবে।
৯. চোখে কোন কষ্টের কারণে ময়লা বা পানি বের হয়ে যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে অযু নষ্ট হবে। কিন্তু যার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে তার জন্যে মাফ।
১০. কোন মেয়েলোকের স্তনে ব্যথার কারণে দুধ ছাড়া কিছু পানি যদি বের হয় তাহলে অযু নষ্ট হবে।
১১. এস্তেহাযার রক্ত এলে।
১২. মুযি বের হলে।
১৩. যে যে কারণে গোসল ওয়াজেব হয় তার কারণে অযুও অবশ্যই নষ্ট হবে, যেমন হায়েয, নেফাস, বীর্যপাত প্রভৃতি।

দ্বিতীয় প্রকার

১. চিত হয়ে কাত হয়ে, অথবা ঠেস দিয়ে ঘুমালে।
২. যে যে অবস্থায় জ্ঞান ও অনুভূতি থাকে না।
৩. রোগ অথবা শোকের কারণে জ্ঞান হারালে।
৪. কোন মাদকদ্রব্য সেবনে অথবা ঘ্রাণ নেয়ার কারণে নেশাগ্রস্ত হলে।
৫. জানাযা নামায ব্যতীত অন্য যে কোন নামাযে অট্যহাস্য কারলে।
৬. দুজনের গুপ্তাংগ একত্র মিলিত হলে এবং দু অংগের মাঝে কোন কাপড় বা প্রতিবন্ধক না থাকলে বীর্যপাত ছাড়াও অযু নষ্ট হবে।
৭. রোগী শুয়ে শুয়ে নামায পড়তে যদি ঘুমিয়ে পড়ে।
৮. নামাযের বাইরে যদি কেউ দু‘জানু হয়ে বসে বা অন্য উপায়ে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তার দু‘পাঁজর মাটি থেকে আলাদা থাকে, অযু নষ্ট হবে।

যে সব কারণে অযু নষ্ট হয় না

১. নামাযের মধ্যে এমনকি সিজদাতে ঘুমালে।
২. বসে বসে ঝিমুলে।
৩. নাবালকের অট্ট হাসিতে।
৪. জানাযায় অট্ট হাসিতে।
৫. নামাযে অষ্ফুট শব্দে হাসলে এবং মৃদু হাস্য করলে।
৬. মেয়েলোকের স্তন থেকে দুধ বের হলে।
৭. সতর উলংগ হলে, সতরে হাত দিলে, অন্যে সতর দেখলে।
৮. যখম থেকে রক্ত বের হয়ে যদি গড়িয়ে না যায়, যখমের মধ্যেই থাকে।
৯. অযুর পা মাথা বা দাড়ি কামালে অথবা নেড়ে করলে।
১০. কাশি ও থুথু বের হলে।
১১. নারী পুরুষ একে অপরকে চুমা দিলে।
১২. মুখ, কান অথবা নাক দিয়ে কোন পোকা বেরুলে।
১৩. শরীর থেকে কোন পোকা বেরুলে।
১৪. ঢেকুর উঠলে এমনকি দুর্গন্ধ ঢেকুর হলেও।
১৫. মিথ্যা কথা বললে, গীবত করলে এবং কোন গুনাহের কাজ করলে (মাআযাল্লাহ)।

হাদাসে আসগারের হুকুমাবলী

১. হাদাসে আসগার অবস্থায় নামায হারাম যে কোন নামায হোক।
২. সিজদা করা হারাম, তেলাওয়াতের সিজদা হোক, শোকরানার হোক অথবা এমনিই কেউ সিজদা করুক।
৩. কুরআন পাক স্পর্শ করা মাকরুহ তাহরীমি, কুরআন পাক জড়ানো কাপড় ও ফিতা হোক না কেন।
৪. কা‘বার তাওয়াফ মাকরুহ তাহরীমি।
৫. কোন কাগজ, কাপড়, প্লাষ্টিক, রেক্সিন প্রভৃতি টুকরায় কোন আয়াত লেখা থাকলে তা স্পর্শ করাও মাকরুহ তাহরীমি।
৬. কুরআন পাক যদি জুযদান অথবা রুমাল প্রভৃতিতে অর্থাৎ আলাদা কাপড়ে জড়ানো থাকে তাহলে স্পর্শ করা মাকরুহ হবে না।
৭. নাবালক বাচ্চা, কিতাবাতকারী, মুদ্রাকর ও জিলদ তৈয়ারকারীর জন্যে হাদাসে আসগার অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা মাকরুহ নয়। কারণ তাদের জন্যে সর্বদা হাদাসে আসগার থেকে পাক থাকা কঠিন।
৮. হাদাসে আসগার অবস্থায় কুরআন শরীফ পড়া, পড়ানো, দেখে হোক না দেখে হোক, মুখস্ত হোক সর্বাবস্থায় জায়েয।
৯. তাফসীরের এমন কেতাব যার মধ্যে কুরআনের মুল বচন আছে, বেঅযুতে স্পর্শ করা মাকরুহ।
১০. হাদাসে আসগার (বেঅযু) অবস্থায় কুরআন পাক লেখা যায় যদি যাতে লেখা হচ্ছে তা স্পর্শ করা না হয়।
১১. কুরআন পাক তরজমা অন্য কোন ভাষায় হলে অযু করে তা স্পর্শ করা ভালো।

রোগীর জন্যে অযুর হুকুম

অযুর ব্যাপারে ঐ ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম মনে করা হবে যে এমন রোগে আক্রান্ত যার শরীর থেকে সব সময় অযু ভংগকারী বস্তু বের হতে থাকে এবং রোগীর এতটা অবকাশ নেই যে, তাহারাতের সাথে নামায পাড়তে পারে। যেমন :
১. কেউ চোখের রোগী সব সময় তার চোখ দিয়ে পিচুটি ময়লা অথবা সব সময় পানি বেরুতে থাকে।
২. কারো পেশাবের রোগ আছে এবং সব সময় ফোঁটা ফোঁটা পেশাব বেরয়।
৩. কারো বায়ু নি:সরণের রোগ আছে। সব সময় বায়ু নি:সরণ হতে থাকে।
৪. কারো পেটের রোগ এবং সর্বদা পায়খান হতে থাকে।
৫. এমন রোগী যার সর্বদা রক্ত বা পুঁজ বেরয়।
৬. কারো নাকশিরা রোগ আছে এবং সর্বদা নাক দিয়ে রক্ত পড়ে।
৭. কারো প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে সর্বদা মনি বা মুযি বের হতে থাকে।
৮. কোন মেয়েলোকের সব সময় এস্তেহাযার রক্ত আসে।
এ ধরণের সকল অবস্থায় হুকুম এই যে, এ ধরণের লোক প্রত্যেক নামাযের জন্যে নতুন অযু করবে এবং অযু ততোক্ষণ পর্যন্ত থাকবে যতোক্ষণ না অন্য দ্বিতীয় কোন কারণ হয়েছে যার দ্বারা অযু নষ্ট হয়। যেমন কারো নাকশিরা ব্যরাম আছে। সে যোহর নামাজের অযু করলো। এখন তার অযু আসর পর্যন্ত বাকী থাকবে। তাবে নাকশিরার রক্ত ছাড়া যদি পেশাব করে, অথবা বায়ু নি:সরণ হয় তাহলে অযু নষ্ট হবে।

রোগীর মাসয়ালা

১. অক্ষম রোগী ব্যক্তি নয়া অযু করার পর ওয়াক্ত থাকা পর্যন্ত সে অযুতে ফরয, সুন্নাত, নফল সব নামায পড়তে পারে।
২. কেউ ফজর নামাযের জন্যে অযু করলো। তারপর সূর্য উঠার পর তার অযু শেষ হয়ে গেল। এখন কোন নামায পড়তে হলে নতুন অযু করতে হবে।
৩. সূর্য উঠার পর অযু করলে যে, অযুতে যোহর নামায পড়া যায়। যোহরের জন্যে দ্বিতীয়বার অযু করার দরকার নেই তবে আসরের ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে এ অযু শেষ হয়ে যাবে।
৪. এ ধরণের কোন রোগীর কোন নামাযের পুরা ওয়াক্ত এমন গেল যে, এ সময়ের মধ্যে তার সে রোগ বিলকুল ঠিক হয়ে গেল। যেমন, কারো সব সময়ে ফোঁটা ফোঁটা পেশাব পড়তো। এখন তার যোহর থেকে আসর পর্যন্ত এক ফোঁটাও পড়লো না। তাহলে তার রোগের অবস্থা খতম হয়ে গেল। এরপর যতবার পেশাবের ফোঁটা পড়বে ততবার অযু করতে হবে।

মুজার উপর মুসেহ

যথাযোগ্য লাঘবতার লক্ষ্যে শরীয়ত মুজার উপর মুসেহ করার অনুমতি দিয়েছে। কোন কোন কঠিন আবহাওয়ায় বিশেষ করে ঐসব দেশে যেখানে ভায়ানক ঠান্ডা পড়ে, শরীয়তের এ সুযোগ দানের জন্যে আপনা আপনি কৃতজ্ঞতার আবেগ-উচ্ছ্বাসে মন-প্রাণ ভরে যায় এবং আল্লাহর অশেষ রহম ও করমের অনুভূতি পয়দা হয়। তারপর এ একীন বাড়তে থাকে যে, দ্বীন আমাদের কোন প্রয়োজন এবং অসুবিধা উপেক্ষা করেনি।
কোন কোন মুজার উপর মুসেহ জায়েয
চামড়ার মুজার উপর মুসেহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত। তাবে পশমী, সূতী, রেশমী ও নাইলন মুজার উপর মুসেহ জায়েয হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে কিছু মতভেদ আছে। অধিকাংশ ফেকাহবিদ পশমী, সূতী প্রভৃতি মুজার উপর মুসেহ জায়েয হওয়ার জন্যে কিছু শর্ত আরোপ করেছেন। আবার কতিপয় আহলে এলম বলেন যে, কোন শর্ত ব্যতিরেকেই সকল প্রকার মুজার উপর মুসেহ জায়েয। সাধারণত ফেকাহের কেতাবগুলোতে শুধু ঐসব মুজার উপর মুসেহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে যেগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত চারটি শর্ত পাওয়া যাবে।
১. এমন মোটা হবে যাকোন কিছু দিয়ে না বাঁধলেও পায়ের উপর লেগে থাকবে।
২. এমন মজবুত হবে যে, তা পায়ে দিয়ে তিন মাইল পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে।
৩. একখানি মোটা হবে যে, ভেতর থেকে পায়ের চামড়া দেখা যাবে না।
৪. ওয়াটর প্রুফ হতে হবে যেন উপরে পানি দিলে পানি চুষতে না পারে এবং পানি নীচ পর্যন্ত পৌছতে না পারে।
যেসব মুজায় এ চারটি শর্ত পাওয়া যাবে না, তার উপর মুসেহ জায়েয হবে না।[কতিপয় দুরদর্শী আলেম এ শর্তগুলো স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন, সুন্নাত থেকে যা কিছু প্রামাণিত আছে তা শুধু এই যে, নবী (সা) মুজা এবং জুতার উপর মুসেহ করেছেন।
অতএব সকল প্রকার মুজার উপর কোন শর্ত ব্যতিরেকেই মুসেহ করা জায়েয। বর্তমান যুগের একজন প্রখ্যাত ও সর্বজন পরিচিত চিন্তাশীল ও দূরদর্শী আলেমে দ্বীন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মুওদুদী স্কটল্যান্ডে বসবাসকারী একজন ছাত্রের প্রশ্নের জবাবে যে বিশদ ব্যাখ্যা দান করন তার দ্বারা বিষয়টির উপর বিশষ আলোকপাত করেন। নিম্নে সে প্রশ্ন ও তার জবাব উধৃত করা হলো:
প্রশ্ন: মুজার উপর মুসেহ করার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। আমি শিক্ষালাভের জন্যে স্কটল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে বাস করি। এখানে শীতকালে ভায়ানক ঠান্ডা পড়ে। সব সময়ে পশমী পুজা পরিধান করা অপরিহার্য হয়। এ ধরণের মুজার উপর মুসেহ করা যায় কি? শরীয়তের তথ্যানুন্ধান ও গবেষণার আলোকে মেহেরবানী করে বিস্তারিত লিখে জানাবেন।


উত্তর: চামড়ার মুজার উপর মুসেহ করার ব্যাপারে প্রায় সব আহলে সুন্নাতের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে। কিন্তু পশমী ও সূতী মুজার ব্যাপারে সাধারণত আমাদের ফেকাহশস্ত্রবিদগণ এ শর্ত লাগিয়েছেন যে, তা মোটা হতে হবে, এমন পাতলা না হয় যেন নীচ থেকে পায়ের চামড়া দেখা যায়। আর সে মুজা কোন প্রকার বন্ধন ব্যতিরেকেই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি আমার সাধ্যমত তালাশ করার চেষ্টা করেছি যে, এসব শর্তের উত্স কি? কিন্তু সুন্নাতের ভেতর এমন কোন জিনিস খুঁজে পাইনি। সুন্নাত থেকে যা কিছু প্রমাণিত আছে তা এই যে, নবী (সা) জুতা এবং মুজার উপরে মুসেহ করেছেন। নাসায়ী ব্যতীত হাদীসের কেতাবগুলোতে এবং মুসনাদে আহমদে মুগীরাহ বিন শু‘বার রেওয়ায়েত রয়েছে যে, নবী (সা) অযু করলেন এবং আপন মুজা এবং জুতার উপর মুসেহ করলেন। আবু দাউদের বর্ণনায় আছে যে, হযরত আলী (রা),আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা), বারা বিন আযেব (রা), আনাস বিন মালেক (রা), আবু উসামা (রা) সাহল বিন সা‘দ (রা) এবং আমর বিন হারেস (রা) মুজার উপর মুসেহ করেন। উপরন্তু হযরত ওমর (রা) এবং ইবনে আব্বাস (রা) এ কাজ করেছেন বলে বর্ণিত আছে। বরঞ্চ বায়হাকী ইবনে আব্বাস (রা) এবং আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে এবং তাহাবী আউস ইবনে আবি আউস (রা) থেকে ও রেওয়ায়েত করেছেন যে, নবী (সা) শুধু জুতার উপর মুসেহ করেছেন। এতে মুজার উল্লেখ নেই। হযরত আলী (রা) ও এরূপ করতেন বলে বর্ণিত আছে। এসব বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, শুধু মুজা এবং শুধু জুতা এবং মুজা পরা অবস্থায় জুতার উপর মুসেহ করাও ঐরূপ জায়েয যেমন চামড়ার মুজার উপর। এসব বর্ণনায় কোথাও এমন পাওয়া যায় না যে, নবী (সা) ফকীহগণের আরোপীত শর্তগুলোর মধ্যে কোন একটি শর্তের কথা বলেছেন। আর কোথাও এ বর্ণনা পাওয়া যায় না যে, নবী (সা) এবং উপরোক্ত সাহাবীগণ যে মুজার উপর মুসেহ করেছেন তা কোন ধরণের ছিল। এ জন্যে আমি এ কথা বলতে বাধ্য যে, ফকীহগুণের আরোপিত শর্তগুলোর কোনই উত্স নেই, যার উপর ভিত্তি করে তারা এসব আরোপ করেছেন। আর ফকীহগণ যেহেতু শরীয়ত প্রণেতা নন সে জন্যে তাঁদের আরোপিত শর্তের উপর যদি কেউ আমল না করে তাহলে সে গুনাহগার হবে না।
ঈমান শাফী (রহ) এবং ইমাম আহমদের (রহ) অভিমত এই যে, মুজার উপর এ অবস্থায় মুসেহ করা যদি কেউ জুতা পায়ের উপর থেকে পারিধান করে থাকে। কিন্তু উপরে যেসব সাহাবী (রা) এর আমল বর্ণনা করা হয়েছে তাঁরা কেউই এ শর্তের অনুসারণ করেননি।
মুজার উপর মুসেহ করার বিষয়টির উপর চিন্তা-ভাবনা করে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা এই যে, প্রকৃতপক্ষে এটা তায়াম্মুমের ন্যায় একটি সুবিধা দান (conesion) যা আহলে ইমানকে এমন অবস্থায় দেয়া হয়েছে যখণ যেমন করেই হোক পা ঢেকে রাখতে তারা বাধ্য হয় এবং বার বার পা ধোয়া ক্ষতিকর অথবা কষ্টকর হয়। এ সুবিধাদানের ভিত্তি এ ধারণার উপর রাখা হয়নি যে, তাহারাতের পর মাজা পরিধান করলে পা নাজাসাত থেকে রক্ষা পাবে এবং তা আর ধোয়ার প্রয়োজন হবে না। বরঞ্চ তার ভিত্তি হলো আল্লাহর রহমত যা বন্দাহকে সুবিধা দানের দাবী জানায়। অতএব ঠান্ডা এবং পথের ধুলিবালি থেকে পা-কে রক্ষা করার জন্যে পায়ের কোন যখমের রক্ষণা-বেক্ষণের জন্যে মানুষ যা কিছুই পরিধান করে এবং যা বার বার খুলে পরিধান করতে কষ্ট হয়, এমন সব কিছুর উপরেই মুসেহ করা যেতে পারে। সেটা পশমী মুজা হোক অথবা সুতী, চামড়ার জুতা হোক অথবা ক্রীচ অথবা কোন কাপড়ই হোক যা পায়ের সাথে জড়িয়ে বাঁধা হয়েছে।
আমি যখন কাউকে দেখি যে, সে অযুর পর মুসেহ করার জন্যে পায়ের দিকে তার হাত পাড়াচ্ছে তখন আমার মনে হয় যেন সে বান্দাহ আল্লাহকে বলছে, হুকুম হলে এক্ষুণি এ মুজা খুলে ফেলে পা ধুয়ে ফেলবো। কিন্তু সকল কর্তৃত্ব প্রভূত্বের মালিক যিনি তিনিই যেহেতু অনুমতি দিয়ে রেখেছেন সে জন্যে মুসেহ করেই ক্ষন্ত হচ্ছি।“ আমার কাছে প্রকৃতপক্ষে এই অর্থই মুজার উপর মুসেহ করার সত্যিকার তাত্পর্য। আর এ তাত্পর্যর দিক দিয়ে ঐ সকল জিনিসই একরূপ যা প্রয়োজন অনুসারে মানুষ পরিধান করে, যার সুবিধা দানের লক্ষ্যে মুসেহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। (রাসায়েল ও মাসায়েল দ্বিতীয় খণ্ড –পৃ: ২৫৮)।
এ তথ্যানুসন্ধানের সংক্ষিপ্ত সার এই যে, সকল প্রকার মুজার উপর নিশ্চিত মনে মুসেহ করা যেতে পারে, তা সে মুজা পশমী হোক অথবা সুতী, রেশমী হোক অথবা চামড়ার, অথবা অয়েল ক্লথ এবং রেক্সিনের হোক না কেন। এমন কিন পায়ের উপর কাপড় জড়িয়ে যদি বাঁধা হয তাহলে তার উপর মুসেহ করাও জায়েয হবে।
আল্লামা মওদুদী ছাড়াও আল্লামা ইবনে তাইমিয়া তাঁর ফতোয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে অনুরূপ ফতোয়াই দিয়েছেন।
হাফেয ইবনে কাইয়েম এবং আল্লামা ইবনে হাযেমের অভিমতও এই যে, বিনা শর্তে সকল প্রকার মুজার উপর মুসেহ করা যেতে পারে। (বিস্তরিত বিবরণের জন্যে “তরজুমানুল কুরআন“ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮, রাসায়েল ও মাসায়েল শীর্ষ নিবন্ধ-পৃ: ৫৩ দ্রষ্টব্য)]

মুজার উপর মুসেহ করার পদ্ধতি

  • দুহাত অব্যবহৃত পানি দিয়ে ভিজিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কিছুটা ফাঁক করে তা ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ডান পা এবং বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাম পা মসেহ করতে হবে।
  • পায়ের আঙ্গুলের দিক থেকে উপরের টাখনুর দিকে আঙ্গুল বুলিয়ে আনতে হবে।
  • আঙ্গুলগুলো একটু চাপ সহকারে টেনে আনতে হবে যেন মুজার উপর ভেজা হাতের স্পর্শ অনুভূত হয়।
  • মুসেহ পায়ের উপরিভাগে, নীচের দিকে নয়।
  • মুসেহ দু‘পায়ের উপর মাত্র একবার করে করতে হবে।
মুসেহের মুদ্দত
মুসাফিরের জন্যে মুসেহ করার মুদ্দত তিন দিন তিন রাত। মুকীমের জন্যে একদিন এক রাত। এ মুদ্দতের সময় অযু নষ্ট হওয়ার পর থেকে ধরা হবে। মুজা পরিধান করার সময় থেকে ধরা হবে না। যেমন ধরুন, কেউ যোহরের সময় অযু করে মুজা পরলো। তারপর সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় অযু নষ্ট হলো। তাহলে মুকীমের জন্যে পরের দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় পর্যন্ত মুসেহ দুরস্ত হবে। অর্থাৎ যখনই অযু নষ্ট হবে তখন অযুর সাথে মুসেহ করবে। আর যদি সে মুসাফির হয় তাহলে তৃতীয় দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় পর্যন্ত তার মুসেহ করা দুরস্ত হবে। অর্থাৎ নষ্ট হওয়ার সময় থেকে তিন দিন তিনরাত পুরা করার পর মুসেহ করার মুদ্দত খতম হবে। যেমন ধরুন, জুমার দিন সূর্য ডুবার সময় অযু নষ্ট হলো। তাহলে সোমবার সূর্য ডুবার সময় পর্যন্ত মুসেহ করার মুদ্দত থাকবে আর যদি সোমবার সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সে মাগরেবের জন্যে অযু করে তাহলে পা ধেতে হবে।
যে যে কারণে মুসেহ নষ্ট হয়ে যায়
১. যে যে কারণে অযু নষ্ট হয়, সেই সেই কারণে মুসেহ বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ অযু করার পর পুনরায় মুসেহ করতে হবে।
২. কোন কারণে মুজা খুলে ফেলে, অথবা মুজা আপনা আপনি খুলে গেলে অথবা পায়ের অধিকাংশ খুলে গেল বা বাহির হয়ে পড়ল।
৩. মুজা পরা অবস্থায় যদি পা পানিতে ভিজে যায়, সমস্ত পা অথবা পায়ের অধিকাংশ যদি ভিজে যায়।
৪. মুসেহ করার মুদ্দত খতম হয়ে গেলে। অর্থাৎ মুকীমের জন্যে একদিন একরাত এবং মুসাফিরের জন্যে তিন দিন তিন রাত পার হয়ে গেলে।
শেষোক্ত তিন অবস্থায় পুনরায় অযু করার দরকার নেই, শুধু পা ধয়ে নিলেই হবে।

মুসেহ করার কতিপয় মাসয়ালা

১. যদি মুসেহ না করার কারণে ওয়াজেব ছুটে যাওয়া অপরিহর্য হয়ে পড়ে তাহলে মুসেহ করা ওয়াজেব হয়ে পড়বে। যেমন মনে করুন কেউ আশংকা করলো যে, পা ধুয়ে সময় নষ্ট করতে গেলে আরফাত অবস্থান করার সুযোগ পাওয়া যাবে না, অথবা জামায়াত চলে যাবে অথবা নামাজের ওয়াক্ত চলে যাবে এসব অবস্থায় মুসেহ করা ওয়াজিব হবে।
২. কারো নিকটে এতটুকু পানি আছে যে, তাতে শুধু পা ব্যতীত অন্য অংগসমূহ ধোয়া যায়, তাহলে মুসেহ ওয়াজেব হবে।
৩. মুজা এতো ছোট যে, টাখনু খলে যায়। তখন চামড়া অথবা কাপড় প্রভৃতি দিয়ে মুজা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে তার উপর মুসেহ জায়েয হবে।
৪. এমন জুতার উপর মুসেহ করা জায়েয যা টাখনু সমেত গোটা পা ঢেকে রাখে এবং যার দ্বারা পায়ের কোন স্থানের চামড়া দেখা যায় না। তা সে জুতা চামড়ার হোক, রাবার, প্লষ্টিক অথবা নাইলনের হোক।
৫. যদি কেউ মুজার উপর মুজা পরে থাকে তাহলে উপরের মুজার উপর মুসেহ করলেই যথেষ্ট হবে।
৬. তায়াম্মুমকারীদের জন্যে মুসেহ করার দরকার নেই। গোসলের সাথেও মুজার উপর মুসেহ দুরস্ত হবে না, পা ধোয়া জরুরী।

0 comments:

Post a Comment